স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১ প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয়: সামরিক শাসন : আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের শাসনামল (১৯৫৮-১৯৭১)
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৫.০১. সামরিক শাসনের সংজ্ঞা দাও । সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, সামরিক শাসন কাকে বলে? সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : বিশ্বের প্রতিটি দেশে সামরিক বাহিনী দেশের অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে একটি শক্তিশালী, সুসংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। সামরিক বাহিনীর দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, পেশাদারিত্ব অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে উৎকৃষ্ট এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করায় সামরিক বাহিনী নিজেদেরকে অন্যান্য গোষ্ঠী ও শ্রেণি থেকে আলাদা ভাবতে শেখায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতির গতিপ্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ।
সামরিক শাসন : সাধারণত বেসামরিক কার্যাবলি যখন সামরিক লোক দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তাকে সামরিক শাসন বলে । অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যখন বেসামরিক ব্যক্তির পরিবর্তে সামরিক ব্যক্তি আসে তখন ঐ অবস্থাকে সামরিক শাসন বলে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
সামরিক শাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফাইনার (Prof. Finer) বলেন, “সামরিক বাহিনী যখন তার নিজস্ব নীতি বাস্তবায়নের জন্য বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে তাকেই সামরিক শাসন বলে।”
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম (Prof. Nazrul Islam) বলেন, “সামরিক শাসন কতকগুলো Techniques এর সমন্বয়, যার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর চড়ষরপু প্রকাশ পায়। এ সামরিক শাসন অবৈধতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে গতানুগতিক সাংবিধানিক কাঠামো শাসনকার্যে কোনো সহায়তা প্রদান করে না।”
অধ্যাপক এলান আর. বল (Prof. Allan R. Ball) বলেন, “সামরিক শাসন বলতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বা সোজাসুজি ক্ষমতা করায়ত্ত করাকে বুঝায়।” ” সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য : সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে
আলোচনা করা হলো :
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
১. রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্য : রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দেয়। দেশের চলমান রাজনৈতিক কার্যাবলি তার গতিশীলতা হারায়। উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের ওপর দমন পীড়ন চালিয়ে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়।
এরূপ দমন-পীড়নের ফলে রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্যতার সৃষ্টি হয় ।
২. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসসাধন : কোনো দেশে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো প্রকার চর্চা থাকে না। দেশে স্বৈরতন্ত্রের পথ সুগম হওয়ায় জোর যার রাজ্য তার –এ নীতির প্রতিফলন ঘটে। এতে দেশের সমস্যাসমূহ আরও জটিল আকার ধারণ করে ।
৩. সংবিধান স্থগিত : কোনো দেশে সামরিক শাসন জারি হলে সেদেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়। তাছাড়া আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়। আর জনগণের মতামত প্রকাশের অধিকার তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
৪. মৌলিক অধিকার হরণ : সামরিক শাসন প্রথমেই জনগণের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে থাকে। নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা ইত্যাদি অধিকার খর্ব করা হয়।
৫. শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধ্বংসসাধন : সাধারণত দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে থাকে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরাই এজন্য সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রথমেই শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে শিক্ষা সংকোচন নীতি চালু করেন, যা শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধ্বংসসাধনে অশনিসংকেতস্বরূপ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
৬. আমলাতন্ত্রের সামরিকীকরণ : সামরিক আমলাদের কাজ সামরিক কাজ দেখা এবং বেসামরিক আমলারা প্রশাসনিক কার্যাবলি সম্পাদন করে। কিন্তু যখন সামরিক আমলারা বেসামরিক প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করে তখন স্বাভাবিকভাবে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এজন্য সামরিক সরকার আমলাদের সামরিকীকরণে তৎপর হয়।
৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ : সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বিচার বিভাগ বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা চর্চা করে। কিন্তু সামরিক শাসনামলে সামরিক আদালতে বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা হয়। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হয়।
৮. সংহতির সংকট : অনেকেই জাতীয় সংহতির সংকট নিরসনের জন্য সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে কিন্তু বাস্তবে তারা দীর্ঘস্থায়ী সংকট নিরসনে ব্যর্থ হয়। বরং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের মধ্যে অসংহতির সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হয় অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামরিক শাসক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু পদদলিতই করে না, বরং রাজনৈতিক এলিটদের অকর্মণ্য ও নির্জীব করে রাখে। জনগণের বাকস্বাধীনতা হরণ করে গণতন্ত্রকে টুটি চেপে ধরা হয়। মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সামরিক শাসকরা বেসামরিক প্রশাসনের মেধা ও বুদ্ধিমত্তাকে উপেক্ষা করে। আর তাই সামরিক শাসনের প্রবণতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং জনগণও এ শাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
৫.০২. পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণ আলোচনা কর।
অথবা, পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণগুলো লেখ ।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হয়। পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের পর প্রবর্তিত শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কার্যকর হতে না পারায় রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা সংসদীয় ব্যবস্থাকে প্রায় অকার্যকর করে দেয়।
এ প্রেক্ষিতে ১৯৫৮ সালে সমগ্র পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সামরিক শাসন জারি করা হয় ।
পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণ : যেসব কারণের প্রেক্ষিতে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা কর হলো :
১. গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতা : ১৯৫১-‘৫৮ পর্যন্ত কেন্দ্রে ৭টি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। প্রাদেশিক সরকারও আরও অস্থায়ী ছিল । পূর্ববাংলার আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১ দিন। বিশেষ করে ১৯৫৭ সালের দিকে গণতান্ত্রিক সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়।
এর ফলে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে সামরিক শাসন জারি করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
২. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলার অভাব, দলবদলের পালা, উপদলীয় কোন্দল প্রভৃতি কারণে জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, যা আইয়ুব খানকে সামরিক শাসন জারি করতে উদ্বুদ্ধ করে।
৩. সংগঠিত সেনাবাহিনী : পাকিস্তান সেনাবাহিনী খুবই সুসংগঠিত । তাছাড়া ১৯৫৪ সালে পাক-মার্কিন চুক্তির ফলে পাকিস্তানের * সেনাবাহিনী একদিকে যেমন প্রচুর অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভার সংগ্রহে সফল হয়, অন্যদিকে তেমনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনেক বেশি সুসংহত হয়ে ওঠে।
এদিকে এ বাহিনী অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও ঐক্যবোধ অর্জনে সক্ষম হয়। সুতরাং সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ।
৪. মুসলিম লীগের দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থান : ঐক্যবন্ধনের প্রতীক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে মুসলিম লীগের অবস্থা হয়ে ওঠে অত্যন্ত শোচনীয় । ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ববাংলায় যুক্তফ্রন্টের নিকট মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে।
পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগের নেতারা রিপাবলিকান দলে যোগদান করায় দুর্বল হয়ে পড়ে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক অবস্থান।
৫. বাঙালি ও পাঞ্জাবি অন্তর্দ্বন্দ্ব : তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালি বনাম পাঞ্জাবি দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। এ দ্বন্দ্বের ফলে গণতান্ত্রিক শাসন কার্যকরী হতে ব্যর্থ হয়। এ দ্বন্দ্বের অবসান না হওয়ায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
৬. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : ১৯৫৬ সালের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রাতারাতি ক্ষমতার রদবদল হয় । ক্ষমতার এরূপ রদবদল দেশটিকে শোচনীয়ভাবে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনায় নিক্ষেপ করে। ফলে সামরিক শাসন জারি অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
৭. নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সম্ভাবনা : পাকিস্তানে ১৯৫৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় লাভের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কাজেই আইয়ুব খান নির্বাচনকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।
৮. প্রশাসনিক দুর্নীতি : তৎকালীন পাকিস্তানের সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি সকল যুগের দুর্নীতিকে ছাড়িয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়।
৯. আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য : ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে পাকিস্তানে একদশকে আমলাদের দৌরাত্ম্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মির্জা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, জেনারেল আইয়ুব খান সকলে হয় আমলা না হয় সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
কাজেই তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে রাজনীতিকে বিসর্জন দিয়ে সামরিক শাসনকে উৎসাহিত করে।
১০. সেনাবাহিনীর ক্ষমতার লিপ্সা : পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে এসেছিলেন। দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব নিজের হাতে কুক্ষিগত করার লোভেই সামরিক শাসন জারি করা হয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
১১. সংবিধান অকার্যকর হওয়া : ১৯৫৬ সালের সংবিধান কার্যকর হতে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতা গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতাকে ফুটিয়ে তুলেছিল তাই ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন।
১২. বার্মা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রভাব : ১৯৫৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বার্মার সেনাপ্রধান জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখল প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও জেনারেল আইয়ুব খানকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করায় তারা সামরিক শাসন জারি করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বিশেষত ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের পর রাজনীতি ও প্রশাসনে দ্রুত পালাবদল হতে থাকে, নানা অনৈক্য সৃষ্টি হয় ।
ফলশ্রুতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ আবশ্যক হয়ে পড়ে।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
৫.০৩. পাকিস্তানের রাজনীতিতে বার বার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ আলোচনা কর ।
অথবা, কী কী কারণে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকাঃ বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধো উত্তরকালে বিশ্বরাজনীতিতে বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনী ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান একটি সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হয়।
১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান রচিত হলেও এর কার্যকারিতার ভিত্তি দুর্বল থাকায় ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু সেই সময় থেকে সামরিক বাহিনী কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। আর এ কারণে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বার বার রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে বার বার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ : বার বার পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ নিম্নে তুলে ধরা হলো।
১. সংবিধানের অনুপস্থিতি : যেকোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। কিন্তু পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর দীর্ঘ নয় বছর রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হয়। আর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর এই সুযোগে ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
২. আইনশৃঙ্খলার অবনতি : নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে পাকিস্তা -১নে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে সেদেশে আইনশৃঙ্খলা অবনতির ফলে দেশে যে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয় তা মোকাবিলার দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বার বার অবৈধভাবে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে।
৩. অর্থনৈতিক সংকট : পাকিস্তান রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়। আর বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য আরো নানা ধরনের সমস্যা বিরাজ করছিল । আর অর্থনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে ।
৪. সামরিক বাহিনীর ক্ষমতালিপ্সা : উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মধ্যে একদিকে পেশাগত আনুগত্য ও শৃঙ্খলাবোধ দুর্বল, অন্যদিকে ক্ষমতার প্রতি প্রচণ্ড মোহ আর সে কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে।
৫. অকার্যকর গণতন্ত্র : ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানে গণতন্ত্র পদ্ধতি গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সেখানে সবসময় অকার্যকর। আর এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বার বার সে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে।
৬. দুর্বল রাজনৈতিক দল : ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান কোনো দলীয় রাজনীতির বিকাশ ঘটেনি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংগঠনিক ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
ভারতের কংগ্রেস যেমন দলীয় কর্মীদের মধ্যে একটি বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছে পাকিস্তানে মুসলিম লীগ বা পিপলস পার্টি তেমনটি পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো এমন দুর্বল অবস্থার সুযোগে পাকিস্তানে বার বার সামরিক হস্তক্ষেপ হয় ।
৭. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি : পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তখন জনগণ তাদের ওপর থেকে আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসন ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ফলে জনগণ তাদের ওপর কোনো সময় আস্থা স্থাপন করতে পারেনি। ফলে তারা সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়েছে।
৮. রাজনীতিবিদদের মধ্যে ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব : পাকিস্তানে ঘন ঘন সরকার পতন ও রাজনীতিবিদদের চরম ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
তৃতীয় বিশ্বের একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যদিও এ অবস্থা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, তথাপি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এ সুযোগগুলো হাতছড়া না করে বার বার রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে।
৯. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব : যেকোনো দেশের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শাসন কাঠামো শক্তিশালী ও গণতন্ত্রের যাত্রাকে কার্যকর করতে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল ভূমিকা পালন করে।
পাকিস্তানের রাজনীতি এখন পর্যন্ত সেভাবে গড়ে ওঠেনি, যা সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
১০. জাতীয় ঐক্যের সংকট : পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য অনুপস্থিত। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে পাকিস্তানও সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর একই সঙ্গে এদেশটিকে জাতি গঠন ও রাষ্ট্রের গঠন সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
বিভিন্ন সময় পাকিস্তানে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতিসত্তা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সংঘর্ষ জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় আর এ সুযোগে সেনাবাহিনী বার বার ক্ষমতা দখল করে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
১১. বৈধতার সংকট : রাজনৈতিক সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানে এ ধরনের নির্বাচনের অভাব রয়ে গেছে।
নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের কারচুপির বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ এনে পরিচালিত আন্দোলনে একপর্যায়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয় ।
১২. ক্ষমতা দখলের ঐতিহ্য : ইস্কান্দার মির্জা কর্তৃক ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি ও পরবর্তীতে জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল সে দেশের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতি আগ্রহ ও অভিজ্ঞ করে তোলে ।
এ কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বার বার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে ।
১৩. গণতন্ত্রের ধ্বংসসাধন : সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটে। আর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সন্ত্রাসকে বাড়িয়ে দেয়।
কারণ অসাংবিধানিক উপায়ে শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সমগ্র জাতি একই ধারায় পরিচালিত হতে পারে না। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সেদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বার বার হস্তক্ষেপ করে।
১৪. রাজনৈতিক সংকটের দীর্ঘসূত্রতা : উন্নয়নশীল দেশে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে বিরোধ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ বিরোধ সবসময় লেগেই থাকে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
আর এ ধরনের রাজনৈতিক বিরোধের কারণে রাজনৈতিক অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর এ সুযোগে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে ।
১৫. আইনের শাসনের অভাব : শান্তির জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য। কিন্তু তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানে আইনের শাসন একেবারে অনুপস্থিত ছিল। যার ফলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আসছে। পাকিস্তানের রাজনীতির একটি অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে যেকোনো সরকারকেই সামরিক বাহিনীর সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়।
সর্বশেষ ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর জেনারেল পারভেজ মোশারফের নেতৃত্বে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। আবারো যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হতে পারে।
৫.০৪ আইয়ুব খানের শাসনামলের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর ।
অথবা, আইয়ুব খানের শাসনামলের বৈশিষ্ট্যগুলো বিস্তারিত বর্ণনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন অপরাপর স্বৈরশাসকদের মতোই ছিল। ইস্কান্দার মির্জার কাছ থেকে আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর ক্ষমতা দখল করে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
শাসনতন্ত্র বাতিল, মৌলিক অধিকার স্থগিত, রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তির মাধ্যমে শুরু হয় দীর্ঘ এক দশকব্যাপী আইয়ুব খানের বঞ্চনা ও উন্নয়ন মিথ্যার সামরিক শাসন।
আইয়ুব খানের শাসনামলের বৈশিষ্ট্য : প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. সামরিক একনায়কত্ব : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হলো আইয়ুব শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । তিনি সামরিক একনায়কতন্ত্র শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন। তার এক দশক শাসনকালের মধ্যে চার বছর ছিল নিরঙ্কুশ একনায়কতান্ত্রিক সামরিক শাসনকাল ।
২. রাজনীতিকদের ওপর কলঙ্ক লেপন : ক্ষমতায় এসেই আইয়ুব খান বলেন যে, রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দেওয়ার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর।
এজন্য রাজনীতিবিদদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের জন্য শুরুতেই তিনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করেন।
৩. মৌলিক গণতন্ত্র : ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব খান সীমিত মাত্রার গণতন্ত্রের ধারণা বাস্তবে রূপ দিতে ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর অভিনব মৌলিক গণতন্ত্র বা বুনিয়াদি গণতন্ত্র চালু করেন। এতে তিনি ৫ স্তরবিশিষ্ট পিরামিড আকৃতির একটি কাঠামো সৃষ্টি করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
কাঠামোগুলো হলো- ১. ইউনিয়ন কাউন্সিল, ২. থানা কাউন্সিল, ৩. জেলা কাউন্সিল, ৪. বিভাগীয় কাউন্সিল ও ৫. প্রাদেশিক কাউন্সিল ।
৪. সংবিধান প্রণয়ন : ১৯৬২ সালের ১ মার্চ আইয়ুব খান একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ঐ বছরের ৮ জুন কার্যকর হয়। অতঃপর ১৯৬২ সালের প্রণীত সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করেন, যা আইয়ুব খানের শাসনামলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
৫. সরকারবিরোধী আন্দোলন : আইয়ুব সরকার একপর্যায়ে বেসামরিকীকরণের প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে চাইলেও জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেন।
শেখ মুজিব ছয়দফা দাবি জানালে আইয়ুব সরকার সাধারণ মানুষের ওপর দমনপীড়ন শুরু করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়।
৬. ট্রেনিং কমিটি গঠন : আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের আরও দক্ষ এবং সুযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে চারটি ট্রেনিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে আইয়ুব খান সামরিক আমলাদের নানাবিধ সুযোগ সুবিধার পথ সৃষ্টি করেন।
৭. বিরোধীদের দমনপীড়ন : আইয়ুব খানের শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার সামরিক সরকারবিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন অত্যাচার ও নির্যাতন নেমে আসে।
শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার ডাক দিলে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও গ্রেফতার করা হয় । কিন্তু জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
৮. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ হলো -১ আইয়ুব খানের শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । তিনি ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করেন । কোনো আইন বা বিধিবিধানকে অসাংবিধানিক ঘোষণার ক্ষমতা বিচার বিভাগের ছিল না ।
৯. রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ : বিলুপ্তি ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করাই ছিল তার শাসনামলের একটি বৈশিষ্ট্য । ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে সকল রাজনৈতিক দলকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
১০. উৎপীড়নমূলক শাসন : নিজের শাসন পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং ফিরোজ খান নূনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনেন। এছাড়াও অনেক সাবেক কেন্দ্ৰীয় মন্ত্রী এবং প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
মূলত আইয়ুব খান পাকিস্তানে নিজ ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণের মধ্যে সামরিক শাসনব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
১১. সংবিধান বাতিল ও মৌলিক অধিকার স্থগিত : নিজ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সামরিক শাসক আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের সংবিধান রহিত করেন। তিনি জনগণের মৌলিক অধিকারও হরণ করেন।
১২. আইনবিরোধী শাসনব্যবস্থা : প্রচলিত আইনবিরোধী শাসনব্যবস্থা ছিল আইয়ুব খানের শাসনব্যবস্থা। উক্ত শাসনব্যবস্থায় নতুন নতুন আইনের প্রচলন করা হয়। শুধুমাত্র দেশের আপামর জনসাধারণকে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নিত্যনতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -১
১৩. বাংলা ভাষাকে রোমান অক্ষরে পরিবর্তন : আইয়ুব খানের শাসনামলে বাংলা ভাষাকে তথাকথিত মুসলমানিত্ব প্রদানের উদ্দেশ্যে রোমান অক্ষর বা আরবি অক্ষরে পরিবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আন্দোলনের মুখে বাস্তবায়িত হয়নি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আইয়ুব খানের শাসনামল বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। উক্ত সময়ে বাঙালি জাতি পদে পদে নির্যাতিত এবং অত্যাচারিত হয়।
মূলত তার শাসনব্যবস্থা তথা সামরিক শাসনব্যবস্থা একটি মানবতা বহির্ভূত শাসনব্যবস্থা। উক্ত শাসনব্যবস্থায় অনেক রাজনীতিবিদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ এনে তাদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হয়। এমনকি রাজনৈতিক দলসমূহকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আর এগুলো আপামর জনসাধারণের জন্য চরম অপমানজনক। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কারণেই পাকিস্তানের উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয় ।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।