HSC | বাংলা ২য় পত্র | গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা ৪১-৪৫ | PDF Download: বাংলা দ্বিতীয় পত্র হতে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রবন্ধ রচনা গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্য বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়টির গুরুপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
৪১. একটি শীতের সকাল
[চ. বো. ১৩, ব. বো. ১৩, য. বো. ১২, ঢা. বো. ১১, রা. বো. ১০]
ভূমিকা : বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালাক্রমে ছয়টি ঋতু এসে বাংলাদেশকে নব নব রূপে সাজায়। সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে তারা আসে আর যায়। বসন্ত ঋতুর আগে এর আগমন ঘটে। প্রকৃতিকে কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে নিতে আবির্ভাব ঘটে শীতকালের। আর শীতের সকাল এক বিচিত্র অনুভ‚তির সঞ্চার করে মানবমনে। এ সময় প্রকৃতি রিক্ততার সন্ন্যাসী রূপ ধারণ করে যেন।
কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে মানুষের মনে অলসতা ভর করে। চাদর মুড়ি দিয়ে শীতকে দূরে ঠেলার প্রগাঢ় চেষ্টায় লিপ্ত মানুষ বারবার ব্যর্থ হয়। ধরণীর বুকে শীতের আগমন আনে বৈরাগ্যের সুর। এর সাথে সাথে শীতের সকালও একই রূপ পরিগ্রহ করে। তাই বুঝে কবি বলেন
“হিম হিম শীত শীত
শীত বুড়ি এলো রে,
কনকনে ঠাণ্ডায়
দম বুঝি গেলো রে।”
শীতকালের বৈশিষ্ট্য : ষড়ঋতুর মধ্যে পঞ্চম ঋতু হলো শীতকাল। পৌষ ও মাঘ এ দুই মাস শীতকালের ব্যাপ্তি থাকে। ইংরেজি বর্ষপঞ্জি অনুসারে মোটামুটি নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত শীত অনুভ‚ত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালের বিপরীত অবস্থানে থাকে শীতকাল। বর্তমান সময়ে শীতকালে আবার বৃষ্টি হতেও দেখা যায়। প্রবল শৈত্যপ্রবাহে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রাণহানিও ঘটে।
শীতের সকালের স্বরূপ : কুয়াশার চাদরে মোড়া শীতের সকাল হাড় শীতল করা ঠাণ্ডা নিয়ে দেখা দেয়। এ সময় এক ফালি রোদ সকলের কাছে বহুল প্রতীক্ষিত হয়ে ওঠে। গ্রাম হোক কিংবা শহর, সব জায়গাতেই শীতের রয়েছে একটি ভিন্ন আমেজ। শীতের সকালে মানুষের মাঝে এক অজানা অলসতা ভর করে। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকাতেই যেন তখন স্বর্গীয় সুখ অনুভ‚ত হয়।
কর্মব্যস্ত মানুষ ঘুমের জগতে হারিয়ে যায়। কুয়াশার অন্ধকারে সূর্যদেবতার দেখা পাওয়া ভার। তাই সকালের উপস্থিতি টের পাওয়াও কষ্টকর। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা শীতকেও দূরে সরিয়ে দেয়। তাই আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই হয় সকলকে। নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
শীতের সকালে শান্ত প্রকৃতি ভোরের আলো-আঁধারিতে রহস্যময় রূপ ধারণ করে থাকে। তবে ধীরে ধীরে শীতের কুয়াশা কাটতে থাকে। অতঃপর শীতের আকাশে মুচকি হাসি নিয়ে দেখা দেয় রবির কিরণ। এর মধ্যেই শীতের সকালের অপার আনন্দের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাই কবি বলেন
“ঋতুর দল নাচিয়া চলে
ভরিয়া ডালি ফুল ও ফলে,
নৃত্যলোকে চরণতলে মুক্তি পায় ধরা
ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়া উঠে জ্বরা।”
শীতের সকালে প্রকৃতি ও প্রাণীর অবস্থা : শীতের সকালে প্রকৃতি ও প্রাণীর মধ্যে এক ভিন্ন আমেজ লক্ষ করা যায়। শীতের সময় দিন ছোট এবং রাত বড় হয়। সকাল হয়েও যেন হয় না। মানুষ, জীবজন্তু, পাখ-পাখালি শীতের বেলায় সূর্যের প্রত্যাশায় প্রহর গুনতে থাকে। ঠাণ্ডায় জড়সড় হয়ে থাকতে দেখা যায় সবাইকে। কুয়াশার জালে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে চারদিক। শিশির ঝরতে থাকে অবিরাম। কেবল মানুষই নয়, প্রাণীরাও বাইরে বের হতে চায় না। আড়ষ্ট হয়ে থাকে শীতের প্রকোপে।
গ্রামের প্রকৃতিতে শীতের সকাল : শীতের সকালের প্রকৃত আনন্দ গ্রামীণ জীবনেই খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলার গ্রামগুলোতে শীতের সকাল বেশ মনোরম হয়। গ্রামের মাঠে মাঠে শীতের প্রভাব বেশ চোখে পড়ে। শীতের কুয়াশা ভেদ করে নিজ নিজ গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়ে বের হয় গ্রামের কর্মঠ মানুষেরা।
সূর্যের দেখা পাওয়া মাত্রই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রোদ পোহাতে শুরু করে। গ্রামের মানুষেরা খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীতকালে উষ্ণতা খুঁজে ফিরে। আগুনের চারপাশে বসে তারা তাপ পোহাতে থাকে। তবে গ্রামীণজীবনে দারিদ্র্যের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। বস্ত্রাভাবে দরিদ্র পরিবারের অনেক মানুষের শীতে নাকাল অবস্থা হয়। গ্রামের অনেক প্রবীণ ব্যক্তির প্রাণহানিও ঘটে থাকে শীতের প্রকোপে।
শীতের সকালে গ্রামের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত হলো পিঠা-পুলি খাওয়ার মুহূর্ত। গাছে গাছে খেজুরের রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। সে হাঁড়ি নামালে ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা রস খাওয়ার লোভে ছুটে ছুটে আসে। এ রস দিয়ে নানা রকম পিঠা বানানো হয়। বাড়িতে বাড়িতে মা, চাচি কিংবা দাদিরা সকালবেলাতেই পিঠা তৈরি করতে বসে। অনেকে শীতের ছুটি উপভোগ করতে শহর থেকে ছুটে যায় গ্রামে। শীতের সকালে নানা পিঠা খাওয়ার চিত্রকে তুলে ধরতেই মনে হয় কবি বলেছেন
“পৌষ মাসে পার্বণে খেতে বসে খুশিতে বিষম পেয়ে
আরও উল্লাস বেড়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”
শহুরে জীবনে শীতের সকাল : শহুরে জীবনে শীতের সকালের রূপ ভিন্ন হয়ে থাকে। গ্রামীণ জীবনের আবেদন এখানে পাওয়া যায় না। ইট-কাঠ-পাথরের শহরে শীতের সকালের আমেজ একদম আলাদা। শহরে দেখা যায় বারান্দায় বসে রোদ পোহানোর দৃশ্য কিংবা গরম চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে খবরের কাগজ পড়ার দৃশ্য। লেপ জড়ানো কর্মব্যস্ত মানুষ নির্দিষ্ট সময়ের পরেও আরও একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়।
কিন্তু জীবিকার টানে তকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতেই হয়। নিজ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য গরম কাপড় পরিধান করে প্রস্তুত হতে হয় সকলকে। ঘাসের ওপরে টলমল করতে থাকা শিশির বিন্দু শহরে তেমন একটা দেখা যায় না। খেজুরের রস কিংবা নানা স্বাদের পিঠার সুঘ্রাণ এখানে খুঁজে পাওয়া বিরল। এখানে কেবল কাকের কর্কশ আওয়াজ, যানবাহনের শব্দ এবং মানুষের কোলাহলমিশ্রিত যান্ত্রিক জীবনই দেখা যায়।
উপসংহার : শীতের সকাল অন্য সব ঋতুর চেয়ে একদম আলাদা। শীতের রিক্ততা প্রকৃতির সবুজকে ছিনিয়ে নিলেও দিয়ে যায় ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী বার্তা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা গোটা প্রকৃতি শীতকে যে একেবারেই উপভোগ করে না, তা ঠিক নয়। শীতের আবেদন চিরন্তন।
হিমঠাণ্ডার কনকনে অনুভ‚তি প্রতিটি মানুষকে আলোড়িত করে। তাই শীত চলে গেলেও এর রেশ থেকে যায় এবং প্রকৃতি বসন্তের আগমন হেতু অপেক্ষমাণ হয়। তাই তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ
‘এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরি জয়,
যুগের পরে যুগান্তরে মরণ করে লয়।
বর্ষাকাল
সূচনা : সকাল দুপুর
টাপুর টুপুর
রিম-ঝিমা-ঝিম বৃষ্টি।
আকাশ উপুড়
ঝাপুর ঝুপুর
বন্ধ চোখের দৃষ্টি।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সাজে। গ্রীষ্মের পরই বর্ষার আগমন ঘটে। আষাঢ়Ñশ্রাবণ এ দুই মাস মিলে বর্ষাকাল। ঋতুবৈচিত্র্যের এই দেশে এ সময় বাংলা লাভ করে এক ভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
বর্ষার আবহাওয়া : বর্ষাকালে আকাশ ঢাকা থাকে কালো মেঘে। মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনে প্রকৃতি থেমে থেমে শিউরে ওঠে। ঘন ঘন বৃষ্টি হয়। একটানা কয়েক দিন সূর্যের মুখ দেখা যায় না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বয়। বিদ্যুৎ চমকায়, কখনো প্রবল ঝড় হয়। টানা বর্ষণের ফলে অনেক সময় বন্যা হয়।
বর্ষার প্রকৃতি : বর্ষার আগমনে প্রকৃতি থেকে মুছে যায় গ্রীষ্মের ধূসর ক্লান্তি। গাছপালা যেন প্রাণ ফিরে পায়। মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, ডোবা-পুকুর, নদী-নালা পানিতে ডুবে যায়। নদীতে ভেসে চলে পালতোলা নৌকা, ডিঙি আর কলাগাছের ভেলা। জলাবদ্ধতার কারণে অনেক স্থানে লোকজনের চলাচলে খুবই সমস্যা হয়।
বর্ষার ফুল : বর্ষাকালে আমাদের ঝিলে-বিলে ফোটে পদ্ম, শাপলা, কলমিসহ কত ধরনের ফুল। ডাঙায় ফোটে কদম, হিজল, কেয়া, গন্ধরাজ, বেলি ইত্যাদি। বৃষ্টির জলে ভিজে এসব ফুল সজীব হয়ে যায়। মনে হয় চারদিক জুড়ে যেন তখন ফুলের মেলা বসে।
বর্ষার ফল : বর্ষাকালে এ দেশে হরেক জাতের ফল পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ জাম, পেয়ারা, আমড়া, লটকন, আতা, বাতাবি লেবু ইত্যাদি। এসব ফল বর্ষার বৈশিষ্ট্যকে স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরে।
বর্ষার অবদান : গ্রীষ্মের রুক্ষতার পর বর্ষা যেন নিয়ে আসে প্রাণের স্পন্দন। এ সময় প্রকৃতি যেন ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়। এ সময় নদীর পানির সাথে আসা পলিমাটি জমির উর্বরতা বাড়ায়। ফলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
সাহিত্য সংস্কৃতিতে বর্ষার অবদান : বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। বর্ষা যেমন প্রকৃতিকে করেছে সজীব তেমনি মানুষের মনকেও করেছে সরস। বর্ষার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক কবি-সাহিত্যিকই রচনা করেছেন গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রভৃতি।
প্রাচীন কবি জয়দেব থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত অনেক কবি সাহিত্যিকই মুগ্ধ হয়েছেন বর্ষার সৌন্দর্যে। বর্ষা যেমন প্রকৃতিকে সিক্ত করেছে রসের ধারায় তেমনি কবিদের সিক্ত করেছে ভাবরসের ধারায়। তাই তো কবিগুরু বলেছেন
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বারিষায়।”
উপসংহার : কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বর্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঋতু। এটি রূপবৈচিত্র্যে তুলনাহীন। ভালোবাসার উচ্চ স্পর্শে প্রকৃতির মাঝে জাগে প্রাণের স্পন্দন। অতি বৃষ্টির কারণে বন্যা হওয়ার বিষয়টি বাদ দিলে বর্ষাকাল অবশ্যই আমাদের জন্য আশীর্বাদ।
৪২. আমার দেখা একটি মেলা
অথবা, একটি লোকজ মেলা
সূচনা : মেলা আমাদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক। আক্ষরিকভাবে ‘মেলা’ শব্দের অর্থ হলো ‘মিলন’। মেলায় পরিচিতিজনদের সঙ্গে দেখা হয় এবং ভাববিনিময় হয়। একের সঙ্গে অন্যের সংযোগ ঘটে মেলায়। গ্রামীণ মেলাগুলোতে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির পসরা বসে। সেই সাথে পাওয়া যায় নির্মল বিনোদনের নানা উপায়।
মেলার প্রচলন : অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে মেলার প্রচলন ছিল। তবে পূর্বে মেলার আয়োজন করা হতো সুনির্দিষ্ট কিছু স্থানে এবং বৃহৎ পরিসরে। বর্তমানে দেশের প্রায় সব স্থানেই মেলা বসে। কোনো কোনোটির আয়োজন অনেক বড়, আবার কোনোটির ক্ষুদ্র। তবে মেলার আনন্দ এখনো আগের মতোই রয়েছে।
মেলার উপলক্ষ্য : আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেলা বিভিন্ন স¤প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দুদের দুর্গাপূজা, রথযাত্রা, দোল উৎসব, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের ১০ই মহরমকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষেও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমার দেখা মেলার উপলক্ষ্য ছিল পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ।
মেলার স্থান : সাধারণত খোলা কোনো বৃহৎ স্থানে, যেখানে মানুষের চলাচল রয়েছে, তেমন স্থানেই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমি যে মেলাটি দেখেছি, সেটি বসেছিল নদীর ধারের বিশাল একটি বটগাছের নিচে। সেটি আমাদের এলাকার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। এখানে প্রায়ই বিভিন্ন উপলক্ষে মেলা বসে।
মেলার প্রস্তুতি : পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির সবচেয়ে আনন্দের দিন। এদিনকে উপলক্ষ্য করে মেলার প্রস্তুতি ছিল বিশাল। অস্থায়ীভাবে বটগাছের চারদিকে দোকানপাট তৈরি করা হয়। একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালার জন্য একটি বড় মঞ্চ তৈরি করা হয়। কিছু মানুষ মূল স্থানে জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে বসার প্রস্তুতি নেয়। মঞ্চের চারদিকে মাইক লাগানো হয়।
মেলার চিত্র : পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের দিন থেকে মেলা শুরু হয়। মেলা শুরু হতেই এতে প্রচুর লোকসমাগম দেখা যায়। দোকানগুলো ছিল নানা দ্রব্যসামগ্রীতে কানায় কানায় ভরা। মানুষ রঙিন পোশাক পরে মেলায় আসছিল। ছোট ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক। তারা ভিড় করে মাটির খেলনা, বেলুন, বাঁশি আরও নানা জিনিসের দোকনে।
আর নারীরা ভিড় করেন প্রসাধনসামগ্রী ও চুড়ির দোকানে। এ ছাড়া কাপড়ের দোকানেও তাঁদের ভিড় লক্ষ করা যায়। মেলায় ছিল নানা বৈচিত্র্যময় খাবারের আয়োজন। ছোলাভাজা, বাদামভাজা, পাঁপরভাজা, ভুট্টার খই, কনক ধানের খই, মুড়কি, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই ও নানা রকমের মিষ্টি পাওয়া যাচ্ছিল। মেলার একদিকে একটি লোক সাপের খেলা দেখাচ্ছিল। তা দেখতে ভিড় করে অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়া ছোটখাটো একটা সার্কাসের আয়োজনও ছিল।
মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান : সন্ধ্যার সময় মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় শিল্পীদের গান পরিবেশনের পর শুরু হয় যাত্রাপালা। মঞ্চে ভেলুয়া সুন্দরীর পালা পরিবেশন করা হয়। ভেলুয়া সুন্দরীর দুঃখগাথা দেখে অনেকেই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমেই দিনব্যাপী এই মেলাটর সমাপ্তি টানা হয়।
মেলার তাৎপর্য : এ ধরনের গ্রামীণ মেলায় মানুষের স¤প্রীতির এক বন্ধন তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে তৈরি জিনিসের একটি প্রদর্শনী হয় মেলায়। শহুরে মানুষ তার নিজের শেকড় সম্পর্কে জানতে পারে মেলায় এসে। শুধু তাই নয়, এখানে অর্থনৈতিক বিষয়ও যুক্ত থাকে। ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করার জন্য মেলার ওপর নির্ভর করে। অনেকে মেলাকে ঘিরে গোটা বছরের বিকিকিনির বড় পরিকল্পনাও করে থাকে।
উপসংহার : বাঙালি সংস্কৃতির বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে লোকজ মেলা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবহমান গ্রামবাংলার প্রথা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। গ্রামীণ এই মেলাটি আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। আমাদের লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি মেলায় গিয়ে।
৪৩. পাহাড়পুর
অথবা, একটি ঐতিহাসিক স্থান
অথবা, একটি দর্শনীয় স্থান
সূচনা : গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগত কারণে ইতিহাসে মর্যাদা পাওয়া যে কয়টি স্থান বাংলাদেশে রয়েছে তার মধ্যে পাহাড়পুর অন্যতম। এটি বাংলাদেশের এমনকি দুনিয়ার একটি বিখ্যাত স্থান, যা মূলত একটি সুপ্রাচীন বৌদ্ধবিহার। পাল আমলের গঠিত এই বৌদ্ধবিহার ইতিহাসকে বুকে ধরে এটি আজও দাঁড়িয়ে আছে।
অবস্থান : পাহাড়পুর বিহারটি বর্তমান রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার ‘পাহাড়পুর’ গ্রামে অবস্থিত। এর আরেক নাম ‘সোমপুর বিহার’ বা ‘সোমপুর মহাবিহার’।
আবিষ্কারের ইতিহাস : আজ থেকে প্রায় ১৪শ বছর আগে বিহারটি নির্মাণ করা হয়। রাজা দ্বিতীয় ধর্মপাল এটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ সময় এটি খালি পড়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো কাজে ব্যবহৃত হয়নি।
অনেকে মনে করেন, যুগ যুগ ধরে উড়ে আসা ধুলোবালি ও মাটি এর চারদিকে জমতে থাকার কারণে একসময় মাটির স্তূপে ঢাকা পড়ে এটি পাহাড়ের মতো হয়ে যায়। সেই থেকে এর নাম হয়ে যায় ‘পাহাড়পুর’। দীর্ঘকাল পরে ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম এটি আবিষ্কার করেন।
নির্মাণশৈলী ও বিবরণ : সুপ্রাচীন এ বিহার এলাকাটি প্রায় ৪০ একর জায়গাজুড়ে লালচে মাটির ভ‚মিতে বিস্তৃত। ২৭ একর জমির ওপর এর বিশাল দালান। মাটির নিচের অংশে এটি চারকোণা আকারের। বাইরের দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটি দিয়ে নানা রকম ফুল-ফল, পাখি, পুতুল, মূর্তি ইত্যাদি বানানো আছে।
উত্তর দিকের ঠিক মাঝখানে মূল দরজা। তারপরেই রয়েছে অনেকগুলো ছোটÑবড় হলঘর। দেয়ালের ভেতরে সুন্দর সার বাঁধা ১৭৭টি ছোট ছোট ঘর। সামনের দিকে আছে লম্বা বারান্দা। বিহারটিতে আরও আছে পুকুর, স্নানঘাট, ক‚প, স্নানঘর, রান্নাঘর, খাবার ঘর ও টয়লেট। সব মিলিয়ে বিহারটিতে ৮০০ মানুষের থাকার ব্যবস্থা ছিল।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থাপনা : বিহারের ভেতর বিশাল উঠানের মাঝখানে বড় এক সুন্দর মন্দির। ধাপে ধাপে উঁচু করে বড় মন্দিরটা বসানো হয়েছে। পোড়ামাটির দুই হাজার ফলকের চিত্র দিয়ে মন্দিরের বাইরে আর ভেতরে সাজানো। একই রকম ছোট ছোট মন্দির পুরো বিহারের নানা জায়গায় আছে।
বিহারটির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে দেয়ালের বাইরে একটা বাঁধানো ঘাট আছে। ওটাকে বলা হয় ‘সন্ধ্যাবতীর ঘাট’। পাহাড়পুর বিহারের পাশে আছে দেখার মতো একটা জাদুঘর। সেখানে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে খনন করে পাওয়া অনেক পুরাতন আর দুর্লভ জিনিসপত্র। এই এলাকার একটু দূরেই আছে ‘সত্যপীরের ভিটা’। সেখানে অনেকেই ভক্তিভরে প্রার্থনা করে, মানত করে।
গুরুত্ব : বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে পাহাড়পুর এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটি ছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। ভারতবর্ষের বৃহত্তম বিহার হিসেবে এখানের বিহারটির রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। এখানে প্রাপ্ত প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলো থেকে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
উপসংহার : পাহাড়পুর বিহারের প্রতœতাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে এটি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এলে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। আমাদের সকলেরই উচিত একবারের জন্য হলেও পাহাড়পুর ঘুরে আসা।
৪৪. ফেলে আসা দিনগুলো
অথবা, আমার শৈশব স্মৃতি
ভূমিকা : জীবন গতিশীল। আর এই গতিই বেঁচে থাকা। গতি হারানোর অর্থই মৃত্যু। জীবনের এই ছুটে চলার মাঝে অনেক পদচিহ্ন পেছনে পড়ে থাকে। জীবনছবির ফ্রেমে সেই দিনগুলো বাঁধিয়ে রাখলে হয় তো একটি মহাকাব্য হবে। সেই কাব্যে যেমন থাকবে সুখের মোহনীয় মুহূর্তগুলোর রোমাঞ্চকর স্মৃতি, আবার এর বিপরীত অনেক কিছু থাকবে, যা শুধু যন্ত্রণাই বাড়াবে। ইচ্ছে করবে কলমের একটানে মুছে ফেলতে।
নয় তো ইচ্ছে করবে এমন করে ভাবতে- ‘এটা আমার জীবনের পর্ব নয়।’ কিন্তু যা একবার ফেলে এসেছি তা ফিরে না এলেও মনের পাতা থেকে, জীবন খাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার খাতার হিসাব মিলিয়েই নির্ধারিত হয় মানুষের পরবর্তী জীবনের এমনকি পরপারের জীবনের পথচলা। তাই, ফেলে আসা দিনগুলি যতই তুচ্ছ ভাবি তুচ্ছ নয় ঐদিনের সিঁড়ি বেয়েই আসে জয়-পরাজয়।
জীবনটা খুব ছোট : বাংলাসাহিত্যের অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,‘ আমাদের জীবনটা খুব ছোট। একটা কচ্ছপ বাঁচে তিনশ বছর। মানুষ একশ বছরও বাঁচে না।’ তাঁর মতো বড়মাপের মানুষরা যখন এমন কথা বলেছেন, তখন আমি কী আর বলব, আমার ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে? আমার জীবনের ফেলে আসা স্মৃতি ভরা দিনগুলো এখনো পরিপুষ্টই হয়নি। এখনও স্কুলের বারান্দা দিয়ে কেবল হাঁটছি। কৈশোর পেরিয়ে এখনো যৌবনের দ্বারে পা পড়েনি।
‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না-
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না-
সেই- যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
এই গান গাওয়ার সময় এখনো আমার আসেনি। তারপরও জীবন খাতার পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে কিছু স্মৃতিময় স্মরণীয় ক্ষণ।
কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি : আমার ফেলে আসা দিনের ফ্রেমে আছে একটা সোনালি শৈশব। গ্রামের সবুজ-শ্যামল আঁচলের ছায়া। মায়ের স্নেহভরা মিষ্টি মুখ। বাবার কর্মক্লান্ত অথচ হাসোজ্জ্বল প্রিয়মুখ। বাঁশবাগানের মাথায় ওঠা চাঁদ। বাড়ির পিছন দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদী।
গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেলিম স্যারের আদরভরা শাসন। বন্ধুদের সাথে দুপুরের রৌদ্রে ঘুড়ি ওড়ানোর ধূসর ম্মৃতি। নদী, বিল-ঝিলের পানিতে মাতামাতি, জেলেদের মাছ ধরার ছবি। আজও মনের কোণে উঁকি দেয় ঝুপ করে মাছরাঙার পাখির মাছধরা কিংবা কাঠঠোকরার খট-খট শব্দে কাঁঠাল গাছে গর্ত করার ছবিগুলো।
শীতকালের কিছু মধুর স্মৃতি কোনো দিন ভোলা যাবে না। ভাইবোন সবাই মিলে চুলার কাছে বসে মায়ের পিঠা বানানো দেখতে দেখতে পিঠা। তারপর শিশির ভেজা ভোরে চাচা, চাচি, মামা, মামি, ফুফু ও চাচাতো, মামাতো ভাই-বোনেরা আসতেন। পাড়াপ্রতিবেশীরা আসতেন। সবাই মিলে একসাথে বসে শীতের পিঠা খাওয়ার পর ঝালমুখ করা হতো হাঁসের গোশত দিয়ে গরম গরম ভাত।
খাওয়ার পর্ব শেষে ভাই-বোনরা সবাই রঙিন ঘুড়ি হাতে বেরিয়ে যেতাম পাশের মাঠে। সর্ষে ক্ষেতের সবুজ পাতার পাতায় হলদে ফুল আহ! কী মনকাড়া ছবি। তারপর সারাদিন হইচই। স্কুল হোস্টেলের এই বন্দিদশায় খুব বেশি বেশি মনে পড়ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা শেষের সেই সোনালি দিনগুলো।
বৈশাখ মাসে আকাশে মেঘ করলে মা ব্যস্ত হয়ে যেতেন আমাদেরকে ঘরে নিতে, আর আমরা মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে আম কুড়াতে চলে যেতাম আমাদের বাগানে। বাড়ি ফিরে আমগুলো দিতাম মায়ের হাতে। তারপর মা হাসিমুখে হাজির হতেন কাঁচা আমের সাথে কাসুন্দী মিশিয়ে নিয়ে। সেই স্বাদ ভোলার নয়। এখনো ভাবলে জিভে পানি আসে।
আরো মনে পড়ে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসে টিনের চালে ঝুম-ঝুম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে অলস দুপুরে ভাইবোনে মিলে তিনগুটি, লুডু কিংবা দাবা খেলার মধুর স্মৃতি। এখন পড়ালেখার এত চাপ খেলার কথা ভাবতেই পারি না।
বড় বুবুর বিয়ে। সবাই ব্যস্ত বিয়ের আয়োজনে। আমাদের পক্ষ থেকে কলাগাছে রঙিন কাগজ লাগিয়ে গেট করা হয়েছে। তার সাথে রঙিন কাপড়ে সুন্দর কারুকাজ। পালকি চড়ে বর এলো। দুই পক্ষের মধ্যে চলল ধাঁধার পাল্লা। না জিতলে বরকে বাড়িতে আসতে দেওয়া হবে না।
অনেক সময় ধরে চলল। কিন্তু না, কোনো পক্ষই কম নয়। হারার নাম নেই কারো। দাদু ভাই এগিয়ে গিয়ে বরকে মানে পাগড়ি পরা দুলাভাইকে নিয়ে এলেন। হাতে রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন দুলাভাই। এখন ভাবতে গেলে খুব হাসি পায়। আর সেদিন বুবু যখন পালকিতে উঠে তার শ্বশুরবাড়ি চলে যায় খুব কেঁেদছিলাম।
প্রতিদিন তিনবার রান্নার পর প্লেটে খাবার নিয়ে মায়ের স্নেহভরা ডাক, এই স্কুল হোস্টেলে নেই। ঘড়ি দেখে নিজেকেই যেতে হয় ডাইনিং টেবিলে। এখন আমি মায়ের স্নেহের ছায়া ছেড়ে অনেক দূরে শহরের স্কুলের হোস্টেলে থাকি। হাই স্কুলে পড়ি। অনেক বড় হয়ে গেছি কারণ আমাকে অনেক বড় হতে হবে। মা-বাবার স্বপ্ন আমি পড়ালেখা শিখে প্রকৃত মানুষ হব। তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করব। তাই স্নেহ, মায়া আর স্মৃতির ফাঁদে বাঁধা পড়লে চলবে না।
সামনে চলার শক্তি : ফেলে আসা দিনগুলো ফিরে আসবে না। তারপরও মানুষ ফেলে আসা দিনে ফিরে যেতে চায়। আমার ফেলে আসা দিনগুলোও আমাকে দারুণভাবে ভাবায়, আনন্দ আর বেদনার মাঝে জড়িয়ে রাখে। এখনকার দিনগুলো একসময় অতীত হবে। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে চলার শক্তি খুঁজে ফিরি সবসময়।
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১-৫ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ৬-১০ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১০-১৫ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১৬-২১ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১-১০ | PDF Download
উপসংহার : আমার অতীত দিনগুলোকে ফেলে আসা দিন বললেও ফেলে আর আসতে পারলাম কই! আমার মনের ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে সেই দিনগুলো। আমার জীবনের সাথে মিশে আছে। আমি যখন যেখানে যাচ্ছি তারাও আমার সাথে সাথে চলছে। কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। হয়তো কোনো দিন পারবও না। কারণ সেই দিনগুলো আমার জীবনেই অংশ। তার সাথে মিলিয়েই গড়ে উঠছে আমার ভবিষ্যৎ।
অতীতকে ভুলে ভবিষ্যৎ গড়ার চিন্তা করা অসম্ভব। তাই আমি আমার ফেলা আসা দিনগুলোর স্মৃতিগুলো খুব যতেœর সাথে মনের মাঝে সংরক্ষণ করছি। সেই স্মৃতির শক্তিতে আগামী দিনের মজবুত ভিত গড়ার প্রত্যাশাকে লালন করে পথ চলছি।
৪৫. বর্ষণমুখর একটি সন্ধ্যা
[রা. বো. ১৪, ব. বো. ১০]
অথবা, আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা
জীবন খাতার পাতায় জমে অভিজ্ঞতার নানা বিচিত্র ঘটনা। আজ আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এমন একটি স্মরণীয় ঘটনার তুলে ধরছি। শ্রাবণ মাস। সকাল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা। মাঝে কয়েকবার হালকা বৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে কালো মেঘের ফাঁকে পশ্চিম আকাশে পড়ন্ত সূর্যের আবির রং দেখে মনটা নেচে ওঠে। আমরা কয়েক বন্ধু মনের আনন্দে রবিঠাকুরের কবিতায় গানের সুর তুলে গাইতে গাইতে বাড়ি হতে বের হই
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,
বাদল গেছে টুটি।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি
আমাদের বাড়ি থেকে হারাবিলের দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি নয়। বন্যার পানিতে সেই দূরত্বরেখা মিশে গেছে। এক কিলোমিটারের ফসলের মাঠ পানিতে একাকার। বিল আর ফসলের মাঠের পার্থক্য বোঝা যায় না। বাড়ির ঘাটে বাঁধা ছিল আমাদের নৌকা।
আমাদের বৈঠার হেইয়া টানে নৌকা এগিয়ে চলছে। সূর্য ডুবে গেছে কখন আমাদের কোনো খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো-আঁধারির খেলা চলছে। মেঘের ভেলা জমে জমে কখন যে আকাশ ভরে গেছে, বন্ধুদের হৈহুল্লোড় আর আনন্দ-উল্লাসে আমরা খেয়ালই করেনি যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
হঠাৎ আকাশ ভেঙে সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামল। আমরা বিলের পাড়ের গাঁয়ের ছেলে। ঝড়, বৃষ্টি, বাদল, বন্যা দেখে খুব সহজে সাহস হারা হই না। হারাবিল নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনি, কিংবদন্তি এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। যার বেশির ভাগই ভয় আর শরীরের রক্ত হিম করার মতো। ভ‚ত পেতœী নয় তো ডাকাতের কায়-কারবার নিয়ে কল্পনার রংমাখা ভয়ংকর সব কাহিনি। আরো আছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কাহিনি।
পাকবাহিনী এই বিলের বটগাছের নিচে ক্যাম্প করে কত মানুষকে মেরে বটগাছের নিচে গর্ত করে পুঁতে রেখেছে তার হিসেব নেই। সেই সব অতৃপ্ত আত্মারা নাকি সন্ধ্যা হলেই বের হয়ে ঘুরে বেড়ায় বিলের পানির ওপর দিয়ে। এমন সব কাহিনি দিনের আলোতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন যেন সত্যি বলে মনে হচ্ছে।
আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। নৌকায় পানি জমছে। আমরা কাকের মতো ভিজছি। চারদিক অন্ধকার। দূরে গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলা সন্ধ্যা বাতির আলোও চোখে পড়ছে না বৃষ্টির আঁধারের ঘনঘটায়।
বৃষ্টিতে ভিজে শীত শীত লাগা শুরু হলো। বাড়ির কথা মনে পড়তেই অস্বস্তি ঘিরে ধরল। বৃষ্টিমুখর এই সন্ধ্যায় আমাদের না পেয়ে নিশ্চয়ই মা-বাবা চিন্তায় অস্থির। নিজেদের অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। সবাই মিলে বৈঠা ঠেলতে লাগলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
আমরা বিলের মাঝখানে চলে এসেছি। হঠাৎ বৃষ্টির ছন্দময় শব্দকে মনে হচ্ছে ভ‚তের কান্না। বাতাসের শিরশির শব্দ কানে এসে বাজছে পেতœীর হিহিহি হাসির মতো। বিকট শব্দে দূরে একটা বাজ পড়ল, কিন্তু মনে হলো আমাদের ওপরই যেন পড়ল।
ব্রজপাতের আলোয় যতটুকু দেখা গেল, তাতে মনে হলো আমরা ভুল পথে চলছি। আশপাশে আর কোনো নৌকা বা লোকজনের দেখা নেই। বিলের মাঝখানের ঢিবির ওপরের বটগাছ অর্ধেকটা ডুবে আছে। এই বটগাছতলায় নাকি প্রতি অমাবস্যার রাতে ভ‚তদের আসর বসে। এ কথা মনে হতেই শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল।
এমন সময়, ‘ঐ তো দূরে আলো দেখা যাচ্ছে’- আমাদের মাঝ থেকে একজন চিৎকার করে উঠল। আমি চমকে উঠলাম। তাকে চুপ করতে বলে বললাম। ‘ঐ দিকে তো বটগাছ। নিশ্চয়ই ভ‚তের আগুন। নয় তো ডাকাতরা ওত পেতে বসে আছে। মহাজনদের নৌকা লুট করার জন্য। চিৎকার করো না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকো।’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই কালিমা শাহাদাত আর দোয়া ইউনুছ পড়া শুরু করল।
মনে মনে পড়তে বললেও তা আর মনে মনে থাকল না। ভয়ে কাঁপা গলায় তা এক অন্য রকম ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করল। দূরের আলো আস্তে আস্তে কাছে আসছে। আমরা অজানা ভয় আর সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে দুলতে লাগলাম। আলো থেকে পালাব নাকি কাছে যাব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না।
হঠাৎ মনে হলো আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। দাদির কাছে শুনেছি ভ‚তরা নাম ধরে ডাকে। ডেকে নিয়ে তারপর ঘাড় মটকে রক্ত খায়। আমার এক বন্ধু বলল, ‘এটা তো চাচা মিয়ার গলা।’ আমাদের বাড়ির কাজের লোককে আমরা চাচা মিয়া বলে ডাকি। চাচা মিয়া ডাকছে শুনে মনে সাহস ফিরে পেলাম। ভয় আর আনন্দের মিশ্রণে চিৎকার বেরিয়ে এলো আমাদের গলা দিয়ে।
আমাদের চিৎকার লক্ষ্য করে আলোটি এগোতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকাটি আমাদের কাছাকছি চলে এলো। নৌকা থেকে টর্চ লাইটের আলো এসে পড়ল আমাদের মুখের ওপর। বাবার গলার আওয়াজ পেলাম। আবার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল। মনে হলো এবার আর রক্ষা নেই। নিশ্চয়ই যে কাণ্ড ঘটিয়েছি, ভীষণ রেগে আছেন। কিন্তু না, ঘটনা ঘটল উল্টো। আমাদেরকে দেখে বাবার চোখে পানি এসে গেল।
তিনি নিজে চাচা মিয়ার নৌকা ছেড়ে আমাদের নৌকায় এসে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা চালাতে শুরু করলেন। তখনও ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকা এসেছে ঘাটে ভিড়ল, মা দৌড়ে এসেছে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে নিয়ে গরম কাপড় পরতে দিলেন।
বাড়ির ঘাটে আমার অন্য বন্ধুদের বাবা-মা, ভাই-বোনরাও অপেক্ষা করছিলেন। তারাও যার যার বাড়ি চলে গেল। আমার জীবনে অনেক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা এসেছে, আরো আসবে। কিন্তু এই সন্ধ্যার স্মৃতি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।