স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত) প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিষয়: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
সামরিক শাসন : আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের শাসনামল (১৯৫৮-১৯৭১)
বিষয় কোড: ২১১৫০১
খ-বিভাগঃ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর
০১. সামরিক শাসন কী?
অথবা, সামরিক শাসন বলতে কী বুঝ?
উত্তরঃ ভূমিকা : বিশ্বের প্রতিটি দেশে সামরিক বাহিনী দেশের অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে একটি শক্তিশালী, সুসংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান।
সামরিক বাহিনীর দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা, পেশাদারিত্ব অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে উৎকৃষ্ট এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করায় সামরিক বাহিনী নিজেদেরকে অন্যান্য গোষ্ঠী ও শ্রেণি থেকে আলাদা ভাবতে শেখায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
সামরিক শাসন : সাধারণত বেসামরিক কার্যাবলি যখন সামরিক লোক দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তাকে সামরিক শাসন বলে। অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যখন বেসামরিক ব্যক্তির পরিবর্তে সামরিক ব্যক্তি আসে তখন ঐ অবস্থাকে সামরিক শাসন বলে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: সামরিক শাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফাইনার (চৎড়ভ. ঋরহবৎ) বলেন, “সামরিক বাহিনী যখন তার নিজস্ব নীতি বাস্তবায়নের জন্য বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে তাকেই সামরিক শাসন বলে।”
অধ্যাপক এলান আর. বল (চৎড়ভ. অষষধহ জ. ইধষষ) বলেন, “সামরিক শাসন বলতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বা সোজাসুজি ক্ষমতা করায়ত্ত করাকে বুঝায়।”
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম (Prof. Finer) বলেন, “সামরিক শাসন কতকগুলো ঞবপযহরয়ঁবং এর সমন্বয় যার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর চড়ষরপু প্রকাশ পায়। এ সামরিক শাসন অবৈধতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।
সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে গতানুগতিক সাংবিধানিক কাঠামো শাসনকার্যে কোনো সহায়তা প্রনান করে না।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামরিক শাসন যেমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংস ডেকে আনে, তেমনিভাবে রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেয়। ফলে দেশে বিনিয়োগ কমে যায়, বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়।
তাছাড়াও ব্যাপক গণঅসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ফলে জনগণের ম্যান্ডেটহীন শাসন। বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না।
০২. সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে লেখ ।
অথবা, সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : মানবজাতি সভ্যতার শুরু থেকে সুসংহত ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে আগ্রহী। এ উদ্দেশ্যে মানুষ গঠন করেছে রাষ্ট্র। আর এ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী অপরিহার্য একটি প্রতিষ্ঠান।
শক্তিশালী এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অজুহাতে উন্নয়নশীল দেশে হস্তক্ষেপ করে বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে থাকে। তবে রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে যে সামরিক শাসনের সূচনা হয় তা দেশের উন্নয়নের চেয়ে ক্ষতিই করে বেশি।
সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য : সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য : রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়। দেশের চলমান রাজনৈতিক কার্যাবলি তার গতিশীলতা হারায়।
উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়। এরূপ দমন-পীড়নের ফলে রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্যতার সৃষ্টি হয়।
২. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসসাধন : কোনো দেশে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো প্রকার চর্চা থাকে না।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
দেশে স্বৈরতন্ত্রের পথ সুগম হওয়ায় জোর যার রাজ্য তার এ নীতির প্রতিফলন ঘটে। এতে দেশের সমস্যাসমূহ আরও জটিল আকার ধারণ করে।
৩. সংবিধান স্থগিত কোনো দেশে সামরিক শাসন জারি হলেই সেদেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়। তাছাড়া আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়। আর জনগণের মতামত প্রকাশের অধিকার তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
৪. মৌলিক অধিকার হরণ : সামরিক শাসন প্রথমেই জনগণের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে থাকে। নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি অধিকার খর্ব করা হয়।
৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ : সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বিচার বিভাগ বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা চর্চা করে। কিন্তু সামরিক শাসনামলে সামরিক আদালতে বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা হয়। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামরিক শাসক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু পদদলিতই করে না, বরং রাজনৈতিক এলিটদের অকর্মণ্য ও নির্জীব করে রাখে।
রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সামরিক শাসকরা বেসামরিক প্রশাসনের মেধা ও বুদ্ধিমত্তাকে উপেক্ষা করে। আর তাই সামরিক শাসনের প্রবণতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং জনগণও এ শাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
০৩. ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির ফলাফল বর্ণনা কর।
অথবা, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলাফল লেখ।
উত্তরঃ ভূমিকা : আইয়ুব খান পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি করেন। এর ফলে এদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোও নিষিদ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে সামরিক একনায়কত্বের বেড়াজা পাকিস্তান রা ঢুকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে।
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির ফলাফলঃ নিম্নে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির ফলাফল বর্ণনা করা হলো:
১. সংবিধান বাতিল: পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ যে সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করেছিল সে প্রস্তাবসমূহ গণপরিষদ ও শাসকচক্রের দুরভিসন্ধির ফলে বাতিল হয়ে যায়।
দ্বিতীয় গণপরিষদ পাকিস্তানের জন্য প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ ও মোটামুটি সবার কাছে গ্রহণীয় সংবিধান প্রণয়ন করে। কিন্তু সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে সংবিধান ও গণপরিষদ সবকিছুই বাতিল হয়ে যায়। সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক আইনের সমষ্টি।
সংবিধান বাতিলের মাধ্যমে এ মৌলিক আইনের বিলুপ্তি ঘটে।
২. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বাতিল : আইয়ুব খান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলোকে বরখাস্ত করেন।একই সাথে তিনি জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহ ভেঙে দেন এবং সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
৩. রাজনৈতিক সংস্কার : আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্কারের পরিকল্পনা করেন। এ লক্ষ্যে তিনি Elective Body Disqualified Order (EBDO) জারি করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনীতিকদের রাজনীতি করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন।
৪. মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচন : প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পর ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বলাবাহুল্য এ দুটি নির্বাচনে আইয়ুব খান বিশাল ব্যবধানে নির্বাচিত হন।
৫. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার : ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উদ্ভব ঘটেছিল তা আইয়ুব খানের আমলে বেশ সুদৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। কেননা অন্যান্য সামরিক শাসকের ন্যায় আইয়ুব খানও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ব্যাপারে ছিলেন অতি উৎসাহী।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর সামরিক বেসামরিক এলিটদের কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টার সফল বাস্তবায়ন ঘটেছিল ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে।
ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল । যার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
০৪. আইয়ুব খান কীভাবে পাকিস্তানে তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন?
অথবা, পাকিস্তানে কীভাবে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল । এ সামরিক শাসনের সর্বাধিনায়ক ছিলেন আইয়ুব খান। সামরিক আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় ।
ফলে তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী বহু অত্যাচার এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সামরিক আইন পাকিস্তানিদের জন্য ছিল অভিশাপস্বরূপ।
পাকিস্তানে আইয়ুব খানের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা : ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাত ১০:৩০ মিনিটে তৎকালীন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।
এতে তিনি আইন প্রশাসক হিসেবে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খানকে মনোনীত করেন। এছাড়াও ৭ অক্টোবরের ফরমানে তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করেন।
এমনকি কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারসমূহকে বরখাস্ত করা হয়, জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদসমূহকে বিতাড়িত করা হয়, রাজনৈতিক দলসমূহকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এসময় জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত করা হয়।
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ইস্কান্দার মির্জাকে পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করার পর আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৮ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
মূলত অসাংবিধানিক উপায়ে আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিলেন ।
আর তাই তিনি দেশের মানুষের সমর্থন অর্জনের লক্ষ্যে জনগণকে বুঝিয়েছিলেন পূর্বের শাসনব্যবস্থা দেশকে ধ্বংসের মুখে পতিত করেছে এবং তিনি শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতো।
এমনকি দেশকে তিনি সুনিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন তিনি জনগণের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সামরিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব।
মূলত সামরিক শাসনব্যবস্থা জারি হওয়ার ফলেই পূর্ব পাকিস্তানে এক অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট মির্জাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জেনারেল আইয়ুব খান নিজ দক্ষতা ও চাতুর্যের বলে পাকিস্তানে তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। স্বার্থবাদী আইয়ুব খান নিজ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য এবং নিজ স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে সামরিক শাসনব্যবস্থা বেছে নিয়েছিল।
আইয়ুব খান ছলেবলে, কৌশলে পাকিস্তানে তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন, যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
০৫. আইয়ুব খানের শাসনের বৈশিষ্ট্য লেখ।
অথবা, আইয়ুব খানের শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করার পর দেশের আপামর জনগণের অধিকারকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। তার শাসনব্যবস্থা ছিল দায়িত্বহীন ও প্রচলিত আইনবিরোধী।
আইয়ুব খানের শাসনের বৈশিষ্ট্য : আইয়ুব খান তার শাসনামলে অর্থনীতি, ভূমি আইন, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রভৃতি কতকগুলো সংস্কার সাধন করেন। নিম্নে তার শাসনামলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :
১. সামরিক একনায়কত্ব : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হলো আইয়ুব শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি সামরিক একনায়কতন্ত্র শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন। তার এক দশক শাসনকালের মধ্যে চার বছর ছিল নিরঙ্কুশ একনায়কতান্ত্রিক সামরিক শাসনকাল ।
২. রাজনীতিকদের ওপর কলঙ্ক লেপন : ক্ষমতায় এসেই আইয়ুব খান বলেন যে, রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দেওয়ার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর।
এজন্য রাজনীতিবিদদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের জন্য শুরুতেই তিনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করেন।
৩. মৌলিক গণতন্ত্র : ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব খান সীমিত মাত্রার গণতন্ত্রের ধারণা বাস্তবে রূপ দিতে ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর অভিনব মৌলিক গণতন্ত্র বা বুনিয়াদি গণতন্ত্র চালু করেন। এতে তিনি ৫ স্তরবিশিষ্ট পিরামিড আকৃতির একটি কাঠামো সৃষ্টি করেন।
কাঠামোগুলো হলো— ১. ইউনিয়ন কাউন্সিল, ২. থানা কাউন্সিল, ৩. জেলা কাউন্সিল, ৪. বিভাগীয় কাউন্সিল ও ৫. প্রাদেশিক কাউন্সিল ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
৪. বিরোধীদের দমনপীড়ন : আইয়ুব খানের শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার সামরিক সরকারবিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন অত্যাচার ও নির্যাতন নেমে আসে।
শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার ডাক দিলে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন ।
৫. রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ : বিলুপ্তি ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করাই ছিল তার শাসনামলের একটি বৈশিষ্ট্য। ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে সকল রাজনৈতিক দলকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।
৬. সংবিধান বাতিল ও মৌলিক অধিকার স্থগিত : নিজ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সামরিক শাসক আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের সংবিধান রহিত করেন। তিনি জনগণের মৌলিক অধিকারও হরণ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আইয়ুব খানের শাসনামল বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। উক্ত সময়ে বাঙালি জাতি পদে পদে নির্যাতিত এবং অত্যাচারিত হয়।
মূলত তার শাসনব্যবস্থা তথা সামরিক শাসনব্যবস্থা একটি মানবতা বহির্ভূত শাসনব্যবস্থা। উক্ত শাসনব্যবস্থায় অনেক রাজনীতিবিদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ এনে তাদেরকে হয়রানি করা হয়, এমনকি রাজনৈতিক দলসমূহকে উচ্ছেদও করা হয়।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
০৬. আইয়ুব খানের রাজনৈতিক নিপীড়নের বর্ণনা দাও ৷
অথবা, আইয়ুব খানের রাজনৈতিক নিপীড়ন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে আইয়ুব খানের শাসনামলে রাজনৈতিক দমনপীড়ন এক দশকের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। আইয়ুব খানের নির্দেশে ১৯৬৮ সালের ১১-১২ অক্টোবর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বহু নেতাকর্মী গ্রেপ্তার করা হয় ।
তাদের মধ্যে ছিল মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, হামিদুল হক চৌধুরী, আব্দুল খালেক প্রমুখ বিখ্যাত রাজনীতিবিদগণ । আইয়ুব খানের রাজনৈতিক নিপীড়ন : আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে সবচেয়ে বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছে সাবেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীবৃন্দ।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা প্রাপ্তির পর পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক দলসমূহ উচ্ছেদ করে শুধুমাত্র এককভাবে তার প্রভাব বিস্তার করার উদ্দেশ্যে। আইয়ুব খান নিজেই বিভিন্ন ধরনের মনগড়া আইন সৃষ্টি করে।
তিনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলসমূহকে ভেঙে দিয়ে চুপ করে বসে থাকেননি, বরং সাবেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব নেতাকর্মীকে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আখ্যায়িত করেন স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির অভিযোগে।
তিনি সোহরাওয়ার্দী এবং ফিরোজ খান নূনের প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এছাড়াও আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছিল ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
এমনকি এম. এ. খুহরো নামক একজন সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে আটক রাখা হয়েছিল। কালোবাজারে গাড়ি বিক্রি করার অভিযোগে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
১৫০ জন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি এবং প্রায় ৬০০ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যকে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে।
আইয়ুব খান তাদের উক্ত অভিযোগ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৫৯ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে ‘Elective Bodies Disqualification Order’ বা সংক্ষেপে (EBDO) এবং ‘Public Office Disqualification Order’ (PODO) নামক দুটি আইন প্রবর্তন করেন ।
আইয়ুব খান উক্ত আইনদ্বয়ের আওতায় যেকোনো সরকারি সদস্য কিংবা নির্বাচিত সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আনতে পারবেন।
আইয়ুবের শাসনামলে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য অসৎ উপায় অবলম্বন করা, দুর্নীতি করা প্রভৃতি কাজকে ‘অসদাচরণ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ।
কোনো সরকারি সদস্য বা নির্বাচিত সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ এলে উক্ত অভিযোগ তদন্ত করার উদ্দেশ্যে দুই প্রদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি কেন্দ্রে একটি ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছিল ।
উক্ত ট্রাইবুনালের আওতায় কেউ দোষী প্রমাণিত হলে ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত তিনি যেকোনো প্রকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
এবডোর আওতায় সামরিক সরকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খান আবদুল গাফফার খান, মিয়া মমতাজ দৌলতানা প্রমুখসহ ৮৭ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আইয়ুব খানের শাসনামলে রাজনৈতিক নিপীড়ন ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। আইয়ুব খান একটানা ৪৪ মাস দেশে স্টিমরোলার চালান।
জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল যাতে ভবিষ্যতে একটি সময় পর্যন্ত কোনোরূপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে তার প্রয়াস চালান। নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বিভিন্ন কালাকানুন তৈরি করেন এবং দমনপীড়ন চালান ।
০৭. ১৯৬২ সালের সংবিধান কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
অথবা, ১৯৬২ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে ১৯৬২ সালের সংবিধান বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
পরবর্তীতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা দখল করে এবং ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করেন। ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থ হওয়ার কারণ : নিয়ে ১৯৬২ সালের সংবিধান ব্যর্থ হওয়ার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. জনমত উপেক্ষা ১৯৬২ সালের সংবিধানে জনমতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে এ সংবিধান প্রণীত হয়েছিল।
জাতীয় ধ্যানধারণার তথা জনমতের কোনো প্রতিফলন এ সংবিধানে ঘটেনি। যার ফলশ্রুতিতে এ সংবিধান সফলতার মুখ দেখেনি।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব : ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
কিন্তু প্রাদেশিক সরকারের ওপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের ফলে কেন্দ্রের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে সমাবেশ ঘটে তাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক সরকারে রূপান্তরিত হয়। যার ফলে এ সংবিধান ব্যর্থ হয়।
৩. শাসনকার্যে পূর্ব পাকিস্তানের অনুপস্থিতি : পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রাণের দাবি স্বায়ত্তশাসনকে ১৯৬২ সালের সংবিধানে অবহেলা করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
সংবিধানের আলোকে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ছিল খুবই নগণ্যসংখ্যক, যা ১৯৬২ সালের সংবিধানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
৪. মৌলিক গণতন্ত্র প্রচলন : আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের সংবিধানের মাধ্যমে মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। এটি প্রচলনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয় এবং মৌলিক গণতন্ত্রীদের হাতে ভোটাধিকার চলে যায়।
জনগণ ভোটাধিকারের দাবিতে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে এবং তারা সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান করে।
৫. অর্থনৈতিক বৈষম্য : আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের সংবিধান পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পাহাড় সমান বৈষম্যের সৃষ্টি করে। তাছাড়া সরকারের আর্থিক নীতি পশ্চিম পাকিস্তান ঘেঁষা হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়।
এ বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে, যা সংবিধানকে ব্যর্থতার দিকে ধাবিত করে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের সংবিধানে গণসমর্থন ছিল না। কেননা কায়েমি স্বার্থবাদীদের চালিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত জনকল্যাণ ও জনসমর্থন লাভে সক্ষম হয়নি।
পাকিস্তানের ভৌগোলিক প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা একেবারেই অবান্তর ছিল। ১৯৬২ সালের সংবিধানের ব্যর্থতা সে কথাই প্রমাণ করে ।
০৮. মৌলিক গণতন্ত্র কী?
অথবা, মৌলিক গণতন্ত্র বলতে কী বুঝ?
উত্তরঃ ভূমিকা : প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। যখন আইয়ুব খান ক্ষমতায় আরোহণ করেন তখন তিনি তার শাসন ক্ষমতাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে মৌলিক গণতন্ত্র প্রণয়ন করেন।
স্থানীয় পর্যায়কে একটা শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে মূলত আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন । তার এ মৌলিক গণতন্ত্র ছিল অগণতান্ত্রিক প্রকৃতির ।
মৌলিক গণতন্ত্র : ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব খানের উত্থান বা ক্ষমতা দখল কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল অনেক চিন্তাভাবনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল ।
এজন্য আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই স্বীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মৌলিক গণতন্ত্র (Basic Democracy) তন্মধ্যে অন্যতম।
ক্ষমতা দখলের এক বছর পর ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ’ (Basic Democracy Order) জারি করেন।
এ আদেশবলে তিনি স্থানীয় সরকারের চার স্তরবিশিষ্ট যে পরিকল্পনা করেন তার নামকরণ করা হয় মৌলিক গণতন্ত্র বা বুনিয়াদি গণতন্ত্র। মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে আইয়ুব খান জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
কারণ মৌলিক গণতন্ত্র চালুর ফলে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার বিনষ্ট হয়। এ ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হতো। পরবর্তীতে তারাই প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচন করতেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যেই ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র ও অধ্যাদেশ জারি করেছেন।
এ অধ্যাদেশের মাধ্যমেই জনগণের অংশগ্রহণে নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করা হয়। আইয়ুব খানের এ মৌলিক গণতন্ত্র ছিল অগণতান্ত্রিক প্রকৃতির শাসনব্যবস্থা ।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
০৯. মৌলিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কী অথবা, মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা কর
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইয়ুব খানের উত্থান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল অনেক চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনার ফল। যার কারণে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই আইয়ুব খান স্বীয় ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ।
মৌলিক গণতন্ত্র (Basic Democracy) তন্মধ্যে অন্যতম। আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর ‘মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ’ নামে এক অদ্ভুত আদেশ জারি করেন ।
মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ : মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. অগণতান্ত্রিক : মৌলিক গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করা যায় না।
কারণ একদিকে এ ব্যবস্থায় যেমন জনগণের ভোটাধিকার ছিল সংকুচিত, তেমনি ইউনিয়ন কাউন্সিল ছাড়া বাকি তিনটি ধাপ তথা থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল এবং বিভাগীয় কাউন্সিলের সদস্যগণ কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না।
এ তিনটি স্তরে সরকারি কর্মকর্তা তথা আমলাদেরই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ।
২. ভোটাধিকার হরণ : মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের ব্যাপক ভোটাধিকার হরণ করা হয়। এ অবস্থায় জনগণ নয়, কেবল নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথা মৌলিক গণতন্ত্রীদেরকেই ভোটাধিকার প্রদান করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচনের ক্ষমতা জনগণের ছিল না।
৩. রাজনৈতিক অনীহা তৈরি : মৌলিক গণতন্ত্রের ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক অনীহা তৈরি হয়। সরকারের উদ্দেশ্যই ছিল জনগণকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা । মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে আইয়ুব খানের এ অসৎ উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
৪. দুর্নীতির বিস্তার মৌলিক গণতন্ত্রীরা ছিল সমাজের অন্যতম ক্ষুদ্রতম অংশ। এ সংখ্যা ছিল মাত্র আশি হাজার। ফলে এ মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গের ওপর সরকার খুব সহজেই প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
নানা প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রদান করে এসব ব্যক্তিকে সরকারের পক্ষে নিয়ে আসা তেমন কঠিন ছিল না। এতে সমাজে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।
৫. প্রতারণা : মৌলিক গণতন্ত্র জনগণকে জাতীয় ইস্যুর পরিবর্তে স্থানীয় ইস্যুতে আবদ্ধ করে রাখে।
আইয়ুব খানের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম যাতে গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য এ ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার মাধ্যমে জনগণের সাথে প্রতারণা করেন।
এটি ছিল অনিশ্চিত একটি পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মৌলিক গণতন্ত্র আদেশবলে স্থানীয় আইনের আওতায় স্থানীয় সংস্থাগুলোকে অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
এ ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে তাদেরকে আরও বেশি মাত্রায় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত করা হয় তাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। ফলে এ ব্যবস্থায় জনগণের পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ বেড়ে যায়।
১০. আইয়ুব খানের ধর্মে রাজনীতির ব্যবহার সম্পর্কে কি জান?
অথবা, আইয়ুব খানের আইয়ুব খানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিবরণ দাও ।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে আইয়ুব খান সামরিক স্বৈরাচার আমলে যত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তার মধ্যে ধর্মকে রাজনীতির সাথে ব্যবহার করা অন্যতম।
১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা গ্রহণের পর ধর্মের সাথে রাজনীতির ব্যবহার শুরু করেন। আইয়ুব খান এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি ও অভিন্ন ঐতিহ্য গড়ে তোলার জন্য ইসলামি মনোভাবকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন।
আইয়ুব খানের ধর্মে রাজনীতির ব্যবহার নিম্নে আইয়ুব খানের ধর্মে রাজনীতির ব্যবহার সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. ধর্মীয়ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবহার : আইয়ুব খান সামরিক স্বৈরাচারে ধর্মকে ব্যবহার করেন। ধর্মকে রাজনীতির সাথে ব্যবহার বলতে কোনো এক সুদূরপ্রসারী কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করাকে বুঝানো হয়।
আইয়ুব খান তার দর্শনকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষা কমিশন ও বাংলা একাডেমিকে রোমান হরফে প্রবর্তন, বাংলা ভাষার সংস্কার এবং বিভিন্ন প্রদেশে উর্দুকে বাধ্যতামূলক শিক্ষা ইত্যাদি তুঘলকি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এসময় তিনি কবি-সাহিত্যিকদের, মৌলিক সাহিত্যকর্মেরও সংস্কার করেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলের বিখ্যাত কবিতা চল, চল, চল নব নবীনদের গাহিয়া গান ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ চরণটি সংশোধন করে তা লিখেন ‘সজীব করিব গোরস্তান’।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
তখন জনপ্রিয় ছড়া ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’, এটিকে মুসলিম রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। চরণ দুটি নতুনভাবে লেখা হয়, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি’।
ছাত্রছাত্রীদের পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও তথাকথিত মুসলমানি ভাবধারা আনার প্রয়াস চালানো হয়। যা আইয়ুবের ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের দৃষ্টান্ত।
২. ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রচার : কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। বিভিন্ন লেখক, শিল্পীগোষ্ঠী এসময় তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে জিহাদি চেতনা জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পায়।
এসময় সাম্প্রদায়িকতা জাগিয়ে তুলতে রেডিও পাকিস্তানও বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে। রেডিও পাকিস্তানে এসময় ইসলামকে শক্তি ও কুরআন সুন্নাহকে রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিজীবনের দিশারি হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচার চালানো হয়।
৩. সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যবহার : আইয়ুব শাসনামলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ববাংলার সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরে এ বিতর্ক রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে।
সরকারি দলের নেতা খান এ সবুর ১৯৬৭ সালে ২০ জুন প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
তার ভাষায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে বিভাগপূর্ব সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করার অশুভ তৎপরতা চলছে এবং ইসলামি আদর্শকে তথা পাকিস্তানের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হচ্ছে এবং পাকিস্তান আদর্শ বিরোধী কবির কিছু গ্রন্থ নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়।
তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলনের ফলে সামরিক সরকার পূর্ববর্তী ঘোষণা প্রত্যাহার করে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম অধ্যায় – সংক্ষিপ্ত)
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার মোটেও কাম্য নয়, যা করতে চেয়েছিল পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। আইয়ুব খান যে এক ধর্ম, এক সংস্কৃতি ও এক ভাষা কায়েম করতে চেয়েছিল তা বাস্তবে সফল হয়নি।
পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি এবং ইসলামি আদর্শকে সর্বদা অভিন্ন জ্ঞান করতেন।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।