স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২ প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয়: সামরিক শাসন : আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের শাসনামল (১৯৫৮-১৯৭১)
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৫.০৫. ১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : সংবিধান হলো যেকোনো দেশের সর্বোচ্চ দলিল বা আইন। এখানে দেশের আপামর জনসাধারণ আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তব চিত্র পরিলক্ষিত হয়।
একটি কার্যকর গণপরিষদ ও অভিজ্ঞ লোকদের মাধ্যমে যদি একটি দেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয় তাহলে সেদেশে শান্তিশৃঙ্খলা সহজেই প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯৬২ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধান দেশটির তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বাস্তব রূপায়ণ । এ সংবিধান ছিল আইয়ুব খানের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ার ।
১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্য : নিম্নে ১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো
১. ইসলামি প্রজাতন্ত্র : ১৯৬২ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থি কোনো আইন পাস করা যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়। এ সংবিধান অনুযায়ী কেবল একজন মুসলিমই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন।
২. লিখিত সংবিধান : ১৯৬২ সালের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান। এটি ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ন্যায় পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম দলিল । এ সংবিধান ১২টি ভাগে বিভক্ত এবং ২৫০টি ধারায় লিপিবদ্ধ। এর সাথে ৪টি তফশিলও সংযুক্ত ছিল । এ সংবিধান ছিল দুষ্পরিবর্তনীয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
৩. ইসলামি ব্যবস্থা : ইসলামি বিধি ব্যবস্থার ওপর এ সংবিধানে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ইসলামি জীবনধারা যাতে মুসলিম জনগণ অনুসরণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে নির্দেশনা পাওয়ার জন্য ইসলামি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করা হয় এবং প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসলামি গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা : ১৯৬২ সালের এ সংবিধান পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এ দুই প্রদেশের সমন্বয়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়।
জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আর প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয় অবশিষ্ট বিষয়গুলো ।
৫. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার : ১৯৬২ সালের এ সংবিধানে পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক ছিলেন রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের নিকট মন্ত্রিপরিষদ দায়ী ছিল ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
৬. এককক্ষবিশিষ্ট আইন পরিষদ : ১৯৬২ সালের আইয়ুব খানের সংবিধানে কেন্দ্র ও প্রদেশের জন্য এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রবর্তন করা হয়।
৭. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : ১৯৬২ সালের সংবিধান ছিল দুষ্পরিবর্তনীয়। সংবিধান পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের জন্য এক বিশেষ পদ্ধতি নির্দিষ্ট ছিল । জাতীয় পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট একমত হলেই কেবল সংবিধান সংশোধন করা যেত ।
৮. আইন পরিষদের কেন্দ্র ঢাকা : এ সংবিধানে উল্লেখ ছিল যে, ঢাকায় হবে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কেন্দ্র এবং সরকারপ্রধান কেন্দ্র হবে ইসলামাবাদে ।
৯. আইন প্রণয়নের মূলনীতি : ১৯৬২ সালের এ সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিবর্তে ১৬টি আইন প্রণয়নের মূলনীতি সংযোজন করা হয়। তবে ১৯৬৪ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের তালিকা সংযোজন করা হয়েছিল ।
১০. একটিমাত্র বিষয় তালিকা : ১৯৬২ সালের এ সংবিধানে একটিমাত্র বিষয় তালিকা ছিল। সংবিধানের তৃতীয় তালিকায় জাতীয় পরিষদের আওতাভুক্ত বিষয়ের বিবরণ দেওয়া হয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের ওপর ন্যস্ত করা হয় তালিকা বহির্ভূত অবশিষ্ট বিষয়সমূহ ।
১১. মৌলিক গণতন্ত্র : ১৯৬২ সালের এ সংবিধানে ‘মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থাকে’ শাসনব্যবস্থায় গ্রহণ করা হয়। মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচকমণ্ডলী গঠন করে জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও প্রেসিডেন্টের পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
এ ব্যবস্থায় সর্বনিম্ন স্তরে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করা হয়। ১২. নীতিনির্ধারক মূলনীতি : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ন্যায় ১৯৬২ সালের সংবিধানে ২১টি নীতিনির্ধারক মূলনীতি ছিল। মূলনীতিগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি সম্পাদনের আদর্শস্বরূপ।
১৩. পরোক্ষ নির্বাচন : ১৯৬২ সালের সংবিধানে পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত হতেন।
১৪. গণভোট বিধান : গণভোটের বিধান ১৯৬২ সালের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পরিষদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে বিষয়টি গণভোটে দেওয়ার বিধান ছিল। প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পরিষদ গণভোটের ফলাফল মেনে নিতে বাধ্য ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের লিখিত সংবিধানটি পাকিস্তানের দলিল, যাতে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি পৃথিবীর এককক্ষবিশিষ্ট আইন পরিষদের একটি দৃষ্টান্ত বলা যায়।
এ সংবিধানে মৌলিক গণতন্ত্রের কথা বলে গণতন্ত্রকে বড় করে দেখা হলেও তা ছিল সামরিক শাসক আইয়ুব খানের এক অদ্ভূত ব্যবস্থা। এজন্য এ সংবিধানকে ‘আইয়ুবি সংবিধান’ বলা হয় ।
৫.০৬. ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন সম্বন্ধে যা জান লেখ।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা ১৯৬৩ সালেও ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ।
আর এ ছাত্র আন্দোলনে অনেক ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনও অংশগ্রহণ করে। ছাত্রলীগ, সিপিবিসহ অনেক ছাত্র সংগঠন অংশগ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনের ফলে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে ওঠে তা পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বিকশিত হয়।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় : ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
এদিকে ছাত্র সংগঠনগুলোর গতিবিধি লক্ষ রাখার জন্য সামরিক সরকার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে এবং ছাত্র রাজনীতিকে শয়তানের জনক বলে আখ্যা দেয়। ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন বিভক্ত ছিল তিনটি পর্যায়ে। নিম্নে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো :
প্রথম পর্যায় : সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন : ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রথম পর্যায় ছিল সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন। নিম্নে তা দেওয়া হলো :
১. আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শুরু : আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা আতাউর রহমানের বাসভবনে সরকারবিরোধী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী করাচি সফরে গেলে তাকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভি -২যোগে গ্রেপ্তার করা হয় । এ সংবাদ পরেরদিন পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ছাত্রসমাজ সরকারবিরোধী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এর মধ্য দিয়েই ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শুরু হয়।
২. সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড : ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের ছাত্ররা প্রতিবাদস্বরূপ ৩১ জানুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে বৈঠকে মিলিত হয় এবং পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়।
কিন্তু এ খবর সংবাদপত্রিকায় না ছাপানোর কারণে ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবে যায় এবং সরকারি পত্রিকায় আগুন দেয়। আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সফরে এলে ছাত্ররা তাকে নাজেহাল করে ।
৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকারবিরোধী লেখায় ভরে ওঠে ঢাকার দেওয়ালগুলো ।
৩. আন্দোলনের গতিসঞ্চার : সরকার ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এর প্রতিবাদে মিছিল বের করে এবং উত্তেজিত ছাত্ররা পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী স্বয়ং আইয়ুব খানকেই ঘেরাও করার কর্মসূচি দেওয়া হয়। এ কারণে ৭-৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন চলতে থাকে এবং প্রায় ২২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় ।
এর প্রতিবাদে পূর্ববাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আন্দোলন জোরদার হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ মার্চ মাসে খুললে আবার আন্দোলন শুরু হয়। এদিকে ১৫ মার্চ থেকে অব্যাহতভাবে ধর্মঘট চলতে থাকে। সামরিক সরকার এ সময় ডাকসুর সহসভাপতি রফিকুল হক ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হায়দার আকবর খান প্রমুখ নেতাসহ বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে ।
দ্বিতীয় পর্যায় : শাসনতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন : ১৯৬২ সালের ছাত্রদের গণআন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল শাসনতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন।
আইয়ুব খান রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণার্থে প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুপারিশ, প্রাপ্ত বয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত ভোটাধিকারের কথা এবং ভোটারদের যোগ্যতা হিসেবেও সম্পদের বিধান করেন। এর প্রতিবাদে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ আন্দোলনের ডাক দেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
ছাত্রদের নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনের কারণে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। নির্বাচন শেষে আন্দোলনরত ছাত্ররা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নিকট ১৫ দফা দাবি উত্থাপন করে।
এর মধ্যে প্রধান দাবিগুলো ছিল সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দান, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, সামরিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্তি, রাজনৈতিক কর্মী ও বন্দিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ প্রত্যাহার, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর আরোপিত চঙউঙ কালাকানুন প্রত্যাহার, বাকস্বাধীনতা প্রদানসহ ছাত্রদের স্বার্থ।
এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত দাবি। ছাত্রদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরকারবিরোধী গ্রুপ নিজেদের ৮ দফা নীতিমালা গ্রহণ করে। তাছাড়া বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকসহ অন্যরাও ছাত্রদের সমর্থন দেন । এদিকে মোনায়েম খান রাজবন্দিদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেন এবং ছাত্রদের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালান।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
তৃতীয় পর্যায় : শরীফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন : ১৯৬২ সালের আগস্ট মাস থেকে ছাত্ররা শরীফ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন শুরু করে, যা নিম্নরূপ :
১. শরীফ কমিশনের বিরোধিতা : শরীফ শিক্ষা কমিশন সংক্রান্ত রিপোর্টকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলন ১৯৬২ সালের আগস্ট মাস থেকে তুমুলভাবে শুরু হয়।।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক)
আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে ১৯৫৮ সালে ড. এস. এম. শরীফকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিশন গঠন করে এবং পাকিস্তানের পরবর্তী শিক্ষানীতি কী হবে এ সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদান করেন।
১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে কমিশনের রিপোর্ট সরকারকে প্রদান করলেও তা প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে কমিশনের রিপোর্টে পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার পরিপূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত।
ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক, উর্দুকে সর্বজনীন ভাষায় রূপান্তর, উর্দু ও বাংলা ভাষার সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠতর করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় ।
২. আন্দোলন প্রক্রিয়া : এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়) ও ঢাকা কলেজ থেকে আন্দোলনের সূচনা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের মেডিকেল কলেজসহ স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আন্দোলনের ডাক দেয় ।
১০ আগস্ট ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্ররা এক সমাবেশে মিলিত হয়ে ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ধর্মঘটের এবং ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয়। দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয় ১৫ আগস্ট এবং ঐদিন থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
১০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে ছাত্ররা ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেয় । এদিকে ১০ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি প্রদান করে। সরকার তার মুক্তি প্রদান সম্পর্কে কটাক্ষ করলে ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা রাস্তায় পিকেটিং শুরু করে।
পূর্ববাংলার ব্যবসায়ী সমিতি, কর্মচারী সমিতি, রিকশা ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠন এ দিন ছাত্রদের সঙ্গে যোগদান করে। আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করার জন্য সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করে।
১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ নির্যাতনে কয়েকজন ছাত্র নিহত ও আহত হয়। কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যশোর চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের নির্যাতনে বহু ছাত্র আহত ও গ্রেপ্তার হয়। এমতাবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গোলাম মোহাম্মদের সাথে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন।
তারই পরামর্শক্রমে সরকার শরীফ, শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের আদেশ স্থগিত ঘোষণা করে । এদিকে সরকার ১৯৬৩ সালের জন্য যে সকল ছাত্র স্নাতক পরীক্ষার্থী ছিল তাদের পরীক্ষা ব্যতীত ডিগ্রি প্রদান করার ঘোষণা দেয় । এর ফলে ছাত্র আন্দোলন ক্রমে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। আর ছাত্র আন্দোলনে ছাত্ররা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায় । এর জন্য সরকারবিরোধী তৎপরতা ছাত্ররা আরো বেশি চালাতে থাকে ।
১৯৬৩ সালে সলিমুল্লাহ হলে একদল ছাত্র মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি সংসদ ও কার্যালয় থেকে অপসারণ করে। আবার কায়েদে আজম কলেজ, সলিমুল্লাহ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ কিছুদিন বন্ধ থাকে। সরকারের দমনপীড়ন সত্ত্বেও ছাত্ররা তাদের আন্দোলন সফল করতে সক্ষম হয় ।
৫.০৭. ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব লেখ।
অথবা, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তানে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ আন্দোলনের তীব্রতা ১৯৬৩ সালের প্রথম থেকেই ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও এতে অংশ নেয়।
মোনায়েম খানকে গভর্নর নিয়োগ এবং তার আস্থাভাজন ওসমান গণি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দমননীতি বেড়ে যায়। ফলে ছাত্ররা প্রথম থেকেই মোনায়েম খানকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব : ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল ছিল গুরুত্বপূর্ণ নিম্নে তা আলোচনা করা হলো : ১. অভিজ্ঞতা অর্জন : ১৯৬২-৬৪ এর ছাত্র আন্দোলন ছাত্রসমাজ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য অভিজ্ঞতার দ্বার খুলে দেয়।
শিক্ষা বিষয়ক ব্যাপার নিয়ে এতো ব্যাপক ও বিশাল ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে তা ছিল ছাত্র নেতৃবৃন্দের জন্য একটি বিরাট শিক্ষা। যার ফলশ্রুতিতে আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
২. জাতীয়তাবোধের বিকাশ : পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সর্বপ্রথম দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দেয়। আর বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে এই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে জাতীয় চেতনার সঙ্গে প্রগতিশীল ধারার স্ফুরণ ঘটায়। সমগ্র দেশে এই আন্দোলন জাতীয়তাবোধের বীজ বপন করে ।
৩. আন্দোলনের সফলতা : আইয়ুব খানের মতো লৌহমানব ছাত্র আন্দোলনের নিকট নতিস্বীকার করে। সরকার শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি প্রদান ও ১৯৬২ সালের শেষ দিকে শরীফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত করতে বাধ্য হয়, যা এ আন্দোলনের এক বিরাট সফলতা ।
৪. সামরিক সরকারের নতিস্বীকার : এ ছাত্র আন্দোলনের কাছে সামরিক সরকার নতিস্বীকারে বাধ্য হয়। এর ফলে আইয়ুব খান ক্রমবর্ধমান ছাত্র আন্দোলনের বা ছাত্রদের রোষানল থেকে রক্ষা পেতে বিনা পরীক্ষায় ছাত্রদের ডিগ্রি প্রদান করেন।
৫. রাজনৈতিক নেতৃত্ব : ১৯৬২ সালের আন্দোলন শিক্ষা আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হলেও এ আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকও উপেক্ষণীয় নয়।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দমনপীড়ন ও বিভিন্ন নিবর্তনমূলক ও রাজনীতিবিদদের অকেজো করার জন্য বিভিন্ন অযোগ্যকরণ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানে এক চরম রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
কিন্তু ১৯৬২-৬৪ সালের এ আন্দোলন রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায় ।
৬. আগরতলা মামলা প্রত্যাহার : ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের এগারো দফা ঘোষণা এবং এগারো দফাভিত্তিক আন্দোলনে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে ভূমিকা রাখে ।
৭. বিজয় অর্জন ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন অধিকতর প্রভাব বিস্তার করে । পঞ্চাশের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন এবং ষাটের দশকের শেষ নাগাদ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের মধ্যে সমন্বয়ক হিসেবে ১৯৬২-৬৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য ।
৮. পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের ওপর আঘাত : ১৯৬২-৬৪ সালের আন্দোলনে ছাত্র শক্তি ও এন. এস. এফ -এর মতো কড়া পাকিস্তানপন্থি সংগঠন জড়িত থাকলেও আন্দোলনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৯৬৩ সালে জিন্নাহর ছবি পুড়িয়ে, কোথাও কোথাও নামিয়ে ফেলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের ওপর আঘাত হানে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
আইয়ুব হটাও স্লোগান দিয়ে ছাত্রসমাজের একাংশ রাজনীতিবিদদেরও সক্রিয় করে তোলে।
৯. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত : ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপকতা গ্রামীণ পর্যায়েও সম্প্রসারিত হয়। এর ফলে স্বায়ত্তশাসন দাবি জোরদার হয় এবং এ দাবির সপক্ষে জাতীয়তাবাদী চেতনারও বিকাশ ঘটে। ১৯৬৪ সালকে বলা হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বছর, ব্যাপক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার বছর।
১০. স্বাধিকার আন্দোলন : ১৯৫২, ১৯৬২ সালের আন্দোলন ও পরবর্তী স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে যুগান্তকারী ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এজন্য বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে ১৯৬২-‘৬৪ সাল একটি মাইলফলক। ১৯৬২-৬৪ সালের আন্দোলন থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার সরাসরি প্রয়োগ ঘটিয়ে ছাত্রসমাজ ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতন ঘটায় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৫ম – রচনামূলক) -২
তাই শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম । কেননা এ আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্ররা পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলন সফল করার শিক্ষা লাভ করে।
বাংলার রাজনীতিতে ছাত্ররা যুগান্তকারী অবদান রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ঘোষণার পর ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর ওপর যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছিল ছাত্র আন্দোলনের কারণে ১৯৬৯ সালে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।