HSC | সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | বিশ্লেষণ – ৩ | PDF : বাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক হতে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্যবাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
তৃতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৭৫৭ সালের ১০ জুন থেকে ২১ জুনের মধ্যে যে কোনো একটা রাত। স্থান লুৎফুন্নেসার কক্ষ। লুৎফুন্নেসা ও আমিনা বেগম উপবিষ্ট। ঘসেটি বেগম প্রবেশ করে শ্লেষবিজড়িত কণ্ঠে বলেন যে, রাজ-মাতা আমিনা বেগম বড়ো সুখে আছেন। লুৎফুন্নেসা সাদর সম্ভাষণ জানান তাঁর খালা শাশুড়িকে। ঘসেটি বলেন, সুখী ও সৌভাগ্যবতী হবার দোয়া করলে তা তার জন্যে অভিশাপ বয়ে আনবে।
আমিনা বেগম বড় বোনকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। তাঁকে আমন্ত্রণ জানান কাছে গিয়ে বসতে। ঘসেটি বেগম শ্লেষপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, তিনি বসতে অসেননি, এসেছেন কত সুখে আছেন বোন আমিনা বেগম পুত্র নবাব, পুত্রবধূ নবাব-বেগম শ্লেষপূর্ণ শাহজাদীকে নিয়ে তা দেখতে।
আমিনা বাধা দিয়ে বলেন, সিরাজ তো তাঁরও পুত্র, তিনিও তো তাঁকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। ঘসেটি আক্ষেপ করেন। বলেন, অদৃষ্টের পরিহাসে তিনি ভুল করেছিলেন। তিনি তখন জানতেন না যে সিরাজ বড়ো হয়ে একদিন তাঁর সুখের অন্তরায় হবে, অহরহ তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
জানলে সেদিন দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতেন না। লুৎফা বলেন, তাঁরা ঘসেটি বেগমকে মায়ের মতো ভালোবাসেন, মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করেন।
ঘসেটি প্রতিবাদের সুরে বলেন, যিনি তাঁদের সত্যিকার মা তাঁকে নিয়ে তাঁরা চাঁদের হাট বসিয়েছেন। লুৎফুন্নেসা তাঁকে পরিহাস করছেন। তিনি দরিদ্র রমণী, নিজের সামান্য বিত্তের অধিকারিণী হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নবাব সে অধিকারটুকুও তাঁকে দেন নি।
ঘসেটির কথায় আমিনা বেগম বিরক্ত হন। তিনি বলেন, পুত্রবধূর সামনে তার এমন রূঢ় ব্যবহার অশোভন। ঘসেটি জবাবে বলেন যে, কেউ তাঁর পুত্র বা পুত্রবধূ নন। সিরাজ বাংলার নবাব, আর তিনি তাঁর প্রজা। সিরাজ ক্ষমতার অহঙ্কারে উন্মত্ত, তা না হলে তিনি তাঁর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করতেন না, মতিঝিল থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দিতে পারতেন না।
লুৎফুন্নেসা বলেন, তিনি শুনেছেন নবাব ঘসেটি বেগমের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন কলকাতা অভিযানের সময় তাঁর টাকার প্রয়োজন হয়েছিল বলে এবং গোলমাল মিটে গেলে তিনি তার টাকা ফেরত দেবেন বলে। ঘসেটি কথাটা বিশ্বাস করেন না। লুৎফুন্নেসা বলেন, সে টাকা ফেরত না দেবার কোনো কারণ নেই।
নবাব সে টাকা ব্যয় করেছেন দেশের প্রয়োজনে। ঘসেটি ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি সিরাজকে বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছেন, কিন্তু তার সম্বন্ধে লুৎফুন্নেসার মুখে বড়ো কথা শুনলে গায়ে তার জ্বালা ধরে যায়।
আমিনা বলেন, সিরাজ তার কোনো ক্ষতি করেন নি। কিন্তু ঘসেটি বলেন, তাঁর নবাব হওয়াটাই তাঁর ক্ষতি। আমিনা দুঃখিত হন। তিনি বলেন, তাঁর বড়ো আপা অনর্থক বিষ উদ্গীরণ করে চলেছেন; তাঁর এমন ব্যবহারের অর্থ তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।
সিরাজ ঘরে ঢুকে খালাকে বলেন, তিনি একটা দিনও সুখে নবাবী করেন নি। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে খালাম্মার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তাঁর আরো কিছু টাকার দরকার। তিনি জানেন, বাংলার ভাগ্য নিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা চলছে তার সব খবরই ঘসেটি বেগম জানেন।
সিরাজকে দেখে, বিশেষ করে তিনি টাকা চাইতে এসেছেন বলে ঘসেটি তাঁকে শয়তান বলে, অত্যাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে খালাম্মার আক্রোশ নয়, তাঁর খালাম্মা রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের উন্মাদিনী। তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন খালাম্মার সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করতে তাঁকে যেন বাধ্য করা না হয়। ঘসেটিও তাঁকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, তাঁর চোখে রাঙানোর স্পর্ধা আর বেশি দিন থাকবে না।
উত্তরে সিরাজ বলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ ভেবে তাঁর খালাম্মার উৎকন্ঠিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। সিরাজ তাকে তার নিজের সম্বন্ধে সতর্ক করে দেন। তিনি তাঁর খালাম্মাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, নবাবের মাতৃস্থানীয় হয়ে তাকে শত্র“দের সাথে যোগাযোগ রাখা বাঞ্ছনীয় নয়।
অন্তত সিরাজ তাকে সে দুর্নাম থেকে রক্ষা করতে চান। ঘসেটি বলেন নবাবের মতলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। নবাব তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময় কোনো ক্ষমতাভিলাষী স্বার্থপরায়ণ রমণীর পক্ষে রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দেশের পক্ষে অকল্যাণকর; তিনি তাই তাঁর গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখার ব্যবস্থা করেছেন। নবাবের প্রাসাদে ঘসেটির স্বাধীনতার ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, তবে লক্ষ রাখা হবে যাতে দেশের তৎকালীন অশান্তি দূর হবার আগে বাইরের কারও সাথে তিনি কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারেন।
ঘসেটি বুঝতে পারেন নবাবের উদ্দেশ্য ও মতলব। তিনি নবাব জননীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বিরক্ত হয়ে তাঁকে বলেন, নবাব তাঁকে বন্দিনী করেছেন। এবার আমিনা তা বুঝতে পেরেছেন তিনি নবাবের কেমন মা আর নবাব ঘসেটির কেমন পুত্র। এই বলে তিনি সরোষে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে যান। আমিনা বেগমও তাঁর বড়ো আপাকে ডাকতে ডাকতে তাঁর পেছনে পেছনে বেরিয়ে যান।
লুৎফুন্নেসা নবাবকে বলেন, খালাম্মা বড়ো বেশি অপমান বোধ করছেন। তাঁর সাথে নবাবের অমন ব্যবহার করাটা হয়তো উচিত হয় নি। নবাব ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, তাঁর ব্যবহারে সবাই অপমান বোধ করেছেন, শুধু তাঁর নিজেরই কোনো অপমান নেই। তিনি বলেন, তাঁর জীবন-সঙ্গিনী লুৎফুন্নেসাও যদি অমন অন্ধ হন তবে তিনি আশ্রয় পাবেন না কোথাও।
তিনি বেগমকে বলেন, তিনি দেখতে পাচ্ছেন না শুধু অপমানই নয় নবাবকে ধ্বংস করার জন্যে সবাই কেমন মেতে উঠেছে। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে খালাম্মাই খুশি হবেন সবচেয়ে বেশি। খালাম্মা তাঁর নিজের বোনের ছেলের ধ্বংস করতে চান কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন বলেই মনে করেন লুৎফুন্নেসা। তবে তিনি নবাবকে বলেন, খালাম্মার মন যে তার ওপর যথেষ্ট বিষিয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
অত্যন্ত সংকোচের সাথে তিনি স্বামীকে বলেন, খালাম্মা বিধবা মেয়ে মানুষ, তাঁর সম্পত্তিতে নবাব বার বার অমন হস্তক্ষেপ করতে থাকলে ভরসা নষ্ট হবারই কথা। লুৎফুন্নেসা তাঁর কাজের সমালোচনা করছেন দেখে নবাব ক্ষুব্ধ হন। লুৎফুন্নেসা কৈফিয়তের সুরে বলেন, তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার জন্যে কোনো কথা বলেননি। খালাম্মা রেগে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন, তাই তিনি ও কথা বলেছেন।
নবাব তাঁকে বাধা দিয়ে অভিমান-ক্ষব্ধু কণ্ঠে বলেন, তাই বুঝি লুৎফার মনে হলো, নবাব তাঁর টাকা-পয়সায় হাত দিয়েছেন বলেই তিনি নবাবের ওপর অতখানি বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু লুৎফুন্নেসা জানেন না, কতোখানি উৎসাহ নিয়ে তিনি শওকতজঙ্গের সফলতার জন্যে অজস্র অর্থ ব্যয় করেছেন। শুধু শওকতজঙ্গ নয়, নবাবের শত্র“দের শক্তিবৃদ্ধির জন্যেও ঘসেটি বেগমের দান কম নয়।
লুৎফুন্নেসা নিজের ভুল বুঝতে পেরে নবাবের কাছে ক্ষমা চান। নবাব তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁর চারপাশে অতো দেয়াল কেন? উজির, অমাত্য সেনাপতিদের এবং তাঁর মাঝখানে দেয়াল, দেশের নিশ্চিন্ত শাসন-ব্যবস্থা এবং নবাবের মাঝখানে দেয়াল, খালাম্মা আর তাঁর মাঝখানে দেয়াল, দেয়াল তাঁর চিন্তা আর কাজের মাঝখানে, তাঁর স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে, তাঁর অদৃষ্ট আর কল্যাণের মাঝখানে শুধু দেয়াল আর দেয়াল।
তিনি সে-সব দেয়ালের কোনোটি ডিঙিয়ে যাচ্ছেন, কোনোটি ভেঙে ফেলছেন, কিন্তু তবু দেয়ালের শেষ হচ্ছে না। মসনদে বসার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত যেন দু’পায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সমস্ত প্রাণশক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তিনি লুৎফুন্নেসার কথায় সায় দিয়ে বলেন, সত্যিই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
লুৎফুন্নেসা তাঁকে সব দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তাঁর কাছে দু’একদিন বিশ্রাম নিতে বলায় নবাব বলেন, কবে যে তিনি দু’দণ্ড বিশ্রাম পাবেন তার ঠিক নেই; আবারও তাঁকে যেতে হচ্ছে যুদ্ধে। শুনে লুৎফুন্নেসা ভীত হন। নবাব বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোম্পানির আয়োজন সম্পূর্ণ।
তিনি এগিয়ে গিয়ে বাধা না দিলে তারা সরাসরি রাজধানী আক্রমণ করবে। তাদের সাথে আলীনগরে যে সন্ধি হয়েছিল সে সন্ধি এক মাস না যেতেই তারা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। আর বিদেশি বেনিয়াদের অতদূর স্পর্ধা হয়েছে তাঁর ঘরের লোক অবিশ্বাসী হয়েছে বলেই।
তিনি শুধু একটা জিনিস বুঝে উঠতে পারছেন না, ধর্মের নামে ওয়াদা করে মিরজাফর, রাজবলভেরা কি করে সে ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। তাঁদের কাছে স্বার্থ কি ধর্মের চেয়েও বড়ো?
লুৎফুন্নেসার প্রশ্নের উত্তরে নবাব তাঁকে জানান যে, ওসব ষড়যন্ত্রের কোনো প্রতিকার করতে পারেন নি। তিনি চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ভরসা পাননি। রাজবলভ, জগৎশেঠকে কয়েদ করলে, মিরজাফরকে ফাঁসি দিলে হয়তো প্রতিকার হতো, কিন্তু সেনাবাহিনী তা বরদাস্ত করতো কিনা তা অনিশ্চিত।
লুৎফুন্নেসা নবাবের সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে ব্যাকুলভাবে প্রস্তাব করেন সেদিন নবাব যেন তাঁর কাছে বিশ্রাম নেন, শুধু তিনি আর নবাব থাকবেন, আর কেউ না। নবাব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, তেমন একটা বিশ্রামের কথা অনেক সময় তিনি নিজেও ভেবেছেন।
তিনি বেগমের কাছে বহুদিন আসতে পারেননি। তাঁদের মাঝখানে একটা রাজত্বের দেয়াল। মাঝে মাঝে তিনি কামনা করেছেন বাধাটা দূর হয়ে যাক। তাহলে নিশ্চিন্ত সাধারণ গৃহস্থের ছোট্ট সাজানো সংসার তাঁরা পেতেন। মোহনলালের কাছ থেকে খবর এলে সিরাজ লুৎফুন্নেসার বাধা না মেনে বেরিয়ে যান।
তৃতীয় অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ২২ জুন। পলাশীতে সিরাজের শিবির। গভীর রাতে চিন্তাক্লিষ্ট নবাব পায়চারী করেছেন। দূর থেকে ভেসে আসছে শৃগালের প্রহর ঘোষণার শব্দ। নবাব বলেন, রাতের দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত। ঘুম নেই শুধু শেয়াল আর সিরাজের চোখে। ভেবে তিনি অবাক হয়ে যান……..।
মোহনলাল এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ান। তিনি মোহনলালকে বলেন, সত্যিই তিনি ভেবে অবাক হয়ে যান। তিনি শুনেছেন ইংরেজ সভ্য জাতি। তারা শৃঙ্খলা জানে, শাসন মেনে চলে, কিন্তু পলাশীতে তারা যা করছে, সেতো স্পষ্ট রাজদ্রোহ, একটা দেশের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরেছে, ভেবে তিনি অবাক হন।
মোহনলাল নবাবকে জানান, ইংরেজের পক্ষে মোট সৈন্য তিন হাজারের বেশি হবে না। তারা অবশ্যি অস্ত্র চালনায় সুশিক্ষিত। নবাবের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। ছোটবড়ো মিলে ইংরেজের কামান হবে গোটা দশেক, আর নবাবের কামান পঞ্চাশটার অধিক।
মোহনলাল বলেন, তাঁর সব সৈন্য লড়বে কিনা, সব কামান গোল বর্ষণ করবে কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন। মোহনলালের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে নবাব বলেন, তিনিও তেমন একটা আশঙ্কা করছেন। মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ নিজ নিজ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে, তাঁরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বেন।
মোহনলাল বলেন, মিরজাফরের আর একখানা পত্র ধরা পড়েছে। তিনি পত্রখানা নবাবের হাতে দেন। চিঠি পড়ে নবাবের মুখে উচ্চারিত হয় ‘বেঈমান’। মোহনলাল বলেন, ক্লাইভেরও তিনখানা পত্র ধরা পড়েছে। সে মিরজাফরের জবাবের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে বেলে মনে হয়। সিরাজ বলেন, সাংঘাতিক লোক ক্লাইভ।
মতলব হাসিল করবার জন্যে সে যে-কোনো অবস্থার ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কাছে সবকিছুই যেন একটা বড়ো রকমের জুয়াখেলা। মিরমর্দান প্রবেশ করে বলেন, ইংরেজ সৈন্য লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। ক্লাইভ আর তার সেনাপতিরা উঠেছে গঙ্গাতীরের ছোট বাড়িটায়। সেখান থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরে।
নবাব জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের ফৌজ সাজাবার আয়োজন শেষ হয়েছে কিনা। একটা প্রকাণ্ড নকশা নবাবের সামনে মেলে ধরে মিরমর্দান বলেন, তাঁরা সব গুছিয়ে ফেলেছেন। নবাবের ছাউনির সামনে গড়বন্দি হয়েছে, ছাউনীর সামনে মোহনলাল, সাঁফ্রে আর তিনি নিজে।
আর ডানদিকে গঙ্গার ধারে ঢিপিটার ওপরে একদল পদাতিক তাঁর জামাতা বদ্রী আলী খাঁর অধীনে যুদ্ধ করবে। তাদের ডান পাশে গঙ্গার দিকে একটু এগিয়ে নৌবেসিং হাজারীর বাহিনী। বাঁ-দিক দিয়ে লক্ষবাগ পর্যন্ত অর্ধচন্দ্রাকারে সেপাই সাজিয়েছেন সিপাহ্সালার মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁ।
নকশার কাছ থেকে সরে এসে নবাব পায়চারী করে বলেন, তাঁর শক্তিটা কত বড়ো অথচ কতই না তুচ্ছ। তিনি ভাবছেন অঙ্কের হিসেবে শত্র“র যেন সুবিধের পালাটা ভারি হয়ে উঠেছে। মিরমর্দান বলেন, ইংরেজকে ঘায়েল করতে সাঁফ্রে, মোহনলাল আর তিনিই যথেষ্ট।
সিরাজ তাঁকে বলেন, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। তিনি জানেন, তাঁদের বাহিনীতে পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার আর আট হাজার পদাতিক সৈন্য রয়েছে আর তারা জান দিয়ে লড়বে, কিন্তু মিরজাফরদের বাহিনী সাজিয়েছে দূর লক্ষবাগের অর্ধেকটা ঘিরে।
যুদ্ধে মিরমর্দানেরা হারতে থাকলে তারা দু’কদম এগিয়ে ক্লাইভের সাথে হাত মেলাবে বিনা বাধায়, আর তাঁরা যদি না হারেন তবে মিরজাফরদের সৈন্যরা যে তাদের ওপর গুলি চালাবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তবু তিনি ওদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন; কারণ তাদের চোখে চোখে না রাখলে তারা সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী দখল করতো। মিরমর্দান নবাবকে ভরসা দিয়ে বলেন, তাদের জীবন থাকতে নবাবের কোনো ক্ষতি হবে না। নবাব বলেন, সে কথা জানেন বলেই আরো বেশি করে ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভাবছেন, তাদের প্রাণ বিপন্ন হবে অথচ স্বাধীনতা রক্ষা হবে না এ চিন্তাটাই বেশি পীড়াদায়ক।
মিরমর্দান নবাবকে আশ্বাস দেন, তাঁদের জয় হবে। সিরাজ বলেন, পরাজয়ের কথা তিনিও ভাবছেন না, তিনি শুধু অশুভ সম্ভাবনাগুলো শেষবারের মতো খুঁটিয়ে দেখছেন। পরদিন যুদ্ধ করবে মিরমর্দানেরা অথচ হুকুম দেবেন মিরজাফর।
যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এড়াবার জন্যে যুদ্ধের সর্বময় কর্তৃত্ব সিপাহ্সালারকে দিতেই হবে। তার ফল কি হবে কেউ তা জানে না। নবাব কর্তব্য স্থির করতে পারছেন না এবং কেন পারছেন না তা মিরমর্দান বুঝেছেন বলেই তিনি আশা করেন।
নবাব বলেন, সেনাবাহিনীর শক্তির ওপর নয়, তাঁর একমাত্র ভরসা পরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীনতা মুছে যাবার সূচনা দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁর যদি দেশপ্রীতি জেগে ওঠে সে সম্ভাবনাটুকুর ওপর।
রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে। সিরাজ সবাইকে বিশ্রামের জন্যে বিদায় দিয়ে পায়চারী করেন। সোরাহী থেকে পানি ঢেলে খান। তারপর রেহেলে রাখা কোরআন শরীফের কাছে গিয়ে জায়নামাজে বসেন। কোরআন শরীফ তুলে ওষ্ঠে ঠেকিয়ে রেহেলের ওপর রেখে পড়তে থাকেন। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। শুনে কোরআন শরীফ মুড়ে রাখেন তিনি। ‘আস্সালাতো খায়রুম মিনান্নাওম’; এরপর মোনাজাত করেন। হঠাৎ সুতীব্র তুর্যনাদ নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দেয়।
তৃতীয় অঙ্ক : তৃতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ২৩ জুন। পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র। সিরাজ নিজের তাঁবুতে পায়চারী করেছেন। প্রহরী এসে জানায় যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ইংরেজ ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। মিরজাফর, রায়দুর্লভ আর ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্যরা যুদ্ধে যোগ দেয়নি। মিরমর্দান আর মোহনলাল সসৈন্যে পশ্চাদ্ধাবন করে লক্ষবাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
দ্বিতীয় সৈনিক এসে জানায় যে, সেনাপতি নৌবেসিং হাজারী ঘায়েল হয়েছেন। তৃতীয় সৈনিক এসে বলে, একটু আগে যে বৃষ্টি হয়েছিল তাতে ভিজে নবাবের বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। সেনাপতি মিরমর্দান তাই কামানের অপেক্ষা না করে হাতে হাতে লড়বার জন্যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন। শত্র“দের সময় দিতে চান না বলেই তিনি শুধু তলোয়ার নিয়েই সামনে এগোচ্ছেন।
দ্রুত সৈনিক এসে খবর দেয় সেনাপতি বদ্রী আলী খাঁ নিহত। যুদ্ধের অবস্থা খারাপ। সিরাজ বলেন, মিরমর্দান ও মোহনলাল রয়েছেন কোনো ভয় নেই।
হঠাৎ সাঁফ্রে প্রবেশ করে উৎকণ্ঠিত নবাবকে বলেন, নবাব সৈন্যের তখন পর্যন্ত পরাজয় না হলেও যুদ্ধের অবস্থা তাঁদের জন্যে খারাপ হয়ে উঠেছে।
সিরাজ তাঁকে রণক্ষেত্রে যেয়ে যুদ্ধ করতে ও জয়ী হতে নির্দেশ দেন। সাঁফ্রে বলেন, তিনি তো ফ্রান্সের শত্র“দের বিরুদ্ধে লড়ছেন। প্রয়োজন হলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেবেন, কিন্তু নবাবের বিরাট সেনাবাহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজ দৃঢ়তায় সাথে বলেন, মিরজাফর, রায়দুর্লভদের বাদ দিয়েও সাঁফ্রে, মিরমর্দান প্রমুখ যুদ্ধে জিতবেন। তিনি জানেন, জয় হবেই।
সাঁফ্রে জানান, তাদের গোলার আঘাতে কোম্পানির ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময় এলো বৃষ্টি এবং হঠাৎ জাফর আলী খাঁ হুকুম দিলেন তখন যুদ্ধ হবে না। মোহনলাল যুদ্ধ বন্ধ করতে চান নি, কিন্তু সিপাহসালরের আদেশ পেয়ে পরিশ্রান্ত সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করে শিবিরে ফিরতে থাকে। সুযোগ পেয়ে কিলপ্যাট্রিক তখনি তাদের আক্রমণ করে।
মিরমর্দান তাদের বাধা দিচ্ছেন, কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। তাঁকে এগুতে হচ্ছে কামান ছাড়া। এমন সময় সৈনিক খরব দেয় সেনাপতি মিরমর্দান নিহত হয়েছেন। সাঁফ্রে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আচ্ছন্নের মতো সিরাজ বলেন, সেনাপতি মিরমর্দানের পতন হয়েছে। সাঁফ্রে বলেন, ‘ঞযব নৎধাবংঃ ংড়ষফরবৎ রং ফবধফ’. তিনি চলে যান এবং কথা দিয়ে যান ফরাসিরা প্রাণপণে লড়বে।
সিরাজ বলেন, সাঁফ্রে ঠিকই বলেছেন শ্রেষ্ঠ সৈনিকের পতন হয়েছে। নৌবেসিং, বদ্রী আলী, মিরমর্দান নিহত। হঠাৎ মনে পড়ে আলীবর্দীর সাথে থেকে যুদ্ধ তিনিও করেছেন, বাংলার সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ বীর সৈনিক তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি উপস্থিত নেই বলেই পরাজয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। তিনি সৈনিককে হুকুম করেন তাঁর হাতিয়ার নিয়ে আসতে, তিনি যুদ্ধে যাবেন; এতোদিনের ভুল সংশোধন করার সে সুযোগ তাঁকে নিতে হবে।
এমন সময় মোহনলাল প্রবেশ করে জানান, পলাশীতে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তখন আর আত্মভিমানের সময় নেই। নবাবকে অবিলম্বে ফিরে যেতে হবে রাজধানীতে। মিরজাফরের কৈফিয়ৎ চাইবারও সুযোগ নেই, সে ততক্ষণে হয়তো ক্লাইভের সাথে যোগ দিয়েছে।
নবাব যেন এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করেন; মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে তাঁকে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে। নবাবকে একাই ফিরে যেতে হবে; কারণ মোহনলাল আর সাঁফ্রের যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। মোহনলালের শেষ যুদ্ধ পলাশীতে।
মোহনলাল চলে গেলে নবাব আত্মগতভাবে বলেন, মোহনলালের সাথে তাঁর আর দেখা হবে না। তার কথামতো নবাবকে একাকীই প্রস্তুতি নিতে হবে নতুন করে। সবকিছু প্রস্তুত ছিল; সিরাজ রাজধানী অভিমুখে বেরিয়ে পড়লেন। যাবার আগে মোহনলালের জন্যে নির্দেশ রেখে গেলেন, মীরমর্দানের লাশ যেন উপযুক্ত মর্যাদায় মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
তুমুল কোলাহলের মধ্যে সসৈন্যে প্রবেশ করেন ক্লাইভ, মিরজাফর, রাজবলভ আর রায়দুর্লভ। সিরাজের প্রহরীরা বন্দি হয়। ক্লাইভ তাদের সিরাজের খবর জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু তারা নিরুত্তর। রাইসুল জুহালাকে বুটের লাথি মারেন ক্লাইভ। সে হেসে উঠে বাংলার সিপাহ্সালারকে জিজ্ঞেস করে, যুদ্ধে বাংলাদেশের জয় হয়েছে কিনা। ক্লাইভ তাকে আবারও লাথি মারেন। সে বলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তখনো জীবিত, তার বেশি আর কিছু সে জানে না।
রাজবলভ তাকে রাইসুল জুহালা বলে চিনতে পারে। ক্লাইভ টান মেরে তাঁর পরচুলা ফেলে দিলে মিরজাফর বলে ওঠে সে নারান সিং, সিরাজের প্রধান গুপ্তচর। ক্লাইভ মিরজাফরকে বলে, তখনই মুর্শিদাবাদের দিকে মার্চ করতে হবে।
তার আদেশে নারান সিং বলে, বাংলাদেশে থেকে সে দেশটাকে ভালোবেসেছে, গুপ্তচরের কাজ করেছে দেশের স্বাধীনতার খাতিরে। সে কাজ বেঈমানী আর মোনাফেকির চেয়ে খারাপ নয়। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলে, তবু ভয় নেই, নবাব তখনো বেঁচে আছেন।
সে প্রার্থনা করে, ভগবান যেন সিরাজউদ্দৌলাকে রক্ষা করেন; ক্লাইভ পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে। নারান সিং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
তৃতীয় অঙ্ক : চতুর্থ দৃশ্য
১৭৫৭ সালের ২৫ জুন। মুর্শিদাবাদ, নবাবের দরবার। দরবারে গণ্যমান্য লোকের সংখ্যা কম, সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। সিরাজ বক্তৃতা করছেন। তিনি বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁকে পালিয়ে আসতে হয়েছে, সে কথা গোপন করে কোনো লাভ নেই।
তবে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসেন নি। সেনাপতিদের পরামর্শে যুদ্ধের বিধি অনুসারেই এসেছেন, তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বিজয়ী শত্র“র কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা করবেন বলে ফিরে এসেছেন রাজধানীতে। এক ব্যক্তি বলে, রাজধানী ছেড়ে সবাই পালিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ বলেন, তারা পালাবে কোথায়? পেছন থেকে আক্রমণ করবার সুযোগ দিলে মৃত্যুর হাত থেকে পালানো যায় না। সিরাজ বলেন, জনগণ যেন অধৈর্য না হয়, সবাই যেন শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সেটাই তাদের শেষ সুযোগ। ক্লাইভের হাতে রাজধানীর পতন হলে দেশের স্বাধীনতা চিরদিনের জন্যে চলে যাবে।
সিরাজ শ্রোতৃমণ্ডলীকে বলেন, দু’একদিনের মধ্যে বিভিন্ন জমিদারের কাছ থেকে যথেষ্ট সৈন্য আসবে, নাটোরের মহারাণীর কাছ থেকেও সৈন্য সাহায্য আসবে, অর্থেরও অভাব নেই। সেনাবাহিনীর খরচের জন্যে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
প্রতারক সৈনিকরা রাজধানী রক্ষার জন্যে সদলবলে লড়বে বলে রাজকোষ থেকে টাকা নিয়ে ভেগে পড়ে। সিরাজ ভেবেছিলেন যে, নগর রক্ষার জন্যে মুর্শিদাবাদে অন্তত দশ হাজার সৈন্য রয়েছে। আরও আশা করেছিলেন জমিদারদের সৈন্য আসবার আগে তাঁদের দিয়ে শত্র“র গতিরোধ করতে পারবেন। কিন্তু বার্তাবাহক এসে তাঁকে জানায়, শহরে বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছে।
স্বয়ং নবাবের শ্বশুর ইরিচ খাঁ সপরিবারে শহর ছেড়ে চলে গেছেন। সিরাজ শুনে বিস্মিত হন, কারণ মাত্র কিছুক্ষণ আগে তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন সেনাবাহিনী সংগঠনের জন্যে। তবু তিনি আশা ছাড়েন না। এমন সময় তিনি খবর পান, সৈন্য-সংগ্রহের জন্যে যারা টাকা নিয়েছে তাদের অনেকেই নিজেদের লোকজন নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ তবু আশা রাখেন। তিনি বলেন, ভীরু প্রতারকের দল চিরকালই পালায়, কিন্তু তাতে বীরের মনোবল ক্ষুণœ হয় না। এমনি করে পালাতে পারতেন মিরমর্দান, মোহনলাল, বদ্রী আলী, নৌবেসিং; তার বদলে তাঁরা পেতেন শত্র“র অনুগ্রহ, প্রভূত সম্পদ ও সম্মান, কিন্তু তা তাঁরা করেন নি।
দেশের স্বাধীনতার জন্যে দেশবাসীর মর্যাদার জন্যে তাঁরা জীবন দিয়ে গেছেন। তাঁদের আদর্শ যেন লাঞ্ছিত না হয়, দেশপ্রেমিকের রক্ত যেন আবর্জনার ¯তূপে চাপা না পড়ে।
নীরব জনতাকে লক্ষ্য করে তিনি তাদের ভেবে দেখতে বলেন, কে বেশি শক্তিমান। একদিকে দেশের সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন দেশদ্্েরাহী যাদের আছে কেবল অস্ত্র, শঠতা আর ছলনা। অস্ত্র দেশবাসীরও আছে। আর তা ছাড়াও আছে মহামূল্যবান দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা রক্ষার সঙ্কল্প। এ অস্ত্র নিয়ে তারা কাপুরুষ দেশদ্রোহীদের অবশ্যই দমন করতে পারবেন।
হাজার হাজার মানুষ একযোগে রুখে দাঁড়াতে পারলে কৌশলের প্রয়োজন হবে না বিক্রম দিয়েই তারা শত্র“কে পরাজিত করতে পারবে। তা না হলে বাংলার ঘরে ঘরে হাহাকারের বন্যা বইয়ে দেবে মিরজাফর ও ক্লাইভের লুণ্ঠন ও অত্যাচার, কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই তিনি জনগণকে বলেন একযোগে মাথা তুলে দাঁড়াতে এবং আশ্বাস দেন, জনগণের অবশ্যই জয় হবে।
সিরাজ বলতে থাকেন, সৈন্য পরিচালনার যোগ্য সেনাপতিও তাঁদের আছে। মোহনলাল বন্দি হন নি, তিনি অবিলম্বে তাঁদের সাথে যোগ দেবেন। তাছাড়া তিনি নিজেও আছেন। আবার যুদ্ধ হবে, আর সৈন্য পরিচালনা করবেন তিনি নিজে। তাদের সাথে যোগ দেবেন বিহার থেকে রামনারায়ণ, পাটনা থেকে ফরাসি বীর মসিয়েঁ লা।
বার্তাবাহক এসে খবর দেয় সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হয়েছেন। শুনে হতাশাগ্রস্ত জনতা দরবার ত্যাগ করে যেতে থাকে। সিরাজ ভেঙে পড়েন। আত্মসংবরণ করে জনতাকে বলেন, তাহলেও কোনো ভয় নেই। তারা যেন হাল ছেড়ে না দেয়।
তিনি অনুরোধ করেন, জনতা যেন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়, তাঁরা অবশ্যই শত্র“কে রুখবেন। কিন্তু তাঁর আশ্বাসে কান না দিয়ে জনতা পালিয়ে যায়। অবসন্ন সিরাজ দু’হাতে মুখ ঢেকে আসনে বসে পড়েন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। ধীরে ধীরে লুৎফুন্নেসা প্রবেশ করে নবাবের মাথায় হাত রেখে তাঁকে ডাকেন।
তিনি নবাবকে বলেন, অন্ধকারে ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। নবাব আবেগ ভরে লুৎফুন্নেসাকে বলেন, তাঁর কেউ নেই, সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। লুৎফুন্নেসা তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, তবু ভেঙে পড়লে চলবে না। মুর্শিদাবাদে থেকে যখন হলো না তখন যেখানে নবাবের বন্ধুরা রয়েছেন সেখান থেকেই বিদ্রোহীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নবাব তার কথায় সায় দেন।
লুৎফুন্নেসা ইতোমধ্যেই সব আয়োজন করে ফেলেছিলেন। তখনি তাঁদের প্রাসাদ ছেড়ে যেতে হবে। লুৎফুন্নেসাও স্বামীর সঙ্গিনী হবেন। সব অহঙ্কার বিসর্জন দিয়ে, সব কষ্ট সহ্য করে নবাবের সাথে পালিয়ে লুৎফুন্নেসাও যাবেন পাটনায়। সেখান থেকে যদি বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার আয়োজন করা যায়, সে চেষ্টা করবেন তারা।
চতুর্থ অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৮৫৭ সাল, ২৯ জুন। মিরজাফরের দরবার। রাজবলভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ প্রমুখ সভাসদেরা দরবারে আসীন। দরবারটা নাচ-গানের মজলিশের মতো আনন্দমুখর। নতুন নবাব মিরজাফর তখনো দরবারে আসেননি। তা নিয়ে রাজবলভ, জগৎশেঠরা মুখরোচক মন্তব্য ও রঙ্গ-রসিকতা করছেন।
যথাসময়ে মিরনকে নিয়ে দরবারে প্রবেশ করেন মিরজাফর। তিনি সরাসরি সিংহাসনে না বসে সিংহাসনের হাতল ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরেই দরবারে প্রবেশ করে কর্নেল ক্লাইভ, সঙ্গে ওয়াট্স আর কিলপ্যাট্রিক।
মিরজাফরের মুখমণ্ডল আনন্দে ভরে ওঠে। ক্লাইভ নতুন নবাবের দীর্ঘজীবন কামনা করেন এবং নবাব তখনো মসনদে বসেন নি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। মিরজাফর সবিনয়ে বলেন, ক্লাইভ তাঁকে হাত ধরে তুলে না দিলে তিনি মসনদে বসবেন না।
ক্লাইভ নিচু গলায় ওয়াটসকে বলেন, লোকটা আস্ত একটা ভাঁড়। তিনি প্রকাশ্যে দরবারীদের বলেন, নবাব জাফর আলী খাঁ তাঁকে লজ্জায় ফেলেছেন, তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে মিরজাফরের হাত ধরে তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে বলেন, তিনি নতুন নবাব জাফর আলী খানকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। ওয়াট্স ও কিলপ্যাট্রিক হর্ষধ্বনি করেন।
মিরজাফর মসনদে বসলে দরবারে সবাই তাঁকে কুর্নিশ করেন। ক্লাইভ দরবারীদের বলেন, বাংলায় আবার শান্তি এসেছে। তিনি নবাবকে নজরানা দেন। ওয়াট্স আর কিলপ্যাট্রিক নবাবের দীর্ঘজীবন কামনা করেন। একে একে অন্যেরা নজরানা দিয়ে কুর্নিশ করতে থাকে। হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে প্রবেশ করে উমিচাঁদ।
ক্লাইভের কাছে গিয়ে বলে, তিনি যেন তাকে খুন করে ফেলেন এবং ক্লাইভের তরবারির খাপ টেনে নিয়ে নিজের বুকে ঠুকতে থাকে। মিরজাফর ব্যাপারটা জানতে চাইলে উমিচাঁদ বলে, ওরা সব বেঈমান, তাকে খুন করা হোক। সে আত্মহত্যা করবে। সে নিজের গলা টিপে ধরে।
গলা দিয়ে গড় গড় আওয়াজ বেরোতে থাকে। ক্লাইভ সবলে তার হাত ধরে ছাড়িয়ে নিতে ঝাঁকুনি দিতে দিতে উমিচাঁদকে বলেন, সে পাগল হয়ে গেছে। উমিচাঁদ বলে, তাঁরাই তাকে পাগল বানিয়েছে, এবার ক্লাইভ যেন তাকে খুন করে ফেলে।
উমিচাঁদ বলে, যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে গেলে তাকে বিশ লাখ টাকা দেয়া হবে বলে তারা দলিলে সই করেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে ইংরেজরা সে দলিল জাল করেছে। দৌড়ে সিংহাসনের কাছে গিয়ে মিরজাফরকে অনুরোধ করে সুবিচার করতে। ক্লাইভ বলেন, তিনি উমিচাঁদের ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
উমিচাঁদ বলে, ক্লাইভ তা জানবেন কেন? নবাবের রাজকোষ বাটোয়ারা করে ক্লাইভের ভাগে পড়েছে একুশ লাখ টাকা। সবার ভাগেই অংশ মতো কিছু না কিছু পড়েছে। শুধু উমিচাঁদের বেলাতে শূন্য। ক্লাইভ সবলে উমিচাঁদের বাহু আকর্ষণ করে বলে, উমিচাঁদ স্বপ্ন দেখছে।
তিনি সই করলে তা তাঁর মনে থাকতো। উমিচাঁদের বয়স হয়েছে, কাজেই তার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। সে কিছুদিন তীর্থ করলে, ঈশ্বরকে ডাকলে তার মন ভালো হবে। কিলপ্যাট্রিক তাকে টেনে বাইরে নিয়ে যান। সে যেতে যেতে বলতে থাকে, আমার টাকা, আমার টাকা।
জগৎশেঠ বলে, একটা শুভদিনকে লোকটা থমথমে করে দিয়ে গেলো। ক্লাইভ নবাবকে বলেন যে, প্রথম দরবারে নবাবের কিছু বলা উচিত। রাজবলভ তাকে সমর্থন করেন। নবাব ধীরে ধীর উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমেই শুকরিয়া জানান কর্নেল ক্লাইভকে।
তিনি ঘোষণা করেন, ক্লাইভকে পুরস্কার দেয়া হলো বার্ষিক চার লাখ টাকা আয়ের জমিদারি, ২৪ পরগণার স্থায়ী মালিকানা। তিনি দেশবাসীকে আশ্বাস দেন তাদের দুর্ভোগের অবসান হয়েছে, সিরাজের অত্যাচারের হাত থেকে তারা রেহাই পেয়েছে, এখন থেকে কারো শান্তিতে আর কোনো রকম বিঘœ ঘটবে না।
এমন সময় সেনাপতি মির কাসেমের দূত এসে তাঁর পত্র প্রদান করে। মির কাসেম লিখেছেন, তাঁর সৈন্যরা সিরাজউদ্দৌলাকে ভগবানগোলায় বন্দি করেছে এবং তাঁকে নিয়ে আসা হচ্ছে রাজধানীতে। দরবারের সবাই খবর শুনে উলসিত হয়ে ওঠেন। ক্লাইভ বলেন, এখন তাঁরা সবাই সত্যিকার নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারবেন।
মিরজাফর বলেন, সিরাজকে রাজধানীতে নিয়ে আসার দরকার ছিল না, তাকে বাইরে কোথাও আটকে রাখলেই চলতো। ক্লাইভ প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, নতুন নবাবকে শক্ত হতে হবে। শাসন চালাতে হলে মনে দুর্বলতা রাখা চলবে না। তিনি যে শাসন করতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন, সে-কথা দেশের লোকের মনে প্রতি মুহূর্তে জাগিয়ে রাখতে হবে। কাজেই সিরাজকে শেকল-বাঁধা অবস্থায় পায়ে হেঁটে সবার চোখের সামনে দিয়ে আসতে হবে জাফরাগঞ্জের কয়েদখানায়। কোনো লোক তার জন্যে এতটুকু দয়া দেখালে তার গর্দান যাবে। এখন মসনদের মালিক নবাব জাফর আলী খাঁ। সিরাজউদ্দৌলা এখন কয়েদি, ওয়ার ক্রিমিনাল, তার জন্যে যে সহানুভূতি দেখাবে সে ঃৎধরঃড়ৎ, আর আইনে ঃৎধরঃড়ৎ-এর শাস্তি মৃত্যু।
মিরজাফর সবাইকে জানিয়ে দেন, সিরাজকে বন্দি করা হয়েছে। যথাসময়ে তাঁর বিচার হবে। তিনি আশা করেন, কেউ তার জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে বিপদ ডেকে আনবেন না।
মিরজাফর মসনদ থেকে নেমে দাঁড়াতেই দরবারের কাজ শেষ হয়। নবাব দরবার থেকে বেরিয়ে যান, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যান অন্য সবাই। কথা বলতে বলতে প্রবেশ করে মিরন আর ক্লাইভ। ক্লাইভ বলেন, সে রাতেই কাজ সারতে হবে, ওসব ব্যাপারে সুযোগ নেয়া চলে না।
মিরন বলে, তার আব্বা তাতে রাজি হন নি, কাজেই হুকুম দেবে কে? রাজবলভ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ কেউই হুকুম দিতে রাজি হন নি। ক্লাইভ বলেন, তাহলে হুকুমটা মিরনকেই দিতে হবে। মিরন বলে, প্রহরীরা তার হুকুম শুনবে না। ক্লাইভ বলেন, মিরনকে নিজের স্বার্থে নিজের হাতে মারতে হবে সিরাজউদ্দৌলাকে। সিরাজ বেঁচে থাকতে মিরনের কোনো আশা নেই। নবাবের আসন তো দূরের কথা।
মিরন বলে, সে একটা লোক ঠিক করেছে, তবে ক্লাইভের হুকুম দরকার হবে। দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করে, মোহাম্মদি বেগ হত্যা করবে সিরাজকে। তাকে দিতে হবে নগদ দশ হাজার টাকা। ক্লাইভ নির্দেশ দেন কাজ শেষ হলেই তাঁকে যেন খবর দেয়া হয়। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ বেরিয়ে যায়।
চতুর্থ অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৭ সাল, ২ জুলাই। জাফরাগঞ্জের কয়েদখানা। প্রায়ান্ধকার কারাকক্ষে সিরাজউদ্দৌলা। এক কোণে একটি নিরাবরণ দড়ির খাটিয়া। অন্য প্রান্তে একটি সোরাহী আর পাত্র। সিরাজ অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন আর বসছেন। কারাকক্ষের বাইরে প্রহরারত শান্ত্রী। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ প্রবেশ করে।
তার দুহাত বুকে বাঁধা। ডান হাতে নাতিদীর্ঘ মোটা লাঠি। প্রহরী দরজা খুলে দিলে কামরায় একটুখানি আলো এসে পড়ে। আলো দেখে চমকে ওঠেন সিরাজ। প্রভাত হয়েছে ভেবে মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসেন তিনি। মিরন আর মোহাম্মদি বেগ এসে দাঁড়ায় মঞ্চের মাঝখানে।
মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত তুলে সিরাজ বলেন, সে প্রভাত শুভ হোক লুৎফার জন্যে, শুভ হোক তাঁর বাংলার জন্যে, নিশ্চিত হোক বাংলার প্রত্যেকটি নরনারীর জীবন। তিনি পড়েন আলহামদুলিলাহ।
মিরন বলে, সিরাজ যেন আলাহর কাছে মাফ চেয়ে নেন। সিরাজ চমকে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন, মিরন তখন সেখানে কেন? সে কি তাঁকে অনুগ্রহ দেখাতে গিয়েছে, না পীড়ন করতে। মিরন বলে, সে গেছে সিরাজের অপরাধের জন্যে নবাবের দণ্ডাজ্ঞা শোনাতে।
বাংলার প্রজাসাধারণকে পীড়নের জন্যে, দরবারের পদস্থ আমির-ওমরাহদের মর্যাদাহানির জন্যে, বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনসঙ্গত বাণিজ্যের অধিকার ক্ষুণœ করবার জন্যে, অশান্তি ও বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে সিরাজ অপরাধী। নবাব জাফর আলী খাঁ তাই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দিয়েছেন।
কথাটা সিরাজের বিশ্বাস হয় না। তিনি জাফর আলী খাঁর স্বাক্ষরযুক্ত আদেশ দেখতে চান। মিরন বলে আসামীর তেমন অধিকার থাকে না। সে পেছন ফিরে মোহাম্মদি বেগকে নবাবের হুকুম তামিল করার হুকুম দিয়ে বেরিয়ে যায়। মোহাম্মদি বেগ লাঠিটা মুঠো করে ধরে নবাবের দিকে এগোতে থাকে।
সিরাজ বলেন, প্রথমে মিরন তারপর মোহাম্মদি বেগমিরন তবু মিরজাফরের পুত্র কিন্তু মোহাম্মদি বেগ কেন গিয়েছে তাঁকে খুন করতে। মোহাম্মদি বেগ এগোতে থাকে। সিরাজ ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বলেন, তিনি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত, কিন্তু মোহাম্মদি বেগ যেন সে কাজ না করে।
মোহাম্মদি বেগ যেন তাঁকে হত্যা না করে। তিনি তাকে অতীতের কথা ভেবে দেখতে বলেন। তিনি বলেন, তাঁর আব্বা-আম্মা তাকে পালন করেছে পুত্রস্নেহে, তাঁদেরই সন্তানের রক্তে সে যেন ঋণ পরিশোধ না করে।
মোহাম্মদি বেগ লাঠি দিয়ে সিরাজের মাথায় প্রচন্ড আঘাত করে। তিনি লুটিয়ে পড়েন। মোহাম্মদি বেগ স্থিরদৃষ্টিতে দেখতে থাকে মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সিরাজ ডান হাতের কনুই আর বা হাতের তালুতে ভর দিয়ে কিছুটা মাথা তোলেন। কাতর কণ্ঠে বলেন লুৎফুন্নেসা তাঁর স্বামীর ওপর সে পীড়ন দেখতে পায় নি, সে জন্যে খোদার কাছে শুকরিয়া।
মোহাম্মদি বেগ লাঠি ফেলে খাপ থেকে ছোরা খুলে সিরাজের ভূলুণ্ঠিত দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিরাজের পিঠে পরপর কয়েকবার আঘাত হানে ছোরা দিয়ে। সিরাজের দেহ তখন ধীরে ধীরে নিথর হতে থাকে। মোহাম্মদি বেগ উঠে দাঁড়ায়। ঈষৎ মাথা নাড়াবার চেষ্টা করতে করতে মৃত্যু-কাতর কণ্ঠে সিরাজ বলেন লা ইলাহা ইলালাহু………..।
মোহাম্মদি বেগ লাথি মারে। সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় সিরাজের জীবন। শুধু মৃত্যুর আক্ষেপে তাঁর হাত দুটি মাটি আঁকড়ে ধরবার চেষ্টায় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে চিরকালের মতো নিস্পন্দ হয়ে যায়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।