অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ এর সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয়: অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস ও উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৪৭
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
২.০১ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব, বিকাশ ও এর ফলাফল ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে প্রধানত দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। একটি হিন্দু অপরটি মুসলিম। ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় ছিল।
কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হলে তা নষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে বৈষম্য দেখা দেয়। হিন্দু ও মুসলমানরা ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যায়। তারা একে অন্যের পরিপূরক না ভেবে শত্রু ভাবা আরম্ভ করে । ফলে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িক – মনোভাব।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিকাশের কারণ : নিম্নে ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতা উদ্ভব ও বিকাশের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. ব্রিটিশদের চক্রান্ত : ভারতে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির পিছনে বিশেষভাবে দায়ী ব্রিটিশদের চক্রান্ত। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটলে ইংরেজরা ভারতবর্ষে মুসলমান সম্প্রদায়কে ভিন্ন। দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করে। কেননা তারা মনে করতো যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একমাত্র মুসলমানরাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
তাই মুসলমানদেরকে পিছনে রেখে ব্রিটিশরা হিন্দুদেরকে সহায়তা দিতে থাকে যা হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ঘটিয়ে সম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষাপটকে প্রশস্ত করে।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
২. মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে বৈষম্য : ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয় তা সাম্প্রদায়িকতার পিছনে ইন্ধন জোগায়। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে যে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চা গড়ে তুলেছিল হিন্দুরা তা গ্রহণ করলেও মুসলমানরা তা সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।
যার ফলে সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে অফিস, আদালত, ব্যবসা বাণিজ্যে হিন্দুরা একতরফাভাবে এগিয়ে যায়। মুসলমানরা এসব প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যার ফলে মুসলমানরা হিন্দুদেরকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। যা সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয় ।
৩. ধর্মভিত্তিক সংগঠন : ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনামলে বেশকিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল, যা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে। যেমন— ১৮৩৭ সালে বেনারসের হিন্দুরা উর্দু’ ভাষার পরিবর্তে ‘হিন্দি ভাষার প্রচলনের জন্য আন্দোলন করেন।
এতে মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হয় তাছাড়া একই বছর নবগোপাল মিত্র ‘হিন্দুমেলা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এটি ছাড়াও এসময় হিন্দুদের কিছু ধর্মীয় সংগঠন জনপ্রিয়তা লাভ করে, যা সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়।
৪. কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা : ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক সমস্যা আরও বে ঘনীভূত হয়ে ওঠে। কেননা মুসলমানগণ লক্ষ করল যে, কংগ্রেস একটি হিন্দুপ্রধান রাজনৈতিক দল। এর বেশির ভাগ সদরে ছিল হিন্দু। তাছাড়া এসময় ভারতে উর্দু-হিন্দি বিরোধ সৃষ্টি হয় এককথায় কংগ্রেসের সকল সিদ্ধান্ত ছিল মুসলিম বিরোধী।
এতে মুসলমানরা ক্ষুব্ধ হন এবং নিজেরাও বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন গড়ে তোলায় উদ্যোগী হন ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
৫. ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ : ১৯০৫ সালে মুসলমানদেরকে কিছু সুবিধা দিয়ে ব্রিটিশরা বঙ্গকে বিভক্ত করেন। কিন্তু এটি ছিল মূলত ব্রিটিশদের ভাগ কর ও শাসন কর নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।
হিন্দুরা মুসলিম সুবিধা সংবলিত এ বঙ্গভঙ্গকে মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে আর হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে, যা সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়।
৬. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা : ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক সংগঠন যার কারণে এর সকল সদস্যই ছিল মুসলমান। তারা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় কর্মসূচি গ্রহণ করে। হিন্দুরা এতে অসন্তুষ্ট হয়। তারা জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করে।
যার ফলে হিন্দু-মুসলমানদের বৈরিতা চরম আকার ধারণ করে সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার ফলাফল : নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার ফলাফল আলোচনা করা হলো :
১. দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব : কংগ্রেস ১৯৩৭ সালের জুন মাসে ৬টি প্রদেশে এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করে। কংগ্রেস শাসিত প্রাদেশিক সরকারগুলো সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করে। আইন-আদালত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কংগ্রেসি পতাকা উত্তোলন ও বন্দেমাতরম সংগীত গাইবার ব্যবস্থা করা হয়।
এর ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়। এ ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় হিন্দু-মুসলিম স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় মুসলমান নেতৃবৃন্দ নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এসময় তার ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ (ঞড়ি ঘধঃরড়হং ঞযবড়ৎু) উপস্থাপন করেন ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
২. কলকাতায় দাঙ্গা সৃষ্টি : ১৯১১ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ হওয়ার পর গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ব্রিটিশ ভারতের বৈদেশিক বা রাষ্ট্রিক জাতীয়তা গড়ে তোলার প্রয়াস চালাচ্ছিল। তিনি খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করে হিন্দু-মুসলিম সংহতি অসহযোগ আন্দোলন করে দৃঢ় করতে চাইলেন ।
কিন্তু আগে থেকে বিচলিত ব্রিটিশ সরকার বিভেদনীতির প্রয়োগ তীব্রতর করে তোলে ফলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধে ময়মনসিংহে ১৯০৬-০৭ সালে ও কলকাতা-পাবনা-ঢাকায় দাঙ্গা বাধে ১৯১৯-১৯২৬ সালের পরিসরে। পটুয়াখালী, পোনাবালিয়া, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও চট্টগ্রামে দাঙ্গা বাধে ১৯২৭ ১৯৩১ সালের মধ্যকার বিভিন্ন সময়ে।
ঢাকার দাঙ্গা ১৯৪১ থেকে চলতেই থাকে নওয়াবপুর ও ইসলামপুরে । এগুলোর মধ্যে ১৯২৬ সালের ও ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গা ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ।
৩. ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব : ব্রিটিশ সরকার এ পর্যায়ে শেষদিকে উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয় ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
৪. দেশত্যাগ : ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে শেষাবধি লাভবান হয় পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলিমরা, আর উত্তর প্রদেশ এবং আংশিকভাবে মধ্য প্রদেশ ও বিহারের হিন্দুরা।
উপমহাদেশের সুবৃহৎ অন্যান্য অংশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবনে নেমে এসেছে জানমালের অনিশ্চয়তা। মুসলমানরা ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানে এবং হিন্দুরা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সাম্প্রদায়িক সমস্যা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের দ্বারা সৃষ্ট একটি সমস্যা। ব্রিটিশরা সুকৌশলে ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করার জন্য হিন্দু ও মুসলমানদেরকে উভয়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। যার ফলে এতদিন একসাথে বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলমানগণ একে অপরের শত্রু ভাবতে থাকে ।
পরবর্তীতে নানা কারণে এ সাম্প্রদায়িকতা তীব্র আকার ধারণ করে, যা শেষ পর্যন্ত অখণ্ড ভারতবর্ষকে খণ্ডিত করে ফেলে। পরবর্তীতে হিন্দু আর মুসলমানরা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটি জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে আসীন হয় ।
২.০২. বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কারণ ও প্রভাব আলোচনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর লর্ড কার্জন শাসনকার্যের সুবিধার জন্য পূর্ববঙ্গ ও আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গ নামে দুটি প্রদেশ গঠন করেন। অবশ্য ১৯০৫ সালের পূর্বেও বঙ্গভঙ্গের সুপারিশ করা হয়েছিল ।
সেই সুপারিশ অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও আসামকে নিয়ে পূর্ববাংলা প্রদেশ গঠন করা হয় যার রাজধানী করা হয় ঢাকাকে । – বঙ্গভঙ্গের কারণ : বঙ্গভঙ্গের পিছনে অসংখ্য কারণ ছিল । নিম্নে বঙ্গভঙ্গের কারণসমূহ বর্ণনা করা হলো :
১. প্রশাসনিক : বঙ্গকে বিভক্ত করার প্রশাসনিক যুক্তি দেখিয়ে ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন ভারত সচিবকে লেখেন যে, বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ২,০০,০০০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা প্রায় ৭কোটি ৮৫ লক্ষ। এ বিশাল আয়তন এবং বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাকে একজন প্রশাসকের পক্ষে সুচারুরূপে শাসন করা সম্ভব নয়।
পক্ষান্তরে, প্রতিবেশি আসাম প্রদেশ ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং জনসংখ্যাও ছিল কম। এজন্য বাংলাকে বিভক্ত করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিভাগ ও আসামকে নিয়ে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশের সৃষ্টি করা হয় যার রাজধানী হয় প্রাচীন শহর ঢাকা ।
২. রাজনৈতিক : বাংলাকে বিভক্ত করার পশ্চাতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হলো :
ক. জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ : ১৮৮৫ সালে ভারতদরদি ইংরেজ স্যার অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউমের নিরলস প্রচেষ্টায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হমৎবংং) প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতের হিন্দুসমাজ সচেতন হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। এতে ব্রিটিশ সরকার হতচকিত হয়ে প্রশাসনিক সংকটে পড়ে যায়।
এরূপ জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় ।
খ. ভাগ কর ও শাসন কর : ব্রিটিশ সরকার উরারফব ধহফ জঁষব নীতিতে বিশ্বাসী। তাই বাংলাকে বিভক্ত করে একটি সম্প্রদায়কে নিজেদের অনুকূলে রেখে অপর সম্প্রদায়কে শাসন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
গ. মুসলমানদের উন্নতির প্রয়াস : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমান সামন্তশ্রোণ মুসলমানদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। অপরদিকে, স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালান। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের স্বার্থ সম্বন্ধে সচকিত হয়ে ওঠে।
৩. অর্থনৈতিক কারণ : তৎকালে বাংলা প্রেসিডেন্সির (বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার ও ছোট নাগপুর) রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। পূর্ববাংলায় পাট উৎপন্ন হলেও পাটকলগুলো গড়ে ওঠে কলকাতায়।
ফলে কলকাতা অল্পদিনে সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হতে থাকে। এরূপ অবস্থার হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব মি. রিজলি প্রশাসনিক ও রাজস্ব আদায়ের সমস্যার কথা উল্লেখ করে বড়লাটকে পত্র লিখেন । উক্ত পত্রের যৌক্তিকতা বিচার করে বাংলা ভাগ করা হয় ।
৪. সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক কারণ : হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ নিজেদের সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে নতুন প্রদেশে সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যাশা করে।
বঙ্গভঙ্গের ফলাফল : বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সাময়িক হলেও বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় বেশি লাভবান হয়েছিল নিম্নে বঙ্গভঙ্গের ফলাফল আলোচনা করা হলো :
১. মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া : বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা নতুন প্রদেশের তথা ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’-এর রাজধানী হয় । রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে মুসলমানগণ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা লাভে সক্ষম হয়। অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বড় বড় সুরম্য অট্টালিকা গড়ে ওঠায় ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
বঙ্গভঙ্গকে মুসলমানগণ তাদের হৃত গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাটি কার্যকর করার দিন ঢাকায় এক জনসভায় বলেন, “বঙ্গভঙ্গ আমাদেরকে নিষ্ক্রিয়তার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে।
এটা আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে কর্মসাধনায় এবং সংগ্রামে।” অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববাংলার গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয় ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
২. হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অবস্থান ছিল খুবই কঠোর। বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুরাই এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঝড় তুলেছিল । কলকাতার আইনজীবী সমিতি মনে করল বঙ্গভঙ্গের অর্থ নতুন প্রদেশে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা। অপরদিকে, কলকাতার সাংবাদিকরাও তাদের স্বার্থ নস্যাৎ হবে জেনে এর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।
পশ্চিমা শিক্ষিত হিন্দুসমাজ মনে করে যে, পূর্ববাংলায় ক্রমোন্নতিশীল শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন হিন্দুসমাজের বিকাশ রোধের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ব্রিটিশ সরকার পূর্ববাংলার মুসলমানদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য এ ব্যবস্থা নিয়েছে।
কাশিম বাজারের এক জনসভায় সভাপতি মহারাজা মহীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেন, “নয়া প্রদেশে এ মুসলমান জনগণের রাজত্ব হবে বাঙালি হিন্দুরা হয়ে পড়বে সংখ্যালঘু। আমরা নিজেদের মাটিতে আগন্তুক হয়ে পড়ব। এ সম্ভাবনায় আমি আতঙ্কিত। এ সম্ভাবনা আমাকে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগাকুল করে তোলে।”
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি রচনামূলক প্রশ্নোত্তর সাজেশন
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর সাজেশন
৩. মুসলিম লীগের জন্ম : ১৯০৬ সালে কতিপয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের দাবিদাওয়া পেশ করার জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। পরবর্তীতে ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি স্বীকৃত হলে হিন্দু সম্প্রদায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের গণমানুষের মনে এক নতুন আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। ঢাকা নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় নতুন অফিস, আদালত ও সুরম্য অট্টালিকা গড়ে ওঠে এবং ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদী মহল ও বর্ণবাদী হিন্দুরা এটি মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়।
২.০৩. ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির ইতিহাসে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চের ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ দিন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানিয়ে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হয় ।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব : ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সম্মেলনে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক যে প্রস্তাব পেশ করেন, তাই হচ্ছে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব।
লাহোর অধিবেশনে এ প্রস্তাব গৃহীত হয় বলে একে লাহোর প্রস্তাব বলা হয়। লাহোর প্রস্তাব ছিল মূলত ভারতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য মুসলিম লীগের প্রথম গঠনমূলক প্রস্তাবনা ।
নিম্নে লাহোর প্রস্তাব সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো :
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
ক. ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করলেও আইনসভায় এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করতে ব্যর্থ হয়। তাই মুসলিম লীগ বাধ্য হয়ে কংগ্রেসের সাথে যুক্তভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দিলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে।
শুধুমাত্র বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনের পর নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে । এ অবস্থায় মুসলমানদের অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়ে। এমনকি মুসলমানদের ধর্মীয় কাজে পর্যন্ত বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
কংগ্রেসের রাজত্বকালে মুসলমানদের এ ধারণা জন্মে যে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কখনও সম্ভব নয়। এরই পটভূমিতে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বাংলার কৃতী সন্তান শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
খ. লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখযোগ্য ধারা : ১৯৪০ সালে প্রবর্তিত লাহোর প্রস্তাবের প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ অধিবেশনের সুনিশ্চিত অভিমত এই যে, কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকর করা যাবে না বা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদিও তা নিম্নরূপ মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয় :
র. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসমূহকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে; এসব অঞ্চলকে প্রয়োজনমতো সীমা পরিবর্তন করে এমনভাবে
রর. গঠন করতে হবে যাতে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যেসব স্থানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং
ররর. স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম প্রকৃতির ।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, “এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে যথোপযুক্ত কার্যকর ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে করতে হবে।
ভারতবর্ষে মুসলমানগণ যেসব স্থানে সংখ্যালঘু সেসব স্থানে তাদের ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে যথার্থ কার্যকর ও বাধ্যতামূলক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকতে হবে।”
এছাড়াও লাহোর প্রস্তাবে আরও বলা হয়, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও প্রয়োজনমতো অন্যান্য বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
গ. লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব : নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক গুরুত্ব : লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার উদ্ভব ঘটায়। এতদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে দুটি রাজনৈতিক দল থাকলেও সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো একপক্ষীয়ভাবে কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের রাজনীতি সমানভাবে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যার ফলে রাজনীতি নতুন ধারায় প্রবাহিত হয়।
২. মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়। এতদিন হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পর মিলেমিশে চলত এবং নিজেদেরকে একই জাতীয়তাবোধের অধীন বলে মনে করতো।
কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুসলিম ঐক্যবোধের সূত্রে আবদ্ধ হয় এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করে।
৩. মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এতদিন অনেক মুসলমান কংগ্রেসের অধীনস্থ ছিল কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানদের নিকট ‘কংগ্রেস হিন্দুদের দল’ এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে মুসলমানরা মুসলিম লীগের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ।
৪. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের প্রভাব : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। কেননা এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ মোট ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮টি আসন লাভ করে।
অথচ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের আগে মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাত্র ১০৯টি আসন লাভ করে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
৫. পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সকল বন্ধনকে ছিন্ন করে ও সমস্ত বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যার ফলে লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাস্তব রূপ লাভ করে। মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যতা লাভ করে।
৬. স্বাধীন বাংলার বীজ বপন : লাহোর প্রস্তাবই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিল। কেননা লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে পরবর্তীকালে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একাধিক জায়গায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয় ।
কিন্তু বাংলার মুসলমানরা সর্বদাই লাহোর প্রস্তাবের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন করতে থাকে । নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এটি সহজেই প্রতীয়মান হয় বাংলার স্বাধীনতা অনেকাংশে লাহোর প্রস্তাবেরই ফল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন এর উপস্থাপক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আর এ প্রস্তাবের মধ্যেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির বীজ নিহিত ছিল।
২.০৪. লাহোর প্রস্তাবের কারণ আলোচনা কর ।
অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে লাহোর প্রস্তাবের পিছনে অসংখ্য যৌক্তিক কারণ বিদ্যমান ছিল। মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বায়ত্তশাসন লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ।
লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পিছনে বিভিন্ন কারণ ছিল ।
লাহোর প্রস্তাবের কারণ : একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে লাহোর প্রস্তাবের পিছনে অসংখ্য যৌক্তিক কারণ বিদ্যমান ছিল। নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের কারণসমূহ বর্ণনা করা হলো :
১. ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা : ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্রিটিশরা মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করে । ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দেয় ।
১৯০৯ সালে ইংল্যান্ডের হাউস অব লর্ডসে লর্ড মর্লি ঘোষণা করেন যে, ভারতীয় মুসলমানরা শুধুমাত্র একটি পৃথক ধর্ম অনুসরণ করে তা নয়, সামাজিক আচরণ ও জীবনযাত্রার দিক দিয়ে পৃথক জাতির সমতুল্য ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
২. স্যার সৈয়দ আহমদের অবদান : স্যার সৈয়দ আহমদ খান উনিশ শতকের শেষদিকে ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপন করেন। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, ভারতে দুটি ভিন্ন জাতি বসবাস করে। সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব এখান থেকেই মূলত শুরু হয়। যে কারণে তিনি হিন্দু প্রভাবিত কংগ্রেস মুসলমানদের যোগ দিতে নিষেধ করেন।
৩. লক্ষ্ণৌ চুক্তি ও জিন্নাহর চৌদ্দ দফা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪ ১৯১৯) সময় ও পরে মুসলমানরা স্বতন্ত্র নির্বাচন দাবি করে। আসছিল । লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬) ও জিন্নাহর চৌদ্দ দফা (১৯২৯) দাবিতে এর প্রতিফলন ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উলামা সম্প্রদায়ের রাজনীতিতে প্রভাব মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাকে আরও চাঙ্গা করে। ফলে মুসলমানদের একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য লাহোর প্রস্তাব পেশ করা হয়।
৪. নেহেরু রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া : সকল রাজনৈতিক দল ও সমস্ত দলের প্রতিনিধি নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সংবিধানিক সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ১৯২৮ সালে নেহেরু রিপোর্টের কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে মুসলমানদের যে স্বার্থ ছিল তা সংরক্ষণের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাদি অস্বীকার করেই সুপারিশ প্রণয়ন করে।
আর এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় মুসলিম নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার পরিবর্তন দেখা দেয়।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
৫. উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ : ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে যখন কংগ্রেসের সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেন যে, “ভারতে দুটি শক্তির অস্তিত্ব লক্ষণীয়।” একটি হলো সরকার এবং অপরটি হলো কংগ্রেস দল।
তার একথা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, অন্য কোনো দলের বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব তিনি এবং কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ও মহাত্মা গান্ধী কেউ স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। আর তাদের এ সংকীর্ণ মনোভাব মুসলমান নেতাদের মধ্যে বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাই মুসলমানদের আলাদা একটি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পরোক্ষ ইচ্ছাও তাদের মধ্যে ছিল ।
৬. মুসলিম চিন্তাবিদদের স্বপ্ন : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে যে স্বাধীন মুসলিম আবাসভূমির দাবি করা হয় অনূরূপ একটি প্রস্তাব ১৯৩০ সালে মহাকবি আল্লামা ইকবাল এলাহাবাদে তার একটি ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একত্রিত হতে আহ্বান জানান।
আর তিনি এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উত্তর-পশ্চিম ভারতে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন । তিন বছর পর ১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫টি মুসলিম এলাকার জন্য পাকিস্তান নামের উদ্ভাবন করেন।
কিন্তু তখনও অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন নেতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য পৃথক কোনো রাষ্ট্রের কথা ভাবেননি। পরে অবশ্য কংগ্রেস সভাপতি নেহেরু গভীরভাবে তাকে এ বিষয়ে ভাবতে প্ররোচিত করেন।
৭. ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন : ১৯৩৫ সালে প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন ভারতীয় জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এজন্য এ আইনের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয়ে অবস্থান নেয়। যার ফলে আইনগুলো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে এ আইনগুলো শুধু প্রদেশে বাস্তবায়ন করা হয়।
এ আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগে মুসলমানরা নির্যাতিত-নিগৃহীত হতে থাকে। তারা বুঝতে পারে এ আইনে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না। তাই মুসলিম নেতৃবৃন্দ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের চিন্তা করতে থাকেন।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
৮. ১৯৩৭ সালের নির্বাচন ও মুসলিম স্বার্থবিরোধী নীতি গ্রহণ : ১৯৩৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে কংগ্রেস অধিকাংশ প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মুসলিম লীগ বাংলা ও পাঞ্জাবে উল্লেখযোগ্য আসন পায় এবং সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে।
মাদ্রাজ, যুক্ত প্রদেশ, সীমান্ত প্রদেশ, বুম্বাই ও আসামে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে মুসলিম লীগের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করে। তারা দলীয় পতাকা উত্তোলন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দে মাতরম জাতীয় সংগীত, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দি চালু করে।
এসময়ে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে, ভারতে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জিন্নাহ নিজেও কংগ্রেস শাসনকে হিন্দু শাসনের নামান্তর বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া তিনি বলেন, কংগ্রেস জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে ভারতে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর । এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালে উত্থাপিত হয় ।
৯. জিন্নাহ কর্তৃক দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা : ১৯৪০ সালের ২২-২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভারত সরকারের যুদ্ধনীতির প্রতি মুসলিম লীগের নীতিনির্ধারণের জন্য অধিবেশন ডাকা হয় ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১ *
মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ এসময় দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা করেন। তিনি দুটি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যাখ্যা করে বলেন ভারতের সমস্যা আন্তঃসাম্প্রদায়িক ধরনের নয়, দৃশ্যত এ সমস্যা হলো আন্তর্জাতিক। আমাদের প্রধান পথ হলো জাতিগুলোকে মাতৃভূমি গঠনে সহায়তা করে ভারতকে দুটি স্বশাসিত জাতীয় রাষ্ট্রে বিভক্ত করা।
দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে কংগ্রেস হিন্দু রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোষণা ভারতের মুসলমানদের চেতনায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেয়। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বা স্বাধীনতার স্বপ্ন তাদেরকে জাগিয়ে তোলে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মুসলমানদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, অসহিষ্ণু মনোভাব, একতরফা সিদ্ধান্ত ইত্যাদি কারণে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
এসব কারণে এককথায় বলা যায় ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব যথাযথ কারণেই যথাসময়ে উত্থাপন করা হয়েছে। মূলত লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। মুসলমানরা তাদের আলাদা আবাসভূমির স্বপ্ন দেখতে থাকে।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।