উনিশ’শ পঁচাত্তর সালে সংবিধান পরিবর্তন করে বাকশাল গঠন থেকে শুরু করে ২০১৮ সালে বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন – সব ঘটনারই রয়েছে নানা ধরণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে যেসব ঘটনা গভীর দাগ কেটেছে সেখানে থেকে ১৪টি বিষয় তুলে ধরা হল:
১.বাকশাল গঠন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মাত্র চার বছরের মাথায় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এই সরকার পদ্ধতি চালু করা হয়। ফলে এটি পরিচিত হয়ে উঠে বাকশাল হিসেবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস-History of Bangladesh
এই পদ্ধতিতে দেশের অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই এই সরকার পদ্ধতি ছিল গণতন্ত্রের প্রতি বিরাট আঘাত। এজন্য দেশে -বিদেশে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
২.শেখ মুজিব হত্যা
উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ১৫ই অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যেকে হত্যা করা হয়। একদল সেনা কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বহু বছর বিদেশে নির্বাসনে থাকতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে।
মুজিব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ডানপন্থী রাজনীতি খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে। প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনীতির আরেকটি ধারা। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা সমালোচনা রয়েছে।
৩. নভেম্বর ১৯৭৫: অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান ও জেল হত্যা
শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয় তার ফলশ্রুতিতে ৩রা নভেম্বর সেনাবাহিনীর আরেকটি অংশ পাল্টা অভ্যুত্থান করে। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সে পাল্টা অভ্যুত্থান হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হলেও সব কিছুর কলকাঠি নাড়ছিল হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তারা। তখন সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড কার্যত ভেঙ্গে পড়েছিল। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আসে ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থান।
এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং বন্দী করা হয় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে।
মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যখন এই অভ্যুত্থান সংগঠিত হচ্ছিল তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের চার সিনিয়র নেতাকে কারাগারের ভেতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়। তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় ফিরতে না পারে সেজন্য চারজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু খালেদা মোশাররফের এই অভ্যুত্থান স্থায়ী হয়েছিল মাত্র চারদিন। সাতই নভেম্বর পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানে নিহত হন খালেদা মোশাররফ এবং আরো কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা। সে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন সৈনিকরা। এরপর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান।
৪. জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ ও হত্যাকাণ্ড
তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অফিসাররা। উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ৫ই নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এরপর ৬ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
কিন্তু ৭ই নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম একধারে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন। এসময় জিয়াউর রহমান ছিলেন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন।
কিন্তু এক বছর পরে ১৯৭৬ সালের ১৯শে নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এর পাঁচ মাস পরেই ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি গঠন করেন।
উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ৭ই নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের জন্য এক বড় আশীর্বাদ হয়ে আসে। এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির খোল-নলচে বদলে দেয়।
জিয়াউর রহমানের গঠিত রাজনৈতিক দল নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের প্রতি। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে মধ্য-ডানপন্থী রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে।
এক সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ এবং ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ যোগ করা হয়। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি স্পষ্টত বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষকে তুষ্ট করেতে চেয়েছেন।
এছাড়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে তিনি নতুন আরেকটি রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টি করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় সেনা ও বিমানবাহিনীতে দফায়-দফায় অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। তবে প্রতিটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা কঠোর হাতে দমন করেন জিয়াউর রহমান।
উনিশ’শ একাশি সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক অভ্যুত্থানে নিহত হন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
৫. এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ ও পতন
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সংবাদপত্রে নানা বিবৃতির মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনীতিতে আসার বাসনা প্রকাশ পেতে থাকে। তবে তিনি খুব তাড়াহুড়ো করেননি। উনিশ’শ বিরাশি সালের ২৪শে মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ।
রাজনীতির ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদ অনেকটাই জেনারেল জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। জিয়াউর রহমানের মতো জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল মধ্য-ডানপন্থী। তিনি সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যুক্ত করেন।
জেনারেল জিয়া যেভাবে বিএনপি গঠন করেছিলেন, ঠিক তেমনি জেনারেল এরশাদও জাতীয় পার্টি গঠন করেন। জেনারেল এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী সামরিক শাসক।
জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে সড়ে দাঁড়ান।
৬.উনিশ’শ একানব্বই সালের নির্বাচন
এই নির্বাচনকে মনে করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন’, যদিও এই নির্বাচনে পরাজিত দল আওয়ামী লীগ ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ তুলেছিল।
এটি ছিল বাংলাদেশের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। এর আগে বাংলাদেশে আরো চারটি সংসদীয় নির্বাচন হলেও সেসব নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ছিল। এই নির্বাচনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
এর আগের নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি সাহাবু্দ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সরকারের সাথে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের কেউ নির্বাচনে অংশ নেননি।
৭. খালেদা জিয়ার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। দলের প্রধান খালেদা জিয়া উনিশ’শ একানব্বই সালের ২০শে মার্চ বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হলেন মিসেস জিয়া।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, তখনকার সময়ে বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল সমাজে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছিল।
৮. সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া
উনিশ’শ একানব্বই সালের ৬ই অগাস্ট বাংলাদেশের সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুন:প্রবর্তন ঘটে।
বাংলাদেশের সংবিধানে যতগুলো সংশোধনী হয়েছে তার মধ্যে দ্বাদশ সংশোধনী হচ্ছে একমাত্র যেখানে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী হন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীপরিষদকে জাতীয় সংসদের নিকট দায়বদ্ধ করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু করা হয়।
৯. ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার
বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার মাঝামাঝি সময়ে মাগুরা জেলায় একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। একই সাথে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটি সহিংসতায় রূপ নেয়। এক পর্যায়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা।
আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না।
রাস্তায় যখন সহিংস আন্দোলন চলছে তখন ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যায় বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নে নির্বাচন বর্জন করলে অনেকটা ভোটার-বিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটার-বিহীন সে নির্বাচনে জয়লাভের পর আবারো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া। সে সংসদের প্রথম অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করে সংবিধানে সেটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১০. একুশ বছর পর ক্ষমতায়আওয়ামী লীগ
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যুক্ত হবার পরে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ২১ বছরে আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে।
উনিশ’শ পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরে নানা চড়াই-উতরাই পার করেছে দলটি। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করেছিল।
শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ভেবেছিল, দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান নেই। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে ১৯৯৬ সালে আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ।
১১. এক এগারো ২০০৭
দু’হাজার এক সালে বিএনপি সরকার আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো নতুন সংকট তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, নিজেদের পছন্দমতো সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
তীব্র রাজনৈতিক সংকটের মুখে কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও সংকট কাটেনি। তখন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। এতে সংকট আরো ঘনীভূত হয়।
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিসহ তাদের রাজনৈতিক জোট নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। কিন্তু তারপরেও ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি এক তরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এনিয়ে আন্দোলন ও সংঘাত আরো তীব্র হয়।
সংঘাতময় এক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনী ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। রাজনীতিতে সেনা বাহিনীর এই হস্তক্ষেপ করার ঘটনা ‘১-১১’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
সেনাবাহিনীর সমর্থনে এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্ব নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তখন ধারণা করা হত সেনা প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ছিলেন মূল ক্ষমতাধারী।
১২. দু’হাজার আট সালের নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার
ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে সরকার প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭১ সালে সংগঠিত মানবতা-বিরোধী অপরাধের বিচার করার উদ্যোগ নেয়। সে জন্য ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।
এই বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাস্তায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং সরকার বেশ কঠোরভাবে সেটি মোকাবেলা করেছে। জামায়াতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা এই বিচারের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেবার দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জমানসহ শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। এরপর তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
১৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল
দু’হাজারএগারো সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর আগে বাংলাদেশের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সর্ম্পকিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। তবে একই সাথে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অভিমত দিয়েছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপের পর বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এর পর নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের আর কোন সুযোগ রইল না এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেবার পর বাংলাদেশে আরো দুটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে দেশে-বিদেশে।
১৪. দু’হাজার চৌদ্দ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিএনপি এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তায় আন্দোলন করলেও তাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এ সময় বিএনপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক জোট নির্বাচন বর্জন করে।
নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের মধ্যস্থতায় সমঝোতার চেষ্টাও বিফলে গেছে। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একটি একতরফা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটারবিহীন সে নির্বাচন দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তবে সমালোচিত হলেও সে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থার আরো সুসংসহত করে নিয়েছে। সূত্র
জাগোরিকে লিখুন
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।