HSC | বাংলা দ্বিতীয় পত্র | ভাষণ ও বক্তব্য ৬-১০ | PDF Download: বাংলা দ্বিতীয় পত্র হতে গুরুত্বপূর্ণ সব ভাষণ ও বক্তব্য গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন ।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্য বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়টির গুরুপূর্ণ কিছু ভাষণ ও বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
উচ্চ মাধ্যমিক ● বাংলা দ্বিতীয় পত্র ● বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও পরীক্ষা প্রস্তুতি
৫. আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভার প্রধান অতিথির একটি ভাষণ তৈরি কর।
শ্রদ্ধেয় সভাপতি, উপস্থিত সুধীমÐলী, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
বাংলাদেশের শহিদ দিবস বা একুশে ফেব্রæয়ারি আজ আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
দিন আসে দিন যায়, মাস আসে মাস যায়, বছর আসে সেও হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। কিন্তু জাতির জীবনে এমন কিছু দিন আছে, যা ভুলবার নয়- তা আসে মানুষকে চেতনাবোধে সমৃদ্ধ করতে। তেমনি একটি দিন হলো ভাষা আন্দোলনের এ মহান দিবস।
ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, এমন নজির বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নয়। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে এতখানি আত্মত্যাগ আর কোনো জাতি করেনি। ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে আপন সত্তা আবিষ্কারের মহিমা। অসা¤প্রদায়িক গণচেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে এ দিনে। ভাষা শহিদের ম্মৃতি রক্ষার্থে শহিদ মিনার গড়ে উঠেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষাকে স্বমর্যাদায় আসীন করার বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম নয়, আত্মচেতনা সমৃদ্ধ জাতীয় জাগরণের উন্মোষ মুহূর্ত। শোষকের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, কূপমন্ডূকতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে উদার মানসিকতার, খÐিত অধিকারের বিরুদ্ধে সামগ্রিক অধিকারের এবং অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের চিরন্তন সংগ্রামের স্মারক একুশ। একুশের মর্মবাণী মাথা নত না করা- সর্ববিধ অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু রেখে প্রাণেরও জীবনের দাবিকে ঘোষণা করাই একুশে অঙ্গীকার।
একুশ প্রতি বছর আমাদের কাছে চায় সত্যের প্রতিষ্ঠা, একুশ আমাদের কাছে চায় মিথ্যার উৎখাত, একুশ আমাদের কাছে চায় সর্বস্তরের জীবনকে সুন্দর ও সুস্থ রাখার অঙ্গীকার। বুকের রক্তে ইতিহাস রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় জীবনের মর্মমূলে গ্রোথিত করেছে দিয়েছে একটি চেতনা যা চির অ¤øান। শাশ^ত সত্যরূপে চিহ্নিত অমর দিন আজ। যে দিনটি এদেশের ইতিহাসকে দিয়েছে পাল্টে এবং বিপ্লবী চেতনায় পরিবর্তিত করেছে আমাদের সংগ্রামী চিত্তকে।
বাংলাদেশের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি অতি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয় চেতনার দিন। এ দিন আমাদের বাঙালি সমাজের ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। আমাদের অস্তিত্ব ও সাহসিকতার উদ্ধোধনি দিবস এবং বাঙালির সুপ্ত চেতনার মুক্তি আন্দোলনের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারির সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে লাখো শহিদের নাম, যাদের ম্মৃতি ভাস্বর এবং অনন্তকালের পথপরিক্রমায় মৃত্যুহীন।
আমাদের স্বাধিকারের সংগ্রাম ও বাঙালি চেতনার উন্মেষের ইতিহাসের সঙ্গে শহিদ দিবসের ইতিহাস সম্পৃক্ত। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে শহিদ দিবসের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে মূল প্রেরণা ও উদ্দীপনা, ভাষাগত জাতীয়তাবাদের যে অনুভাবনা তার সূচনা একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা থেকেই। শহিদ দিবস বার বার আমাদের দিয়েছে সাহস ও সংগ্রামের দীক্ষা। ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শহিদ দিবস যেন একটি প্রতীক। ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তান সৃষ্টি হয় তার মূল ভিত্তি ছিল দ্বিজাতি তত্ত¡।
মুসলমান ও পাকিস্তান চেতনার দ্বরা বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার জন্য পাকিস্তানের তদানীন্তন শাসনচক্র এক গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। তার প্রথম নগ্ন প্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার জনসভায় ভাষণদানের সময়ে বলেন, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা।” সেদিন সচেতন বাঙালি তরুণেরা এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে।
সরকার এরপর বাংলা ভাষাকে অবলুপ্ত করার জন্য নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। এরপর শুরু হয় সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট ইত্যাদি। এক পর্যয়ে ১৪৪ দ্বারা উপেক্ষা করায় পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয় সাধারণ জনতার উপর। গুলিতে একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি লুটিয়ে পড়েন শফিক, রফিক, জব্বার ও বরকতসহ আরো নাম না জানা তরুণ।
পরিবেশে বলা দরকার যে, ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদরা রমনার রক্তিম কৃষ্ণচূড়া আর লক্ষ লক্ষ পলাশকে সাক্ষী রেখে বুকের তাজা রক্তে মাটি ভিজিয়ে এদেশের আপামর মানুষের মাতৃভাষার অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এজন্য আমাদের ভুললে চলবে না যে, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে ধ্রুবতারা, অন্ধকার সমুদ্রে পাঞ্জেরি। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু শহিদ দিবস নয়- আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহিদের প্রাপ্য অধিকার আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই এরম মর্যাদা অক্ষুণ্ন ও অ¤øান রাখতে আমরা চাই বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হোক।
এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার বক্তব্য শোনার জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
৬. ফেসবুক ব্যবহারের ভালো ও মন্দ দিকগুলো নির্দেশপূর্বক একটি ভাষণ তৈরি করো।
ফেসবুক ব্যবহারের ভালো ও মন্দ দিক নির্দেশ করার উদ্দেশ্যে আয়োজিত এই মহতী সভার মাননীয় সভাপতি, সম্মানিত প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচক বৃন্দ ও সম্মানিত সুধীমÐলী আপনাদের জানাই আন্তরিক অভিবাদন।
আজ একটি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ভালোমন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করব। ‘ফেসবুক’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম৷ এটি বিশ্ব সামাজিক আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট। ২০০৪ সালে ফেসবুক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মার্কজুকারবার্গ। ২০০৪ সালের ডিসেম্বর ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ। বর্তমানে এর সংখ্যা হয়েছে ১৮৫ কোটির চেয়ে বেশি। বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৪২ কোটি। এই ফেসবুক এখন এতটাই জনপ্রিয় যে, যাবতীয় সামাজিক যোগাযোগ ছাড়াও অনলাইনে কেনাকাটার কাজেও এই নেটওয়ার্কই ব্যবহৃত হয়।
সুধী,
ফেসবুকে অনেক সুবিধার মধ্যে অন্যতম সুবিধা হলো ‘যোগাযোগ’ ফেসবুকের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করা সম্ভব। পুরনো বন্ধু-বান্ধবী খুঁজে পাওয়ার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। পরিচিত ও অপরিচিত অনেককেই এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। আমাদের অনেক বন্ধুর ফোন নম্বর অজানা থাকে বা তার ফোন নম্বর পরিবর্তন করে থাকে তারপরও ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা যায়।
যেকোনো কাজে আমরা একজন আরেকজনকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুকের মাধ্যমে খুব সহজেই এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো যায়, সাহায্য পাওয়া যায়, হতদরিদ্রদেরও সাহায্য করা যায়। ভালো কিছু ভিডিও, নিউজ, লেখা ইত্যাদি শেয়ার করে বন্ধুদের দেখানোর সুযোগ রয়েছে। কারো সঙ্গে ভালো কিছু হলে বা অন্যায় কিছু হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটার পক্ষে বা বিপক্ষে অনেক বড়ো আকারে সাড়া পাওয়া যায়।
প্রিয় সুধী,
ফেসবুকের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আলোচনা। এখানে অনেকেই গ্রুপের মাধ্যমে আলোচনা করে থাকেন। সেটা হতে পারে ব্যবসায়িক, শিক্ষাবিষয়ক, সংগঠনিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করা। অনেকে নানা ব্যস্ততার মধ্যে থাকে, অনেক সময় সংগঠন বা অন্যান্য মিটিং-এ অংশগ্রহণ করতে পারে না, তাই কোনো বিষয়ে সংগঠন বা গ্রুপকে জানানোর প্রয়োজন হলে সবাইকে ফোন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তখন গ্রুপে একটি পোস্ট করে দিলে সবাই সেই বিষয়ে জানতে পারে।
বর্তমানে ফেসবুকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড়ো আকারে ধারণ করছে সেটা হলো ফেসবুক মার্কেটিং। বর্তমানে নিউজ পোর্টালগুলো বেশিরভাগ ভিউ বা ট্রাফিক নিয়ে আসে এই ফেসবুকের মাধ্যমে। অন্য দিকে অনলাইন শপিং এর মার্কেটিং করা হচ্ছে এর মাধ্যমে। ফেসবুক থেকে আপনি ইনকামও করতে পারেন। এই মাধ্যমে মার্কেটিং করে।
সম্মানিত সুধী,
ফেসবুকের ভালোদিকের পাশাপাশি কিছু মন্দ দিকও রয়েছে। ফেসবুকের সবচেয়ে বড়ো নেতিবাচক হলো এটি সময় নষ্ট করে। বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে যেখানে অনেকেই ফেসবুকে ঢুকে বসে আছে যা ওই সময় একটা খারাপ দিক তুলে ধরে। কেউ কাউকে সময় দিতে পারছে না। ফেক আইডি, মানে ভুয়া নাম, ঠিকানা, অন্য মানুষের ছবি ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে কিছু সংখ্যক ফেসবুক ব্যবহারকারী। পরবর্তী পর্যায়ে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলছে কেউ কেউ এবং মোটা অংকের টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে।
সুপ্রিয় সুধী,
আইডি হ্যাক, মানে একজন ব্যক্তি অন্য একজনের ফেসবুক আইডিতে ঢুকছে তার অনুমতি ছাড়া। বিভিন্ন কোডিং-এর মাধ্যমে এবং সেখানে আপত্তিকর ছবি ভিডিও আপলোড করে বা তাকে ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করছে অনেকেই। অন্যদিকে তরুণ-তরুণীরা ফেসবুকের মাধ্যমে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে তারা অনাকাঙ্ক্ষিত নানা ঘটনার শিকার হচ্ছে। মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই করছে সাহায্যের নামে ব্যবসা। মানুষের কাছ থেকে নিচ্ছে প্রচুর পরিমাণ অর্থ।
প্রিয় সুধী,
ফেসবুক একদিকে যেমন দিয়েছে বেগ, তেমনি কেড়ে নিয়েছে আবেগ। ফেসবুকের কল্যাণে আমরা আজ আমাদের পরিবার পরিজন থেকেও দূরে সরে গিয়েছি। পরিবারের লোকজন আমাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সময় পায় না। ফলে সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক ভাঙ্গন এসব প্রকট হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি ফেসবুকের নেশায় মত্ত হয়ে আজকের তরুণ সমাজ পড়াশোনা থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে, ফলে তাদের মেধাটাও ভিন্নখাতে প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে কাঙ্ক্ষিত মেধাবী ঝড়ে পড়ছে এবং ফেসবুকের নেশা ছাড়তে না পেরে আমাদের তরুণ সমাজ পর্যায়ক্রমে আরো অবক্ষয়ের দিকেও ধাবিত হতে পারে। তাই প্রযুক্তির কল্যাণে ফেসবুকের কাঙ্ক্ষিত ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাই ফেসবুক ব্যবহারে আমাদের সচেতন হতে হবে।
৭. ২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে একটি ভাষণ প্রস্তুত করো।
শ্রদ্ধেয় সভাপতি এবং সমাগত সুধীবৃন্দ,
আজ আমরা এক পরম পুণ্যলগ্নে এখানে সমবেত হয়েছি। সমগ্র বাঙালি জীবনে ২২ শ্রাবণ শুধু স্মরণীয় দিন নয়, আমাদের জীবনের মহত্তম আবেগকে আশ্রয় করে আছে এ দিনটি।
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এ দিনটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন। আশি বছরের জীবনে তিনি চিন্তাচেতনায়, রচনায়, অনুভাবনায় বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি বাঙালির জীবনকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে, আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে, আমাদের সংগীতের সঙ্গে, মোটকথা আমাদের জীবনের প্রতিটি শোভনতম আবেগের সঙ্গে বিজড়িত হয়ে আছেন। তিনি আমাদের কাছে শুধু একজন ব্যক্তিমাত্র নন; একটি জাতির সমগ্র জীবনের আধার। বাঙালি জাতির জীবনে বিশ শতকের প্রথম চল্লিশ বছরকে রবীন্দ্রযুগ বলেই চিহ্নিত করা যায়।
বাল্যকালেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল। বয়সের সাথে সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর এ প্রতিভার বিকাশ অব্যাহত ছিল। মহামনীষীদের জীবনেও এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর দীর্ঘ জীবনে সারস্বত-সাধনা সৃষ্টির কত বিচিত্র পথেই না ঐশ্বর্য লাভ করেছে! ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের বিপুল সৃষ্টি-সম্ভারের কণিকামাত্র। কবিকৃত এ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে সেদিন ইউরোপ বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়েছিল। এ কাব্যই বাঙালির ঘরে বহন করে আনে বিশ্ববিজয়ীর বরমাল্য— ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
পরাধীন ভারতবর্ষে এর চেয়ে বড় গৌরব সেদিন আর কিছু ছিল না। দেশ ও কালের সাথে তাঁর চিন্তা ছিল ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ— সর্বত্রই তিনি শ্রেষ্ঠ। নবযুগে বাঙালির সঙ্গীত তাঁরই দান। একটি সমুদ্রকে যেমন গÐুষে তুলে ধরা যায় না, একটি আকাশকে যেমন মুঠিতে ধরা সম্ভব নয়, রবীন্দ্রপ্রতিভাকেও তেমনি কোনো সভায় উপস্থাপন করা অসম্ভব। অনাগত কালে আরো মহত্তম প্রতিভার আবির্ভাবের পূর্বে তিনি আমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠতম মনীষী।
প্রিয় সুধী,
রবীন্দ্রনাথই আমাদেরকে আঞ্চলিক সংকীর্ণতার গÐী ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানসিকতার অধিকারী করে তুলেছিলেন। সভ্যতা কোনো জাতির নিজস্ব সম্পত্তি নয়; তা সমগ্র মানবজাতির। দেশকে গভীরভাবে ভালোবেসেও তিনি ছিলেন বিশ্বের নাগরিক। মানুষের ক্ষুদ্র চেতনা, অন্ধ বুদ্ধি, সংকীর্ণ সংস্কার এবং মানুষের প্রতি অবিশ্বাস তাঁকে আহত করত সবচেয়ে বেশি। তাঁর কণ্ঠেই আমরা প্রথম শুনেছি— দেশ মৃন্ময় নয়, দেশ চিন্ময়।
তিনি চিন্ময় মানুষকেই ভাবীকালের অগ্রদূত বলে ঘোষণা করেছেন। এ মানুষ নির্মাণের জন্যে তিনি গড়েছিলেন শান্তিনিকেতন। মৃত্যুর উপান্তে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী দিনগুলোতে তিনি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোকে পাপ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন, সত্য ও কল্যাণের প্রশস্তি গেয়েছেন। মূলত তাঁর সারা জীবনের সাধনা ছিল সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সাধনা। আমরা মানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম। রবীন্দ্রভাবনা যেন সবার মধ্যে স¤প্রসারিত হয়— এ কামনা এবং রবীন্দ্রপ্রেমীদের সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য এখানেই শেষ করছি।
৮. বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির জন্য একটি ভাষণ রচনা করো।
সম্মানিত সভাপতি, উপস্থিত সুধীবৃন্দ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথি করায় অনুষ্ঠানের আয়োজকদের জানাচ্ছি শুভেচ্ছাও কৃতজ্ঞতা। জীবনের জন্য অন্যতম প্রয়োজন ক্রীড়া শিক্ষা। একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষের জন্য ক্রীড়ার সাথে জড়িত থাকা একান্ত জরুরি। খেলাধুলা মানুষকে শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ সবল করে।
ক্রীড়া শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন ধারণের মৌলিক বিষয়। আজকে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সকলকে যেমন আনন্দ দিবে তেমনি সবার মাঝে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করবে। একজন প্রকৃত ক্রীড়াবিদ সকলের বন্ধুতে পরিণত হয়। অনেকের আদর্শ হিসেবে আজীবন বেঁচে থাকে। তার হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ হ্রাস পায় ৷ তিনি সকলের ভালোবাসার পাত্র হিসেবে বেঁচে থাকে। একজন সফল ক্রীড়াবিদ ভক্তদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে। আর পুরষ্কার ক্রীড়াবিদকে সম্মানিত করে। তবে পুরষ্কারের আশায় শুধু ক্রীড়াবিদ হওয়া উচিত নয়। অপরের আনন্দের উৎস হওয়া ও জরুরি।
সুধীবৃন্দ,
যুগ যুগ ধরে খেলাধুলা দেশে দেশে জাতিতে-জাতিতে, গ্রামে-গ্রামে ঐক্য গড়ে তুলেছে। একে অপরকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। সুখী-সমৃদ্ধ জাতি গঠনে সহায়তা করেছে। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি, দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি খেলাধুলা করা অত্যন্ত উপযোগী। এতে শরীর, মন দুই ভালো থাকে।
সারাদিনব্যাপী এই ক্রীড়া অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে যারা মনোনিত হয়েছে তাদের সবাইকে জানাচ্ছি অভিনন্দন। পুরষ্কার হিসেবেও আয়োজকরা এনেছে দেশি-বিদেশি মূল্যবান জিনিসপত্র। এসকল পুরষ্কারক্রীড়ার প্রতি সবাইকে অনুপ্রাণীত করবে।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ,
সবার মধ্যে লুকিয়ে আছে অমিত সম্ভাবনার বীজ। এর অঙ্কুরোধনামে সহযোগিতা করা আমারে সকলেরই দায়িত্ব। যারা পুরষ্কার পেয়েছে অবশ্যই যোগ্যতার নিরিক্ষেই পেয়েছে। আমি তাদের উন্নতি কামনা করছি। যারা পুরস্কার পায়নি, ভবিষ্যতে তাদেরও সাধনার বলে প্রতিযোগিতার অংশ নেওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি। কেননা জীবন একটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। যেখানে নিজেকে তৈরি করতে হয় আগামী প্রতিযোগিতার জন্যে।
সবশেষে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
৯. সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপনের জন্য একটি ভাষণ প্রস্তুত কর।
আজকের অনুষ্ঠানের মাননীয় সভাপতি, বিশেষ অতিথি, সম্মানিত আলোচকবৃন্দ, সুধীমÐলী সবাইকে শুভেচ্ছা। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিশ্ব মানবতার জন্যে একটি গুরুতর সমস্যা। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার পর এ শব্দটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার আগে এর ঐতিহাসিক অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বয়স প্রায় একশ বছর। বিশ শতকের প্রথমদিকে ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের তৎপরতা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম জঙ্গি সংগঠন ছিল ইহুদিদের ‘হাগানাহ’ নামের একটি দল। দলটি ব্রিটিশদের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিন থেকে আরবদের তাড়িয়ে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ‘হাগানাহ’র ইতিহাস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আজকের ফিলিস্তিন ভূখÐ উসমানীয় খেলাফতের অধীন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এ উসমানীয় খেলাফতের পতন হয়।
তখন উসমানীয়দের অধীন থাকা রাষ্ট্রগুলো মিত্রশক্তির অধীন চলে যায়। এতে ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট লাভ করে ব্রিটিশরা। সেখানে ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা থাকলেও ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ সালে বেলফোর চুক্তির মাধ্যমে ঐ ভূখÐে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়। তখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনে আরবরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সেখানে রাতারাতি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। এতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
তখন আরবদের দমনে ইহুদিরা সশস্ত্র পথ বেছে নেয়। তারা একটার পর একটা জঙ্গি সংগঠন গঠন করতে থাকে। ১৯২০ সালে প্রথমেই তারা তৈরি করে জঙ্গি সংগঠন ‘হাগানাহ’। এরপর ইরগুন, স্টার্ন গ্যাং প্রভৃতি সংগঠন গঠন করে তারা জঙ্গি তৎপরতা চালায়।
ইহুদিদের তৎকালীন নেতা বেন গুরিয়ন ১৯৩৮ সালে ঘোষণা করেছিলেন– “আমি ফিলিস্তিন থেকে আরবদের বলপূর্বক বের করে দিতে চাই এবং আমি মনে করি এতে অনৈতিকতার কিছু নেই।” ১৯৪৮ সালে বিশেষ অনুকূল পরিস্থিতিতে তার সেই ‘নৈতিকতা’ বাস্তবরূপ লাভ করে। ঐ বছর ১৪ মে ফিলিস্তিনে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ম্যান্ডেট শেষ হয়। সেদিন রাত ১২টা ১ মিনিটে জুয়িস্ট পিপল কাউন্সিল ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। নৃশংস হত্যা, নির্মম সশস্ত্র আগ্রাসন চলতেই থাকে।ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ছয় মাসের পরিকল্পিত অভিযানের মাধ্যমে ৫৩১টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং ১১টি শহর জনশূন্য করে। ব্রিটিশদের পতনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যের যুগ শুরু হয়। তারা প্রত্যক্ষভাবে ইসলামের নামে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটায়।
এ কারণেই বলা হয় যে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আজকে কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব স¤প্রদায়ের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিভিন্নভাবে পৃথিবীর অনেক দেশ এই সন্ত্রাসবাদের মর্মান্তিক শিকারে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু উগ্রবাদী দল এসব সন্ত্রাসী কর্মকাÐ পরিচালনা করছে। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবেও এসব সন্ত্রাসী কর্মকাÐ কেউ কেউ পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে ইরাকের নাম উল্লেখ করা যায়। ডবধঢ়ড়হং ড়ভ ফবংঃৎঁপঃরড়হ ধ্বংস করার নাম করে ইরাকের মতো প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমিকে কীভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সেই স্মৃতি আমাদের এখনও পুরনো হয়নি।
এখন প্রশ্ন হতে পারে- সন্ত্রাসী কর্মকাÐ কেন পরিচালিত হয়? এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা তাদের মতবাদ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে বা জানাতে চায়। তা কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে নয়, জোর করে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, জোর করে কোনো কালেই কোনো মতবাদই মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে কথা যে সন্ত্রাসীরা জানে না তা নয়, তারা জেনেও তা মানে না। শক্তি প্রয়োগ করে নিরীহদের হত্যা করে, রাষ্ট্রকে কোণঠাসা করে তাদের অন্যায় দাবি আদায় করার চেষ্টা করে। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম তাদেরকে এসব হীনচেষ্টার সফল বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
পৃথিবীর যে প্রান্তেই হত্যা করুক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা স্বীকার করে নিয়ে তারা নিজেদের উগ্রশক্তির জানান দেয়। সন্ত্রাসবাদীরা তাদের অনুসারীদের এই বলে উজ্জীবিত করে যে, তাদের সহিংস কাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া হবে এবং এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে। যারা সহিংস কাজে লিপ্ত হয় তাদের এমন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে, মানসিক অবস্থা আর স্বাভাবিক থাকে না। তারা নেতাদের শিখিয়ে দেওয়া আদর্শ ও মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে। সন্ত্রাসীরা ধর্মের নামে যে অপতৎপরতা ও হত্যাযজ্ঞ চালায় তা মোটেই ধর্মসম্মত নয়। কারণ কোনো ধর্মেই মানুষ হত্যাকে প্রশ্রয় দেয় না এবং সমর্থন করে না।
সন্ত্রাস আজকের বাংলাদেশ ভূখÐে জঙ্গিবাদ এসেছে সা¤প্রদায়িকতার হাত ধরে। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সা¤প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করে। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, বাঙালি, আদিবাসী নৃগোষ্ঠী সবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ যে চারটি নীতিকে গুরুত্ব দিয়েছিল সেগুলো অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা- চেতনাগতভাবে যা অসা¤প্রদায়িকতা। ধর্মনিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা নয় এ কথাটা আমরা সে সময়ে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে সক্ষম হইনি। হয়তো সেকুলারিজমের বাংলা ধর্মনিরপেক্ষতা করা ঠিক হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সমস্যা আজ সারা বিশ্বের সমস্যা। কাজেই জঙ্গিবাদ নির্মূলের জন্য এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কেবল সরকারি উদ্যোগে অস্ত্র দিয়ে আজকের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিহত করা যাবে না।
সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের মধ্যে মানবিক চেতনার জাগরণ ঘটাতে হবে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের জঙ্গি তৎপরতা বন্ধের জন্য সার্বিকভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা-
১. একে অন্যকে বোঝা, সংলাপে প্রবৃত্ত হওয়া, ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
২. কল্পিত শত্রুর পেছনে না ছুটে অন্য ধর্ম, অন্য সংস্কৃতির মানুষকে জানার চেষ্টা করা।
৩. আন্তঃধর্মীয় মূল্যবোধের জাগরণ, আন্তঃসংস্কৃতি, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির ব্যবস্থা করা।
৮. সমাজের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মধ্যে বহুমুখী ও সার্বিক সংলাপের আয়োজন করা এবং গণতন্ত্র ও বহুবাদিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
৫. জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান আগ্রাসী তাগিদ নিয়ন্ত্রণ করা।
৬. জনশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার বিকাশের মাধ্যমে মানবিকবোধ জাগরিত করা।
৭. জঙ্গিবাদ নিরসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং মানববিদ্যা চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মনুষ্যত্ববোধ চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করা এবং মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগ উপযোগী পাঠ্যক্রম চালু করা।
৯. শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে ‘জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা’ বিষয়ক করা, যাতে দেশে সুস্থ চিন্তাবিকাশের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়।
১০. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মের অপব্যাখ্যা থেকে দূরে রাখা এবং স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং আত্মশক্তির জাগরণে তৎপরতা বৃদ্ধি করা।
১১. সহনশীল জাতি হিসেবে বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য জাগরিত করা।
১২. ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা এবং পরস্পরের কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করা।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ
১০. “শিশুশ্রম বন্ধের আবশ্যকতা” বিষয়ে প্রধান অতিথির একটি ভাষণ তৈরি কর।
‘শিশুশ্রম বন্ধের অবশ্যকতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, আলোচকবৃন্দ, উপস্থিত সুধী মÐলী, এতক্ষণ ধরে শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে সম্মানিত আলোচকবৃন্দ যে কথাগুলো বলেছেন, তার বাইরে কিছু বলা সম্ভব নয়। আমার সব কথাই তাঁরা বলে গেছেন। তাঁদের পরামর্শ সমর্থন করে নিয়ে আমি সংক্ষেপে কিছু বলতে চেষ্টা করব।
আমরা একটা কথা প্রায়শই বলি, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। সেটা কীভাবে, তাঁর ব্যাখ্যা আপনাদের অজানা নয়। আবার কথায় কথায় আমরা বলি, শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? পাঁচ বছর বয়স থেকে কলকারখানায়, গ্যারেজে, ওয়ার্কশপে কাজ করে, গাড়ির হেলপারি করে, ইট-পাথর ভাঙার কাজে যোগ দিয়ে, পিতা-মাতা পরিবারের স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে, স্কুলে না গিয়ে, লেখাপড়া না শিখে, নিরক্ষর থেকে, নানা রকম রোগে ভুগে, জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে বেঁচে থেকে? মোটেই না।
শিশুরা কীভাবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে? এগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো শিশুই জাতির ভবিষ্যৎ হতে পারবে না। এসব করে কোনো শিশুই তার পিতার স্বপ্ন, দেশের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। শিশুদের দিয়ে আমরা অল্প বেতনে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু দুবেলা খাবারের বিনিময়ে যে সুবিধা নিই, তা শুধু তাদের জন্য ক্ষতিকর নয়, আমাদের জন্যও আত্মঘাতী।
আমরা অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমিতিতে, সেমিনারে শিশুশ্রম বন্ধের জন্য বড় বড় কথা বলি, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা করি না। প্রথমে আমাদের এ স্ববিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সরকার শিশুশ্রম বন্ধের জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো পালন করতে হবে এবং যারা তা অমান্য করছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। শিশুকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে আমাদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এসব কথা আজকের অনেক বক্তাই এখানে আপনাদের বলেছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির মূলে রয়েছে শিক্ষা। আমরা যদি শিশুদের যথাযথভাবে শিক্ষার আওতায় না আনতে পারি তাহলে জাতীয় উন্নতি সম্ভব হবে না।
কারণ শিশুরা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে না উঠলে তারা দেশের জন্য অকল্যাণকর কাজের কর্মী হয়ে উঠবে। তাতে দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি ব্যাহত হতে বাধ্য। শিশুশ্রমের ভয়াবহ পরিণতি এবং শ্রমবাজারে শিশুদের অমানবিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক আলোচক অনেক পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। আমার কাছে এমনই একটি পরিসংখ্যান আছে। আইএলও’র হিসাবমতে পৃথিবীতে শ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ।
এদের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখ। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেরই রয়েছে ১২ কোটি ৭০ লাখ শিশুশ্রমিক। বিশ্বের প্রতি ৬ শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে নিযুক্ত। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম, পাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন প্রভৃতি কারণে প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার শিশু মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের অবস্থা আরও করুণ।
তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা তাদের টোকাই বলে, পিচ্চি বলে ডাকি। আমাদের এ আচরণ বন্ধ করতে হবে। সারাদেশে অব্যাহতভাবে শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে। দেশের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় এখনও বেআইনিভাবে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া হয়। শিশুশ্রম বন্ধের কঠোর আইন থাকলেও সে আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকার কারণে শত চেষ্টা করেও শিশুশ্রম বন্ধ করা যায় না। অথচ অবশ্যই তা বন্ধ করতে হবে। আজকের অনুষ্ঠানের আলোচকদের এ বিষয়ে নানা পরামর্শের সারসংক্ষেপ করে আমি বলতে চাই যে, শিশুশ্রম বন্ধের জন্য-
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
শিশুশ্রমে নিয়োগকারী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুশ্রমে শিশুর পিতা-মাতা এবং সমাজের মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আশা করি, আজকের আলোচনা আপনাদেরকে শিশুশ্রম বন্ধের ব্যাপারে উৎসাহিত করবে। শিশুর জন্য সুন্দর জীবন বয়ে আনুক আজকের আলোচনা- এ প্রত্যাশায় শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।