(PDF ফ্রি) অনার্স সেন্ট টমাস একুইনাস: রচনামূলক প্রশ্নোত্তর ও (PDF ফ্রি) অনার্স সেন্ট টমাস একুইনাস: রচনামূলক প্রশ্নোত্তর সহ শিক্ষমূলক সকল বিষয় পাবে এখান থেকে: অধ্যায় ৫.২ : এরিস্টটল, এর অতিসংক্ষিপ্ত, প্রশ্নোত্তর,সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ও রচনামূলক প্রশ্নোত্তর, সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
(PDF ফ্রি) অনার্স সেন্ট টমাস একুইনাস: রচনামূলক প্রশ্নোত্তর
অনার্স প্রথম বর্ষ
বিষয়ঃ রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি
অধ্যায় ৫.৪ : সেন্ট টমাস একুইনাস
বিষয় কোডঃ ২১১৯০৯
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নোত্তর
০১. সেন্ট টমাস একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শন মূল্যায়ন কর ।
অথবা, সেন্ট টমাস একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শন সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : সেন্ট টমাস একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা। তিনি তার দর্শন ও চিন্তাধারার আলোকে মধ্যযুগের শেষপ্রান্তের ভাস্কর হয়ে আছেন। একুইনাস রাষ্ট্রতন্ত্র, রাজনীতি ও পোপতন্ত্রের সমন্বয় সাধন করেন এবং আইন, ন্যায়বিচার, রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্রের সংগঠন প্রভৃতি বিষয়ের ওপর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেন।
তার রাষ্ট্রচিন্তা শুধু মধ্যযুগেই নয়- বর্তমান যুগের চিন্তাকেও অত্যন্ত গভীরভাবে আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছে। অধ্যাপক ডানিং ((PDF ফ্রি) অনার্স সেন্ট টমাস একুইনাস: রচনামূলক প্রশ্নোত্তর) তাই বলেছেন, “মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধের পণ্ডিতদের মধ্যে এবং সম্ভবত সকল পণ্ডিতের মধ্যে একুইনাস ছিলেন নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত ব্যক্তি।”
সেন্ট টমাস একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শন : মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় সেন্ট টমাস একুইনাসের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে তার রাষ্ট্রদর্শন আলোচনা করা হলো-
১. একুইনাসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা : একুইনাসের ধারণা, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। অর্থাৎ সামাজিকতা ও রাজনৈতিকতা মানুষের স্বভাবগত ধর্ম। এ দুটি প্রবণতার কারণে মানুষ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং সংঘবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত হয়। এরিস্টটলের মতো একুইনাস মনে করতেন সমাজ থেকেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান ।
যেকোনো সমাজে একাধিক শ্রেণি থাকে এবং তাদের স্বার্থ সমসত্ত্ব বিশিষ্ট নয় বলে সংঘর্ষ অনিবার্য। এ পরিস্থিতিতে সংঘর্ষ যাতে না ঘটে অথবা ঘটলে মীমাংসার জন্য একটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন । একুইনাসের মতে সেটিই হলো রাষ্ট্র।
এ যুক্তিতে তিনি রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক সমিতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরও মনে করতেন যে, সমাজে সকল মানুষ সহযোগ্যতাসম্পন্ন নয়। স্বতন্ত্রভাবে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এ কারণে একুইনাস রাষ্ট্রকে স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করেছেন ।
২. সরকার ও সরকারের প্রকারভেদ : এরিস্টটলের পথ অনুসরণ করে সেন্ট টমাস একুইনাস রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য করেননি। তার মতে যে রাষ্ট্র শাসিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, সে রাষ্ট্র কল্যাণকর ও বৈধ।
পক্ষান্তরে, এর বিপরীত রাষ্ট্র অকল্যাণকর এবং অবৈধ। একুইনাস এরিস্টটলের মতো মিশ্র প্রকৃতির সরকারের সপক্ষে অভিমত প্রদান করেন একুইনাস ও এরিস্টটলের মতো সংখ্যা ও উদ্দেশ্য নীতির ওপর ভিত্তি করে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন।
একুইনাস উত্তম ও বিকৃত সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। তিনি উত্তম সরকার বলতে একজন শাসক এবং রাজতন্ত্র অভিজাততন্ত্র ও মধ্যতন্ত্রকে বুঝিয়েছেন। এছাড়া তিনি বিকৃত সরকার বলতে স্বৈরতন্ত্র, ধনিকতন্ত্র, গণতন্ত্রকে বুঝিয়েছেন ।
৩. দাসপ্রথা সম্পর্কিত ধারণা : গ্রিস দার্শনিক এরিস্টটল এবং মধ্যযুগীয় চিন্তাবিদ অগাস্টিনের পথ অনুসরণ করে একুইনাসও দাস প্রথাকে সমর্থন করেন। রাষ্ট্রীয় সংগঠনের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য দাস প্রথাকে তিনি ন্যায়সংগত বলে বর্ণনা করেছেন।
এক্ষেত্রে এরিস্টটল ও অগাস্টিন যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা থেকে একুইনাসের যুক্তি ভিন্ন প্রকৃতির। একুইনাস মনে করতেন এক শ্রেণির মানুষ পাপাচারে লিপ্ত থাকে এবং তাই ক্রীতদাস হয়ে তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সুতরাং ক্রীতদাস হওয়ার জন্য মানুষ নিজেই দায়ী।
তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধে যারা বন্দি হয় তাদের হত্যা না করে ক্রীতদাস করে নেয়া উত্তম। সৈনিকদের বীরত্বকে উৎসাহিত করার জন্য এটি একটি ভলো ব্যবস্থা বলে তার ধারণা ছিল।
এছাড়াও একুইনাস তার দাস প্রথার বর্ণনা দিতে গিয়ে মানুষের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেছেন মানুষের মধ্যে দুই ধরনের প্রকৃতি প্রত্যক্ষ করেন। একটি হলো পাপের প্রকৃতি এবং অপরটি হলো সামাজিক প্রবৃত্তি। আর সামাজিক প্রবৃত্তি থেকে প্রভুত্ব ও আধিপত্য করার প্রবণতা উৎসারিত হয়।
৪. আইনতত্ত্ব : রাষ্ট্রচিন্তায় একুইনাসের আইন সংক্রান্ত আলোচনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তার চিন্তার এক বড় অংশ জুড়ে তিনি তার ছিল আইন সম্পর্কিত ধারণা। ”Summa Theologica’ ধ’ নামক গ্রন্থে আইন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তিনি আইনকে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, “আইন হচ্ছে সমাজ বা সম্প্রদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত এমন একটি বিধান যা যুক্তি থেকে উৎসারিত এবং মানুষের বিভিন্ন কল্যাণ নিশ্চিত করাই যার প্রধান লক্ষ্য।”
একুইনাস আইনের যে সুবিস্তৃত ও সুনিপুণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন তা সমগ্র রাষ্ট্রদর্শনে প্রচ্ছন্নভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একুইনাস তার আইন তত্ত্বকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন তা হলো:- ক. শাশ্বত আইন, খ. প্রাকৃতিক আইন, গ. ঐশ্বরিক আইন ও ঘ. মানবিক আইন ।
৫. প্রাচীন যুগের ধ্যানধারণা ও খ্রিস্টধর্মের সমন্বয় : সেন্ট টমাস একুইনাস তার ‘ঝঁসসধ ঞযবড়ষড়মরপধ’ গ্রন্থে এরিস্টটলের যুক্তিবাদী দর্শনের সাথে খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসের সমন্বয় সাধন করেছেন প্রকৃতপক্ষে একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগের ধর্মনেতারূপী এরিস্টটল।
তিনি গ্রিক যুক্তিবাদী ও খ্রিস্টীয় ধর্মচিন্তার সমন্বয় করে মধ্যযুগীয় ইউরোপের চিন্তাধারাকে এক নতুন খাতে প্রবাহিত করেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সেন্ট টমাস একুইনাসকে মধ্যযুগের এরিস্টটল বলে অভিহিত করা হয় ।
৬. রাষ্ট্রের সাথে চার্চের সম্পর্ক : একুইনাসের মতে, রাষ্ট্র একটি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করাই শুধু এর কাজ নয়, সৎ জীবন নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পলন করাও রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য।
চার্চের হাতে যদিও সার্বভৌম ক্ষমতা বিদ্যমান এবং রাষ্ট্র চার্চের অধীন তথাপি এর অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্র চার্চের নিকট থেকে ক্ষমতা প্রাপ্ত হবে। তাই রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার চার্চের নেই। তবে চার্চ সাধারণভাবে রাজার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। তাই একুইনাস বলেন, “রাষ্ট্র ও চার্চের সম্পর্ক শত্রুতার সম্পর্ক নয়, তা পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সম্পর্ক।”
৭. স্বৈরচারী শাসন ও তার উচ্ছেদ : এরিস্টটল রাজার বিরুদ্ধাচারণকে পাপ বলে মনে করতেন। কিন্তু একুইনাস স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থাকে স্বীকার করেননি; বরং তিনি এর জন্য দুটি প্রতিষেধকের কথা চিন্তা করেছেন,
যথা : ক. চাপ প্রয়োগ : শাসক যেহেতু কতকগুলো শর্তের বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা করে জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভ করে। তাই এসব শর্ত পলনের জন্য শাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যুক্তিসংগত।
খ. . ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন : যেহেতু সেখানে শাসকের ওপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থাকে সেখানে সেই কর্তৃপক্ষের কাছে স্বেচ্ছাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ পেশ করা। এ দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে স্বৈরাচারের প্রতিরোধ সম্ভব বলে একুইনাস মনে করেন ।
৮. লোকায়ত শাসক : সেন্ট টমাস একুইনাস ধর্মের ওপর লৌকিকতার প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য স্থাপন করার মানসে একজন লোকায়ত শাসকের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পণের কথা বলেন । তিনি লোকায়ত শাসককে রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনের জন্য জনগণের জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন। তবে তিনি লোকায়ত শাসকের ঊর্ধ্বে পোপ তথা গির্জার কর্তৃত্বকে স্থান দিয়েছেন।
৯. নীতিশাস্ত্র ও প্রাকৃতিক জগৎ : একুইনাস বলেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবে সুখের ঘরের চাবিকাঠি পেতে পারে এবং স্বাভাবিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। তিনি আরও বলেন, মানুষের পরম সুখ হলো আত্মার মুক্তি ও পূতপবিত্র জীবন ।
১০. স্কলাস্টিসিজমের বিকাশ : ত্রয়োদশ শতকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে দেবতন্ত্র, কলাবিদ্যা, আইন ও ভেজষবিদ্যা বিষয়ে অধ্যয়ন সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্কলাস্টিসিজমের বিকাশে একুইনাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এরিস্টটলের দর্শনকে একুইনাস ইউরোপে প্রচার করে। পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, রাজনীতি, মনোবিদ্যা, প্রকৃত বিষয়ে এরিস্টটলের ধ্যানধারণা প্রচারিত হতে থাকে। তার পুনর্জীবনের জন্য একুইনাসের অবদান অসীম।
১১. ন্যায়বিচার : সেন্ট টমাস ন্যায়বিচারকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : ক. সাম্যমূলক ও খ. বন্ধনমূলক। নির্দিষ্ট লোকদের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে সাম্যমূলক ন্যায়ের ভিত্তিতে। মানুষ ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় বন্ধনমূলকতার ওপর ভিত্তি করে।
পক্ষান্তরে সমাজের নাগরিকের যতখানি অংশ আছে তার ভিত্তিতে সে ন্যায়বিচার পাবে। সমাজে প্রশাসন এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে করে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সাথে আসবে ন্যায়বিচার। সাম্য ও ন্যায়বিচারকে সেন্ট টমাস একই দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন।
১২. চূড়ান্ত কার্যকরণ তত্ত্ব : সেন্ট টমাস একুইনাস তার সুবিখ্যাত ‘ঝঁসসধ ঞযবড়ষড়মরপধ’ গ্রন্থে বলেন, বিশ্বপ্রকৃতির ন্যায় মানবসমাজও একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা নিয়মের অধীন। এ নিয়মানুসারে নিম্নশ্রেণি উচ্চশ্রেণির আদেশ দ্বিধাহীন চিত্তে ও নিঃসংকোচভাবে পালন করবে এবং নিম্নশ্রেণি নিয়ন্ত্রণ ও পথ প্রদর্শন করবে । তার এ তত্ত্বটি চূড়ান্ত কার্যকরণ তত্ত্ব নামে পরিচিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি চিন্তার ক্ষেত্রে একুইনাস যে পরিবর্তন এনেছিলেন সমকালীন যুগের আলোকে তা অভূতপূর্ব।
যে ধর্মীয় চিন্তা মধ্যযুগকে আচ্ছন্ন করেছিল, খ্রিস্টধর্ম ও ধর্মীয় মতবাদের স্রোতে যে যুগের সম্পূর্ণ রূপে ভেসে গেছে সে যুগেই বিপরীতমুখী না হলেও অনেকটা স্বতন্ত্র চিন্তার খোরাক যুগিয়েছিলেন টমাস একুইনাস। বাঁধাধরা, একঘেয়ে, গতিহীন চিন্তার অক্টোপাস থেকে মধ্যযুগের মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন একুইনাস। বস্তুত একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগের সর্বাপেক্ষা সফল দার্শনিক।
০২. সেন্ট টমাস একুইনাসকে মধ্যযুগের এরিস্টটল বলা হয় কেন?
অথবা, সেন্ট টমাস একুইনাসকে মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শনের মধ্যমণি বলা হয় কেন? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাষ্ট্রচিন্তার সমন্বয়ের যুগে যে পণ্ডিত সর্বাপেক্ষা সুখ্যাতি অর্জন করেন তিনি হলেন সেন্ট টমাস একুইনাস। মধ্যযুগীয় স্তব্ধ চিন্তারাজ্যের প্রান্তসীমায় তার দর্শন বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
তিনি খ্রিস্টীয় পণ্ডিতদের আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য এরিস্টটলের দর্শন ও যুক্তিকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে একুইনাস তার রাষ্ট্রদর্শন চর্চায় এরিস্টটলকে অনুসরণ করেন বেশি। এই কারণে একুইনাসকে মধ্যযুগের ধর্মনেতারূপী এরিস্টটল বলা হয়।
সেন্ট টমাস একুইনাসকে মধ্যযুগের এরিস্টটল বলার কারণ :
নিম্নে যেসব কারণে একুইনাসকে মধ্যযুগীয় এরিস্টটল বলে অভিহিত করা হয় সেগুলো আলোচনা করা হলো—
১. রাষ্ট্রের উৎপত্তি : রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে একুইনাস এরিস্টটলকে অনুসরণ করে বলেন যে, রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের সহজাত ও ইতিবাচক সামাজিক প্রবৃত্তিই রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রধান কারণ। তিনি আরও বলেন, মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য সেবার ভিত্তিতে পারস্পরিক চুক্তিবাদের ফলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ও সুশৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে।
২. সরকারের শ্রেণিবিভাগ : একুইনাস সরকারের শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রেও এরিস্টটলকে অনুসরণ করেন। জনগণ ও শাসকের কথা চিন্তা করে তিনি সরকারকে দু’ভাগে ভাগ করেন। যথা : ক. উত্তম সরকার ও খ. বিকৃত সরকার।
এরিস্টটলের ন্যায় তিনি রাজতন্ত্রকে সর্বপেক্ষা উত্তম শাসনব্যবস্থা বলে মনে করেন। তার মতে, উত্তম জাতীয় সরকার হলো রাজতন্ত্র। আর এই সরকার ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে রাজা শাসন করে। তবে একুইনাস রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আর এরিস্টটল যুক্তির ভিত্তিতে রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন।
৩. প্রাচীন যুগের ধ্যানধারণা ও খ্রিস্টধর্মের সমন্বয় : সেন্ট টমাস একুইনাস মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। তার মধ্যে ‘ঝঁসসধ ঞযবড়ষড়মরপধ’ হলো তার অমর গ্রন্থ। এ গ্রন্থেই তিনি প্রাচীন যুগের বিশেষত প্লেটো ও এরিস্টটলের ধ্যানধারণার সাথে রোমের আইন ও খ্রিস্টধর্মের অপূর্ব সমন্বয় ঘটান।
৪. আইনতত্ত্ব :এরিস্টটল তার আইনের ব্যাখ্যায় বলেন যে, যুক্তি ও ইচ্ছা উভয়ই আইনের উৎস। একুইনাসও একথা সমর্থন করে আইনের ব্যাখ্যা দেন তবে এরিস্টটল আইন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা প্রদান করেননি।
কিন্তু একুইনাস এরিস্টটলের দর্শন ও রোমান দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়ে আইনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। একুইনাস তার আইনের ব্যাখ্যাও এরিস্টটলকে অনুসরণ করেন।
৫. যুক্তি ও ধর্মতত্ত্ব : এরিস্টটল যেখানে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন সেখানে একুইনাস আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, “দর্শনই সবকিছুর শেষ নয়, এর বাহিরেও একটি স্তর আছে এবং সেটা হলো ধর্মতত্ত্ব।
তিনি বিশ্বাস করতেন দৃশ্যমান এ প্রাকৃতিক জগতের ঊর্ধ্বে আছে আরেক বৃহৎ জগৎ যা অনুধাবন করতে ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন মানুষের মনে এ অনুভূতি ঐশী বাণীর মাধ্যমে প্রতিভাত হয় এবং ধর্মতত্ত্ব তার সার্থক রূপায়ণ ঘটায় ।
৬. আইনের সার্বভৌমত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ : একুইনাস তার রাষ্ট্রদর্শনে আইনের সার্বভৌমত্বের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে তিনি এরিস্টটলের সমর্থক হয়ে এর বিশ্লেষণ করেন।
এরিস্টটল আইনের সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আইন সবকিছুর ঊর্ধ্বে এবং আইনের বিকল্প কিছু থাকতে পারে না। একুইনাস এরিস্টটলের ন্যায় সর্বত্র আইনের সার্বভৌমত্ব মেনে চলার আদেশ দেন।
৭. সমাজ সম্পর্কিত ধারণা : একুইনাস তার সমাজ সম্পর্কিত ধারণায়ও এরিস্টটলকে অনুসরণ করেন। তার মতে, সমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ তাদের স্ব-স্ব স্থান থেকে কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকবে।
সমাজে প্রতিটি মানুষের সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমেই সমাজে সামগ্রিক কল্যাণ সম্ভব হয়। তার মতে, সমাজ হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাতে বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজে কল্যাণ সাধন করতে পারে।
- আরো পড়ুন:- (PDF ফ্রি) অনার্স সেন্ট টমাস একুইনাস: সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
- আরো পড়ুন:- অনার্স সেন্ট টমাস একুইনাস: অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর PDF ফ্রি
- আরো পড়ুন:- অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF)
- আরো পড়ুন:- (ফ্রি PDF) অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর
- আরো পড়ুন:-অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF)
- আরো পড়ুন:-অনার্স এরিস্টটল: রাজনৈতিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (ফ্রি PDF)
৮. দাসতত্ত্ব : সেন্ট টমাস একুইনাস দাসতত্ত্বের ক্ষেত্রে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের দ্বারা প্রভাবিত হন। এরিস্টটলের মতো তিনিও মনে করেন যে রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য দাস প্রথা ন্যায়সংগত।
তিনি আরও বলেন, মানুষে মানুষে বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানের অসমতা হলো দাসতত্ত্বের মূল। একুইনাস বিশ্বাস করেন দাসত্ব একান্তভাবে স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে তিনি এরিস্টটলের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে বলেন, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবার চেয়ে সৈনিকদের সাহসের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয় ।
৯. সর্বোত্তম সরকার : এরিস্টটল রাজতন্ত্রকে সর্বোত্তম সরকার বলে অভিহিত করেন। একুইনাস উত্তম সরকার চিহ্নিত করার উদ্দেশ্য উত্তম ও আইনসংগত শাসনব্যবস্থায় একজন, কয়েকজন বা বহুজনের দ্বারা পরিচালিত সরকার ব্যবস্থার কথা বলেছেন।
যা যথাক্রমে রাজতন্ত্র, অভিজ্ঞতাতন্ত্র ও মধ্যতন্ত্র নামে পরিচিত এদের বিকৃত রূপ হলো স্বৈরতন্ত্র, ধনিকতন্ত্র ও গণতন্ত্র। একুইনাসের মতে, রাজতন্ত্রই হলো ঐক্যের প্রতীক।
একমাত্র এ ধরনের সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্র বা সমাজের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব । তাই একুইনাস রাজতন্ত্রকে সর্বোত্তম সরকার বলে দাবি করেছেন ।
১০. যুক্তিবাদ : একুইনাস ও এরিস্টটলের মতো যুক্তিবাদকে মানুষের শ্রেষ্ঠতম মানবিক গুণ বলে অভিহিত করেন। এ সম্পর্কে একুইনাস বলেন, “যুক্তিবাদ মানুষের গুণ ঠিকই, তবে তার ঊর্ধ্বে আরও একটি গুণ আছে তা হলো আত্মা আর আত্মার মুক্তিই মানব জীবনের চরম লক্ষ্য।”
সেন্ট টমাস একুইনাস এরিস্টটলের যুক্তিবাদকে গ্রহণ করেন এবং যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাস ও যুক্তি পরস্পর বিরোধী নয়, বরং বিশ্বাসই যুক্তিকে পূর্ণতা দান করে ।
১১. ধর্মতত্ত্ব জ্ঞানের প্রতিজ্ঞা : একুইনাস ধর্মতত্ত্বের জ্ঞানের সার্থক রূপায়ণ ঘটায়। এরিস্টটলের মৌলিক দর্শনের প্রতিধ্বনি করেই সেন্ট টমাস একুইনাস বলেন যে, মানুষের যা জ্ঞান তা এক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ । এই জ্ঞান বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত। তিনি আরও বলেন, দর্শনের ঊর্ধ্বেও একটি জ্ঞানের শাখা আছে এবং তা হলো ধর্মতত্ত্ব।
তিনি বিশ্বাস করেন যে, দৃশ্যমান এ প্রাকৃতিক জগতের ঊর্ধ্বে আছে আরেক বৃহত্তর জগৎ, অনুধাবন করতে হলে ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। মানুষের মনে এ অনুভূতি ঐশীবাণীর মাধ্যমে প্রতিভাত হয় এবং ধর্মতত্ত্ব তার স্বার্থক রূপায়ণ ঘটায়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও দর্শন যা শুরু করে, ধর্মতত্ত্ব তাকে সার্থকতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেয় ।
১২. নীতিশাস্ত্র ও প্রাকৃতিক জগৎ : একুইনাস বলেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবে সুখের ঘরের চাবিকাঠি পেতে পারে এবং স্বাভাবিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। তিনি আরও বলেন, মানুষের পরম সুখ হলো আত্মার মুক্তি ও পুতপবিত্র জীবন। টমাস একুইনাসও এরিস্টটলের মতো রাষ্ট্রের সংহতি ও কল্যাণের জন্য নীতিশাস্ত্র ও প্রাকৃতিক জগতের প্রতি সমভাবে বিশ্বাসী ছিলেন।
১৩. নগররাষ্ট্র : নগররাষ্ট্র সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় একুইনাসের চিন্তাধারায় এরিস্টটলের অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। এরিস্টটল নগররাষ্ট্রকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিখুঁত বলে বর্ণনা করলেও একুইনাস নগররাষ্ট্রকে উত্তম বলে গ্রহণ করেননি। তিনি মনে করেন কতকগুলো নগররাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তম রাষ্ট্র গঠন করাই শ্রেয়।
১৪. স্কলাস্টিসিজমের বিকাশ : ত্রয়োদশ শতকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে দেবতন্ত্র, কলাবিদ্যা, আইন ও ভেষজবিদ্যা বিষয়ে পড়াশুনা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্কলাস্টিসিজম বিকাশে একুইনাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এরিস্টটলের দর্শনকে একুইনাস ইউরোপে প্রচার করে। পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, রাজনীতি, মনোবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে এরিস্টটলের ধ্যানধারণা প্রচারিত হতে থাকে। তার পুনর্জীবনের’ জন্য একুইনাসের অবদান অসীম।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একুইনাস মধ্যযুগের মতো একটি অরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান দখল করে পুরো সমাজ কাঠামোকে যেভাবে বিশ্লেষণ করে যুক্তিভিত্তিক আলোচনা করেছেন তা শুধু বিস্ময়কর নয়, রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
একুইনাস এরিস্টটলের মতবাদের সাথে খ্রিস্টধর্মের সমন্বয় সাধন করতে পেরেছিলেন। তিনি এরিস্টটলের নিয়মতান্ত্রিকবাদকে সাফল্যের সাথে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই বলা যায় যে, একুইনাস ছিলেন মধ্যযুগের এরিস্টটল ।
০৩. সেন্ট টমাস একুইনাসের আইনতত্ত্বটি বর্ণনা কর।
অথবা, সেন্ট টমাস একুইনাসের আইনের শ্রেণিবিভাগের সমালোচনাসহ বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক চিন্তাবিদ সেন্ট টমাস একুইনাসের আইনতত্ত্ব তার রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে মৌলিক অংশ। রাষ্ট্রচিন্তায় একুইনাসের আইন সংক্রান্ত আলোচনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
তার চিন্তার এক বিরাট অংশ ছিল আইন সম্পর্কিত ধারণা। তিনি তার ‘ঝঁসসধ ঞযবড়ষড়মরপধ’ গ্রন্থটিতে আইন সংক্রান্ত আলোচনা উপস্থাপন করেন ।
অধ্যাপক ডানিং সেন্ট টমাসের আইনতত্ত্ব সম্পর্কে বলেন, “ সেন্ট টমাস একুইনাসের আইন সম্পর্কিত ধারণা মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক দর্শনের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক।”
সেন্ট টমাস একুইনাসের আইনতত্ত্ব : সেন্ট টমাস আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, আইন হচ্ছে ক্রিয়াকর্মের পদ্ধতি ও নিয়ম। এ পদ্ধতি ও নিয়মের দ্বারা মানুষ কোনো কাজ করতে প্রলুব্ধ হয় অথবা কোনো কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে।
এ সংজ্ঞাটিকে টমাস ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, মানুষের ক্রিয়াকর্মের নিয়ম ও মাপকাঠি বা পদ্ধতি হচ্ছে যুক্তি। আইনের সাথে যুক্তির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই তিনি বলেন, “Law is something pertaining of reason’ তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে
মানুষের জোট এবং এ জোট ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, যদি নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা ও সম্প্রীতি না থাকে এবং এটি সম্ভব কেবল আইনের দ্বারা অর্থাৎ, তিনি আইনকে সমাজকল্যাণে বাস্তবায়িত করার একটা পদ্ধতি হিসেবে দেখেছেন।
একুইনাসের আইনের শ্রেণিবিভাগ : একুইনাসের আইনের সংজ্ঞা প্রদানের সাথে সাথে এর শ্রেণিবিভাগ করেছেন। একুইনাস তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ঝঁসসধ ঞযবড়ষড়মরপধ তে আইনকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন এগুলো হলো-
ক. শাশ্বত আইন: একুইনাসের মতে, শাশ্বত আইন হলো এমন আইন যা বিশ্বপ্রভু কর্তৃক নিয়োজিত এবং যার দ্বারা বিশ্ব চরাচর প্রতিপালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং যার কোনো পরিবর্তন হয় না। স্যাবাইন বলেন, “It is the eternal plan of divine wisdom by which the whole creation is orderd.” এ আইন নিখিল বিশ্বের একটা অংশ। তার মতে, শাশ্বত আইন ও দৈব প্রজ্ঞার বিচার বুদ্ধি প্রায় সমার্থক।
দৈব প্রজ্ঞাই শাশ্বত আইনের আকারে পার্থিব সমাজে প্রচলিত। একুইনাস শাশ্বত আইনকে সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা দিয়েছেন। এ আইনের নির্দেশে অন্যান্য আইনকে মেনে চলতে হবে। স্রষ্টার প্রজ্ঞা ও সদাচার মানুষের মধ্যে প্রতিফলিত হয় এবং এ ক্ষমতা বলে সে শাশ্বত আইনে অংশগ্রহণ করতে পারে। অতএব শাশ্বত আইনকে সমাজ বহির্ভূত কোনো বিষয় বলে ধারণা করা বাঞ্ছনীয় নয়।
এ আইন মানুষের দৈহিক প্রকৃতির ঊর্ধ্বে এবং এর সামগ্রিকতা মানুষের ধারণার বাইরে, তবে এটা মানুষের বুদ্ধির কাছে অপরিচিত নয়। মানুষ, জিন, ফেরেশতা, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতা সর্বোপরি প্রাণহীন ও প্রাণী জাতীয় সৃষ্টির কোনোটিকেই এই শাশ্বত আইনের কার্যকারিতার বাইরে নয়।
খ. প্রাকৃতিক আইন : প্রাকৃতিক আইন মূলত শাশ্বত আইনের প্রকাশিত রূপ। মানুষের সহজাত প্রবণতা এবং ন্যায়বোধের ধারণা হতে প্রাকৃতিক আইনের উৎপত্তি হয়েছে বলে একুইনাস ধারণা পোষণ করেন। তার মতে, যাবতীয় পার্থিব বিষয় ব্যতীত স্বর্গীয় যুক্তির প্রতিফলন হলো প্রাকৃতিক আইন।
একুইনাসের এ সম্পর্কিত বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করে স্যাবাইন বলেন, “Natural law may perhaps be described as reflection of divine reason in created things..” অর্থাৎ সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার শাশ্বত জ্ঞানের প্রকাশই প্রাকৃতিক আইন। এরূপ প্রকাশ ঘটে কেবল ব্যবহারিক বিচারবুদ্ধি দিয়ে।
ব্যবহারিক বিচারবুদ্ধি বলতে টমাস বলতে চেয়েছেন, যে মানুষ সৎ ও ভালো হতে চায় ও অন্যায় বা খারাপকে উপেক্ষা করার প্রয়াস চালায়, আত্মরক্ষা বা নিরাপত্তার বিষয়টিও তাদের কাছে সবসময় অগ্রাধিকার পায় ।
স্রষ্টা মানুষকে যে স্বাভাবিক প্রবণতা বা গুণাবলি দিয়েছেন নর সেগুলোর যথাযথ সদ্ব্যবহার করে জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য তৎপর থাকে। একুইনাস মনে করেন একমাত্র প্রাকৃতিক আইনের সাহায্যে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
গ. দৈব আইন : একুইনাস ঐশ্বরিক বা দৈব আইনকে ঈশ্বরের পরম আশীর্বাদ বলে অভিহিত করেছেন। শাশ্বত ও প্রাকৃতিক আইনের সাথে সংগতি বিধানের জন্য বিধাতা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে মানব জাতির জন্য প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন তাই দৈব আইন দৈব আইনকে স্বাভাবিক আইনের বিরোধী বলে মনে করা উচিত নয়।
মানুষ যে সমস্ত লক্ষ্যার্জনের জন্য সচেষ্ট হয় সামর্থ্য তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এজন্য দৈব আইন প্রয়োজন । একুইনাস দৈব আইনকে স্রষ্টা কর্তৃক বিরোধ নিষ্পত্তির একটি মাধ্যম বলে অভিহিত করেছেন।
তার মতে, “পূর্ণতা লাভ ও পুণ্যকর্মের জন্য মানুষের আত্মার যে অভ্যন্তরীণ গতিবেগ আবশ্যক, তা মানবিক আইনের অধিগম্য নয়। এ কাজ কেবল দৈব আইন করতে পারে।” সেন্ট টমাস একুইনাস দৈব আইনকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন । যথা: ১. আদি বিধি ও ২. নব বিধি ।
ঘ. মানবিক আইন : মানুষকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য মানুষ তাদের নিজস্ব প্রজ্ঞার সাহায্যে প্রাকৃতিক আইনের নীতির ভিত্তিতে যে সকল আইন তৈরি করে তাই মানবিক আইন ।
মানবিক আইন সম্পূর্ণ মানুষের তৈরি এবং এ আইন সমাজের সকল আইনকেই অন্তর্ভুক্ত করে। তাছাড়া এ আইন ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই প্রয়োজন পূরণ করে থাকে।
তাছাড়া একুইনাস আরও মনে করেন, সৎ ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য মানুষ তার নিজস্ব যুক্তিবোধ থেকে যে আইন তৈরি করে তা মানবিক আইন । মানবিক আইন প্রয়োজনের ক্ষেত্রে আইন প্রণেতাকে দুটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। যথা :
১. যুক্তির সাথে সংগতিহীন এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা যায় না, করলেও সেটা মান্য করা হয় না ।
২. প্রাকৃতিক আইন যেহেতু দৈব আইনের অভিব্যক্তি তাই দৈব প্রাকৃতিক আইন এবং মানবিক আইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে দৈব ও প্রাকৃতিক আইন প্রাধান্য পাবে। এ আইন কেবল জনসাধারণের কল্যাণেই প্রণীত হবে,
কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য নয়। সেজন্য এ আইনকে সমগ্র সম্প্রদায়ের অভিন্ন সম্মতি ও সহযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ আইন আবার দুই প্রকার। যথা : ক. সামাজিক আইন ও খ. সর্বজনীন আইন ।
একুইনাসের প্রণীত চার প্রকার আইন আপাতদৃষ্টিতে পৃথক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এদের উৎস ও লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। এরা পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
- আরো পড়ুন:- অনার্স: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি‘এরিস্টটল অতিসংক্ষিপ্ত PDF
- আরো পড়ুন:- প্লেটো রচনামূলক প্রশ্নোত্তর রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি PDF
- আরো পড়ুন:- রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, প্লেটো রচনামূলক প্রশ্নোত্তর PDF
- আরো পড়ুন:- প্লেটো: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, রচনামূলক প্রশ্নোত্তর PDF
- আরো পড়ুন:-অনার্স: রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (PDFফ্রি)
সমালোচনা : সেন্ট টমাস একুইনাসের আইনতত্ত্বের সমালোচনা নিম্নে দেয়া হলো-
১. প্রাকৃতিক আইনের প্রাধান্য : একুইনাস মানবিক আইনের ওপর প্রাকৃতিক আইনকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষকে ধর্মীয় গোঁড়ামির দিকে উদ্দীপ্ত করেছেন।
২. নিয়ম ভঙ্গ : প্রাকৃতিক আইনকে একুইনাস দু’ভাগে বিভক্ত করে প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করেছেন।
৩. ব্যাখ্যায় অপূর্ণাঙ্গতা : তিনি শাশ্বত আইন, প্রাকৃতিক আইন ও ঐশ্বরিক আইনের ব্যাখ্যার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের উদাহরণও দিয়েছেন । কিন্তু তার এ ব্যাখ্যাসমূহ পূর্ণাঙ্গতা অর্জন করতে পারেনি।
৪. শ্রেণিবিভাগে ত্রুটি : একুইনাস আইনকে চার ভাগে বিভক্ত করতে গিয়ে শ্রেণিবিভাগের সুনির্দিষ্টতা রক্ষা করতে পারেননি । তাই তার আইনের শ্রেণিবিভাগকে সমালোচকগণ অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট টমাস একুইনাস তার আইনতত্ত্বে অভিন্ন কল্যাণ ও যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দিয়ে আইনের ভিত্তি অনেকখানি পাকাপোক্ত করে গেছেন ।
একুইনাসের পর কয়েক শতাব্দী পার হয়ে গেছে এবং আইন নিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত ব্যক্তিরা অনেক আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেন্ট টমাস একুইনাসের বক্তব্যকে কেউ অযৌক্তিক বলে চিহ্নিত করতে পারেননি। আইন সম্পর্কে একুইনাস যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা তার রাষ্ট্রদর্শনকে বহুলাংশে সম্প্রসারিত করেছে।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। ফ্রি পিডিএফ ফাইল এখান থেকে ডাউনলোড করে নিন। (PDF ফ্রি) অনার্স সেন্ট টমাস একুইনাস: রচনামূলক প্রশ্নোত্তর