স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১ প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয় : জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধিকার আন্দোলন
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৬.০১. পাকিস্তানি শাসনামলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রকৃতি আলোচনা কর ।
অথবা, পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলার প্রতি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিবরণ দাও ।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই বাঙালিরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে শুরু করে সকল দিক দিয়ে ছিল উপেক্ষিত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলার বিপুল ধনসম্পদ পাকিস্তানে পাচার করতো যার ফলে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল শিল্প সমৃদ্ধ আর পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ছিল শোচনীয়। যদিও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বাঙালিরা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল ।
তবুও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। এমনকি তারা পূর্ববাংলার সংস্কৃতি ধ্বংসের হীন চেষ্টায় লিপ্ত হয়।
পাকিস্তানি শাসনামলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রকৃতি : পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদেরকে শুধু অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা . পূর্ববাংলার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নানারকম আগ্রাসন শুরু করে।
নিম্নে পাকিস্তানি শাসনামলে বাংলায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রকৃতি আলোচনা করা হলো :
১. প্রকৃতি আলো ভাষার সংস্কার : পাকিস্তানিরা ভাষা সংস্কারের নামে বাঙালিদের ওপর আঘাত হানে। তারা বাংলা ভাষা সংস্কার ভিন্ন । করার জন্য ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ভাষা কমিটি গঠন করে।
মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন এ কমিটির সভাপতি এবং কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন এ কমিটির সেক্রেটারি। তারা এক রিপোর্টে বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ ও বর্ণমালার গুরুতর সংস্কারের পরামর্শ দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
তাদের সুপারিশসমূহের একটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে বাংলা ভাষা থেকে “ঈ, ঊ, ঋ, ৯, ঐ, ঔ, ঙ, ঞ, . ঘ, য, ঢ়, ক্ষ, ৎ, ” প্রভৃতি বাদ যাবে এবং নতুন স্বরবর্ণ অ্যা তা যুক্ত হবে। অর্থাৎ ভাষা সংস্কার ছিল তাদের প্রথম আগ্রাসন।
২. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিবর্তন : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শরিফ কমিশন নামে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে।
এ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি সরকারি কারখানায় পরিণত করতে উদ্যোগী হয়। এ আইনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
এগুলো ছাড়াও আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা ছিল। এগুলো হল ছাত্ররা আবাসিক হলের = বারান্দায় সাইকেল চালাতে পারবে না, প্রভোস্টের অনুমতি ছাড়া = আবাসিক হলে কোনো সভা করা যাবে না, কোনো সমিতি গঠন চলবে না।
উপাচার্য যেকোনো সময় যেকোনো ছাত্রসংস্থা করে দিতে পারবে। অর্থাৎ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কেই সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হয়।
৩. শিক্ষার অধিকার সংকোচন : ছাত্ররা শরীফ কমিশনের রিপোর্ট পুড়িয়ে দিয়ে আন্দোলন শুরু করার প্রেক্ষিতে আইয়ুব সরকার Commission on Student Problems and Welfare নতুন এক কমিশন গঠন করল
শিক্ষার্থীরা এবার ভেবেছিল হয়তো এ কমিশন তাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হবে। কিন্তু এ কমিশনও শেষে আইয়ুব সরকারের কথামতো ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণের প্রতি দৃষ্টি আরোপ করল। এ কমিশনের সার্বিক রিপোর্টের সারসংক্ষেপ ছিল এরূপ যে, শিক্ষা বড় বেশি ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর সংকোচন আবশ্যক।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
৪. ধর্মীয় শিক্ষার প্রাধান্য সরকার বাংলার সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার লক্ষ্যে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করল। সরকারিভাবে গঠিত কমিশন বলল যে, শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কেননা একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার অভাবেই ছাত্ররা বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে।
তাই কমিশন ধর্মীয় শিক্ষার ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করল। তারা সুপারিশ করল যে, নিম্ন ক্লাসসমূহ ছাড়াও কলেজ তথা উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত।
৫. আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা : পাকিস্তানিরা বাংলার মুসলমানদেরকে বা বাঙালিদেরকে আদিবাসী হিসেবে বিবেচনা করতো। তারা বলত যে বাংলার মুসলমানরা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো সম্বন্ধে অবগত নয় এবং বাংলার সর্বত্র বিকৃত ইসলামের ছড়াছড়ি।
অর্থাৎ তারা বাংলার মুসলমানদের যথেষ্ট তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো এবং এদেরকে শোধরানোর জন্য তাদের শরণাপন্ন হতে বলত।
৬. রবীন্দ্রসংগীতের অপপ্রচার : রবীন্দ্রসংগীতে বাংলার মানুষ প্রাণ খুঁজে পায়। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে নানারকম অপপ্রচার শুরু করে। তারা রবীন্দ্রসংগীতকে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অশুভ প্রয়াস বলে মন্তব্য করেন।
এমনকি অনেক পাকিস্তানি রবীন্দ্রসংগীতকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বলে আখ্যা দেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
৭. বাংলা নববর্ষকে অবহেলা : সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখ চালু করার পর প্রতিবছর ব্যাপক আনন্দোল্লাসের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতো।
আইয়ুব সরকার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বলে অভিহিত করেন পাকিস্তান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র বিধায় এখানে হিন্দু সংস্কৃতি চলতে পারে না এ অজুহাত দেখিয়ে ১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
অর্থাৎ এর দ্বারা বাঙালির শত বছরের পুরোনো সংস্কৃতির মূলে কুঠারঘাত হানা হয় ।
৮. জাতীয় সংগীতে ফারসি ভাষার প্রচলন : একমাত্র জাতীয় সংগীতই পারে দেশের সকল মানুষকে একসুরে বাঁধতে। কিন্তু বাঙালি জাতির জন্য জাতীয় সংগীত বাংলায় রচনা না করে ফারসিতে রচনা করা হয়।
বাঙালি জনগণের কাছে ফারসি ভাষা ছিল দুর্বোধ্য, তাই তারা বাংলায় জাতীয় সংগীত রচনার দাবি জানায়।
৯. রোমান হরফ প্রবর্তন : ক্ষমতা দখলের পরেই আইয়ুব খান পাকিস্তানের সকল ভাষাগুলোর জন্য রোমান হরফ ও একটি অভিন্ন ভাষা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রমূলক প্রস্তাব দেন।
মূলত এক ভাষা এক সংস্কৃতি চালু উদ্যোগের অন্তরালে আইয়ুব সরকার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
এমনকি বাংলা একাডেমিকেও এ কাজে ব্যবহার করে এ কমিশন রোমান হরফে বিভিন্ন বর্ণমালার প্রবর্তন করেন এবং বিভিন্ন প্রদেশে উর্দুকে বাধ্যতামূলক শিক্ষার আওতাধীন করা হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য সফল প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কেননা তারা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, বাঙালি সংস্কৃতি যদি অক্ষুণ্ণ থাকে তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হবে।
যা সৃষ্টি হলে তারা বাংলার মানুষকে সহজে শাসন করতে পারবে না। তাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন কৌশলে বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। কিন্তু বাঙালির দেশপ্রেমের নিকট তাদের সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়।
৬.০২. পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধ ও সংস্কৃতি উজ্জীবনের বর্ণনা দাও ৷
অথবা, পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধ ও সংস্কৃতির উজ্জীবন সম্পর্কে আলোচনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারেও পাকিস্তানিদের মনোভাব ছিল বিরূপ। পাকিস্তানিদের মতো আইয়ুব খানের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড জাত্যাভিমান।
তাই আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে চলমান বিতর্ক মারাত্মক রূপ ধারণ করে। তাই আইয়ুব খানের শাসনামলে নতুনভাবে পূর্ব পাকিস্থানের তথা বাঙালিদের সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালানো শুরু করা হয়।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের বর্ণনা : পশ্চিমা সরকার যখন নানাভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। সেসময় বাঙালিরাও ঐক্যবদ্ধ হয়।
নিম্নে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের ধারাবাহিক বর্ণনা দেওয়া হলো :
১. তমদ্দুন মজলিশের কর্মকাণ্ড : পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনতার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিশ বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র ও অধ্যাপককে নিয়ে ১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। পাকিস্তানিরা যখন জোর করে বাংলার ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয় তখন তমদ্দুন মজলিশ বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২. ভাষা আন্দোলন : বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ হচ্ছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করলে অধিকাংশ মুসলিম লীগ নেতাদের বিরোধিতায় তা নাকচ হয়ে যায়। এতে বাংলার শিক্ষিত মানুষের মনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য সংগঠন নিয়ে গঠন করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এ পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে অনড় থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে।
এদিন মিছিলে পুলিশ গুলি করে এবং বাংলার অনেক তরুণ রাজপথে শহিদ হন । তারপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
৩. আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র প্রতিহত : আইয়ুব খান ফে বাংল পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে নির্দেশ জারি করেন যে, বাংলা ভাষাকে আরবি হরফে লিখতে হবে। কেননা বাংলা হচ্ছে হিন্দু সংস্কৃত ভাষা।
তাই ইসলামি পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাকে আরবি করে লেখার ওপর জোর দেওয়া হয়। এতে বাংলার রাজনৈতিক ও শিক্ষিত মহল প্রতিবাদ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
বাংলা একাডেমির পরিচালক পাকিস্তানের জনৈক সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মত প্রকাশ করেন যে, ভাষা সব সময় তার নিজস্ব গতিতেই চলে। জোর জবরদস্তি করে ভাষার গতি বদলানো যায় না।
৪. রোমান হরফ প্রবর্তনের বিরোধিতা : আইয়ুব সরকার বাংলা ও উর্দুর সমন্বয়ে রোমান হরফে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা প্রবর্তন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্রই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে ওঠে।
বাংলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এর প্রতিবাদে সম্পাদকীয় লেখা হয়। ১৯৫৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে ছাত্রদের সম্মেলনে রোমান হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সাহিত্যিকগণও এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
৫. জাতীয় শিক্ষা কমিশনের বিরোধিতা : ১৯৫৮ সালে এক জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয় উর্দু ও বাংলার জন্য রোমান হরফ বাঞ্ছনীয় কি না তা খতিয়ে দেখা এবং এর ভিত্তিতে সুপারিশ করা।
কমিশন বাংলা ও উর্দু হরফকে উন্নত করে রোমান হরফ গ্রহণের পক্ষে মত দিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিবেদন পেশ করেন। কমিশনের এ প্রতিবেদনের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র জনরোষ সৃষ্টি হয় ।
৬. রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন ও ছায়ানট প্রতিষ্ঠা : রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনকে সরকার বিভিন্ন দিক থেকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন এবং সরকারের সহকারী বিভিন্ন গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়।
কিন্তু সরকারের সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ঢাকায় রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের উদ্যোগে এগারোই বৈশাখ কার্জন হলে প্রধান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
তাছাড়া আরও দুইটি কমিটির মাধ্যমে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এভাবে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সফলভাবে উদযাপিত হলে কোনো কোনো কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত করার জন্য একটি স্থায়ী সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এরই ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ।
৭. ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ পালন : ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের আর্থিক সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ পালন করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
এখানে সাহিত্য, সংগীত, নাটকসহ বিভিন্ন প্রদর্শনীর আলোচনা করা হয়। এ সম্মেলনে সতেরো শতকের বিখ্যাত কবি আব্দুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার লাইনগুলো বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারের মাধ্যমে এঁটে দেওয়া হয়। এতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যথেষ্ট উজ্জীবিত হয় ।
৮. রবীন্দ্রসংগীত বন্ধের প্রতিবাদ : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রসংগীতকে হিন্দু সংস্কৃতির জয়গান ও ইসলাম বিদ্বেষী বলে প্রচার করা হয় যার দরুন রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীতকে নিষিদ্ধ করা হয় এর প্রতিবাদে বাংলার শিক্ষিত সমাজ ক্ষোভ . প্রকাশ করেন।
১৯ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি ছিল এরূপ, “রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সংগীত বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য প্রদান । করেছে এবং আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের কাছে সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।”
৯. প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একসময় ষড়যন্ত্র করে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করে বিভিন্ন বই নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
পাকিস্তানিদের এ অর্ডিন্যান্স ও বই নিষিদ্ধের ঘোষণা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করে । ৩০ জন বুদ্ধিজীবী সরকারের এ পদক্ষেপকে আশঙ্কাজনক ও নিষিদ্ধ বইগুলোকে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে দাবি করে বিবৃতি প্রদান করেন।
এ অর্ডিন্যান্স বাতিলের আন্দোলনের এক পর্যায়ে, ‘লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়
১০. পাঠ্যক্রমের পরিবর্তনের প্রতিবাদ : স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবোধ পাকাপোক্ত করার জন্য পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ড. মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ‘পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি’ নামক দুই খণ্ডের একটি পুস্তক রচনা করেন।
যার মধ্যে অখণ্ড পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। পরে ১৯৭০ সালে পাঠ্য বইয়ে তা সংযোজন করা হয়। এসময় বইটি পাঠক্রম থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীরা সংগঠিতভাবে আন্দোলন শুরু করেন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর পাকিস্তানিরা যেসব আগ্রাসন চালিয়েছিল তা ফলপ্রসূ হয়নি। কেননা বাঙালিরা সংঘবদ্ধভাবে পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বাঙালিরা মনেপ্রাণে শপথ গ্রহণ করে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য। আর বাঙালিদের এ সাংস্কৃতিক উজ্জীবন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে এতটাই শক্তিশালী করে যে যার ভিত্তিতে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয় ।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
৬.০৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির উপাদানসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পটভূমি সৃষ্টির উপাদানসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সমগ্র শাসন ক্ষমতা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। তারা বাঙালিদেরকে নিচু জাতি মনে করতো এবং বাঙালিদের কোনো অধিকারই তারা আদায় করতে দিত না।
তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর বাঙালি বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানিরা তাদের বিষয়ে অনাগ্রহী। তাই বাংলার জনগণ তাদের ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতির ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
তারা বুঝাতে পারে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদই হচ্ছে বাঙালি জাতির নিজস্ব সত্তা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির উপাদান : যেকোনো দেশের জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির পিছনে থাকে একটি সুস্পষ্ট পটভূমি এবং এ পটভূমি সৃষ্টিতে কিছু উপাদান বিশেষভাবে কাজ করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পটভূমি সৃষ্টিতেও এমন কতকগুলো উপাদান বিশেষভাবে কার্যকর করেছিল । নিম্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পটভূমি সৃষ্টির উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. সীমানা নির্ধারণ কমিশন : ভারত বিভাগের প্রাক্কালে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়— যা ‘বাউন্ডারি কমিশন’ নামে পরিচিত।
কিন্তু এ কমিশনে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো তুখোড় ও অভিজ্ঞ আইনজীবীদের স্থান দেওয়া হয়নি। তাদের পরিবর্তে একজন জুনিয়র অনভিজ্ঞ উর্দুভাষী, আইনজীবীকে কমিটিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
যে কারণে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কলকাতা ও দার্জিলিংকে জার্মানির বার্লিন শহরের মতো মুক্ত শহর করা সম্ভব হয়নি।
২. রাজধানী নির্বাচনে জটিলতা : পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্বাধীন পাকিস্তানের রাজধানী করা হয় করাচিকে। এতে বলা হয় যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মস্থান যেহেতু করাচিতে তাই করাচিই হবে পাকিস্তানের রাজধানী।
কিন্তু প্রকৃত জনসংখ্যার অনুপাতে রাজধানী করতে চাইলে ঢাকাই হতো পাকিস্তানের রাজধানী। কেননা করাচির বেশিরভাগ উর্দুভাষী ছিল ভারত থেকে আগত বাস্তুহারা। তাই করাচি পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় বাঙালিরা মর্মাহত হয়।
৩. রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণে জটিলতা : পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বিরোধ দেখা দেয়। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ ও আলীগড় কেন্দ্রীক মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন।
যাতে করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগের মুখের ভাষা বাংলার পরিবর্তে জোর করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার তরুণেরা বাংলা ভাষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। ফলে বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনা জন্ম লাভ করে ।
৪. ক্ষমতা বণ্টনে বিরোধ : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে বিরোধ চরমে পৌঁছায় পাকিস্তান সৃষ্টির উৎস লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তা প্রদান করেননি।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে মত দেয়। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর বাঙালিদের ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে ।
৫. আইনসভার প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিরোধ : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত ‘মূলনীতি কমিটির’ প্রথম রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্রীয় আইনসভায় সমসংখ্যক আসন প্রদান করার কথা বলা হয়। তাই সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব না দেওয়ায় বাংলার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ডানা মেলতে থাকে ।
৬. সংস্কৃতি : দুই পাকিস্তানের জনগণের মধ্যকার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার ফলে উভয় অঞ্চলের মধ্যে সংস্কৃতিগত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতির ওপর নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং সাংস্কৃতিক একত্রীকরণের কথা বলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকৃতি ঘটায়। বাঙালিরা তাদের সংস্কৃতি বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়।
৭. দৃষ্টিভঙ্গি : পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকের ছিল রক্ষণশীল, সংকীর্ণমনা ও ধর্মান্ধ কিন্তু বাঙালি জনগণ ছিল ১ উদারনৈতিক ও সহমর্মী
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
তাই বাঙালিরা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাসহ একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানিদের আশা আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাচেতনার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।
৮. অর্থনেতিক অসাম্য : পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অর্থনেতিক বৈষম্য ছিল উল্লেখযোগ্য।
যদিও পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের বেশির ভাগ আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে; তবু ক্রমাগত পূর্ব পাকিস্তান হতে অর্থ ও শিল্প দ্রব্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি অনেকাংশেই ভেঙে পড়ে।
তাই বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের এ ইচ্ছাকৃত অবহেলা পাকিস্তানিদের প্রতি বাঙালিদের মনে ঘৃণার সৃষ্টি করে যা জাতীয়তাবাদের পথকে সুগম করে।
৯. রাজনৈতিক অনাচার : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই রাজনীতিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল প্রকট। কেন্দ্রীয় সরকারের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদ পশ্চিমারা দখল করেছিল ।
যার ফলে বাংলার জনগণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে ছিল উপেক্ষিত ১৯৪৭-৫৮ সালের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, এ সময়ে পাকিস্তানের ৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে একজন ছিলেন বাংলার এবং তিনিও ছিলেন উর্দুভাষী।
রাজনীতিতে বাঙালিরা তখনই ঠাই পেত যখন তারা পাকিস্তানিদের কথামতো চলত। তাই এ বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে পাকিস্তান বিদ্বেষ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যে শব্দ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয় পাকিস্তানিদের প্রতি তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলার জনগণকে ভাবিয়ে তোলে।
তারা বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নয় বাঙালি জাতীয়তাবাদই পারে বাঙালিদেরকে পুরোপুরি মুক্তি দিতে। তাইতো বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয় ।
প্রশ্ন ৬.০৪. ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ৬ দফা কী? এর ধারাগুলো লেখ ।
উত্তরঃ ভূমিকা : বাংলাদেশের সৃষ্টির ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির ভূমিকা অনন্য সাধারণ। এ কর্মসূচি ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করে । ৬ দফা ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
এছাড়াও ৬ দফাতে পাকিস্তানকে ভাঙতে চাওয়া হয়নি, চাওয়া হয়েছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এবং ৬ দফা : ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘ম্যাগনাকার্টা’ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসে ৬ দফা তেমনি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
ম্যাগনাকাটাকে যেমন ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের বাইবেল বলা হয় তেমনি ৬ দফা কর্মসূচিকেও বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বলা হয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বিদ্বেষবশত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের ওপর দমন পীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ ও বৈষম্যের স্টীমরোলার চালালে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করেন।
১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন তা-ই ইতিহাসে ৬ দফা কর্মসূচি নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পিছনে যে কয়টি আন্দোলনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে তার মধ্যে ৬ দফা অন্যতম। ৬ দফার দাবি ছিল বাঙালিদের প্রাণের দাবি। লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে ভারতবর্ষে মুসলিম প্রধান অঞ্চলসমূহ নিয়ে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠিত হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
কিন্তু পরবর্তীতে এক ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাবকে সংশোধন করে শুধুমাত্র পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র গঠন করার প্রস্তাব করা হয়।
তাও বাঙালিরা খুশি থাকত যদি স্বাধীন পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানকে তথা পূর্ববাংলাকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হতো। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা স্বায়ত্তশাসন বিরোধী ও বাংলা বিরোধী নানারকম কার্যকলাপে লিপ্ত হন।
পাকিস্তানি শাসকদের শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের মাত্রা বাংলায় তীব্র আকার ধারণ করলে বাঙালিরা শুরু করে আন্দোলন। এরকমই একটি আন্দোলন হচ্ছে ঐতিহাসিক ৬ দফা ।
৬ দফার ধারা : আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ৬ দফার নিম্নলিখিত ধারাগুলো উত্থাপন করেন :
প্রথম দফা—সাংবিধানিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নপূর্বক পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে— সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হবে সংসদীয় প্রকৃতির এবং সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাগুলোর সার্বভৌমত্ব থাকবে।
দ্বিতীয় দফা—ক্ষমতা বণ্টন : ফেডারেল (কেন্দ্রীয়) সরকারের হাতে কেবল দুটি বিষয়ের ক্ষমতা থাকবে। যথা: দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রসংক্রান্ত, অবশিষ্ট বিষয়ের ক্ষমতা পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
তৃতীয় দফা—মুদ্রা ব্যবস্থা : মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করে যেকোনো একটিকে গ্রহণের দাবি করা হয় । বলা হয় (ক) পাকিস্তানের দুঅঞ্চলের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে।
দুঅঞ্চলের দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। অথবা, (খ) দুঅঞ্চলের জন্য অভিন্ন মুদ্রা থাকবে তবে সংবিধানে । এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান হতে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে।
পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুঅঞ্চলের জন্য দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
চতুর্থ দফা—রাজস্ব কর ও শুল্কসংক্রান্ত ক্ষমতা সকল প্রকার কর, খাজনা ধার্য এবং আদায় করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।
পঞ্চম দফা—বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমতা : এ দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নোক্ত সাংবিধানিক বিধানের সুপারিশ করা হয়-
ক. দুঅঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব থাকবে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
খ. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে।
গ. ফেডারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমানভাবে অথবা সংবিধানে নির্ধারিত হারে আদায় হবে।
ঘ. দেশজ দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে দুঅঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করা চলবে।
ঙ. ব্যবসায় বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে ।
ষষ্ঠ দফা—আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন : এ দফায় উল্লেখ করা হয় যে, অঙ্গরাজ্যগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কার্যকরী অংশগ্রহণের সুযোগ দান এবং আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলার ইতিহাসে ৬ দফা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যার রয়েছে দালিলিক ভিত্তি। ৬ দফার প্রতিটি দফা ছিল বাঙালির জন্য দলিল স্বরূপ।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি; সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বাঁচার দাবি।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।