সাদকাতুল ফিতরের বিধি বিধান > এইচ বি ফিরোজ ॥ রমযান মাসের সিয়াম ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতি পূরনার্থে এবং অভাবগ্রস্থদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমানের যে খাদ্যসামগ্রী অভাবীদের দান করা হয়ে থাকে শরীয়তের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিতর বা সাদাকাতুল ফিতর বলা হয়ে থাকে।
ইসলামী শরীয়তে প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন, ধনী-গরীব সকলের উপর ফিতরা দেয়া ওয়াজিব। যাকাত প্রদানের আটটি খাতে ফিতরা প্রদান করা যাবে বেেল অধিকাংশ আলেম একমত হয়েছেন।
“আব্দুল্লহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসূল (সা:) স্বাধীন, কৃতদাস, নারী, পুরুষ, ছোট, বড় প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি রমযানের সিয়ামের কারনে এক ‘সা’ খেজুর বা এক ‘সা’ যব ফিতরা হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
যাকাতের বিধি-বিধান
সাদাকায়ে ফিতরের আদায়ের মাধ্যমে পরিমান কত? (বুখারী ও মুসলিম) এর জবাবে বিভিন্ন হাদীসে পাঁচ প্রকারের খাদ্যের বর্ননা পাওয়া যায়। যেমন- যব, খেজুর, পনির, কিসমিস ও গম। এই পাঁচ প্রকারের মধ্যে রাসূল (স:) এর যুগে প্রাচুর্যতা ও সহজলভ্যতা বিবেচনায় পরিমাপের মধ্যে কিছুটা তারতম্য বিদ্যমান ছিল। যেমন- যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দ্বারা ফিতরা প্রদান করলে প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ ছিল- ‘এক সা’ পরিমান।
পক্ষান্তরে ‘গম’ আদায় করতে চাইলে, প্রত্যেকের জন্য নির্ধারন ছিল- অর্ধ ‘সা’ পরিমান। এ পার্থক্যের কারন ছিল তখনকার যুগে ‘গম’ সহজলভ্য ছিল না। এর ফলন ছিল খুবই কম। যার ফলে এটি ছিল দুস্প্রাপ্য। হাদীসে বর্নিত এই পাঁচটি দ্রব্যের যে কোন একটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেয়া হয়েছে যেন মুসলিমগন নিজ নিজ সামর্থ ও সুবিধা অনুযায়ী এর যে কোন একটি দ্বারা তা আদায় করতে পারে। সুনানে নাসাঈর বর্ননায় এসেছে রাসূল (সা:) বলেছেন ফিতরা হচ্ছে ‘এক সা’ পরিমান খাদ্যবস্তু।
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
উন্নত মানের গম বা আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম । যব দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম , কিশমিশ দিয়ে করলে ৩ কেজি ৩০০গ্রাম , খেজুর দিয়ে করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম , পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ফিতরা দিতে হবে।
আসুন মসজিদ মুখি হই (১)
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কে শরিয়তে দুটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘এক সা’ বা ‘নিসফে সা’। খেজুর, পনির, জব ও কিশমিশ দ্বারা আদায়ের ক্ষেত্রে এক ‘সা’=৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়) অর্থাৎ তিন কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। এ ছাড়া গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে ‘নিসফে সা’=১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম, অর্থাৎ এক কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি প্রযোজ্য হবে। (আওজানে শরইয়্যাহ, পৃ. ১৮)
রাসুল (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। খেজুর, কিশমিশ, জব ও পনির। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমাদের সময় ঈদের দিন এক সা খাদ্য দ্বারা সদকা আদায় করতাম। আর তখন আমাদের খাদ্য ছিল জব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (সহিহ বুখারি)
কখন সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়
ঈদের রাতে সূর্যাস্তের সময় জীবিত থাকলে তার উপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক নতুবা নয়। যদি কোন শিশু সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পর ভূমিষ্ট হয় তার উপর আবশ্যক হবে না। তবে আদায় করা সুন্নত। আর সূর্যাস্তের পূর্বে ভূমিষ্ঠ হলে তার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে।
সাদকাতুল ফিতর আবশ্যক হওয়ার ওয়াক্ত রমযানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পরবর্তী সময় নির্ধারন করার কারন হচ্ছে- তখন থেকে ‘ফিতর’ তথা খাওয়ার মাধ্যমে রমযানের সিয়াম সমাপ্ত হয়। এ কারনেই একে রমযানের সাদকাতুল ফিতর বা সিয়াম খোলার ফিতর বলা হয়। বুঝা গেল, ফিতর তথা সিয়াম শেষ হওয়ার সময়টাই সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়।
কখন আদায় করবেনঃ- সদাকাতুল ফিতর আদায়ের সময় দু ধরনের : ১। ফজিলতপূর্ন সময় ২। ওয়াক্ত জাওয়াজ বা সাধারণ সময় । ১. ফজিলত পূর্ন সময় ঃ ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাতের পূর্বে। বুখারীর বর্ননায় পাওয়া যায় ইবনে ওমর (রা:) থেকে বর্নিত, রাসূল (সা:) মানুষের ঈদের সালাত পড়তে যাওয়ার পূর্বেই সদাকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং আমাদেরকে ঈদের সালাতের পূর্বেই তা আদায় করতে হবে।
কেননা মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চই সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় এবং তার পালন কর্তার নাম স্মরন করে, অতঃপর সালাত আদায় করে। (সূরা আলা- ১৪-১৫)
২. জায়েজ সময় ঃ ঈদের একদিন দু’দিন পূর্বে সদাকাতুল ফিতর আদায় করা।
বুখারীতে আছে ইবনে ওমর (রা:) নিজের এবং ছোট বড় সন্তানের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন, তিনি যাকাতের হকদারদের ঈদের একদিন বা দু’দিন পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর দিতেন। ঈদের সালাতের পর আদায় করা জায়েজ নেই। অতএব, বিনা কারনে সালাতের পর বিলম্ব করলে তা গ্রহনযোগ্য হবে না। কারন, তা রাসূল (সা:) এর নির্দেশের পরিপন্থি।
দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখার দোয়া
ওয়াজির হচ্ছে, সাদাকাতুল ফিতর তার প্রাপকের হাতে সরাসরি বা কারো মাধ্যমে যথাসময়ে সালাতের পূর্বে পৌঁছানো, যদি নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে প্রদানের নিয়ত করে। অথচ তার সঙ্গে তার নিকট পৌছাতে পারে এমন কারো সঙ্গে সাক্ষাত না হয়, তাহলে অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করবে, বিলম্ব করবে না।
সাদাকাতুল ফিতরের হকদার
১। দরিদ্র, ২। ঋণ আদায়ে অক্ষম, ৩। ঋনগ্রস্থ, তাকে প্রয়োজন পরিমান দেয়া যাবে। এক সদকাতুল ফিতর অনেক ফকীরকে দেয়া যাবে এবং অনেক সদকাতুল ফিতর এক মিসকিনকেও দেয়া যাবে। যেহেতু রাসূল (সাঃ) সদকাতুল ফিতরের পরিমান নির্ধারন করেছেন, কিন্তু হকদারকে কি পরিমান দিতে হবে তা নির্ধারন করেননি। সুতরাং যদি অনেক ব্যক্তি তাদের সদকাতুল ফিতর ওজন করার পর একটি পত্রে জমা করে এবং সেখান থেকে তা পুনরায় পরিমাপ ছাড়া বন্টন করে, তবে তা বৈধ হবে।
কি দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করবেন ঃ- যে, হাদীসের কোথাও টাকা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করার কথা নেই। সুতরাং খাদ্য দ্রব্য দ্বারা তা আদায় করতে হবে। ইমাম আবু হানিফার (রহ)-এর মতে টাকা দ্বারা দেওয়া উত্তম। তবে যেহেতু খাদ্য দ্রব্যের কথা সরাসরি হাদীসে বলা হয়েছে তাই খাদ্য দ্রব্য দিয়ে আদায় করা বেশি-ই উত্তম। ।
ইসলাম চিরসুন্দর। ইসলামের এ সৌন্দর্য চির আধুনিক। সদকাতুল ফিতর এ সৌন্দর্যের একটি অংশ। যেটি একাধারে ঘটে যাওয়া ভুলের সংশোধন ও অভাবগ্রস্ত হতদরিদ্রের মাঝে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। চলুন, যথাযথভাবে ইসলামী অনুশাসন মেনে সদকাতুল ফিতর আদায় করি। তা আদায়ে কোনো প্রকার কার্পণ্য যেন আমাদের স্পর্শ না-করে। আল্লাহই উত্তম প্রতিদানদাতা।
‘যদি তোমরা (নিয়ামতের) কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তোমাদেরকে আরো বৃদ্ধি করে দেয়া হবে আর যদি অস্বীকার করো, নিশ্চয় আমার আজাব অত্যন্ত কঠিন’ (সুরা ইবরাহীম, আয়াত-৭)।
হে আল্লাহ ! আপনি আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি অনুযায়ী আনুগত্য করার তাওফিক দিন। আমাদের আত্মা, কথা ও কাজ শুদ্ধ করে দিন। আমাদের বিশ্বাস, কথা ও কাজের ব্রষ্টতা থেকে পবিত্র করুন-আমীন। নিশ্চই আপনি উত্তম দানশীল ও করুনাময়।
লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক ও গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব.
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।