ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার বিধি বা তৃতীয় কোন পদ্ধতির মাধ্যমে ডিভাইসটি গ্রাহকের নিকট থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে বা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নয়। এই কথাগুলো সাধারণত আমরা ১০০ থেকে শুরু করে ১০০০০০ টাকা বা বিভিন্ন দামের পণ্যের সাথে থাকা ম্যানুয়াল বা ব্যবহার বিধিতে দেখতে পাই।
যে গুলো অনুসরণ করলে পণ্যটি দীর্ঘ সময় ধরে কাংক্ষিত সেবা দিয়ে থাকে বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুস্বরণ করেও যদি কোন প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়মানুযায়ী ওয়ারেন্টি বা ক্ষতিপূরন দেয়।
সাধারণ মূল্যের ডিভাইসগুলোর সাথে যদি ম্যানুয়াল বা ব্যবহার বিধির বই দেওয়া থাকে এবং সেই ম্যানুয়াল বা ব্যবহার বিধি অনুযায়ী ডিভাইসটি ব্যবহার না করলে ব্যবহৃত ডিভাইস বা পণ্যটি বা পণ্যটির মালিক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং উক্ত মালিক ক্ষতিপূরন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে ১৮০০০ মামলুকাতের শ্রেষ্ঠ বা আশরাফুল মাযলুকাত মানুষের ক্ষেত্রে কি হতে পারে।
অন্যদিকে সূরা আত্-তাওবার ৬০ নং আয়াতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা দান-সদাকার খাত ঘোষণা করে বললেন- “দান-সদকা শুধু নিঃশ্ব, অভাবগ্রস্থ, যাকাত বা দান-সদাকা ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত কর্মী, ইসলামের প্রতি অনুরাগী, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত এবং আল্লাহর পথে জিহাদ ও সফরকারীদের জন্য এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাময়।”
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নিজেই দান-সদাকার খাত সমুহকে নির্ধারিত করে দিলেন কিন্তু সমাজের মানুষ আয়াতে বর্ণিত বিষয়গুলোতে নয় বরং দান-সদাকার জন্য নতুন ভিন্ন ভিন্ন খাত তৈরি করে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।
আরো লক্ষ্য করলে দেখতে পাই মানুষ যেসব খাতে দান-সদকা করার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সেগুলোর অগ্রভাগে রয়েছে মসজিদ, কবরস্থান বা মাজার, ঈদগাহসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এসকল খাতে বেশি বেশি দান করার কারণ হিসাবে পরিলক্ষিত হয় সামাজিক মর্যাদা: কারো কারো ক্ষেত্রে বিপরীত ক্রম ও দেখা যায়।
সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য কোন কাজ করা হলে সেটি “রিয়া” হয়। আর “রিয়া” কারীদের জন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরানের সূরা মাউনের (৪-৫) আয়াতে ধ্বংসের কথা ঘোষণা করেন- “সমস্ত সালাত আদায়কারীদের জন্য ধ্বংস। যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে নির্বোধ। যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে।”
আবার বিশ্বনবী (সঃ) দান-সদকাকে গোপনে করার জন্য তাকিদ দিয়ে বলেছেন- “দান এমনভাবে করবে যেন ডানহাত দ্বারা দান করবে কিন্তু বাম হাত জানতে পারবেনা”।
শীতকাল আসলেই শুরু হয় মাহফিলের আয়োজন, মসজিদ, মাজার বা কবরস্থান, ঈদগাহ ইত্যাদির সংস্কার কাজ। সাধারণ মানুষ প্রকৃত খাতে দান না করে এসব খাতে দানের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় অথচ প্রকৃত খাত মানুষ কোন প্রতিষ্ঠান নয়। আবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাটবাজার, রাস্তাঘাট, মসজিদে এসবের নামে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হয় যেটি সামাজিক ভিক্ষায় পরিণত হয়েছে। যারা এসব চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানান তারা সামাজিকভাবে হন হেয় প্রতিপন্ন।
উৎসাহিত চাঁদা আদায়কারীরা আদায়কৃত চাঁদার একটি অংশ ভোগ করেন এমন তথ্য অহরহ। সামাজিক ভিক্ষা আর নয় এসকল প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী কার্যক্রম চালাবে কারো বাড়ি গিয়ে বা অন্য কোথাও জোর করে চাঁদা আদায় করা যাবেনা। তবে কেউ স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে দান করতে পারেন।
মাহফিল-মসজিদ-মাজার বা কবরস্থানের জন্য সামাজিক ভিক্ষা আর নয়
আরো পড়ুন: সড়ক ও রেলপথের ক্ষতিপূরণ থাকলেও পানিপথের জমির জন্য নেই কোন ব্যবস্থা
নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থদের খাওয়ানো একটি উত্তম এবং সওয়াবের কাজ কেননা দান-সাদাকার জন্য যে খাত আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেছেন তার মধ্যে এই দুইটি খাতের স্থান রয়েছে। কিন্তু আমরা সমাজে দেখতে পাই কোন ব্যক্তি মারা গেলে কুলখানীর আয়োজন করা হয় এবং সেখানে বড় বড় ব্যবসায়ী, সমাজপতিদের অধিক পরিমাণে সমাদর করা হয় এবং অনুষ্ঠানস্থল এমনভাবে সাজসজ্জা করা হয় যেন শোকানুষ্ঠান আনন্দঘন অনুষ্ঠানে পরিণত হয় ফলে যারা নিঃশ্ব, অভাবগ্রস্থ বা প্রকৃতপক্ষে এই খানা পাওয়ার হকদার তাদের উক্ত অনুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার সীমিত হয় অবশেষে অর্থ-সম্পদ, সময়, শ্রম ইত্যাদি ব্যয় করেও সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ অর্জনের আশংকা করা হয় যেটি কখনো কাম্য হতে পারেনা।
মসজিদ, মাজার বা ঈদগাহে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দান করে আলিশান করা জরুরী নয় কেননা মসজিদের বা মাজারে যিনি শায়িত আছেন তার খাদ্যের বা পোষাকের প্রয়োজন হয়না বরং মসজিদে যারা সালাত আদায় করেন বা মাজারে শায়িত মৃত্যুব্যক্তির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন তাদের প্রয়োজন।
মাজারে শায়িত মৃত্যুব্যক্তির সাহায্য করার কোন ক্ষমতা নেই সেই ক্ষমতা শুধুমাত্র এক আল্লাহ তায়ালার ই আছে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা দান করার যে খাতের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে মসজিদ বা মাজারে সওয়াবের আশায় দান করার কথা উল্লেখ করেননি।
বরং নামাজের ওয়াক্ত হলে মসজিদের সামনে যে সকল ভিক্ষুক নামাজের জন্য অপেক্ষা না করে একটু সহানুভূতির জন্য অপেক্ষা করে তাদেরকে ঐ দানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে যেন তারা আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য নয় নামাজের জন্যই মসজিদে আসতে পারে। আর মসজিদ মাটির তৈরি হলে এবং সেখানে সালাত আদায় করলে সওয়াবের কোন কমতি হয়না।
বরং সালাত আদায় করার পর রসুল (সঃ) এর কপালে এবং হাটুতে পাথরের দাগ পরিলক্ষিত হতো। রসুল (সঃ) এর সময়কার মসজিদগুলো এমনই ছিল আজ আমাদের অতিশয় বাড়াবাড়ির কারণে বর্তমানে অধিকাংশ মসজিদগুলো আলিশান ভবনে পরিণত হয়েছে কিন্তু মসজিদ হারিয়েছে তার সূচনালগ্নের চরিত্র।
আমাদের দেশের মসজিদগুলোর বর্তমান কমিটির সদস্যগন বিলাসী দানবক্স তৈরি করে মানুষকে লজ্জায় ফেলে দিয়ে চাঁদা তুলে উন্নত মানের টাইলস দিয়ে নামি দামি এসি সেট করে বাহ্যিক দৃশ্য পরিবর্তন করে বিলাসি করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
যদিও আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মসজিদ কমিটির সদস্য কারা হবেন সদস্যদের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তা পবিত্র কুরানের সূরা আত-তাওবার ১৮ নং আয়াতে ঘোষনা করেছেন- “নিঃসন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি এবং কায়েম করেছে নামাজ ও আদায় করে যাকাত: আল্লাহ ব্যতিত আর কাউকে ভয় করেনা।
অতএব আশা করা যায়, তারা হেদায়েত প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে।” বর্তমান মসজিদের কমিটিগুলোর সদস্যরা যদি আয়াতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যাবলীর অধিকারী হতেন তাহলে তাঁরা মসজিদের বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় বরং মানুষের দারিদ্র্যতা দূরীকরণ এবং সামাজিক মূল্যবোধের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজে বেশি প্রতিযোগিতা করতেন।
ফলে সমাজ সুন্দর হয়ে যেত সেখানে বিশৃঙ্খলা, বৈষম্য, অভাব অনটনের স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতো। কেননা একটি সমাজ মসজিদ কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। সঠিক খাতে দান-সদকা না করার ফলে এবং সঠিক লোকদ্ধারা মসজিদ পরিচালিত না হওয়ার ফলে বর্তমান সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে মসজিদ বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান বাহ্যিকভাবে যতই ধনী বা পাকা হচ্ছে মুছল্লিরা আভ্যন্তরীনভাবে ততই কাঁচা হচ্ছে বা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের কথা যদি বলি সেক্ষেত্রে শ্রীলংকার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। শুধুমাত্র সূদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অভাবের কারণে কিভাবে একটি আধুনিক রাষ্ট্র ২০২২ সালে দেওলিয়া হয়ে গেল? ফলে জনগন রাস্তায় এসে রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধান কে দেশত্যাগে বাধ্য করল এবং সরকারের অন্যান্য সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করল।
যদি বিশ্বের ধনী দেশগুলো তাদের দান-সাদাকা বা যাকাতের অর্থ শ্রীলংকার মতো গরীব দেশগুলোকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত তাহলে বিশ্বভ্রাতৃত্ব বন্ধন আরো সুদৃঢ় হতো এবং বিশ্ব থেকে এই মারামারি হানাহানি দূর হয়ে যেত। ইসলাম কোন সংকীর্ণতা বা জাতীয়তাবাদী চেতনায় নয় বরং সার্বজনীনতায় বিশ্বাস করো।
অন্যান্য যে খাতগুলোর কথা মহান আল্লাহ তায়াল পবিত্র কুরানে উল্লেখ করেছেন সেগুলো সহ সকল খাতে দান-সদাকা সঠিকভাবে প্রদানের মাধ্যমেই কেবল আমাদের ব্যক্তি জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে বৈষম্য এবং বিশৃঙ্খলা দূরভীত করে ইহলৌকিক শান্তি এবং পরলৌকিক মুক্তি আসবে ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং মাহফিল, মসজিদ, মাজার বা কবরস্থান, ঈদগাহ ইত্যাদির জন্য বাড়ি বাড়ি, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, মসজিদে বা অন্য কোথাও জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করার নামে সামাজিক ভিক্ষা আইন করে বন্ধ করতে হবে।
লেখক- এমফিল গবেষক (এবিডি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।