HSC | বাংলা ২য় পত্র | গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা ৫৬-৬১ | PDF Download: বাংলা দ্বিতীয় পত্র হতে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রবন্ধ রচনা গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্য বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়টির গুরুপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
৫৬. বাংলাদেশের বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার
সূচনা : কাজেই মুক্তি। কাজই সমৃদ্ধি। কর্মহীন জীবন কফিনে ঢাকা লাশ। মানুষের দুটি হাতকে দক্ষ কর্মীর হাতে পরিণত করলে সমৃদ্ধি আসবেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য, এই আধুনিক যুগে মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জনশক্তিতে পরিণত হয় না। কর্মহীন বেকার জীবনের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়।
বিপুল জনসংখ্যার আর সীমিত সম্পদের কারণে আমাদের প্রিয় জন্মভ‚মি বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে পরিচিত। এই জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে তাদের দুই হাতের ছোঁয়ায় দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, আসবে সমৃদ্ধি। এজন্য প্রয়োজন বেকারত্বের অভিশাপমুক্ত দেশ।
বেকারের সংজ্ঞা : সাধারণ অর্থে, যার কোনো কাজ নেই তাকে বেকার বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতির পরিভাষায় কর্মহীন মানেই বেকার নয়। যদি কোনো ব্যক্তির কাজ করার যোগ্যতা ও ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও কর্মসংস্থান বা কাজের সুযোগ না পান তবে অর্থনীতির পরিভাষায় তিনিই বেকার। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বেকারত্ব এমন এক সামাজিক অবস্থার নাম যখন সমাজের যথেষ্ট কর্মক্ষম ব্যক্তির বিপরীতে কর্মের সুযোগ থাকে খুবই কম।
বাংলাদেশের বেকারত্বের চিত্র : বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে পর্যাপ্ত শিল্প-কারখানা নেই। বেসরকারি কর্মসংস্থান ও সরকারি চাকরির সীমিত সুযোগের কারণে এ দেশে কর্মক্ষম অধিকাংশ মানুষ কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে কর্মক্ষম লোকের ২৭.৯৫ শতাংশ বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত।
বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মৌসুমি বা প্রচ্ছন্œ বেকার। যাদের সারা বছর কাজ থাকে না, বছরের বিশেষ সময়ে কাজ করেন তাদেরকে মৌসুমি বা প্রচ্ছন্ন বেকার বলা হয়।
বেকার সমস্যার কারণ : বাংলাদেশের বেকার সমস্যার জন্য কোনো একক কারণ দায়ী নয়। কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো :
ক. ঔপনিবেশিক শোষণ : বাংলাদেশে বিদ্যমান বেকার সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। বাংলাদেশের বেকারত্বের অভিশাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা। ইংরেজি ঔপনিবেশিক শক্তি এ দেশের প্রচলিত শিল্পকে ধ্বংস করে নিজেদের পণ্যের বাজারে পরিণত করেছিল। পাকিস্তানি শাসনের প্রভাবেও এ দেশের অর্থনীতির ভিত্তি ধ্বংস হয়েছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শোষকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে নব্য স্বাধীন দেশকে দাবিয়ে রাখতে। তাদের শোষণ ও বঞ্চনা বাংলাদেশে বেকারত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
খ. ত্রটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা : আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেই ইংরেজ আমলে। ইংরেজরা প্রশাসনিক ও তাদের ব্যবসার হিসাব সংরক্ষণের কাজের জন্য এ দেশীয় কেরানি শ্রেণি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে একটি শিক্ষাব্যবস্থা এই জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা চলে যাওয়ার এত বছর পরও শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক যুগের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
গ. জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থান হচ্ছে না : প্রতিবছর যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। কর্মসুযোগ হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ অসম অনুপাত বেকারত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।
ঘ. কুটিরশিল্পে ধস : ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের কুটিরশিল্পে ছিল ঐতিহ্যবাহী। এ দেশের কামার, কুমার, কাঁসারি, শাখারি, তাঁতি, বাঁশ, ও বেতজীবী মানুষেরা নীরবে নিভৃতে নিজ নিজ চিরাচরিত পেশায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু যন্ত্রসভ্যতা, শিল্পবিপ্লব এবং যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ দেশের কুটিরশিল্প বিলুপ্তির পথে।
ঐতিহ্যবাহী দেশীয় পণ্যের বদলে দিন দিন কল-কারখানায় তৈরি পণ্য চাহিদা বাড়ছে। ফলে কুটিরশিল্পের সাথে জড়িত পেশাজীবীরা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে।
ঙ. অপর্যাপ্ত শিল্পায়ন : প্রতিদিন কৃষিব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সাথে কৃষিকাজে শ্রমিকের চাহিদা কমছে। কাজেই শুধু কৃষির ওপর নির্ভর না করে ব্যাপকভিত্তিক শিল্পায়ন হলে কেবল বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। শিল্পোন্নত জাপানে বেকারত্বের হার ৫% এর নিচে, যুক্তরাষ্ট্রে ৭% ও যুক্তরাজ্যে ৯% মাত্র। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। এ দেশে মূলত শ্রমঘন ও কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে না ওঠায় বেকারত্ব প্রতিদিন তীব্র আকার ধারণ করছে।
চ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, খরা, নদীভাঙন প্রভৃতি দুর্যোগ কৃষিকাজ ব্যাহত করে এবং গ্রামীণ জীবনে বেকারত্ব ডেকে আনে। বিশেষ করে নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ জমিজমা ও ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জীবিকার অভাবে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি, দিনমজুরি প্রভৃতিতে লিপ্ত হতে হয়।
ছ. কায়িক শ্রমের অবমূল্যায়ন : আমাদের দেশে শারীরিক শ্রমকে অশিক্ষিত ও মূর্খদের কাজ বলে মনে করা হয়। ফলে লেখাপড়া করে অফিস-আদালতের বাইরে শারীরিক শ্রমমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। অনেকে শারীরিক কাজ করাকে অসম্মানজনক মনে করে, তারা কায়িক শ্রমের কাজের চেয়ে বেকার থাকতে পছন্দ করে। এমন ভুল মানসিকতাও বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ।
জ. নষ্ট রাজনীতি : বেকারত্বের অন্যতম কারণ নষ্ট রাজনীতি। স্বৈরশাসন, গণতন্ত্রহীনতা, দুর্বল নেতৃত্বের প্রভাবে দেশে নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। দলের কর্মী সমর্থক বাড়ানোর নাম করে যুবকদের কর্মবিমুখ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে তুলে তাদের কর্মোজ্জ্বল ভবিষ্যতের কবর রচনা করা হয়।
বেকার সমস্যা সমাধান : বেকারত্ব আমাদের সমাজের জন্য একটি অভিশাপ। এর ফলে অসংখ্য আর্থসামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এই সমস্যা সমাধানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার তথা প্রত্যেক নাগরিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা একটি আদর্শ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অবশ্যই রাষ্ট্রকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। যে জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক. কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা : উপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে দেশে যুগোপযোগী কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা প্রসার ঘটালে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি হবে। এরা দেশে বিদেশে উৎপাদনশীল খাতে খুঁজে পাবে কাজের অফুরন্ত সুযোগ। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলতে পারলে স্ব-কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে।
খ. কৃষির সাথে বিকল্প কর্ম সৃষ্টি : কৃষিকাজে নিয়োজিত মৌসুমি ও প্রচ্ছন্ন বেকারদের জন্য কুটিরশিল্পভিত্তিক বিকল্প কাজ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের ভেতরে ও বিদেশে কুটিরশিল্প পণ্যের বিশাল বাজার ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কুটিরশিল্পে পুনর্জাগরণ ঘটানো গেলে বেকারত্ব লাঘবের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
গ. ব্যাপক শিল্পায়ন : বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। এদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক শিল্পায়নের দিকে নজর দিতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারলে এবং শিল্পায়ন বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশ রক্ষা পেতে পারে।
ঘ. দক্ষ জনশক্তি রফতানি : বিপুল জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। দেশের বাইরে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা আছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ২০১৩ সালের হিসাবে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ।
এই হিসেবের বাইরেও অনেক বাংলাদেশি দেশের বাইরে কাজ করছে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা তারা দেশে পাঠাচ্ছে। পরিকল্পিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলে এবং সরকারি উদ্যোগে জনশক্তি রফতানির বাজার স¤প্রসারণ করলে আমাদের দেশে বেকারত্ব কমবে।
ঙ. দক্ষ নেতৃত্ব : রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, ধর্মঘট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ অন্যান্য বাধার কারণে বাংলাদেশে বিদেশি উদ্যোক্তারা পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
চ. শূন্য পদ পূর্ণ করা : বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। মোট পদসংখ্যা প্রায় এর দ্বিগুণ। এ শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দান করা হলে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আমাদের শিক্ষিত যুব শ্রেণি কিছুতেই চাকরি ছাড়া অন্য কোনো পেশা বা বৃত্তিকে গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে না। তাদের কাজ সৃষ্টিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ছ. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : কায়িক শ্রমের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কৃষি ও শিল্প খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ বাড়লে যেটি আপনাআপনিই ঘটবে। কায়িক শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
উপসংহার : বেকারত্ব বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বেকারত্বের যন্ত্রণা বেকার ছাড়া অন্য কেউ কোনো দিন অনুভব করতে পারবে না। আমাদের দেশের অনেক যুবক বেকারত্ব ঘোচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
বেকার জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সাগর, মরুভূমির পথে পা বাড়িয়ে দেশের হাজার হাজার যুবক প্রাণ হারাচ্ছে। এরা দেশের সম্পদ তাদেরকে বাঁচাতে হবে। সকল বাধা দূর করে দেশকে বেকার সমস্যা মুক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি ও বিত্তশালীদের ব্যাপকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৫৭. জাতি গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা
ভূমিকা:
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ রেখে কোনো জাতির পক্ষে উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করা সম্ভব নয়। কারণ নারীসমাজ দেশের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। অর্ধেক জনশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে নারী তার পূর্ণ অধিকারের দাবিদার।
কিন্তু নারী-পুরুষের অব্যাহত বৈষম্য এটাই প্রমাণ করে যে, নারীর পূর্ণ অধিকারের ব্যাপারটি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিনটি গুরুত্বের সাথে পালিত হয়।
জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা : জাতি গঠনে নারী সমাজের দায়িত্ব পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। জাতীয় জীবনে সচলতা, জ্ঞান, কর্ম ও প্রাণ-চাঞ্চল্যের সৃষ্টি না হলে জাতি অচল হয়ে যায়। নারীরা যেহেতু পুরুষের মতোই সমাজের একটা অংশ, তাই পুরুষের মতো নারী সমাজকেও জাতি তথা সমাজ গঠনে ভ‚মিকা রাখতে হয়।
উন্নত দেশসমূহে নারী জাগরণের ফলে দেশের সমৃদ্ধি এসেছে, সমাজজীবন সচল ও গতিশীল হয়েছে। আমাদের দেশের নারীরা সমাজগঠনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলে সমাজ যে উন্নতির পথে অগ্রসর হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু সেবা ও গৃহকর্মের মধ্যে নারীকে সীমাবদ্ধ না রেখে নারীকে জাতীয় ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি সব স্তরে কর্মময় জীবনের অধিকারিণী করে তুলতে পারলে দেশের সমৃদ্ধি ও জাতির মঙ্গল ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশে নারীর বর্তমান অবস্থান : মানবজাতির অর্ধেক অংশ হয়েও নারীরা আজ বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশে প্রচলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুশাসনের জালে আবদ্ধ নারীসমাজ। শিক্ষা, কর্মসংস্থান সর্বোপরি সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি নানারকম সুযোগ-সুবিধা থেকে নারীরা বঞ্চিত। বর্তমানে দেশে নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। প্রতিনিয়ত এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে অসংখ্য নারী।
গৃহ পরিচারিকার ওপর অমানুষিক নির্যতানের খবরও পত্রিকার পাতায় হরহামেশাই আসছে। তবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীসমাজের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের অন্যতম প্রধান রপ্তানি-খাত গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করছে অগণিত নারী শ্রমিক। পরীক্ষার মেধা তালিকায় চোখ বুলালেও দেখা যায় মেয়েদের প্রাধান্য।
তারপরও সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না। চলার প্রতিটি পদক্ষেপেই নারী অসাম্যের মুখোমুখি হয়। বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের অসম অধিকার, পারিবারিক আইনে নারীর অসম অধিকার, জাতীয় সম্পদে নারীর অসম অধিকার, যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে উপেক্ষাÑ রাষ্ট্রের আয়নায় এখনও নারীর অমর্যাদার প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরে।
নারী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা : নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে মানবজাতির কল্যাণের প্রশ্ন জড়িত। দেশে নারীর মর্যাদা আর অবস্থান থেকেই অনুধাবন করা যায় একটি দেশ কতখানি উন্নত বা সভ্য। তাই নারীকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দেওয়ার জন্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নারীকে দিতে হবে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক, যথাযথ মর্যাদা। মনে রাখতে হবে বিশ্বের মেধা, দক্ষতা, প্রতিভার অর্ধেক ভাণ্ডার সঞ্চিত রয়েছে নারীর কাছে। এই অব্যবহৃত বা স্বল্প ব্যবহৃত মানব-সম্পদের সদ্ব্যবহার পুরো মানবজাতির স্বার্থেই জরুরি।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার করণীয় : সারা পৃথিবীতে এখনও নারীকে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। নারীর কাছ থেকে মঙ্গলজনক কোনো কিছু আশা করতে হলে সর্বপ্রথম তাকে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমায় অধিকার অর্পণ করতে হবে।
সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যত তাড়াতাড়ি বদলানো যাবে ও নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দেওয়া যাবে পরিবার তথা সমাজ ও দেশের জন্য ততই কল্যাণকর। যে কোনো সমাজ তথা দেশ নারীর কাছ থেকে উন্নয়নমূলক ও সৃষ্টিশীল কিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা করতে পারে।
তবে তা চাইলে সর্বাগ্রে ফিরিয়ে দিতে হবে নারীর অধিকার। প্রতিযোগী নয় বরং নারীকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে সকল ক্ষেত্রে। নারী নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি নারীর জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার : দেশে নারী যতদিন তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে ততদিন আমরা সমৃদ্ধ জাতি গঠন করতে পারব না। দেশের অর্ধেক জনশক্তিকে অবমূল্যায়ন করে কখনো কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না। সামাজের প্রচলিত কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা এবং নারীর প্রতি হীনদৃষ্টি দূর করতে পারলেই আমরা জাতীয় জীবনে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারব।
৫৮. সমাজকল্যাণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা
[সি. বো. ১৫, ব. বো. ১১, দি. বো. ১১]
ভূমিকা : স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে ছাত্রসমাজের গৌবরগাথা। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী সময়ের পথপরিক্রমায় সামগ্রিক আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে উত্তরণের সৃষ্টি হয়েছে, তার নেপথ্যেও আছে একদল দেশপ্রেমিক তরুণ তাজাপ্রাণ ছাত্রসমাজের উজ্জ্বল ভ‚মিকা।
দেশকে আরো এগিয়ে নিতে ছাত্রসমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখতে হবে। ষাটের দশকে যে ছাত্র আন্দোলন ছিল, তা স্বাধীনতা অর্জনের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে স্বাধিকার আন্দোলন। আজকের আন্দোলন দেশ গড়ার।
এই দেশ গড়ার আন্দোলনে ছাত্রসমাজ কীভাবে ভ‚মিকা পালন করবে? এই প্রশ্নের উত্তরে নানামুনির নানা মত থাকলেও আন্দোলন সংগ্রাম, রাজনীতির বাইরে থেকেও যে ছাত্রসমাজের সমাজকল্যাণে ভ‚মিকা রাখার সুযোগ আছেÑএ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
পড়ালেখাই একমাত্র সাধনা : সংস্কৃত একটি শ্লোক আছে, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ’ অর্থাৎ ছাত্রদের একমাত্র সাধনা অধ্যয়ন করা। ছাত্ররা এই কাজটি সঠিকভাবে করলে দেশ ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার যা দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করার নামই দেশপ্রেম। শিক্ষার আলো ছাত্রদের হাতে থাকলেই সে আলোকিত সমাজ গঠনে অংশ নিতে পারে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ : নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে না পারলে আমরা বেশিদূর যেতে পারব না। তাদের নিজেদের পড়ালেখার ফাঁকে কিংবা বিভিন্ন ছুটির দিনে ছাত্ররা পরিকল্পিতভাবে নিরক্ষরতা দূর করতে ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
যার যার বাড়ি বা বাসার কাজের ছেলে-মেয়ে, গ্রাম ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের একজন সদস্যকে সাক্ষর করতে যদি একজন করে ছাত্র দায়িত্ব নেয়, তাহলে সমাজে নিরক্ষর ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানবসেবা : মানবসেবা পরম ধর্ম। একজন ছাত্র লেখাপড়ার উদ্দেশ্য ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় মানবিকবোধকে জাগ্রত করতে। লেখাপড়া শেষ করে সে দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করবেÑএই শিক্ষাই তাকে দেওয়া হয়। পুঁথিগত বিদ্যার সাথে মানবসেবার বিষয়টি তাকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সংঘ আছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ দেশ ও জাতির বিভিন্ন সংকটে এইসব সংগঠনের ব্যানারে ছাত্রসমাজ সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে।
বৃক্ষরোপণ অভিযান : মানবসভ্যতার জন্য গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্ব অনুবাধন করেই প্রতিবছর সরকারি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালিত হয়। এই অভিযান সার্থক করতে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। তারা বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি রাস্তাঘাটের পাশে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গাছ লাগিয়ে সমাজ উন্নয়ন ও দেশ গড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
চিকিৎসাসেবা : শুধু বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয় অন্যান্য সময়ও ছাত্ররা চিকিৎসাসেবায় ভ‚মিকা পালন করতে পারে। তারা যে এলাকায় বসবাস করে সেই এলাকার সামর্থ্যবান লোকদের বøাড গ্রæপিং করে তার তালিকা সংরক্ষণ করে জরুরি প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহ পারে।
অসহায় রোগীদের হাসপাতালে নিতে সহযোগিতা করতে পারে। ডেঙ্গু জ¦র প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা, গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং কলেরা ও অন্যান্য রোগে খাবার স্যালাইন ও সরবরাহ সচেতনতা সৃষ্টিতে ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
মাদকাসক্তি রোধে ভূমিকা : মাদকাসক্তি বাংলাদেশে অন্যতম একটি জাতীয় সমস্যার নাম। মাদকের বিস্তার ও অপব্যবহার গোটা যুবসমাজের ওপর আঘাত করেছে। সাধারণত উচ্ছল তরুণ সমাজ ও কোমলমতি কিশোররা মাদকের নেশার পথ ধরে চলে ধ্বংসের পথে।
নেশার ফাঁদে পড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে। মাদকের প্রতি ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে নতুন প্রজন্ম। এজন্য অনেকাংশে দায়ী মাদকের কুফল সম্পর্কে ছাত্র ও তরুণদের অজ্ঞতা, উদাসীনতা, অসচেতনতা। ছাত্রসমাজ এই অজ্ঞতা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ : সামর্থ্যবান ছাত্ররা মিলে তাদের পুরাতন বই সংগ্রহ করে দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করতে পারে। তাদের পুরোনো জামা-কাপড় ফেলে না দিয়ে দরিদ্র বন্ধুদের উপহার দিতে পারে। বিন্দু হতেই সিন্ধু হয়, সবাই দশ/পাঁচ টাকা করে দিয়ে ফান্ড গঠন করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে খাতা-কলম ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে পারে।
পল্লি উন্নয়নে ভূমিকা : আমাদের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস কারে। কিন্তু অশিক্ষা, অবহেলা আর কুসংস্কারের কারণে গ্রামের মানুষ অনেক দিক থেকে পিছিয়ে। ছাত্রসমাজ পল্লি উন্নয়নে হাতের আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে এলে প্রতিটি গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। তারা সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার, খাল কাটা, বায়োগ্যাস প্রকল্প, বিভিন্ন টিকা দান কর্মসূচি পালনে সহযোগিতা করতে পারে।
বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারেও সহযোগিতা করতে পারে। পল্লির অশিক্ষিত অর্ধ-শিক্ষিত কৃষকদের মাঝে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির ধারণা সৃষ্টিতেও ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ‘একতাই বল’ মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করে সমবায়ের ভিত্তিতে উন্নত জীবন গড়ার কাজেও ছাত্রসমাজ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
অন্যায়ের প্রতিবাদ : ছাত্রসমাজ চিরপ্রতিবাদী। তারা অন্যায়-অবিচার সহ্য করে না। আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখতে পাব, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি পর্বেই লেখা আছে এ দেশের ছাত্রসমাজের রক্তরাঙা ইতিহাস।
সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করতে ন্যায়ের পক্ষে আজও ছাত্রসমাজ সোচ্চার হলে কোনো শক্তিই তাদের রুখতে পারে না। সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার দূর করতে তারা সোচ্চার ভ‚মিকা পালন করতে পারে। বাল্যবিবাহ, অনিয়ম, দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে পারে।
উপসংহার : ছাত্রসমাজকে সব সময় মনে রাখতে হবে, ‘বিশ্ব গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে গড়তে হবে।’ তাদেরকে সবার আগে নিজেকে গড়ার দিকে মনোযোগী হতে হবে। সমাজ উন্নয়নে তারা যে ভূমিকা পালন করবে তা তাদের সহ-শিক্ষামূলক কাজ বলে গণ্য হবে। দেশের ভবিষ্যৎ যোগ্য ও দক্ষ কর্ণধার হিসেবে নিজেকে গড়তে এ ধরনের কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু তাই বলে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার বাইরে গিয়ে মূল কাজের ক্ষতি করে নয়। তাদেরকে বুঝতে হবে, শিক্ষক ও অভিভাবকরা চালিত হন বিবেক দিয়ে, কিন্তু তরুণদের বিবেকের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আবেগ বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষক ও অভিভাবকদের পরামর্শ মেনেই সমাজকল্যাণে অবদান রাখতে হবে।
৫৯. মানুষের বন্ধু গাছপালা
অথবা, বৃক্ষরোপণ অভিযান [ব. বো. ১৫, রা. বো. ১৩]
অথবা, গাছ লাগান-পরিবেশ বাঁচান
সূচনা : বৃক্ষ বা গাছপালা মানুষের অকৃত্রিম ও চিরস্থায়ী বন্ধু। মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের অবদান অসামান্য। এ ব্যাপারে সমগ্র বিশ্বই আজ সচেতন। বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আমাদের দেশেও সেøাগান উঠেছে, ‘গাছ লাগান-পরিবেশ বাঁচান’।
বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা : বিশ্বের বনভ‚মি উজাড় হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব-পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। অথচ মানুষের বসবাসের উপযোগী ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীর জন্যে গাছপালার কোনো বিকল্প নেই। অক্সিজেন দিয়ে গাছপালা কেবল আমাদের জীবন রক্ষা করে না, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ পালন করে অনিবার্য ভ‚মিকা।
প্রস্বেদন প্রক্রিয়া ও বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বৃক্ষ আবহাওয়া মণ্ডলকে বিশুদ্ধ রাখে, জলীয় বাষ্প তৈরি করে বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে বায়ুমণ্ডলকে রাখে শীতল। বৃক্ষ বৃষ্টি ঝরিয়ে ভ‚মিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, বাড়িয়ে দেয় মাটির জলধারণ ক্ষমতা।
তাই বৃক্ষকে গণ্য করা হয় বায়ুমণ্ডলের বিশুদ্ধকরণ ও শীতলীভবনের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে। এ ছাড়াও গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটির ক্ষয় রোধ করে। ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা রোধেও পালন করে সহায়ক ভ‚মিকা। নদী ছাপিয়ে আসা বন্যার তোড়তে ঠেকায় বনভ‚মি। মাটির ওপর শীতল ছায়া বিছিয়ে দিয়ে ঠেকায় মরুকরণের প্রক্রিয়াকে।
বাংলাদেশে বৃক্ষনিধন ও তার প্রতিক্রিয়া : ভারসাম্যমূলক প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যে দেশের মোট ভ‚মির অন্তত ২৫ শতাংশ বনভ‚মি থাকা দরকার। সেক্ষেত্রে সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে বনভ‚মির পরিমাণ ১৭ শতাংশ। উপরন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ঐ বনভ‚মির পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। যেখানে তিনটি গাছ কাটা হচ্ছে সেখানে একটি গাছও লাগানো হচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে। ফলে বাস্তবে বনভ‚মি বাড়ছে না।
দুঃখের বিষয়, গত একশ বছরে প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে ব্যাপক হারে নির্বিকার বৃক্ষনিধনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বনভ‚মির পরিমাণ নেমে এসেছে ৩.৫ শতাংশে। তারই বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর আবহাওয়ায়। দিনের বেলা দুঃসহ গরম আর রাতে প্রচণ্ড শীত অনুভ‚ত হচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, এ লক্ষণ মরুকরণ প্রক্রিয়ার আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস।
বৃক্ষরোপণ অভিযান : দেশকে মানুষের বসবাস উপযোগী করার জন্য বনায়নের বিকল্প নেই। কেননা গাছপালাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু গাছ না লাগিয়ে যদি কেবল কেটে ফেলা হয় তাহলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। এজন্য বৃক্ষরোপণে সমাজের সকল স্তরের লোকজনকে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশের বনায়নের সম্ভাবনা বিপুল। নানাভাবে এ বনায়ন সম্ভব।
একটি পন্থা হলো সামাজিক বন উন্নয়ন কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হলো : রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণে জনসাধারণকে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করানো। জনগণ যাতে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে এ কর্মসূচিতে যোগ দেয় সেজন্যে অর্থনৈতিক প্রণোদনা থাকতে হবে। তাছাড়া নানা জাতের বৃক্ষ মিশ্রণ করে রোপণ করতে হবে যেন গ্রামবাসীরা খাদ্য, ফল, জ্বালানি ইত্যাদি আহরণ করতে পারে। সাধারণ জনগণকে যদি বিপন্ন পরিবেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করা যায় তাহলে অনেকেই বৃক্ষরোপণের কাজে এগিয়ে আসবেন।
আমাদের করণীয় : বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল করার জন্য সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। বাড়ির আশপাশে খালি জায়গাগুলোতে যথাসাধ্য গাছ লাগাতে হবে। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের এ ব্যাপারে এখন থেকেই সচেতন করে তুলতে হবে। একটি গাছ কাটার প্রয়োজন হলে আগে কমপক্ষে দুটি গাছ লাগাতে হবে।
উপসংহার : মানুষ ও প্রাণিকুলের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বৃক্ষরোপণ অভিযান অত্যন্ত জরুরি। এ অভিযান সফল হলে আমাদের জীবন সমৃদ্ধ হবে। দেশ ভরে উঠবে সবুজের প্রশান্তিতে।
৬০. বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
ভূমিকা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অন্যান্য শিল্পের তুলনায় বেশ এগিয়ে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ অংশই আসে এই শিল্প থেকে। এই শিল্প বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এককালে মসলিন ও জামদানির জন্য পৃথিবীখ্যাত বাংলাদেশ আবার বস্ত্রক্ষেত্রে নতুন ধরনের গৌরব অর্জনের পথে পা বাড়িয়েছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ এখন সুপরিচিতি লাভ করেছে পোশাক শিল্পের কল্যাণে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের সূচনা : বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। আশির দশকের গোড়ার দিকে গার্মেন্ট শিল্প দ্রæত বিকাশ লাভ করতে থাকে। মূলত বেসরকারি উদ্যোগেই এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ দেশে ১৯৮৩ সালে মাত্র ৫০টির মতো কারখানা ছিল।
বর্তমানে তা তিন হাজারেরও অধিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ সময়ের মধ্যে কর্মসংস্থানও ১০ হাজার থেকে শুরু করে প্রায় ৩০ লাখে উপনীত হয়েছে, যা উৎপাদন খাতে নিয়োজিত মোট শ্রমিকের ১৫%-এরও অধিক। পোশাক শিল্প খাত বর্তমানে দেশের অর্থনীতির বৃহৎ খাত, বৈদেশিক বাণিজ্যের সর্ববৃহৎ খাত এবং নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বৃহৎ খাত।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বাজার : বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ক্রেতা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার পরেই ইউরোপ ও কানাডা। বিশ্বের ১২২টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্য ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে।
জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে বাজার স¤প্রসারিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকের বেশ চাহিদা রয়েছে। ফলে এর বাজার যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি এর উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা করা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক শিল্প বিরাট অবদান রাখবে এবং দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের অবদানের প্রধান দিকগুলো হচ্ছে :
১. জাতীয় আয়ের প্রায় ৬৪ অংশ আসে এই খাত থেকে। তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রাণপ্রবাহ সচল রাখতে সাহায্য করছে।
২. প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। এরা পেয়েছে স্বাবলম্বী জীবন ও অর্থনৈতিক মর্যাদা।
৩. পোশাক শিল্প বিকশিত হওয়ায় দেশে রপ্তানিজাত আইটেমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ৬৩% আসছে এই শিল্প থেকে।
৪. পোশাক শিল্প দেশে দ্রæত শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ¯িপনিং, উইভিং, নিটিং ডাইং, ফিনিশিং এবং প্রিন্টিং শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া গার্মেন্টস শিল্প রপ্তানির জন্যে প্যাকেজিং, গামটেপ, জিপার, বোতাম ও বগলস শিল্পের প্রসার ঘটেছে।
৫. তৈরি পোশাক শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ২৫৪৯ কোটি ডলার।
৬. পোশাক শিল্পের সামগ্রী আমদানি ও রপ্তানির ফলে বন্দর থেকে ফ্যাক্টরি পর্যন্ত পরিবহন শিল্পের অগ্রগতি হয়েছে এবং এসবের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে।
৭. গার্মেন্ট শিল্পে বিনিয়োগ করে ব্যাংক লাভবান হচ্ছে। বিমা কোম্পানির প্রিমিয়ামের পরিমাণ বাড়ছে।
পোশাক শিল্পের সমস্যা : বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে এখনো নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সরকার পোশাক শিল্পের অনুক‚লে প্রায়ই মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে যাচ্ছে। তথাপিও সুদের হার এবং অন্যান্য আর্থিক নীতি এ খাতের অনুক‚ল নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বন্দর সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। অসুবিধাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্ট খরচ।
ফাইল মুভমেন্ট, এলসি খোলা, মাল খালাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা ধরনের অস্পষ্ট ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা এ শিল্পকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাঁচামাল ঢাকার কারখানায় পৌঁছাতে যেখানে সাত দিন সময় লাগার কথা সেখানে বর্তমানে প্রায় একুশ দিন লেগে যায়।
সমস্যা সমাধানে সরকারের করণীয় : ইতিমধ্যে সরকার পোশাক শিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। যেমনÑ এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, এক্সপোর্ট পারফরম্যান্স লাইসেন্স, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা স্থাপন, রপ্তানিকারকদের বিদেশ সফরের সুবিধা, সরকারি পুরস্কার ইত্যাদি। তারপরও আরও কিছু করণীয় সরকারের রয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে :
১. মূল্য সংযোজন কর হার কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে টিকে থাকতে সহযোগিতা করা।
২. কারখানা বিমার ক্ষেত্রে ফ্লাড সাইক্লোন শর্ত শিথিল করা।
৩. দ্রæত রপ্তানির জন্য কার্গো বিমান চার্টার করার অনুমতি প্রদান।
৪. লোডশেডিং বন্ধ করা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৫. রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে ইপিজেডের মতো সুযোগ-সবিধা প্রদান।
৬. পোশাক শিল্প প্রসারের জন্যে উদারভাবে সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
৭. কোটানীতি-সংক্রান্ত দুর্নীতির অবসান।
৮. আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আরো নতুন নতুন পোশাক তৈরির দিকে মনোযোগ প্রদান।
৯. বস্ত্রশিল্পের চাহিদা অনুযায়ী দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ।
পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা : পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। তবে বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এজন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে আইএসও সনদ গ্রহণ করতে হবে; যেহেতু ক্রেতারা এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সর্বোপরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বস্ত্র ও পোশাকের মানোন্নয়ন, মূল্য হ্রাস করে চ্যালেঞ্জকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১-৫ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ৬-১০ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১০-১৫ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১৬-২১ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১-১০ | PDF Download
উপসংহার : আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য দেশের সাথে প্রবল প্রতিযোগিতা করেই আমাদেরকে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু অবকাঠামোগত সুযোগ-সবিধার অভাবসহ বিরাজিত অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ এখনই না নিলে ভবিষ্যতে মুক্ত বাজারে আমাদের এ সম্ভাবনাময় খাতটি যে মার খাবে তা একপ্রকার নিশ্চিত।
বিশেষত আমাদের কাঁচামাল দিয়েই যদি আমরা পোশাক তৈরি করতে পারি তা হবে দেশের জন্য সোনায় সোহাগা। পোশাক শিল্পের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে সমাধান করে বিশ্বের দরবারে এই শিল্পকে অনন্য মর্যাদায় আসীন করা যায়।
৬১. গ্রাম্য মেলা
ভূমিকা: গ্রামীণ জীবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ গ্রাম্য মেলা। বিনোদনহীন নিরানন্দ একঘেয়ে গ্রাম্য জীবনে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে মেলা। গ্রামবাসী এই দিনটির প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। মানুষের সাথে মানুষের, শিল্পের সাথে শিল্পীর এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি হয়। মানুষের মেলা আর মেলার মানুষ একসূত্রে বাঁধা পড়ে।
মেলার উৎপত্তি : মেলার শুরু ঠিক কবে থেকে সে সম্পর্কে কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। অর্থাৎ, মেলার জন্মকথা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এ কথা বলা যায়, যখন থেকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের শুরু, তখন থেকে মেলারও শুরু।
মেলার স্থান, উপলক্ষ্য : গ্রামের বেশির ভাগ মেলাই বসে নদীর তীরে। মেলার পসরা সাজিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসে নৌবহর। বিশাল বট কিংবা অশ্বত্থের ছায়ায়, কখনো বা বিস্তৃত খোলা মাঠে বসে মেলা। নির্জন অশ্বত্থতল কিংবা নদীতীর হয়ে ওঠে কোলাহল মুখরিত। নানা উপলক্ষে গ্রামে মেলা বসে। আবহাওয়া ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন জনপদে মেলার বৈচিত্র্য দেখা যায়।
প্রবীণরা এখনো বলেন, এলো পৌষ বলে শীত যখন জেঁকে বসে তখন প্রথমেই মনে পড়ে যায় মেলার কথা। শীতের শেষে গাঁয়ের মানুষের শস্যভাণ্ডার থাকে পূর্ণ। পিঠা-পার্বণের উৎসব চলে। এ সময় তাদের অখণ্ড অবসর। এই অবসরে আনন্দের স্পর্শ জাগায় মেলা। বাংলা বছরের শেষে চৈত্রসংক্রান্তির মেলার মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় আর বৈশাখি মেলায় নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়।
এ ছাড়াও মহররমের সময়ও মেলা বসে। হিন্দু স¤প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। আবহমানকাল থেকেই ধর্মীয় ও লৌকিক উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মেলা। রবীন্দ্র পরিবারে ছিল মেলার চল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দীক্ষা উপলক্ষে বাংলা ১২৫০ সনের ৭ই পৌষ একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের তত্ত¡াবধানে শান্তিনিকেতনে মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। মেলার উদ্বোধনী দিনে তিনি ভাষণও দিতেন। এমনই এক মেলায় উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘এই মেলার উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়। হৃদয় খুলে দান করবার ও গ্রহণ করবার এই মেলাই হলো প্রধান উৎস ও উপলক্ষ।’
গ্রাম্য মেলার পুরনো ইতিহাস : বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে মেলার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। মোগল আমলে নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রায়ই গ্রাম্য মেলা বসত। ‘আইন-ই-আকবরী’তে বলা হয়েছে, মেলা এলেই গ্রামে পড়ে যেত সাজ সাজ রব। গ্রামবাংলার আসল রূপ যেন তখনই ফুটে উঠত। মানুষের মন তখন আনন্দমুখর। এরও আগে মেলা রাজ-আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কালের আবর্তে মেলা সাধারণ জনগণের আওতায় আসে।
গাঁয়ের সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে গ্রাম্য মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভ‚মিকা ছিল গ্রাম্য মেলাগুলোর। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিগান, পালাগান, যাত্রা, লেটোর আসর। অতীতে প্রধানত শীতকালেই মেলা হতো।
কালক্রমে তা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঋতু উৎসব, লোকজ সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ ইত্যাদিতে বিস্তৃতি পায়। বৈশাখি মেলা, কার্তিকের মেলা, আশুরার মেলা, রথের মেলা, পৌষ সংক্রান্তির মেলা, রাস পূর্ণিমার মেলা, মাঘী পূর্ণিমা তিথি মেলা ইত্যাদি একসময় শুধুই গ্রামবাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে তা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আধুনিক যান্ত্রিক জীবনের কর্মকোলাহলের মাঝেও ঠাঁই করে নিয়েছে।
মেলায় যেসব জিনিসের সমাগম ঘটে : নতুন ধানের তৈরি পিঠে-পুলি, পায়েস, কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য যেমন- বাঁশ-বেতের ডালা, কুলা ও অন্যান্য আসবাব, বিভিন্ন ধরনের খেলনা; মৃৎশিল্প যেমন- মাটির হাঁড়ি-পাতিল, ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিস, পুতুল, তাল পাতার পাখা, শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, লোহার ও কাঠের নানা সামগ্রী, বিন্নি ধানের খই, বাতাসা, নাড়–, ছাঁচের তৈরি বিভিন্ন জিনিস যেমন- হাতি, ঘোড়া, পাখি, আম, কাঁঠাল, মসজিদের গম্বুজ, মন্দিরের চূড়ো, নলেন গুড়ের তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি ইত্যাদি অসংখ্য সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে।
গ্রাম্য মেলার তাৎপর্য : বাংলার গ্রামীণ জীবন যেন সার্থকভাবে ফুটে ওঠে গ্রামের মেলায়। মেলা যেন উপেক্ষিত গ্রামের মানুষদের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র। গ্রামের আর্থ-সামাজিক জীবনের সাথে মেলার যোগ নিবিড়। হস্ত ও কুটিরশিল্প এবং রকমারি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে মেলায়। গ্রামের অবহেলিত স¤প্রদায়- দরিদ্র কুমোর, কামার, তাঁতি তাদের তৈরি
পণ্য নিয়ে সহজেই মেলায় আসতে পারে। পণ্যের কারিগরের সাথে ক্রেতার সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। আবিষ্কৃত হয় নানা রকম নকশা, কারুকাজ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান পায় পূর্ণতা।
কঠোর পরিশ্রমী মানুষ কিছুদিনের জন্য আনন্দে অভিভ‚ত হয়। এমন প্রাণপ্রাচুর্যময় আয়োজন আর দেখা যায় না। পসরা কেনাবেচার পাশাপাশি চলে লাঠিখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা, মোরগের লড়াই, হা-ডু-ডু, পুতুল নাচ প্রভৃতি খেলা। বাঙালি নতুন করে স্বাদ পায় হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যের।
উপসংহার : গ্রামবাংলার মেলা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। বছরের পর বছর এই মেলা আমাদের সংস্কৃতিকে একভাবে টিকিয়ে রেখেছে, যদিও আজ নগর জীবনের বিলাসিতার উপকরণ গ্রামগুলোকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। শহরের বৈদ্যুতিক বাতি, মাইক্রোফোনে ব্যান্ড সংগীত মেলার পুরনো ঐতিহ্যকে অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। তারপরও মেলার দিনটির জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে গাঁয়ের মানুষ। গ্রামে এমন প্রাণোচ্ছল সময়, এমন প্রাচুর্যময় মিলনমেলা আর কখনো আসে না।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।