অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF) ও অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF) সহ শিক্ষমূলক সকল বিষয় পাবে এখান থেকে: অধ্যায় ৫.২ : এরিস্টটল, এর অতিসংক্ষিপ্ত, প্রশ্নোত্তর,সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ও রচনামূলক প্রশ্নোত্তর, সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF)
অনার্স প্রথম বর্ষ
বিষয়ঃ রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি
অধ্যায় ৫.২ : এরিস্টটল
বিষয় কোডঃ ২১১৯০৯
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নোত্তর
০৭. আধুনিক যুগে এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্লেষণ কর ।
অথবা, এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগ বর্তমান যুগে কতটুকু প্রযোজ্য? আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল তার কালজয়ী গ্রন্থ ”The Politics’ এ সংবিধান বা সরকার সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন । তার মতে, সংবিধান বা সরকার হচ্ছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদ বা দপ্তরের বণ্টন, সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান এবং রাজনৈতিক সংঘের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার এক সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা।
মূলত সরকারের শ্রেণিবিভাগ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। এরিস্টটল সরকার বলতে রাষ্ট্রের শাসন ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গঠিত সার্বভৌম সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়েছেন ।
আধুনিক যুগে এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগের গ্রহণযোগ্যতা : এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগ সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং আধুনিক যুগেও বহুল পরিচিত।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এ শ্রেণিবিভাগ বর্তমানকালে গ্রহণযোগ্য কি না তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। কেননা বর্তমানকালে সরকারের রূপের পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক যুগে এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগের গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
১. অনুপযোগী : এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগ বর্তমানে অচল ও অনুপযোগী বলেই প্রমাণিত হয়েছে। কেননা আধুনিককালে সরকারের রূপ ও প্রকৃতির অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
এরিস্টটলের সরকারের রূপরেখা পরিবর্তন, পরিবর্ধন প্রতিফলিত হয়নি। আধুনিক সরকারের স্বরূপ ও প্রকৃতি এতই মিশ্র যে, এদেরকে এরিস্টটলের শ্রেণিবিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা আদৌ সম্ভব নয়।
২. অস্পষ্ট : এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগ নিতান্তই অস্পষ্ট । তিনি রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্য যে পার্থক্য করেছেন তা অত্যন্ত অস্পষ্ট। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট।
তিনি তৎকালীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোকে সম্মুখে রেখে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের আকার আয়তন পরিবেশ বৃহৎ। তাই তার মতামত বর্তমান যুগের সাথে খাপ খায় না।
- আরো পড়ুন:- (ফ্রি PDF) অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর
- আরো পড়ুন:-অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF)
- আরো পড়ুন:-অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF)
- আরো পড়ুন:- অনার্স: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি‘এরিস্টটল অতিসংক্ষিপ্ত PDF
- আরো পড়ুন:- প্লেটো রচনামূলক প্রশ্নোত্তর রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি PDF
- আরো পড়ুন:- রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, প্লেটো রচনামূলক প্রশ্নোত্তর PDF
- আরো পড়ুন:- প্লেটো: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, রচনামূলক প্রশ্নোত্তর PDF
- আরো পড়ুন:-অনার্স: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (PDFফ্রি)
৩. গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা : এরিস্টটল শাসনব্যবস্থার বিকৃত রূপকে গণতন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন এবং নিকৃষ্টতম সরকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু বর্তমানে নানা ধরনের দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র আজকাল আদর্শ শাসনব্যবস্থা। এদিক থেকে বিচার করলে এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগ বর্তমানে অচল ।
৪. রাজতন্ত্রের শাসন : এরিস্টটল মনে করেন রাজতন্ত্র উৎকৃষ্ট সরকার ব্যবস্থা। কিন্তু আধুনিক যুগে বংশানুক্রমিক রাজার শাসন কোথাও দেখা যায় না। তবে রাজতন্ত্র থাকলেও তা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীন। অর্থাৎ আধুনিক যুগে রাজতন্ত্র বিলোপ সাধিত হয়েছে।
৫. দৈবতন্ত্রের ধারণা অস্পষ্ট : দৈবতন্ত্র নামে যে আরেকটি সরকার হতে পারে সে সম্পর্কে এরিস্টটলের কোনো ধারণা ছিল না। যদিও মধ্যযুগ ও প্রাচীনযুগে দৈবতন্ত্রের প্রভাব ছিল ।
৬. যান্ত্রিক শ্রেণিবিন্যাস : এরিস্টটল তার সরকারের শ্রেণিবিন্যাসে সংখ্যানীতির ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। ফলে তা যান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করেছে, যা আধুনিক সরকারের শ্রেণিবিন্যাস ক্ষেত্রে তাৎপর্য হারিয়েছে।
৭. বিজ্ঞানসম্মত নয় : এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগে গুণগত দিক উপেক্ষিত হওয়ায় তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাছাড়া তার এ শ্রেণিবিভাগ এক প্রকার যান্ত্রিক শ্রেণিবিভাগে পরিণত হয়েছে যা বর্তমান যুগে প্রযোজ্য নয়।
৮. পলিটি সম্পর্কে ধারণা : এরিস্টটল তার সরকারের শ্রেণিবিভাগে পলিটিকে সর্বাপেক্ষা বাস্তবসম্মত সরকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এ ধরনের সরকার বর্তমান যুগে পাওয়া কঠিন ।
৯. সমাজতান্ত্রিক ধারণা অস্পষ্ট : এরিস্টটলের শ্রেণিবিভাগ অনুসারে গণতন্ত্র যেহেতু দরিদ্র ব্যক্তিবর্গের স্বার্থ রক্ষার্থে পরিচালিত সেহেতু এটি নিকৃষ্টতম। কিন্তু আধুনিককালে বিত্তবানদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রেণিহীন সমাজ কায়েম করা সমাজতন্ত্রীদের একমাত্র লক্ষ্য। এরিস্টটলের চিন্তায় দরিদ্র শ্রেণিহীন সমাজের ধারণা স্থান পায়নি ।
১০. সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা : বর্তমানকালের রাষ্ট্রব্যবস্থা হলো জাতীয় রাষ্ট্র। তাই তার শ্রেণিবিভাগ নগররাষ্ট্রের জন্য কার্যকর হলেও জাতীয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা অসম্ভব। এরূপ শ্রেণিবিভাগ জাতীয় রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট ছকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে।
১১. সমন্বয়ের ধারণা অস্পষ্ট : এরিস্টটল তার সরকারের যে শ্রেণিবিভাগ করেছেন তাতে শুদ্ধরূপ ও বিকৃতরূপের মতো পরস্পরবিরোধী দুটি শ্রেণিই দেখেছেন। এ দুয়ের মধ্য সমন্বয়ের কথা তিনি চিন্তাও করেননি ।
১২. জটিল ও কঠিন : সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান হিসেবে সরকারের শ্রেণি বিভাগ জটিল ও অস্পষ্ট। কেননা সেকালেও অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের কোথায় যে শাসনব্যবস্থার অবস্থান ছিল তা বলা কঠিন । কারণ অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল তা অত্যন্ত কঠিন।
১৩. পরিবর্তনশীল ও যুগোপযোগী নয় : আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এরিস্টটলের শ্রেণিবিভাগ প্রায় অচল। কেননা আধুনিক কালে সরকারের স্বরূপ ও প্রকৃতির যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আধুনিক সরকারের সাথে এবং যুগের সাথে সাদৃশ্য না থাকায় তার শ্রেণিবিন্যাস অলীক ও অবাস্তবরূপে পরিণত হয়।
মূল্যায়ন বিখ্যাত রাষ্ট্রদার্শনিক এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগ তার সময়ে ব্যাপক গুরুত্ব বহন করতো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে রাষ্ট্রে সরকারের রূপ ও কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাই এরিস্টটলের সরকারের শ্রেণিবিভাগ বর্তমান যুগে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য নয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এরিস্টটলের শ্রেণিবিন্যাস বর্তমানকালে গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা তিনি মূলত তৎকালীন গ্রিক নগররাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে তার সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছিলেন।
যা বর্তমান বৃহৎ জাতীয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অনুপযোগী ও অকার্যকর। এরিস্টটল তার সরকারের শ্রেণিবিভাগে দরিদ্র শ্রেণির কল্যাণের কথা না বলে অভিজাত শ্রেণির কথাই বেশি চিন্তা করেছেন। তাই তার শ্রেণিবিন্যাস বর্তমান যুগে অপ্রযোজ্য ও ব্যর্থ ।
০৮. এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।
অথবা, এরিস্টটল কীভাবে সর্বোত্তম রাষ্ট্র এবং সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের প্রভেদ নির্ণয় করেছেন তা বিশ্লেষণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল সরকার, সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলির সংজ্ঞা, শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে দার্শনিক মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। এরিস্টটল শাসক শ্রেণির গুণাবলি,
সংখ্যা ও কতকগুলো উপাদানের ভিত্তিতে সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। তবে উভয়ের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয়ের পূর্বে উভয় রাষ্ট্র সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক।
সর্বোত্তম রাষ্ট্র : এরিস্টটলের মতে, রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রই সর্বোত্তম রাষ্ট্র। কারণ এতে কয়েকজন গুণীজ্ঞানী, শিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করা হয়।
আর এ ধরনের আইনের সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক প্রশাসন জনগণের সার্বিক কল্যাণসাধন করতে পারে এবং তার আদর্শে জনগণের লক্ষ্যচ্যুত হয় না। এ থেকে বুঝা যায় গ্রিক রাষ্ট্র চিন্তাবিদরা সর্বদা প্রজ্ঞাবানদের শাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের জন্য যে সৎ গুণাবলি ও শর্তাদি প্রয়োজন বাস্তবে তা অতি দুষ্কর।
সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র : এরিস্টটল বলেন, প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে সাধারণত তিন শ্রেণির জনসাধারণ দেখতে পাওয়া যায়। এরা হলো ধনী, গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরিস্টটল পলিটি বা মধ্যবিত্তের শাসনকে সর্বোত্তম ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সরকার বলে উল্লেখ করেছেন।
তার মতে, শাসন ক্ষমতা যদি ধনীদের হাতে ন্যস্ত থাকে, তবে তারা গরিবদেরকে শোষণ করবে এবং গরিবরা আরও গরিব হবে। আবার শাসন ক্ষমতা যদি গরিব জনসাধারণের হাতে ন্যস্ত থাকে তবে তারা বিত্তবানদের সম্পদ লুটে নেওয়ার চেষ্টা করবে এবং এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী।
এজন্য এরিস্টটল এ দুই পরস্পর বিরোধী শ্রেণির মধ্য থেকে একমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রকে সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র বলেছেন। পলিটি বলতে এরিস্টটল এমন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা বলেছেন যারা বিদ্বান, ন্যায়নিষ্ঠ, সচ্ছল ও সর্বদিক দিয়ে সুসংহত।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে স্থায়িত্বের প্রবণতা বেশি ও জীবনযাত্রায় ঝুঁকি কম। তারা ষড়যন্ত্র অপরের সম্পত্তি কখনও গ্রাস করে না। এ জন্য তিনি পলিটিকেই সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছেন।
সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য : এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের পার্থক্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য : এরিস্টটলের মতে, কতিপয় সুশিক্ষিত, ন্যায়বান ও জ্ঞানীদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সর্বোত্তম রাষ্ট্র বলে। পক্ষান্তরে, যে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা মধ্যবিত্তের দ্বারা পরিচালিত হয় তাকে সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্র বলে ।
২. জীবনযাত্রার ঝুঁকি : সর্বোত্তম রাষ্ট্র যাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাদের জীবনযাত্রার ঝুঁকি বেশি থাকে। কিন্তু সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্র মধ্যবিত্তের শাসনব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। এরিস্টটলের মতে, মধ্যবিত্তরা বিদ্যান, ন্যায়নিষ্ঠ ও সচ্ছল হয়। তারা ষড়যন্ত্র করে না এবং ষড়যন্ত্রের শিকারও হয় না। এজন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি কম।
৩. আভিজাত্যের দিক থেকে পার্থক্য : মূলত অভিজাততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই হলো সর্বোত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে, সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্র হলো মধ্যতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এ রাষ্ট্রে আভিজাত্যের অস্তিত্ব তেমন পরিদৃষ্ট হয়নি।
৪. সংখ্যাগত পার্থক্য : সংখ্যাগত দিক দিয়েও উভয় প্রকার রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সর্বোত্তম রাষ্ট্রে আইন প্রণীত হয় কতিপয় ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু পলিটি বা মধ্যতন্ত্রে এ রকম কতিপয় ব্যক্তির শাসন দৃশ্যমান হয় না। এ শাসনব্যবস্থায় সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির মতামত নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়।
৫. শাসনব্যবস্থার কাঠামো : পলিটি/মধ্যতন্ত্রের সরকারকে মিশ্র প্রকৃতির সরকার বলে। কেননা এ সরকার অভিজাততন্ত্র ও ধনিকতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত হয়। কিন্তু সর্বোত্তম সরকার বলতে ধনিকতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র উভয়কেই বুঝানো হয়েছে।
৬. ভারসাম্যগত দিক থেকে পার্থক্য : সর্বোত্তম রাষ্ট্রে অভিজাত সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থগত দিক ঠিক রেখে শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্রে সমাজে সব শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা ভারসাম্য রক্ষা করে।
৭. বিপ্লব বা সংগ্রামের দিক থেকে পার্থক্য : এরিস্টটল পলিটি বা সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্রকে বিপ্লব প্রতিরোধক হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ এ রাষ্ট্রে বিপ্লবের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু সর্বোত্তম রাষ্ট্রে শাসক ও শাসিতের ভারসাম্য না থাকার দরুন বিপ্লবের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
৮. গুণগত: পার্থক্য সর্বোত্তম রাষ্ট্রে অভিজাত সম্প্রদায়ের শাসন যোগ্যতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসক হওয়ায় শাসকের গুণগত বিষয়ের তুলনায় শাসকের সংখ্যার ওপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
৯. ক্ষমতা লাভের পার্থক্য : সর্বোত্তম রাষ্ট্রে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের ষড়যন্ত্র করে না। কিন্তু সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্রে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের প্রবণতা দেখা দেয় ।
১০. জনপ্রিয়তার: ক্ষেত্রে পার্থক্য পলিটি বা মধ্যতন্ত্র আধুনিক বিশ্বের একটি গ্রহণযোগ্য ও সুচিন্তিত শাসনব্যবস্থা। এ শাসনব্যবস্থা সর্বজনস্বীকৃত ও সমাদৃত। কিন্তু সর্বোত্তম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধনী ও অভিজাতদের শাসন পরিদৃষ্ট হয়। এজন্য মধ্যতন্ত্রের জনপ্রিয়তা ধনী ও অভিজাততন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি ।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, এরিস্টটল শাসকের গুণ, ন্যায়নিষ্ঠ, সততা ও সংখ্যার ভিত্তিতে সর্বোত্তম রাষ্ট্র ও সর্বোত্তম কার্যকর রাষ্ট্রের পার্থক্য নিরূপণ করেছেন।
তিনি পলিটিকে তার আদর্শ বা সর্বোত্তম কার্যকরী রাষ্ট্রের সঠিক গঠনতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। তাই তিনি আদর্শ রাষ্ট্রে সব প্রকার জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা পরিহার করার তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি পলিটিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সংবিধান বলেও উল্লেখ করেছেন।
০৯. এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন?— ব্যাখ্যা কর।
অথবা, এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলার কারণ কী?
উত্তর : ভূমিকা : বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক জ্ঞানতাপস এরিস্টটল ছিলেন গ্রিক দর্শন ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রতত্ত্বে এরিস্টটলের অবদান ছিল অপরিসীম।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এরিস্টটলের লেখনী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। এরিস্টটলের মতবাদকে রাষ্ট্রচিন্তা থেকে বাদ দিলে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা নিঃসন্দেহে অসম্পূর্ণ থেকে যেত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে।
এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলার কারণ : এরিস্টটলের হাতে রাষ্ট্রদর্শন চরম উৎকর্ষ লাভ করে। রাষ্ট্রচিন্তায় তার অবদান ছিল সুদূরপ্রসারী। এরিস্টটলের চিন্তাধারার এমন কতকগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলো শাশ্বত মূল্যের অধিকারী এবং এগুলোই এরিস্টটলকে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিম্নে এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. বাস্তববাদী ধারণার প্রবর্তন : এরিস্টটল একজন বাস্তববাদী দার্শনিক ছিলেন তিনি মনে করেন রাষ্ট্রের শক্তি এর শাসনযন্ত্রের ওপর নির্ভর করে না; বরং নাগরিকদের নীতিবোধের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থায় বা সব শাসনব্যবস্থা কার্যকরীর জন্য তার প্রয়াস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২. আইনের শাসন চালু : এরিস্টটলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হলো নিয়মতান্ত্রিক শাসন বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এরিস্টটল আইনের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে রাষ্ট্রকে আইনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার কথা বলেন। তিনি বলেন, যেখানে আইনের শাসন অনুপস্থিত সেখানে শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না। তার এই মতামতে প্রজ্ঞার চেয়ে তিনি জনগণের সম্মিলিত মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
৩. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: এরিস্টটল মনে করতেন যে, মানুষে মানুষে অসমতা একটি প্রাকৃতিক নিয়য়। যদি এ প্রাকৃতিক নিয়ম সামাজিক আইন লঙ্ঘন করে তাহলে ব্যক্তির প্রতিভা ও দক্ষতা বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় । এজন্য তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে সমর্থন করেন ।
৪. রাজনীতির ওপর অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক প্রভাব : এরিস্টটল মনে করতেন, রাজনৈতিক জীবন ও তৎপরতা অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু যে বিভিন্নভাবে সরকারের স্বরূপ নির্ধারণ করে তা সর্বজন স্বীকৃত।
এরিস্টটল আরও বলেন, যে রাষ্ট্রের সম্পদ ও দারিদ্র্য কোনোটাই চরম নয়, সে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন অধিকতর সহজ।
৫. রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দান : এরিস্টটলই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্র হতে স্বতন্ত্র করে একটি বিজ্ঞানের পৃথক মর্যাদা প্রদান করেছেন। তিনি গ্রিক রাজনীতির অধ্যয়নে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন এবং একে বিজ্ঞানের পর্যায়ে/সমমর্যাদায় উন্নীত করেন। এরিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
৬. রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিরূপণ : এরিস্টটলের মতে, নাগরিকদের জন্য উন্নততর এবং কল্যাণকর জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করাই রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এছাড়া জ্ঞানের ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ ও নৈতিক চরিত্রের উন্নতি সাধন করাও রাষ্ট্রের লক্ষ্য।
৭. গণতন্ত্রকে সমর্থন : এরিস্টটল যদিও গণতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি দেননি তবুও এক অর্থে তিনি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রণয়নের ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় জ্ঞানী লোকের প্রজ্ঞার চেয়ে তিনি জনগণের সম্মিলিত মতামতকে গুরুত্ব দেন ।
৮. মধ্যবিত্তের শাসন প্রতিষ্ঠা : সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেন এরিস্টটল। তিনি মধ্যতন্ত্র বা পলিটিকে সর্বাপেক্ষা বাস্তবসম্মত শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন তার মতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধনীর উগ্র স্বভাব ও দরিদ্রের প্রতি অবহেলার মনোভাব থেকে মুক্ত। ধনী ও দরিদ্রের সমন্বয় সাধনকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতেই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা প্ৰদান করার কথা বলেছেন।
৯. মানবকল্যাণে রাষ্ট্র : এরিস্টটল রাষ্ট্রকে একটি মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি এর যৌক্তিকতা প্ৰদৰ্শন করে বলেন, রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলো জনগণকে মহৎ ও উন্নত জীবনযাপনে সাহায্য করা।
১০. শ্রেণিসংগ্রামের ধারণা : এরিস্টটল তার চিন্তাধারায় হেগেলীয় মতাদর্শ, মার্কসীয় অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বীজ নিহিত ছিল। তিনি শ্রেণিসংগ্রাম অর্থাৎ ধনী-দরিদ্রের মাঝে বিদ্যমান সংঘাতের বিবরণ স্বীকার করেন। তার ধারণাসমূহে শ্রেণিসংগ্রামের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
১১. বিপ্লব সম্পর্কিত মতবাদ : প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এরিস্টটল বিপ্লবের যে কারণ নির্দেশ করেছেন তা আজও বাস্তব বলে প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রে যখন চরম সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয় তখনই বিপ্লবের সূচনা ঘটে।
তিনি বলেন, মানুষ যখন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখনই সে বিপ্লব ঘটনে ঝাপিয়ে পড়ে। গ্রিসের নগররাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে তার বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণা রচিত হলেও বর্তমানে তা অম্লান রয়েছে।
১২. শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ : এরিস্টটল আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রে এক আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের পক্ষপাতী ছিলেন। তার মতে, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা ও নাগরিকদের মহত্ত্বর জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করা। তাই তিনি এ লক্ষ্যে আদর্শ শিক্ষানীতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
১৩. গণসম্মতিতে সংবিধান রচনা : এরিস্টটল মনে করেন যে সংবিধানের দেশের অধিকাংশ লোকের সম্মতি রয়েছে সে দেশের সংবিধান উত্তম। কেননা এ ধরনের সংবিধানে জনগণের সর্বাধিক কল্যাণের কথা নিহিত আছে বলে ধরে নেওয়া হয় তাই বর্তমানে সংবিধান রচনায় তার মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় ।
১৪. সরকারের শ্রেণিবিন্যাস : এরিস্টটল রাষ্ট্রের কল্যাণে গুণগত বিচারে সরকারের প্রকারভেদ করেছেন। এরিস্টটল মনে করতেন, সরকার উত্তম হলে তা রাষ্ট্রের জনগণের জন্য কল্যাণকর এবং সরকার অযোগ্য হলে তা জনগণের জন্য অমঙ্গলজনক।
১৫. সরকারের আপেক্ষিকতা : এরিস্টটল সরকারের আপেক্ষিকতা সম্পর্কে বলেন, এক দেশে সর্বদা একই রকম সরকার ব্যবস্থা স্থায়ী হবে না। কেননা জনগণ সবসময় একই রকম সরকার চায় না। তার মতে, জনগণের আদর্শ ও চেতনা, মনমানসিকতা ও ইচ্ছা মোতাবেক সরকার গঠিত হবে।
১৬. পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব : এরিস্টটল তার রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা ও ভাবাদর্শের দ্বারা পরবর্তী প্রজন্মের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। তিনি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের কার্যাবলি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এর বাস্তবসম্মত নির্দেশনা দিয়েছেন । তাই তিনি পরবর্তী প্রজন্মের অন্যতম পুরোধা ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কিছু বিষয়ে মতভিন্নতা ব্যতীত বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এরিস্টটলের সাথে অন্য সব ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন ।
এরিস্টটলই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের সমকক্ষের মর্যাদা প্রদান করেছেন । রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এরিস্টটল যে অবদান রেখে গেছেন, তা যুগ ও কালের প্রশ্নকে অতিক্রম করে বিংশ শতাব্দীর এক শাশ্বত সত্য হিসেবে ধরা দিয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এই আসামান্য অবদানের জন্যই তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
১০. প্লেটোকে কল্পনাবিলাসী এবং এরিস্টটলকে বাস্তববাদী বলার কারণ আলোচনা কর।
অথবা, “প্লেটো কল্পনাবিলাসী এবং এরিস্টটল বাস্তববাদী দার্শনিক ছিলেন।” এর সপক্ষে যুক্তি দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : রাষ্ট্রচিন্তার জগতে দুই মহান ব্যক্তিত্ব হলেন প্লেটো ও এরিস্টটল। এরিস্টটল ছিলেন প্লেটোর শিষ্য । এরিস্টটল প্লেটোর দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তায় উভয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিদৃষ্ট হয়।
তাদের উভয়ের সম্পর্ক গুরুশিষ্যের হলেও একজন ছিলেন কল্পনাবিলাসী, অন্যজন বাস্তববাদী। ফলে তাদের উভয়ের মতাদর্শ ছিল দুই মেরুতে। এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তায় অসাধারণ অবদানের জন্য উভয় দার্শনিকই বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্লেটোকে কল্পনাবিলাসী এবং এরিস্টটলকে বাস্তববাদী বলার কারণ : রাষ্ট্রচিন্তায় প্লেটো ও এরিস্টটল উভয়ের অবদান অনস্বীকার্য, তারা উভয়ে রাষ্ট্রদর্শনে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেন।
তবে প্লেটো এ ক্ষেত্রে কল্পনা প্রবণ ছিলেন, আর এরিস্টটল ছিলেন বাস্তববাদী। এরিস্টটলের ধারণা অনেকটাই বাস্তব, কিন্তু প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা অবাস্তব।
এছাড়া এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবতার নিরিখে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পক্ষান্তরে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা নিছক কল্পনা। নিম্নে উভয়ের পিছনের যুক্তিগুলো পেশ করা হলো-
১. অবস্থানগত পার্থক্য : প্লেটো ও এরিস্টটলের মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য ছিল। প্লেটো ছিলেন অভিজাত বংশের সন্তান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে, এরিস্টটল ছিলেন একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তিনি প্লেটোর মতো অভিজাত বংশোদ্ভূত ছিলেন না ।
২. দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য : এরিস্টটল পিতার সাথে রাজপরিবারে অবস্থান করে চিকিৎসাশাস্ত্রে জ্ঞানলাভ জীববিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে, প্লেটো ছিলেন করেন। তিনি গণিতশাস্ত্রের প্রতি অনুরাগী। তাই প্লেটোর চিন্তাধারা ছিল স্থিতিশীল আর এরিস্টটলের চিন্তাধারা ছিল গতিশীল’।
৩. পদ্ধতিগত পার্থক্য : প্লেটো অবরোহ পদ্ধতির অনুসারী ছিলেন তিনি তার তত্ত্ব বিশ্লেষণে সদগুণ, ন্যায়পরায়ণতা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। তার মতবাদ ছিল কল্পনানির্ভর। পক্ষান্তরে, এরিস্টটল ছিলেন আরোহ পদ্ধতির অনুসারী। তিনি তার পদ্ধতিতে বাস্তব ধারণার ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন।
৪. রচনা কৌশলে পার্থক্য : প্লেটো ও এরিস্টটলের দর্শন রচনা কৌশলেও পার্থক্য ছিল। প্লেটো তার যুক্তিগুলোকে রূপক ও উপমার সাহায্যে প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে, এরিস্টটল তার যুক্তিগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন ।
৫. ভিন্ন শাসনব্যবস্থা : প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনভার ন্যস্ত করেছেন দার্শনিক রাজার হাতে। তার মতে, প্রকৃত দার্শনিকের সদগুণ অন্য সবার সদগুণ অপেক্ষা শ্রেয়। আর তারা অনেক প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অধিকারী। অপরদিকে, এরিস্টটল আইনের শাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, ব্যক্তি বিশেষের গুণ যতো বেশিই হোক না কেন, আইনের শাসন ব্যতীত তা স্বৈরাচার হতে বাধ্য ।
৬. দাসপ্রথা সম্পর্কিত ধারণা : প্লেটো দাসপ্রথাকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন করেছেন। তার মতে, এটা মানবতাবিরোধী। অন্যদিকে, এরিস্টটল দাসপ্রথা সমর্থন করে বলেন, প্রভুর সুখ ও আরামদায়ক জীবনের জন্য দাসপ্রথা অপরিহার্য।
৭. ঐক্যের ধারণা : প্লেটো মনে করতেন, ঐক্যের মধ্যেই রাষ্ট্রের কল্যাণ নিহিত । ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো কাজ করলে তার সফলতা অসম্ভাবী। অন্যদিকে, এরিস্টটল এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন তার মতে, অনৈক্যের মধ্যেও কল্যাণ আসতে পারে।
- অনার্স: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (PDFফ্রি)
- আরো পড়ুন:- (PDFফ্রি)অনার্স: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি অতিসংক্ষিপ্ত MCQ
- আরো পড়ুন:-(PDFফ্রি) রচনামূলক প্রশ্নোত্তর-রাজনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ
- আরো পড়ুন:-সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর-রাজনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ (PDFফ্রি)
- আরো পড়ুন:-(PDFফ্রি) অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর-রাজনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ
- আরো পড়ুন:-সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর-রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বেরধারণা(PDFফ্রি)
- আরো পড়ুন:-রচনামূলক প্রশ্নোত্তর, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বেরধারণা(PDFফ্রি)
৮. শিক্ষাব্যবস্থা : প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিক রাজা সৃষ্টির জন্য এক বিশেষ ধরনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, এরিস্টটল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কল্যাণকামী বাস্তবসম্মত সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন।
৯. সম্পত্তি ও পরিবার সম্পর্কিত ধারণা : প্লেটো শাসক শ্রেণির ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার না রাখার পক্ষপাতী। পক্ষান্তরে এরিস্টটলের মতে, এ ব্যবস্থা মানবতাবিরোধী। তিনি শাসক শ্রেণির নিজস্ব পরিবার ও সম্পত্তি রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন ।
১০. উপস্থাপনা পদ্ধতি : প্লেটো তার রাষ্ট্রদর্শনের যুক্তিসমূহকে প্রধানত রূপক ও উপমার মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কিন্তু এরিস্টটল তার যুক্তিসমূহকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে পাঠক সমক্ষে উপস্থাপন করেছেন।
১১. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য : প্লেটো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে স্বীকার করেন। তাই তিনি শাসক শ্রেণিকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সর্বস্ব ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এরিস্টটল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার মতে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ না থাকলে শাসকের মর্যাদা থাকে না।
১২. সাম্যবাদ নীতি : প্লেটো দার্শনিক রাজার পাশাপাশি দার্শনিক শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্যের কথা বলেছেন। সেখানে তাদের সবার বৈশিষ্ট্য থাকবে সমান। কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পরিবার ও পিতৃমাতৃ পরিচয় থাকবে না।
তারা হলেন সবার মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সমবৈশিষ্ট্যের নিঃস্বার্থ ব্যক্তিত্ব। পক্ষান্তরে, এরিস্টটল শুধু শাসক শ্রেণির সাম্যের কথাই বলেননি তিনি বাস্তবতার নিরিখে সবার মধ্যে সাম্যের বা সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন ।
১৩. রাজনৈতিক চিন্তা : প্লেটো তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ভাববাদী ধারণা উপমা ও রূপকের সাহায্যে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে একটি বিকল্প রূপ দাঁড় করিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে আমরা তার ‘ঞযব জবঢ়ঁনষরপ’ এবং ‘ঞযব খধংি’ গ্রন্থের মধ্যে চিন্তাধারার বিবর্তন লক্ষ করি। অন্যদিকে, এরিস্টটল বক্তব্যগুলো সঠিক যুক্তিবিদ্যার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তুলে ধরেছেন। তিনি বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবের কাছাকাছি আদর্শকে দাঁড় করাতে সচেষ্ট ছিলেন ।
১৪. শাসক শ্রেণির জীবনযাত্রা সম্পর্কিত চিন্তার পার্থক্য : প্লেটো সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় শাসক শ্রেণির ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পারিবারিক জীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তার মতে, শাসক শ্রেণির কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার থাকবে না। পক্ষান্তরে, এরিস্টটল সম্পত্তি ও পারিবারিক জীবন নিষিদ্ধ ঘোষণাকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থি মনে করেছেন।
১৫. নীতিশাস্ত্র সম্পর্কিত ধারণা : প্লেটো নীতিশাস্ত্রকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। এমনকি তিনি নীতিশাস্ত্রকে মাতৃশাস্ত্র হিসেবে গণ্য করতেন। অন্যদিকে, এরিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানই সর্বোচ্চ শাস্ত্র এবং নীতিশাস্ত্রসহ অন্যান্য শাস্ত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত ।
উক্তিটির যথার্থতা : প্লেটো এবং এরিস্টটলের রাজনৈতিক দর্শন পর্যালোচনা করলে প্লেটোকে কল্পনাবিলাসী ও এরিস্টটলকে বাস্তববাদী দার্শনিক হিসেবে অভিহিত করা যায়। এরিস্টটল যে একজন বাস্তববাদী দার্শনিক ছিলেন দর্শনের অনুসৃত নীতির আলোকেই তা প্রতীয়মান হয়েছে।
রাষ্ট্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্লেটো কল্পনাকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু এরিস্টটলের রাষ্ট্রদর্শনে কল্পনার প্রভাব থাকলেও নিছক কল্পনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। এছাড়া প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা ছিল অবৈজ্ঞানিক বা অবরোহ পদ্ধতির, যা অনেকেই গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ প্লেটো ছিলেন কল্পনাবিলাসী ও সংশ্লেষবাদী।
প্লেটো তার যুক্তিগুলোকে রূপক ও উপমার মাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। অপরদিকে, এরিস্টটলের যুক্তিগুলো ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমৃদ্ধ- অর্থাৎ অধিক বাস্তবনির্ভর। তাছাড়া এরিস্টটল ছিলেন আরোহ বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী।
তার এ পদ্ধতি দার্শনিকগণ শুধু গ্রহণই করেননি; বরং একে রাষ্ট্রদর্শনের সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইতিহাস বা বাস্তবতার বিচারে যা বিবেচিত হয়নি সে ধরনের মতাদর্শকে এরিস্টটল গ্রহণ করেননি। তাই বলা যায়, “রাজনৈতিক দর্শনে প্লেটো কল্পনাবিলাসী এবং এরিস্টটল ছিলেন বাস্তববাদী।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্লেটো ও এরিস্টটলের চিন্তাধারায় পার্থক্য দৃশ্যমান। তবে উভয় দার্শনিকের চিন্তাধারার মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে রোমান্টিকতার প্রাধান্য দেখা যায়।
পক্ষান্তরে, এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রে বাস্তবধর্মীতার সাক্ষাৎ মেলে। সুতরাং প্লেটো কল্পনাবিলাসী এবং এরিস্টটল বাস্তববাদী উক্তিটি যথার্থই সঠিক। প্লেটোর চিন্তাধারা ছিল রূপক, উপমা ও কল্পনাভিত্তিক আর এরিস্টটলের চিন্তাধারা ছিল বৈজ্ঞানিক, বাস্তবসম্মত ও সর্বজনীন।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। ফ্রি পিডিএফ ফাইল এখান থেকে ডাউনলোড করে নিন। অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF)