অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩) সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয়: পাকিস্তান : রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও বৈষম্য
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৩.০৮ । পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও ।
অথবা, পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য পর্যালোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হওয়ায় বাঙালিরা আশা করেছিল তারা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেল এবং স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে এবং অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হবে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের আশার প্রতিদানে হতাশার বোঝা চাপাতে থাকে। তারা বাঙালিদের প্রতি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করতে থাকে।
তাদের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের উক্ত শোষণ বৈষম্যের হাত হতে রক্ষার জন্য বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য : নিম্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক বৈষম্য : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে ব্যর্থ হয়। প্রাদেশিক সরকারের হাতে মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা ছিল না।
কেন্দ্র সরাসরি এসব নিয়ন্ত্রণ করতো বলে পূর্ব পাকিস্তানের সমুদয় আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত স্টেট ব্যাংকসহ প্রায় সব ব্যাংক, বিমা, বাণিজ্য, সরকারি বেসরকারি প্রধান এবং বিদেশি মিশনসমূহের হেড অফিস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এ প্রক্রিয়ায় যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন।
পূর্ব পাকিস্তান মুদ্রারাজস্ব নীতিতে প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সাহায্য দাবি করে।
২. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : পাকিস্তানে ১৯৫৫-৫৬ সাল থেকে ১৯৫৯-৬০ সাল পর্যন্ত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । এর পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে সরকারিভাবে মোট ৩০০ কোটি ২০ লক্ষ রূপি বরাদ্দ করা হয়েছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যয় ছিল ১১৩ কোটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার রূপি।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
অপরপক্ষে, পাকিস্তানের তথা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে ব্যয় ছিল ৫০০ কোটি রূপি। আবার এসময়ে ব্যক্তিগত মালিকানা খাতে পূর্ব পাকিস্তানে ৭৩ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২৯৩ কোটি রূপি বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা অর্থনেতিক বৈষম্যের সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত।
৩. দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল ছিল ১৯৬০-৬১ সাল থেকে ১৯৬৪-৬৫ সাল । প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সমালোচনার ঝড় ওঠলে এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ও অসন্তুষ্টি দেখা দিলে আইয়ুব খান পরিকল্পনায় দুই অঞ্চলের বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের বাজেটের ব্যয় ছিল ৯৫০ কোটি আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় ছিল ১,৩৫০ কোটি রূপি। তিনি দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করতে চাইলেও পরিশেষে দেখা গেল মোট বরাদ্দ পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৪৫% কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় হলো ৩১%।
আবার বরাদ্দ ছাড়াও পাকিস্তানের সিন্ধু নদীতে উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছিল ২১১ কোটি রূপি।
৪. রাজস্ব ক্ষেত্রে : পাকিস্তানের রাজস্ব খাতে আয়ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যনীতির ভিন্ন একটি চিত্র লক্ষ করা যায়। ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮-৬৯ সালে বাণিজ্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক, বিক্রয় কর এবং আয়কর থেকে পূর্ব পাকিস্তান জমা দেয় ৭২৮ কোটি টাকা । খরচের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে দেয় ৪৮৫ কোটি টাকা।
বাদবাকি টাকা নিজের কাছে জমা রাখে অথচ পশ্চিম পাকিস্তান ১,৭৮১.৭ কোটি টাকা আয় করে খরচের জন্য পায় ১৬৫৯.৫ কোটি টাকা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উন্নয়ন খাত থেকে পায় যথাক্রমে ৮৫১.৩ কোটি ও ১,১০৭.৬ কোটি টাকা।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
কোনো কোনো গবেষক ১৯৫০-৭০ সাল পর্যন্ত বিশ বছরের হিসেব পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, এসময় পূর্ব পাকিস্তানের ৩৩ শতাংশ রাজস্ব আদায় করে ব্যয়ের জন্য পেয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ রাজস্ব। যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের ঘাটতির মাত্র ৬৪% বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা হয়েছে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯২% অর্থ ।
৫. বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ বণ্টন : পাকিস্তান ১৯৪৭-‘৭০ পর্যন্ত ৭,৬৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেলেও বৈষম্যমূলক নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে মাত্র ২,০২৪ মিলিয়ন ডলার।
অবশ্য বৈদেশিক সাহায্যের এ বণ্টন কাগজে কলমে প্রচলিত থাকলেও সমকালীন দলিলের ভিত্তিতে কোনো কোনো বাঙালি অর্থনীতিবিদ পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার ২১% এর বেশি নয় বলে মন্তব্য করেন। অথচ জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৫৬% বৈদেশিক সাহায্যের অংশ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য ছিল ।
৬. আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ : পাকিস্তানের বহির্বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণে। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় দপ্তর হতে পরিচালনা করা হতো। ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানে বিরাজ করতো।
পাকিস্তানের বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ের ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের আর বাকি ৪০ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের। বিশ্ব বাজারে যখন প্রক্রিয়াজাতকরণ দ্রব্যের চাহিদা ছিল তুঙ্গে তখন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে অগ্রাহ্য করে সব কলকারখানা গড়ে তোলেন পশ্চিম পাকিস্তানে।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
আমদানি ও রপ্তানি পশ্চিম পাকিস্তান হতে নিয়ন্ত্রণ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশি আয় করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি করা হয়েছে ২০,০৬৭ মিলিয়ন টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৪৪,৩২৪ মিলিয়ন টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে।
৭. বাণিজ্যের ক্ষেত্রে : পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে বাণিজ্য ক্ষেত্রেও বৈষম্য ছিল। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক আগ্রহের কিছু কারণ হলো বিশ্ব বাজারের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য কিঞ্চিৎ বেশি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্যগুলো পূর্ব পাকিস্তানে আমদানি হতো তার মূল্য ছিল প্রায় দ্বিগুণ।
এমনিভাবে দুই অঞ্চলের বাণিজ্যের নামে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন ও অর্থ পাচার করে।
৮. উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বৈষম্য পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এমনভাবে বাস্তবায়ন করা হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ছিল তার মূলনীতি। তাই দেখা যায় আঞ্চলিক বরাদ্দ যাই থাকুক না কেন বার্ষিক পরিকল্পনায় পূর্বাঞ্চলের জন্য নানা অজুহাতে বরাদ্দ সীমিত রাখা হতো।
এ বরাদ্দ বাস্তবায়নে পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করতো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। এছাড়া বিভিন্ন উপায়ে উন্নয়ন ব্যাহত করা হতো। এর ফলে দেখা যেত নির্দিষ্ট সময়ের পর অধিকাংশ প্রকল্পের অর্থ অব্যবহৃত থেকে যেত। আবার এসব অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হতো।
৯. সম্পদ পাচার : পাকিস্তানের শুরু থেকেই পশ্চিমাংশ পূর্বাংশ হতে অনেক মূল্যবান দ্রব্য পাচার করে নিয়ে যেত। প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন রূপি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
আর এক হিসেবে দেখা যায় ১৯৪৮–’৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত বিশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাচার করা হয় যা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের ১৯ শতাংশ। তাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছিল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল যদি পূর্ববাংলার জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ বা দারিদ্র্যসীমার নিচে রাখা সম্ভব হয় তাহলে তারা পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার মতো সাহস পাবে না।
কিন্তু তাদের শোষণ বৈষম্যগুলো এতই ব্যাপক ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের সামনে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ব্যতীত কোনো বিকল্প ছিল না। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তারা পরবর্তীতে নিজেদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই আন্দোলন করে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ৩
৩.০৯. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও প্রতিক্রিয়া আলোচনা কর
অথবা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও এর বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : দেশবিভাগের পর পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় বৈষম্যের অশুভ এক ছায়া। বাঙালিরা মনে করেছিল তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অধিকারগুলো ভোগ করতে পারবে এবং শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু বাঙালির স্বপ্ন, তখন ভেঙে যায় যখন দেখল যে তাদের স্বপ্ন ছিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার ন্যায় কাল্পনিক।
প্রকৃতপক্ষে, বাস্তব চিত্র হলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ববাংলার প্রতি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ সব দিক থেকে বৈষম্যের জাল বিস্তার করে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক বৈষম্য : ঞ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বৈষম্য চালায় নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো :
১. বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষার প্রচলন : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথম যেভাবে সাংস্কৃতিক বৈষম্য শুরু করেন তার প্রথমটি হলো ভাষার পরিবর্তন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ইসলামি রাষ্ট্রের পবিত্রতা রক্ষার্থে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ পৃথক।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
পূর্ববাংলার অধিবাসীরা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৫৬ শতাংশ এবং এদের ভাষা ছিল বাংলা। সাহিত্য সংস্কৃতি ছিল হাজার বছরের পুরানো, অপরদিকে, পাকিস্তানের বাকি ৪৫ শতাংশ লোকের ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল বিভিন্ন ধরনের এবং এদের মাত্র ৭.২ শতাংশ লোকের ভাষা ছিল উর্দু।
দেশ বিভাগের পর পরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ব্যবহার কার্যে যেমন— খাম, ডাকটিকেট, রেলগাড়ির টিকেট, বিভিন্ন ধরনের ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখা শুরু হয় । ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে প্রথম বারের মতো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ গৃহীত হয়।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে, ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।”
২. ভাষাগত সংস্কারের মাধ্যমে নির্যাতন : তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা করার পাশাপাশি বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কার এবং বিদেশি ভাষায় বাংলা ভাষার রূপান্তরের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
এক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালে আরবি হরফে বাংলা লেখার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বয়স্ক ছাত্রদের বিনামূল্যে আরবি লেখা বাংলা বই পড়ানো হয়। ১৯৪৯ সালে ভাষা কমিটি গঠনের পর তারা দেড় বছর পরে ঈ, উ, ঝ, ৯, ঐ, ঙ, ঞ, ম, ষ, ঢ়, ক্ষ, ৎ, : বর্ণ বাদ দিয়ে অ্যা বর্ণযুক্ত করার পরামর্শ দেয়।
১৯৬৮ সালে পুনরায় রোমান হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কেবল বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি মূলে আঘাতই নয় ধৃষ্টতাও বটে ।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
৩. শিক্ষা সংকোচন নীতি : ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে ডিসেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব এস. এম. শরীফের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৯৬০ সালে রিপোর্ট পেশ করে।
রাজনীতিতে ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণের তথ্য প্রদান করেন। শিক্ষা সংকোচন নীতিতে বলা হয় প্রতিটি স্কুলের ৬০ শতাংশ অর্থ সংগৃহীত হবে ছাত্র বেতন থেকে ২০ শতাংশ অর্থ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নির্বাহ করবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকার একই নীতি অনুসরণ করেন ।
৪. প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি পূর্ববাংলার যেসব প্রকাশনা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে সরকার সেসব প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সালে ইত্তেফাকসহ প্রগতিশীল পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খানের চক্রান্তে বাংলা ভাষার কতকগুলো পুস্তক বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একটি প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করা হয় ।
৫. রবীন্দ্র বিদ্বেষী মনোভাব : বাংলা ভাষাকে শ্রুতিমধুর করার ক্ষেত্রে যে কজন মনীষী অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার রচনাবলি, গান, নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র বাংলা বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে।
পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক সরকার রবীন্দ্র রচনাবলির প্রতি ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসংগীত, বেতার ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বস্তুত রবীন্দ্র রচনায় আঘাত দিয়ে সরকার বাঙালি সংস্কৃতিকে আঘাত দেন।
৬. বাংলা উৎসব নিষিদ্ধকরণ : পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান দিন। সম্রাট আকবর সর্বপ্রথম পহেলা বৈশাখ উৎসব চালু করেন এবং তখন থেকে পূর্ববাংলায় এ উৎসব প্রচলিত রয়েছে।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
কিন্তু আইয়ুব খান ১৯৬৬ সালে পহেলা বৈশাখ পালনকে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব বলে আখ্যা দেন। মূলত আইয়ুব খানের এরূপ ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির শত বছরের সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করার মতো ঘটনা।
সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিক্রিয়া : নিম্নে সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা হলো :
১. সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়।
নাট্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী ধারার সৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ‘সংস্কৃতি সংসদ’ এর ভূমিকা অপরিসীম আর কিছু আঞ্চলিক সংগঠন ও উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রামের ‘সংস্কৃতি সংসদ’ এবং ‘প্রান্তিক’ নামে দুটি সংগঠন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।
২. রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিক্রিয়া : পূর্ববাংলার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের শাসকমহল কর্তৃক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কিছু ছাত্র সংগঠন যেমন— ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ আর কিছু ছাত্র সংগঠনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তার ২১ দফা কর্মসূচিতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার দাবি করে।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনগুলো তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে ১৯৬৮ সালে ছাত্র সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে গঠন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদ তাদের ১১ দফা দাবি নিয়ে পূর্ববাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলে ।
৩. বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃক পূর্ববাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের বুদ্ধিজীবী মহলও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রসংগীত ও বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহল তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে । বিভিন্ন অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরাও সোচ্চার হন।
উপসংহার উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি বাঙালি জাতির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার মাধ্যমে বাঙালিকে মূর্খ রেখে এ অঞ্চলে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল।
কিন্তু যখনই ক্ষমতাসীন দল এরূপ হীন ষড়যন্ত্র করেছে তখন বাঙালি জাতি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। আর এর ফলে বাঙালিরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম শিক্ষালাভ করেছে বাঙালিরা কীভাবে নিজেদের অধিকার আন্দোলনে জয়ী হতে পারে।
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ৩
৩.১০. পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ পর্যালোচনা কর।
অথবা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যসমূহ আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছিল দুটি অংশ তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তানের এ দুটি অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে দুই ধরনের স্বতন্ত্র সামাজিক কাঠামো লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতাশীল হয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তান শোষিত শ্রেণিতে পরিণত হয়।
মূলত পশ্চিম পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে শোষণ ও বৈষম্যের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে তাদের শাসনাধীন একটি অঞ্চলে পরিণত করতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ : সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক নীতিসমূহ তুলে ধরা হলো :
ক. সামাজিক বৈষম্য : সামাজিক বৈষম্যসমূহ নিম্নরূপ :
১. সামাজিক অবকাঠামো : পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকেও পিছিয়ে ছিল। গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে, কৃষি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রের ১৬টির মধ্যে অবস্থান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ।
২. ধর্মীয় ক্ষেত্রে : ইসলামি সামাজিক ব্যবস্থা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে চালু থাকলেও ইসলাম সম্পর্কে দুই অংশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বেশ পার্থক্য বিরাজমান ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় জীবন ছিল অনেকটা উদারনৈতিক ও মানবতাবাদী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল অনেকটা রক্ষণশীল ও গোঁড়া মানসিকতাসম্পন্ন ।
৩. জাতপাতের ভিন্নতা : পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের জনগণ সমজাতীয় ছিল না। এখানকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ও বেলুচিস্তানে উপজাতিদের প্রাধান্যের ফলে কোনো সময় ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে, নৃতাত্ত্বিক সূত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অনেকাংশেই ছিল সমজাতীয়। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল বাঙালি।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে কিছু কিছু উপজাতীয় গোষ্ঠী ও আদিবাসী বসবাস করলেও তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংগঠনে তারা কোনো প্রতিবন্ধক ছিল না।
৪. প্রশাসনে প্রাধান্য : ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগের পর পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে পুরাতন প্রশাসন বিভাগ ব্যবস্থা মূলত অপরিবর্তিত থেকে যায়। সেখানে এমনকিছু শহর ছিল যেগুলো অতীতে প্রাদেশিক কেন্দ্র ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারি প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়েছিল
খ. অর্থনৈতিক বৈষম্য : অর্থনেতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রেও পাহাড়সম ব্যবধান লক্ষণীয় । যা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :
১. অর্থনৈতিক অবকাঠামো : দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬% জনসমষ্টি পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করলেও সেখানে জাতীয় সম্পদের ৭৫% বরাদ্দ করার ফলে ঐ অঞ্চলে একদিকে যেমন আয় বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি কর্মসংস্থানও বেড়ে যায়।
২. আঞ্চলিক বিনিয়োগ : পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫০ এর দশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট বিনিয়োগের ২১%-২৬% । ১৯৬০ এর দশকে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২%-৩৬% । অন্যদিকে, রাজস্ব ও উন্নয়ন খাত মিলে পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয় প্রথম দশকে ৭৪%-৭৯% এবং দ্বিতীয় দশকে ৬৪%-৬৮%।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
৩. মাথাপিছু গড় আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য : তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয়ে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান ছিল ১৯৬৪-৬৫ অর্থ বছরে পূর্ব পকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২৮১ টাকা। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৪১২ টাকা। যা ব্যাপক বৈষম্যের প্রত্যক্ষ ফলাফল।
৪. শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদনের হার ছিল মোট উৎপাদনের ৯.৪% এবং ১৯৬৯–’৭০ সালে তা উন্নীত হয় ২০%-এ। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়িত খাত ১৯৪৯-৫০ সালে ১৪.৭% থাকলেও ১৯৬৯-‘৭০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশে। শিল্প ক্ষেত্রের বৈষম্যও উল্লেখযোগ্য।
গ. রাজনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের যাত্রা শুরুর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলা ভীষণ রকমের রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম যে রাজনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির প্রয়াস নেওয়া হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বানচাল ও ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার মধ্য দিয়ে তা একটি রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়।
ঘ. শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য : পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল । কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের পরের দুই দশকে (১৯৪৭–৬৭) পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
কারণ এসময়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমেছে, আর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় চারগুণ। শুধু যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগত বৈষম্য ছিল তা নয়; বরং দুই পাকিস্তানের শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দেও বিপুল বৈষম্য বিরাজমান ছিল।
ঙ. সাংস্কৃতিক বৈষম্য : সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য বৈষম্যগুলো নিম্নরূপ :
১. ভাষাগত দ্বন্দ্ব যোগাযোগের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে কোনো সাধারণ ভাষা ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানে অপরিচিত ছিল। অপরপক্ষে, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট ভাষা উর্দুতে কথা বলার মতো মানুষ ছিল খুবই কম ।
২. সাংস্কৃতিক দূরত্বের ব্যাপকতা : শুধু যে ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তানের দুটি অংশ ভিন্ন অবস্থানে ছিল তা নয়, দুই অংশের জনগণের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল ব্যাপক সাংস্কৃতিক দূরত্ব। তাদের ভাষা ছিল স্বতন্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল ভিন্ন । তাদের আহার্যও ছিল ভিন্ন। এমনকি তাদের চেহারাও ভিন্ন ছিল।
৩. উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা : তৎকালীন পাকিস্তানের ৫৬.৪% লোকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা।
কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে ২১ মার্চ ১৯৪৮ সালের জনসভায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে পাকিস্তানের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেন।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)(পর্ব-৩)*
ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রসমাজের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে হত্যা করা যায়।
৪. বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় প্রতিবন্ধকতা : ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে রোমান হরফে বাংলা লেখার জন্য ‘ভাষা সংস্কার কমিটি’ গঠন করেন এবং এর অব্যবহিত পরে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালে বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথেই শাসনকারী এলিটশ্রেণি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সংগত দাবিসমূহ বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রত্যয়সমূহের প্রতি কোনোরূপ সম্মান প্রদর্শন করেনি।
সর্বক্ষেত্রেই তাদের নীতি ছিল শোষণ ও দমনমূলক এর ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একসময় তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দেয়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।