HSC | সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | বিশ্লেষণ – ২ | PDF : বাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক হতে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্যবাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
প্রথম অঙ্ক : তৃতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ১০ অক্টোবর। ঘসেটি বেগমের বাসভবন। প্রৌঢ়া ঘসেটি বেগম জমকালো জলসার সাজে সজ্জিতা। আসরে উপস্থিত রাজবলভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, বাদক আর নর্তকী। খানসামা তাম্বুল আর তামাক পরিবেশন করছে। এমন সময় আসরে প্রবেশ করে উমিচাঁদ, সঙ্গে একজন বিচিত্র বেশধারী মেহমান।
ঠিক এ সময়, এক পর্যায়ের নাচ শেষে উপস্থিত সবাই করতালি দিতে থাকেন। ঘসেটি বেগম উমিচাঁদকে সমাদর করে বসতে দেন। বিচিত্রবেশী লোকটার দিকে তাকাতেই উমিচাঁদ বলেন, তিনি একজন জবরদস্ত শিল্পী, তার সাথে পরিচয় অল্পদিনের। এর মধ্যে তার কেরামতিতে উমিচাঁদ মুগ্ধ, সেদিনকার জলসা সরগরম করতে সে লোকটাকে সাথে নিয়ে এসেছে।
রাজবলভ অপরিচিত লোকের আবির্ভাব সন্দেহের চোখে দেখেন। উমিচাঁদ বলে, ভাবনার কোনো কারণ নেই, লোকটা দরিদ্র শিল্পী, পেটের ধান্দায় আসরে-জলসায় কেরামতি দেখিয়ে বেড়ায়। জগৎশেঠ লোকটাকে তার কেরামতি দেখাতে আহŸান করেন। তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হয় ঘসেটি বেগমের। লোকটা গিয়ে দাঁড়ায় আসরের মাঝখানে। রাজবলাভ নাম জানতে চাইলে বলে নাম তার রাইসুল জুহালা। সবাই হেসে ওঠেন।
রায়দুর্লভ ঠাট্টা করে বলেন, জাহেরদের রইস বলেই কি সে উমিচাঁদকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে? সবাই আবার হাসিতে ফেটে পড়তেই উমিচাঁদ বলেন যে, সে তো বেশ জাহেল, এ কারণে তাঁরা সব সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফটা শুকনো রাখেন, আর সে দুধের হাঁড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাঁড়ির কালি মেখে বনে যায় গুলবাঘা।
ঘসেটি বেগম তাদের কথা কাটাকাটিতে বাধা দেন। তাঁর হুকুমে রাইসুল জুহালা বলে, সে নানা রকম জন্তুজানোয়ারের কথা জানে, তবে সে তখন তাঁদের দেশের একটা নাচ একটা বিশেষ শ্রেণির ধার্মিক পাখির নাচ দেখাবে সে। সমকালীন অবস্থা বিবেচনা করে সে বিশেষ নাচটি জনপ্রিয় করতে চায়। নৃত্য চলতে থাকে।
এ সময় ঘসেটি বেগম আর রাজবলভ নিচুস্বরে পরামর্শ করেন। পরে উমিচাঁদ ও রাজবলভের সাথে আলোচনা চলে। নাচ শেষ হয়। সবাই হর্ষধ্বনি করেন। রাজবলভ রাইসুল জুহালাকে আরো কিছু আনন্দ পরিবেশনের দায়িত্ব দেবার প্রস্তাব করায় উমিচাঁদ তার সাথে এক পাশে গিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেন।
তারপর নিজের আসনে ফিরে এসে জানায় উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে নৃত্যের কলা-কৌশল দেখবার ফাঁকে ফাঁকে দুচারখানা চিঠিপত্রের আদান-প্রদানেও তার আপত্তি নেই। রাজবলভ তাকে দরকার মতো কাজে লাগাবেন বলে তখনকার মতো বিদায় করে দেন। তাঁর ইচ্ছায় নর্তকীরাও দলবল নিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন তাঁদের পরামর্শ শুরু হয়।
ঘসেটি বেগমের ইঙ্গিতে জগৎশেঠ বলেন, শওকতজঙ্গকে তাঁরা পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছেন, কিন্তু তিনি নবাব হলে জগৎশেঠ কী পাবেন? বেগম বলেন, শওকতজঙ্গ তো তাঁদেরই ছেলে, তিনি যদি নবাব হন তবে তারাই হবেন দেশের মালিক।
রায়দুর্লভ কিছু বলতে গেলে জগৎশেঠ তাঁকে থামিয়ে দিতে গেলে রায়দুর্লভ বলেন, জগৎশেঠ তাঁর কথা শেষ হলে আর কোনো কথা ওঠাতে পারবেন না। রাজবলভ বলেন, তর্ক না করে খুব সংক্ষেপে তাঁদের কথা শেষ করতে হবে। তখনকার পরিস্থিতিতে কথা দীর্ঘায়িত হলে বিপদ ঘটতে পারে।
জগৎশেঠ বলতে থাকেন, নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তিনি খোলাখুলি বেগমকে বলেন, শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাং-এর গ্লাস আর নাচওয়ালী ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। কাজেই সে নবাব হবে নামে মাত্র, আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগমের হাতে, আর তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন রাজা রাজবলভ।
ঘসেটি বেগম আর রাজবলভ সম্পর্কে এমন একটা উক্তি করায় রায়দুর্লভ জগৎশেঠকে সতর্ক করে দেন; বলেন, এমন একটা ব্যাপারের জন্যই হোসেনকুলি খাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। জগৎশেঠ তখন বলেন যে, শওকতজঙ্গ নবাব হলে বেগম আর রাজবলভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘœ হবে, তাঁদের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, কাজেই তাঁরা চান নগদ লেনদেন।
বেগম প্রতিবাদ করে বলেন, ধনকুবের জগৎশেঠকে টাকা দিতে হলে শওকতজঙ্গের যুদ্ধের খরচ চলবে না। উত্তরে জগৎশেঠ বলেন, তিনি নগদ টাকা চান না, যুদ্ধের খরচও তিনি তাঁর সাধ্যমতো চালাবেন, কিন্তু আসল আর লাভ মিলিয়ে তাঁকে লিখে দিতে হবে একটা কর্জনামা। কর্জনামা সই করে দিলেই তিনি নিশ্চিত হতে পারেন। রায়দুর্লভও তখন দাবি করেন একটা একরারনামা।
এমন সময় প্রহরী এসে বেগমের হাতে দেয় মিরজাফরের পত্র। তিনি শওকতজঙ্গকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন অবিলম্বে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে। শুনে রাজবলভ খুশি হয়। উমিচাঁদ জানান, মিরজাফরের প্রস্তাব তাঁর পছন্দ হয়েছে। ইংরেজরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠেছে।
তারা সিরাজের পতন চায়, শওকতজঙ্গ যদি ঠিক সে সময় আঘাত হানতে পারেন তবে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা তিনি পাবেন এবং জয় হবে অবধারিত। বেগমের মতে সিরাজের পতন সবাই চায়, তবে সিরাজ সম্বন্ধে উমিচাঁদের প্রবল আশঙ্কা নিয়ে টিপ্পনী কাটেন বেগম। উমিচাঁদ বলেন দওলত তাঁর কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়, তাঁর প্রস্তাব অনুমোদন করে ড্রেক তাঁর চিঠির জবাব দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, শওকতজঙ্গের যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সিরাজের সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ঘটানো হয় এবং ইংরেজদের মিত্র সেনাপতিদের অধীনস্থ ফৌজ যেন রাজধানী আক্রমণ করে, তা হলেই সিরাজের পতন হবে অনিবার্য। রাজবলভ বলেন, তাঁদের বন্ধু মিরজাফর রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ইচ্ছা করলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।
হঠাৎ বাইরে শুরু হয় তুমুল কোলাহল। কে যেন বলে নবাব আসছেন। রাজবলভ আর ঘসেটি বেগম নর্তকীদের ডেকে জলসা সরগরম করে তোলেন। পর মুহূর্তেই জলসার আসরে ঢুকে পড়েন মোহনলালকে নিয়ে স্বয়ং নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজের ব্যঙ্গোক্তির জবাবে তাঁর খালাম্মা ঘসেটি বেগম বলেন, তাঁর বাড়িতে জলসা নতুন নয়।
নবাব বলেন, নতুন না হলেও দেশের সবগুলো সেরা মানুষ সে জলসায় শামিল হয়েছেন বলে জলসার রোশনাই তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। নবাব বলেন, তাঁর খালাম্মা নাচ-গানের মাহফিলের জন্যে দেওড়িতে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেছেন, তারা তো নবাবকে প্রায় গুলি করেই ফেলেছিল।
দেহরক্ষী ফৌজ সাথে ছিল বলেই তিনি বেঁচে গেছেন। নবাব রাজবলভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ সবাইকে বিদায় দিতে গিয়ে বলেন, তিনি চিরদিনের জন্যে সে জলসা ভেঙে দিলেন তাঁর চারদিকে তখন ষড়যন্ত্রের জাল, তাই তখন নবাবের খালা আম্মার বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। তিনি তাঁকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে এসেছেন।
ঘসেটি বেগম ক্রুদ্ধ হন। তিনি সরোষে চিৎকার করে বলেন, নবাব তাঁকে বন্দি করেছেন। তাঁর এত বড়ো স্পর্ধা হলো কি করে তা তাঁর বোধের অতীত। নবাব শান্ত কন্ঠে বলেন তাঁকে বন্দি করা হয়নি; প্রাসাদে তিনি তাঁর বোন সিরাজ-জননীর সাথে একসঙ্গে বাস করবেন। ঘসেটি বেগমের অনুরোধে রাজবলভ নবাবকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। নবাব উত্তপ্ত কন্ঠে বলেন যে, তিনি রাজবলভদের চলে যেতে বলেছেন। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল।
তাঁরা চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নবাব রায়দুর্লভকে বলেন, তিনি শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করেছেন। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠাবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে; তিনিও যেন প্রস্তুত থাকেন। প্রয়োজন হলে তাঁকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।
রায়দুর্লভ হুকুম শুনে নিষ্ক্রান্ত হন। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে ওঠেন। সিরাজ বলেন, মোহনলাল তাঁকে প্রাসাদে নিয়ে যাবেন, তাঁর কোনো অমর্যাদা হবে না। ঘসেটি বেগম উন্মাদিনীর মতো নবাবকে অভিশাপ দিতে থাকেন।
দ্বিতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ১০ মার্চ। মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবার। মিরজাফর, রাজবলভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ ও কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াট্স উপবিষ্ট, অস্ত্রসজ্জিত মিরমর্দান, মোহনলাল আর সাঁফ্রে দাঁড়ানো। দৃঢ় পদক্ষেপে প্রবেশ করেন সিরাজ। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে নতশিরে শ্রদ্ধা জানান। সিংহাসনে বসে নবাব বলেন, কয়েকটি জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্যে সভাসদদের সেদিনকার দরবারে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। রাজবলভ বলেন, দরবারে আগে জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি।
নবাব উত্তর দেন যে, তার কারণ তখন পর্যন্ত তাঁকে কোনো জরুরি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। তাঁর বিশ্বাস ছিল সিপাহসালার মিরজাফর, রাজা রাজবলভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকবেন এবং তাঁর পথ বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে না, অন্তত যাঁরা একদিন আলিবর্দীর অনুগ্রহভাজন ছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি তেমনটিই আশা করেছিলেন।
মিরজাফর নবাবের মনোভাব জানতে চাইলে তিনি জানান, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার অভিপ্রায় তাঁর নেই। তিনি নালিশ করছেন নিজের বিরুদ্ধে, বিচার করবেন তারা। বাংলার প্রজা-সাধারণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করতে পারেন নি বলে তিনি তাদের কাছে অপরাধী। জগৎশেঠ নবাবের অপরাধ কি তা জানতে চাইলে নবাবের ইঙ্গিতে দরবারে এনে হাজির করা হয় এক ব্যক্তিকে।
ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। তার মর্মন্তুদ দুরবস্থার প্রতিকার করতে রায়দুর্লভ তরবারি নিষ্কাষণ করেন। তাঁকে নিরস্ত্র করে নবাব বলেন, লোকটার সে দুরবস্থার জন্যে দায়ী তাঁর দুর্বল শাসন। উৎপীড়িত লোকটা জানায়, সে লবণ বিক্রি করেনি বলে কুঠির সাহেবরা তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, ওদের আরেক জন তার নখের ভেতরে খেজুরকাঁটা ফুটিয়েছে। তার বউকে ওরা খুন করেছে।
নবাব ওয়াটসের কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, নবাবের নিরীহ প্রজার এমন দুরবস্থার জন্যে দায়ী কে এবং ওয়াট্স বলে তা সে জানে না। নবাব রেগে গিয়ে বলেন যে, ইংরেজদের অপকীর্তির সব খবরই তিনি রাখেন। কুঠিয়াল সাহেবরা দৈনিক কতগুলো নিরীহ প্রজার ওপর অত্যাচার করে তার হিসাব চান তিনি ওয়াটসের কাছে। ওয়াটস অপমান বোধ করে। সে বলে, দরবারে ইংরেজের প্রতিনিধি হয়ে দেশের কোথায় কি হচ্ছে তার কৈফিয়ত সে দিতে পারে না।
সিরাজ বলেন, ওয়াটস সত্যিকার প্রতিনিধি নয়, তাঁর এবং ড্রেকের পরিচয় তাঁর অজানা নেই। দুশ্চরিত্রতা আর উচ্ছৃঙ্খলতার জন্যে তাদের স্বদেশ থেকে নির্বাসিত না করে পাঠানো হয়েছে ভারতে বাণিজ্য করতে। এ দেশে এসে তারা দুর্নীতি আর অনাচারের পথ ত্যাগ করতে পারেনি নবাব ওয়াটসের কাছে। নিরীহ প্রজাদের ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচারের কৈফিয়ত দাবি করেন ।
ওয়ার্টস বলতে চায় যে, তারা ট্যাক্স দিয়ে শান্তিতে বাণিজ্য করে, প্রজাদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। উত্তরে নবাব বলেন, ট্যাক্স দিয়ে বাণিজ্য করে বলে তারা তাঁর প্রজাদের ওপর অত্যাচার করার অধিকার পায় নি। তিনি মিরজাফর, জগৎশেঠ প্রমুখ সভাসদদের বলেন, তাঁদের পরামর্শেই তিনি কোম্পানিকে লবণের ইজারাদারী দিয়েছেন।
তাঁরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, রাজস্বের পরিমাণ বাড়লে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হবে। তিনি সভাসদদের জিজ্ঞেস করেন, বাংলার নবাব ব্যক্তিগত অর্থলালসায় বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে কুঠিয়ালদের প্রশ্রয় দিয়েছেন কিনা; তিনি অনাচারীদের বিরুদ্ধে শাসন-শক্তি প্রয়োগের সদিচ্ছা হৃষ্ট মনে গ্রহণ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
সিরাজ জোর গলায় বলেন, সিপাহ্সালার নবাবকে ভয় দেখাচ্ছেন। দরবারে বসে নবাবের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত তাও তার স্মরণ নেই। তিনি সেই মুহূর্তেই সিপাহ্সালারকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করতে পারেন। মিরজাফর, রাজবলভ, জগৎশেঠ সবাইকে কয়েদখানায় আটক করতেও পারেন, আর শত্র“র কবল থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে তাঁকে তা করতে হবে, দুর্বলতা দেখালে চলবে না।
মোহনলাল তরবারি নিষ্কাশন করেন, নবাব তাঁকে হাতের ইঙ্গিতে নিরস্ত করে আবার সভাসদদের বলেন, তিনি তা করবেন না। তিনি ধৈর্য ধারণ করবেন। অসংখ্য ভুল বোঝাবুঝি, অসংখ্য ছলনা আর শঠতার ওপর নবাব আর তাঁর সভাসদদের স¤প্রীতির ভিত প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সন্দেহের কোনো অবকাশ তিনি রাখবেন না। মিরজাফর বলেন, তাঁদের প্রতি নবাবের সন্দিগ্ধ মনোভাবের পরিবর্তন না হলে দেশের অকল্যাণের কথা ভেবে তাঁরা উৎকণ্ঠা বোধ করবেন।
সিরাজ বলেন, দেশের কল্যাণ, দেশবাসীর কল্যাণই সবচেয়ে বড়ো কথা। দেশের কল্যাণের পথেই তাঁরা আবার পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পারেন। তিনি জানতে চান, দেশের কল্যাণের পথে তাঁরা তাঁর সহযাত্রী হবেন কিনা। রাজবলভ নবাবের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে জানতে চাইলে নবাব বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য অস্পষ্ট নয়।
কলকাতায় ওয়াটস এবং ক্লাইভ আলীনগরের সন্ধি খেলাপ করে তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে ফরাসিদের চন্দননগর আক্রমণ করেছে। তাদের ঔদ্ধত্য বিদ্রোহের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এ বিদ্রোহ দমন না করলে একদিন ওরা মুর্শিদাবাদের মর্যাদার ওপর আঘাত হানবে।
মিরজাফর নবাবের হুকুম চাইলে সিরাজ বলেন, তিনি অন্তহীন সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ভরসা নিয়ে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা ইচ্ছে করলে নবাবকে ত্যাগ করতে পারেন। বোঝা যতই দুর্বহ হোক, তিনি তা একাই বইবেন। শুধু একটি অনুরোধ, যেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত না করেন।
মিরজাফর বলেন, দেশের স্বার্থের জন্যে নিজেদের স্বার্থ তুচ্ছ করে তাঁরা নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকবেন। সিরাজ আশ্বস্ত হন। তিনি বলেন, তিনি জানতেন যে, দেশের প্রয়োজনকে তাঁরা কখনও তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। মিরজাফর সিরাজের হাত থেকে পবিত্র কোরান নিয়ে নতজানু হয়ে দুহাতে কোরান ছুঁয়ে আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।
জগৎশেঠ, রাজবলভ, রায়দুর্লভ নিজ নিজ প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করলেন তামা, তুলসী আর গঙ্গাজল ছুঁয়ে; উমিচাঁদ কসম করেন রামজীর নামে। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেন সর্বশক্তি দিয়ে চিরকাল তাঁরা আজ্ঞা পালন করবেন বাংলার নবাবের।
সিরাজ ওয়াটসকে বলেন, আলীনগরের সন্ধির শর্তানুসারে তিনি ওয়াটসকে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওয়াট্স সে সম্মানের অপব্যবহার করে গুপ্তচরের কাজ করছে। তিনি তাঁকে সাজা দিলেন না, তবে বিতাড়িত করলেন তাঁর দরবার থেকে।
তাকে বলে দিলেন ক্লাইভ আর ড্রেককে জানাতে যে, তিনি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবেন। নবাবের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেইমান নন্দকুমারকে ঘুষ দিয়ে তারা চন্দননগর ধ্বংস করেছে। সে ঔদ্ধত্যের যথাযোগ্য শাস্তি তাদের দেয়া হবে।
দ্বিতীয় অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ১৯ মে। মিরজাফরের আবাসগৃহ। মিরজাফর, রাজবলভ, জগৎশেঠ মন্ত্রণারত। জগৎশেঠ বলেন যে, মিরজাফর বড়ো বেশি হতাশ হয়ে পড়েছেন। মিরজাফর প্রতিবাদ করে বলেন যে, তিনি হতাশ হয়ে পড়েন নি, নিস্তব্ধ হয়ে আছেন অগ্নিগিরির মতো প্রচণ্ড গর্জনে ফেটে পড়ার জন্যে। তাঁর বুকের ভেতর আকাক্সক্ষা আর অধিকারের লাভা টগবগ করে ফুটছে ঘৃণা আর বিদ্বেষের অসহ্য তাপে।
তিনি তাঁর আঘাত হানবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজবলভ বলেন, প্রকাশ্য দরবারে সেদিনকার এত বড়ো অপমানের কথা তিনি কল্পনাও করেন নি। মিরজাফর বলেন, সিরাজ সেদিন শুধু অপমান করেন নি, প্রাণের ভয়ে তাদেরকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন। পদস্থ কেউ হলে সেদিন মানীর মর্যাদা বুঝতো, কিন্তু মোহনলালের মতো একটা সামান্য সিপাই যখন নাঙ্গা তলোয়ার হাতে দাঁড়ায় তখন আতঙ্কে তিনি কেয়ামতের ছবি দেখেছিলেন।
রায়দুর্লভ ফোঁড়ন কাটেন যে, সিপাহসালারের অপমানটাই সেদিন তার বুকে বেশি বেজেছিল। জগৎশেঠ অবাক হয়ে বলেন, চারদিকে বিপদবেষ্টিত হয়েও সিরাজ চান তাঁদের বন্দি করতে; সিংহাসনে স্থির হয়ে বসতে পারলে তো কথাই নেই। রাজবলভ বলেন, সিরাজ তাদের অস্তিত্বই লোপ করে দিতে চান।
তাঁদের সম্বন্ধে নবাবের বাইরের আচরণে সন্দেহ প্রকাশ পেয়েছে যতখানি তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে অপ্রকাশিত। শওকতজঙ্গের ব্যাপারে নবাব তাঁদের কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি। শুধু মোহনলালের অধীনে সৈন্য পাঠিয়ে তাকে বিনাশ করেছেন; এতে তাঁদের নিশ্চিন্ত বোধ করার কিছুই নেই।
জগৎশেঠ বলেন, তাঁরা যে নিরাপদ নন, তার প্রমাণ তো হাতের কাছেই রয়েছে। নবাব তাঁদের বন্দি করতে যেয়েও করেন নি, কিন্তু রাজা মানিকচাঁদ তো ছাড়া পান নি। শেষ পর্যন্ত দশ লক্ষ টাকা খেসারাত দিয়ে তাঁকে মুক্তি কিনতে হয়েছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, নন্দকুমারের অদৃষ্টেও বিপদ ঘনিয়ে এসেছে।
মিরজাফর জানান, তাঁদের কারো অদৃষ্টই মেঘমুক্ত নয়। মিরজাফর বলেন, কাজেই নবাবের উচ্ছেদের ব্যাপারে কালক্ষয় করা উচিত হবে না। রাজবলভ জানান যে, তাঁরা প্রস্তুত। নেতৃত্ব ন্যস্ত হয়েছে মিরজাফরের হাতে; তিনি কর্মপন্থার নির্দেশ দিলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
মিরজাফর বলেন যে, যদিও তাঁর ওপর তাঁদের সবার আন্তরিক ভরসা রয়েছে, তবু মনের সন্দেহটা দূর করার জন্যে একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমে পাকাপাকি করে নেয়া উচিত। এমন সময় রাইসুল জুহালা প্রবেশ করে বলে যে, মিরজাফরের নবাব হতে আর বেশি দেরি নেই।
সে বলে, উমিচাঁদের চিঠি নিয়ে গিয়েছিল সে ক্লাইভের কাছে; ক্লাইভ তাকে গুপ্তচর সন্দেহ করে কতল করতে চেয়েছিল; সে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সে অবশ্যি তখন উমিচাঁদের কাছ থেকে তার পত্র নিয়ে এসেছে। পত্রটা সে মিরজাফরের হাতে তুলে দেয়।
মিরজাফর পত্র পড়ে তা এগিয়ে দেন রাজবলভের দিকে। সবার হাত ঘুরে চিঠিটা আবার ফিরে আসে মিরজাফরের হাতে। মিরজাফর অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে চান। চিঠির জবাব দেবার আগে তিনি সরাতে চান রাইসুল জুহালাকে। জগৎশেঠের মতে তাঁদের নিজস্ব গুপ্তচরকেও বিশ্বাস করা যায় না।
তারা মূল চিঠি হয়তো আসল জায়গাতেই পৌঁছে দিচ্ছে কিন্তু তার একখানা নকল হয়তো বা নবাবের লোকের হাতে গিয়ে পড়ছে। রাইসুল জুহালা ফোঁড়ন কেটে বলে, সন্দেহ করাটা অবশ্যি বুদ্ধিমানের কাজ, কিন্তু অতিরিক্ত সন্দেহে বুদ্ধিটা গুলিয়েও যেতে পারে। সে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গুপ্তচরেরাও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে, তাদের বিপদের ঝুঁকিও কম নয়।
জগৎশেঠ তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, রাইস সম্পর্কে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেননি। মিরজাফর তাকে বিদায় দিয়ে বলেন, সে যেন তার সাংকেতিক মোহরটা উমিচাঁদকে দেয়। তাহলে তিনি রাইসের কথা বিশ্বাস করবেন। তাঁকে জানাতে হবে যে, পরবর্তী মাসের ৮ তারিখে দু’নম্বর জায়গায় তাঁদের সবকিছু লেখাপড়া হবে।
রাইস মিরজাফরের সাঙ্কেতিক মোহর নিয়ে বেরিয়ে যায়। মিরজাফর তখন জগৎশেঠকে বলেন, রাইসুল জুহালা অত্যন্ত চতুর লোক। সে উমিচাঁদের বিশ্বাসী লোক। ওর সামনে জগৎশেঠের ওসব কথা বলা ঠিক হয় নি। জগৎশেঠ কৈফিয়তের সুরে বলেন, কি হতে পারে তাই শুধু তিনি বলেছন।
মিরজাফর বলেন, অনেক কিছুই হতে পারে। তাঁরা নিজেরাই তো দিনকে রাত করে তুলেছেন। তাদের চক্রান্তে নবাবের মীর মুন্সি আসল চিঠি গায়েব করে নকল চিঠি পাঠাচ্ছে কোম্পানির কাছে, তাতেই তারা অত সহজে ক্ষেপে উঠেছে।
বুদ্ধিটা অবশ্যি রাজবলভের, কিন্তু নবাবের বিশ্বাসী মীর মুন্সি অসামান্য দায়িত্ব ও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে এটাও একবার ভেবে দেখা উচিত। জগৎশেঠের মতে, গুপ্তচরের সাহায্য ছাড়া তাঁরা এক পাও এগোতে পারতেন না।
মিরজাফর জানিয়ে দেন প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে তাঁর মনে একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি ভাবছেন ইংরেজের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে কি না। রাজবলভ তাঁর কথায় সায় দেন। তাঁর মতে ইংরেজরা বেনিয়ার জাত, পয়সা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।
ওরা জানে নবাবের কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধার আশা তাদের নেই; তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা সিপাহসালারকে মসনদে বসাবার জন্যে সব রকম সাহায্যই দেবে। জগৎশেঠ টাকার লোক। তিনি বলেন, ইংরেজ সব রকমের সাহায্য দেবে বটে, কিন্তু টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। সিরাজকে গদিচ্যুত করা তাদের অপরিহার্য প্রয়োজন, তবুও সিপাহ্সালারকে তারা সাহায্য দেবে নগদ টাকার বিনিময়ে।
রাজবলভের মতে, ইংরেজের প্রবল অর্থলোভও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি যতদূর শুনেছেন ইংরেজের দাবি দু’কোটি টাকার ওপরে যাবে। এত টাকা নবাবের তহবিল থেকে কিছুতেই পাওয়া যাবে না।
মিরজাফর রাজবলভকে জানিয়ে দেন, তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে পড়েছেন, তখন আর ও-কথা ভাববার সময় নেই, উপায়ও নেই। তাঁদের সবার স্বার্থেই ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আবেগে বিভোর হয়ে বলেন যে, স্বপ্ন তাঁর সফল করতেই হবে। বাংলার মসনদ নবাব আলিবর্দীর আমলে, উদ্ধত সিরাজের আমলে, মসনদের পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু এই একটি কথাই ভেবেছেন একটি দিন, শুধুমাত্র একটি দিনও যদি তিনি সে মসনদে বসতে পারেন, তবেই তাঁর জীবনের স্বপ্ন সফল হবে।
মিরজাফরের স্বপ্ন-সাধের একমাত্র প্রতিবন্ধক সিরাজ। তরুণ নবাবকে সরিয়ে সে মসনদ দখল করতে হবে। তার জন্যে যে-কোনো মূল্য দিতে মিরজাফর প্রস্তুত।
আবেগের আতিশয্যে মিরজাফর তাঁর অন্তরের গোপন কামনাকে সুস্পষ্টভাবে ও ভাষায় ব্যক্ত করেন।
বাংলার স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ, কোরান হাতে নিয়ে প্রকাশ্য দরবারে শপথ গ্রহণ, নবাবের প্রতি কর্তব্য সবকিছু ভুলে মিরজাফর তখন বাংলার মসনদের লোভে উন্মাদ, দৃঢ়সঙ্কল্প।
দ্বিতীয় অঙ্ক : তৃতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ৯ জুন। মিরনের আবাসগৃহ। ফরাসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে অর্ধশায়িত মিরন। নর্তকীর হাতে ডান হাত সমর্পিত। অপর নর্তকী নৃত্যরতা। নৃত্যের মাঝেমাঝে সুরামত্ত মিরনের উলাসধ্বনি। সে বলে নর্তকীরা আছে বলেই সে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে তার ভালো লাগছে।
নৃত্যরতা নর্তকী এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দেয় মিরনের দিকে। পরিচারিকা এসে একটা চিঠি দেয় মিরনের হাতে। চিঠি পড়ে বিরক্ত হয় সে। পাশে-বসা নর্তকী তার ইঙ্গিতে উঠে যায় কামরার অন্যদিকে। ছদ্মবেশধারী এক ব্যক্তিকে পৌঁছে দিয়ে পরিচারিকা নিষ্ক্রান্ত হয়।
মিরন বলে যে, সেনাপতি রায়দুর্লভ আসবেন তা সে ভাবেনি। তার ইঙ্গিতে নর্তকীরা চলে যেতে উদ্যত হয়। রায়দুর্লভ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, মিরন তাঁকে নৃত্যগীতের সুধারসে একেবারে নিরাসক্ত বলেই ধরে নিয়েছে। মিরন প্রতিবাদ করে বলে যে, রায়দুর্লভ যখন ছদ্মবেশে এসে হাজির হয়েছেন তখনি সে বুঝেছে যে, প্রয়োজনটা জরুরি; তাই সে চায় না সময় নষ্ট করতে।
রায়দুর্লভ একটি নর্তকীকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন তাকে সে কোথায় পেয়েছে। তিনি বলেন, তাকে যেন আগেও কোথায় দেখেছেন। হঠাৎ মিরনের ওখানে বৈঠকের কথা হয়েছে শুনে তিনি এসেছেন। মিরন বলে, মোহনলালের গুপ্তচর তাদের জীবন অসম্ভব করে তুলেছে, তাই তার বাসগৃহেই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে।
মোহনলাল জানেন, মিরন নাচগানে মশগুল থাকতেই ভালোবাসে। বৈঠকে প্রয়োজনীয় সবাই আসবেন, আর আসবেন কোম্পানির একজন প্রতিনিধি। প্রতিনিধি আসবেন কাশিমবাজার থেকে।
রায়দুর্লভ জানান, তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না। তার পক্ষে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। কখন কোন কাজে নবাব তলব করে বসবেন তার ঠিক নেই। তলবের সঙ্গে সঙ্গে হাজির না হলে সন্দেহ করবেন তিনি।
তাই আগে-ভাগে জানতে এসেছেন, তাঁর সম্বন্ধে তাঁরা কি ব্যবস্থা করছেন। মিরন প্রত্যুত্তরে জানাল, রায়দুর্লভ সম্বন্ধে ব্যবস্থাটা পাকা করা হয়েছে; সিরাজের পতন হলে মসনদে বসবেন তার আব্বা আর রায়দুর্লভ হবেন প্রধান সেনাপতি।
রায়দুর্লভ বলেন যে, তাঁর দাবিটাও তাই, তবে চারদিকের অবস্থা দেখে যদি তিনি বোঝেন যে, তাঁদের সাফল্যের কোনো আশা নেই তখন যেন তাঁরা তাঁর সহায়তার আশা ছেড়ে দেন। মিরন বিস্মিত হয়; বলে, রায়দুর্লভকে যেন কিছুটা আতঙ্কিত মনে হচ্ছে। রায়দুর্লভ বলেন, তিনি আতঙ্কিত নন, তবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। চারদিকে শুধু অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র, তার মধ্যে তিনি কর্তব্য স্থির করতে পারছেন না।
পরিচারিকা খরব দেয় যে, মেহমানেরা সবাই এসে পড়েছেন। মিরনের অনুরোধ সত্তে¡ও রায়দুর্লভ সরে পড়েন। যাবার সময় বলে যান যে, তাঁর সম্পর্কিত ওয়াদার যেন খেলাপ না হয়। কামরায় প্রবেশ করেন রাজবলভ, জগৎশেঠ আর মিরজাফর। মিরন জানায়, একটু আগে রায়দুর্লভ এসেছিলেন; ব্যক্তিগত কারণে তিনি আলোচনায় থাকতে পারবেন না বলে গেছেন, তবে তাঁর দাবিটা খোলাখুলি বলে গেছেন।
রাজবলভ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, সবাই উচ্চাভিলাষী। রায়দুর্লভ চান প্রধান সেনাপতির পদ, অথচ তিনি রাজবলভের কাছ থেকে মাসে মাসে যে বেতন পাচ্ছেন তাতেই তাঁর হাতে স্বর্গ পাবার কথা। মিরজাফর রাজাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, সবাইকে একজোটে কাজ করতে হবে, মানতে হবে সবার দাবি। রায়দুর্লভের মতো ক্ষুদ্র শক্তিধরের সাহায্যেই তাঁরা জিতবেন, এমন কথা নয়; তবে প্রয়োজনের সময় নবাবের সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতার গুরুত্ব প্রচুর।
ঠিক সেই সময় পরিচারিকা এসে জানায়, জানানা সওয়ারি এসেছে। শুনে সবাই একটু বিব্রত হয়ে পড়েন। মিরজাফর পকেট থেকে কয়েক টুকরা কাগজ বের করে তাতে মন দেন। মিরন লজ্জিত হয়। হঠাৎ আত্মসংবরণ করে ধমক দিয়ে পরিচারিকাকে তাড়িয়ে দেয়। রাজবলভের মুখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। তাঁর ইঙ্গিতে মিরন বেরিয়ে যায়।
তিনি নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করে বলেন সেদিনকার আলোচনায় উমিচাঁদের অনুপস্থিতিতে কোম্পানির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব নয়। মিরজাফর হঠাৎ খেই ধরে বলেন, উমিচাঁদ আস্ত কাল কেউটে; তার দাবি আগে না মেটালে সে পরদিনই নবাব দরবারে সব খবর ফাঁস করে দেবে। মিরন জানানাবেশী ক্লাইভ আর ওয়াটসকে নিয়ে প্রবেশ করে। মিরজাফরকে অবাক হতে দেখে ক্লাইভ কারণ জিজ্ঞেস করেন।
মিরজাফর বলেন, তাঁদের ওভাবে সেখানে আসাটা বিপজ্জনক। ক্লাইভ তাঁকে ও জগৎশেঠকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনি নবাবকে ভয় করেন না; নবাব তাঁর কিছুই করতে পারবেন না।
রাজবলভ বলেন, গাল ফুলিয়ে বড়ো বড়ো কথা বললেই হয় না। ক্লাইভ সেখানে একাকী এসেছেন, তাঁকে ধরে বস্তাবন্দি করে হুলো-বেড়ালের মতো পানাপুকুরে নিয়ে দুচারটে চুবুনি দিতে বাদশাহের ফরমানের দরকার হবে না। ক্লাইভ বলেন যে, তিনি রাজার কথা বুঝতে পারছেন না; নবাব তাঁদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবেন না।
ক্লাইভের মতে, নবাবের ক্ষমতা নেই। যাঁর প্রধান সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক, যাঁর খাজাঞ্চি, দেওয়ান, আমির-ওমরাহ্ সবাই প্রতারক, তাঁর কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। তবে রাজবলভরা ইচ্ছে করলে ইংরেজদের ক্ষতি করতে পারেন; কারণ তারা সব পারেন। সেদিন তারা নবাবকে ডোবাচ্ছেন, পরদিন যে তারা কোম্পানিকে পথে বসাবেন না তা বিশ্বাস করা যায় না। ইংরেজরা বরং নবাবকে বিশ্বাস করতে পারে।
মিরজাফর তাঁদের সভার উদ্দেশ্যের কথা উত্থাপন করলে ক্লাইভ বলেন, একটা জরুরি কথা প্রথমে সেরে নেয়া দরকার। তাঁর মতে, উমিচাঁদ সে-যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক। ইংরেজদের মনের কথা সে নবাবকে জানিয়ে দিয়েছে। কলকাতা আক্রমণের সময় উমিচাঁদের যে ক্ষতি হয়েছে নবাব তা পুষিয়ে দিতে চেয়েছেন।
বদমাসটা তাদের কাছে এসেছে আবার একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে। মিরজাফর শুনেছেন, সে আরো ত্রিশ লক্ষ টাকা চায়। ক্লাইভের মতে তাকে অত টাকা দেবার ক্ষমতা তাদের নেই; আর ক্ষমতা থাকলেও তাকে অতগুলো টাকা দেবার কোনো যুক্তি নেই। রাজবলভ বলেন, উমিচাঁদ যেমন ধড়িবাজ তাতে সে অন্যরকম ষড়যন্ত্র করতে পারে। যারা ষড়যন্ত্র করছেন, তাঁদের যাবতীয় গোপন খবরই তার জানা।
ক্লাইভ রাজবলভকে আশ্বস্ত করে বলেন, উমিচাঁদ অনেক বুদ্ধি রাখে, কিন্তু ক্লাইভও তার চেয়ে কম বুদ্ধি রাখে না। তিনি উমিচাঁদকে ঠকাবার ব্যবস্থা করেছেন। দুটো দলিল হবে; আসল দলিলে উমিচাঁদের কোনো উলেখ থাকবে না। নকল দলিলে লেখা থাকবে, নবাব হেরে গেলে কোম্পানি তাকে ত্রিশ লাখ টাকা দেবে।
উমিচাঁদকে ঠকাবার যে ব্যবস্থা ক্লাইভ করেছেন তা মিরজাফর, রাজবলভ প্রমুখ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না। তারা যদি তা ফাঁস করে না দেন তবে তা কখনো প্রকাশ পাবে না। উমিচাঁদ যদি একথা জানে, তবে বুঝতে হবে তাঁরাই তাকে তা জানিয়েছেন। জগৎশেঠ ক্লাইভকে নিশ্চয়তা দেন যে, তাঁরা তা কখনো উমিচাঁদকে জানাবেন না।
ক্লাইভ বলেন যে, দলিলে কমিটির সবাই সই করেছেন, শুধু মিরজাফরই তখনো সই করেন নি। একটা নির্দিষ্ট স্থানে সই করবেন মিরজাফর; রাজবলভ আর জগৎশেঠ হবেন সাক্ষী। দলিলে লেখা ছিল যুদ্ধে সিরাজের পতন হলে কোম্পানি পাবে এক কোটি টাকা, কলকাতার বাসিন্দারা ক্ষতিপূরণ পাবে সত্তর লাখ টাকা, ক্লাইভ পাবেন দশ লাখ টাকা ইত্যাদি।
সন্ধির শর্ত অনুসারে সিপাহ্সালার নামকাওয়াস্তে মসনদে বসবেন, কিন্তু রাজ্য চালাবে কোম্পানি কথাটা বলেন রাজবলভ। ক্লাইভ চঞ্চল হয়ে ওঠেন, মিরজাফর ইতস্তত করেন। কিন্তু তিনি ভাবেন, এমনিতেই বাজারে নানা গুজব রটেছে, সিরাজ যে-কোনো মুহূর্তে সবাইকে গারদে পুরে দিতে পারেন। তাই তিনি কম্পিত বক্ষে দলিলে সই করতে যান; কিন্তু মনের দ্বিধা তার কাটে না। ভাবেন, রাজবলভ যেমন বললেন, তারা সবাই মিলে বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছেন না তো!
ক্লাইভ মিরজাফরকে কাপুরুষ বলেই জানেন। তার মতে, কাপুরুষদের ওপর কোনো কাজেই ভরসা করা যায় না। তাই তিনি দলিল সই করাতে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নিজেই এসেছেন, ওয়াট্সকে পাঠিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন নি।
তিনি মিরজাফরকে বুঝিয়ে বলেন, নবাব হেরে গেলে বাংলা মিরজাফরদেরই থাকবে। কোম্পানি রাজা হতে চায় না; চায় টাকা। তাদের কোনো ভয় নেই। তারা দেশের জন্যেই দেশের নবাবকে সরিয়ে দিচ্ছেন। নবাব থাকলে দেশের কল্যাণ হবে না।
ক্লাইভের কথায় মিরজাফর অনুপ্রাণিত হন। তিনি দলিলে সই করেন। বলেন, ক্লাইভ ঠিকই বলেছেন, কারণ নবাব তাদের সম্মান দেন না। জগৎশেঠ আর রাজবলভও সই করেন দলিলে। ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত হয়। দলিল ভাঁজ করতে করতে ক্লাইভ বলেন, তারা এমন কিছু করেছেন, যা একদিন ইতিহাস হবে। ক্লাইভ, ওয়াট্স রমণীর ছদ্মবেশ পরার পর সবাই বেরিয়ে গেলে প্রবেশ করে মিরন। সে পরিচারিকাকে সোলাসে বলে, পরদিন যুদ্ধ।
তারপরে শাহজাদা মিরন, তারপর একদিন বাংলার নবাব। একটু পরে এসে পড়েন সেনাপতি মোহনলান। মিরন তাঁকে জলসা-ঘরে প্রবেশ করেছেন বলে দোষারোপ করে। মোহনলাল মিরনকে জিজ্ঞেস করেন, সেখানে প্রচণ্ড ষড়যন্ত্র হ্িচ্ছল কিনা।
শুনে মিরন যেন আকাশ থেকে পড়ে; বলে মোহনলাল তার পিতার নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন। নবাবের সাথে তার পিতার সব গোলমাল প্রকাশ্যভাবে মিটে গেছে; নবাব তাঁকে সৈন্য পরিচালনার ভার দিয়েছেন। এ অপবাদের বিচারপ্রার্থী হয়ে সে তখনই পিতাকে নিয়ে নবাবের কাছে যাবে।
মোহননলাল তরবারি কোষমুক্ত করে মিরনকে বলেন, সে যেন প্রতারণার চেষ্টা না করে। তিনি মিরনকে সতর্ক করে দিয়ে জানান, তাঁর গুপ্তচর কখনো ভুল সংবাদ দেয় না। তিনি জানতে চান, সেখানে কি হচ্ছিল, কে, কে ছিল সে মন্ত্রণা-সভায়।
মিরন উত্তর দেয়, মন্ত্রণাসভা হচ্ছিল কিনা, হলেও কোথায় হচ্ছিল সে তার কিছুই জানে না। ওসব বাজে কাজে সময় কাটানোর স্বভাব তার নেই। সে নর্তকীকে ডেকে আবার জলসার আয়োজন করে। সে মালা হাতে নাচের ভঙ্গিতে মোহনলালের দিকে এগিয়ে যায়। মোহনলাল তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে মালাটি শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে তরবারির দ্বিতীয় আঘাতে তা শূন্যেই দ্বিখণ্ডিত করে নিষ্ক্রান্ত হন।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।