HSC | সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | বিশ্লেষণ – ১ | PDF : বাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক হতে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্যবাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
পাঠ-সংশ্লিষ্ট অংশ
সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষায় পূর্ণ নম্বরের উত্তর করতে হলে পাঠ-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের তথ্য ও নানান দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ জানা একান্ত জরুরি। তাই অনুশীলন অংশ শুরু করার আগে এই নাটকের শিখন ফল, নাটক সম্পর্কে আলোচনা, নাটকের সংজ্ঞা, নাটকের শ্রেণিবিভাগ বাংলা নাটকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের পটভূমি, চরিত্র-চিত্রণ ও সার্থকতা, চরিত্রলিপি, সংক্ষেপে নাটকের কাহিনি, চরিত্র আলোচনা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব বিষয় জেনে নিলে এ অধ্যায়ের যেকোনো সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হবে।
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১-৮ | PDF
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ৯-১৭ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১৮-২৫ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ২৬-৩১ | PDF
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১১-২০ | PDF Download
শিখন ফল
নবাব সিরাজ ও তাঁর বৈরী শক্তির সাথে দ্ব›দ্ব সংঘাত সম্পর্কে জানতে পারবে।
ইংরেজ বেনিয়াদের ক‚ট কৌশল চক্রান্ত সম্পর্কে জানতে পারবে।
স্বার্থান্বেষী, সুবিধাভোগী শ্রেণির নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত সম্পর্কে জানতে পারবে।
নবাবের আত্মীয়-স্বজনের চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে জানতে পারবে।
নবাবের মন্ত্রী ও সেনাপতিদের চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় পাবে।
বাংলার গণমানুষের ওপর ইংরেজ বেনিয়াদের শোষণ-নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারবে।
জাতীয় সংকটে নবাবের সহোযোগীদের সততা, ধূর্ততা এবং বিরোধীদের মিথ্যাচারিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে জানতে পারবে।
বাংলার ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে প্রাসাদ চক্রান্ত ও এর ফলাফল জানতে পারবে।
নবাবের পরাজয়ের কারণ ও শাহাদত সম্পর্কে ধারণা পাবে।
জাতীয় জীবনের ভয়াবহ সংকটে জনগণের নিরব দর্শকের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারবে।
ইংরেজদের বাংলার ক্ষমতা দখলের কৌশল জানতে পারবে।
নাটক সম্পর্কে আলোচনা
নাটকের সংজ্ঞা
নাটক হচ্ছে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা। ‘নাটক’ শব্দটির এসেছে ‘নট’ শব্দ থেকে। এ নটের অর্থ হলো নড়াচড়া করা, অঙ্গ চালনা করা। পক্ষান্তরে ইংরেজি ‘উৎধসধ’ শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘উৎধবহ’ শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো ‘ঃড় ফড়’ বা ‘করা’।
শব্দটির অর্থ হলো অ্যাকশন অর্থাৎ কোনো কিছু করে দেখানো। নাটক মানবজীবনের কথা বলে। নাটক মানুষ ও সমাজের বিচিত্র ঘটনার কথা বলে। নাটকের মাঝে মানুষ ও মানবসমাজ মূর্ত হয়। তাই নাটক মানুষের দর্পণ, সমাজের দর্পণ, মানব ভাগ্যের দর্পণ।
সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাটককে দৃশ্যকাব্য আখ্যা দিয়েছেন। নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাট্য-সাহিত্যকে কাব্য-সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাঁহাদের মতে কাব্য দুই প্রকার: দৃশ্য কাব্য ও শ্রব্য কাব্য। নাটক প্রধানত দৃশ্যকাব্য এবং ইহা সকল প্রকার কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কাব্যেষু নাটক রস্যম।
নাটক দৃশ্য করা ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গ মঞ্চের সমন্বয়ে গতিমান মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সন্মুখে মূর্ত করে তোলে। রঙ্গ মঞ্চের সাহায্য ব্যতীত নাটকীয় বিষয় পরিস্ফুট হয় না।
বস্তুত: নাটক একটি প্রয়োগিক শিল্প যা রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপিত ও প্রদর্শিত হয়। তাই স্থান, কাল, ঘটনা ও চরিত্রের সংহতি নাটকের একটি গুরুত্ব বিষয়। নাটকের আঙ্গিক ও গঠন কৌশলে ঐক্য থাকা প্রয়োজন। ঐক্যগুলো হলো
১. স্থানের ঐক্য
২. সময়ের ঐক্য
৩. ঘটনার ঐক্য
এ তিনটি ঐক্যের মিল সাধনে নাটক রচিত হয়। এখানে সময়ের ঐক্য বলতে বুঝানো হয়েছে যেকোনো একটি সময়ের পরিসরে ঘটে, স্থানের ঐক্য বলতে বুঝানো হয়েছে জীবনের একটি ঘটনা স্থানের মাঝে ঘটে। কোনো ঘটনা একটি স্থল ও সময়ের মাঝে ঘটে। আর এসব ঘটে একাধিক চরিত্রের মাধ্যমে।
আসলে নাটক কোনো একক শিল্প নয়। নাটক যৌথ শিল্প। অর্থাৎ নাট্যকার, নির্দেশক অভিনেতা-অভিনেত্রী, মঞ্চ, সংগীত, আলোক প্রক্ষেপণ, দর্শক-শ্রোতা-ইত্যাদি মিলে নাটক। তবে নাটকের, নির্দেশনা, সংলাপ ও অভিনয় দক্ষতার আলোকে একটি নাটকের সার্থকতা নিরূপণ করা হয়।
একটি নাটকে কয়েকটি আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য থাকে। এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে নাট্যকার সফল ও সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে চায়। নাটকের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-
১. প্রারম্ভ,
২. প্রবাহ
৩. উৎকর্ষ,
৪. গ্রন্থিমোচন
৫. পরিণতি
এ ছাড়া প্রতিটি নাটকে বিভিন্ন অঙ্ক ও দৃশ্য বিভাজন থাকে। প্রাচীন যুগে নাটক পাঁচ অঙ্ক বিশিষ্ট হতো। আর প্রতিটি অঙ্কে কয়েকটি দৃশ্য থাকত। আধুনিক যুগে এ সনাতন পদ্ধতি ভেঙে নানা বৈচিত্র্য এসেছে। এখন নাটকে পাঁচ অঙ্ক হয় না। দুই বা তিন অঙ্কের নাটক এ যুগে প্রাধান্য পেয়েছে।
এ যুগে একাঙ্কিতা নামে এক ধরনের এক অঙ্কের নাটক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। নাটক এখন মঞ্চের সীমানা পেরিয়ে বেতার ও টিভিতে স্থান করে নিয়েছে। নাটকের দৃশ্য ও চরিত্র কমে গেছে। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে নাটকের প্রথাগত বিভাজন লোপ পেয়েছে। আজকাল নাটকে নানা প্রযুক্তিগত কৌশল ও অনেক অভিনব নাট্য বৃদ্ধির প্রয়োগ দেখা যায়।
নাটকের শ্রেণিবিভাগ
নাটকের বিষয়বস্তু ও জীবনবোধের আলোকে নাটককে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন ঐতিহাসিক নাটক, সামাজিক নাটক, রাজনৈতিক নাটক, রূপক নাটক, কাব্য নাটক, গীতি নাট্য ইত্যাদি।
ক. ঐতিহাসিক নাটক : ইতিহাস থেকে কোনো কাহিনি ঘটনা চরিত্র নিয়ে যদি কোনো নাটক রচনা করা হয়, তা হলে তাকে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায়। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ঘটনার বিকৃতি না ঘটিয়ে নব রূপ দান করেন।
যেমন- মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ডি. এল রায়ের ‘শাহাজাহান’, মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, আসকার ইবনে শাইখের ‘তিতুমীর’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘রক্তপদ্ম’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘মহাকবি আলাউল’ ইত্যাদি।
খ. সামাজিক নাটক : যে নাটক সামাজিক বিষয় নিয়ে রচিত হয় সে নাটককে সামাজিক নাটক বলা হয়। সামাজিক নাটক রচিত হয় সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, বিশ্বাস, সংস্কার, আচার-আচরণকে ভিত্তি করে। বাংলা নাট্য-সাহিত্যে সামাজিক নাটকের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।
আর সামাজিক নাটকের জনপ্রিয়তা ও অনেক বেশি। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’, ‘সধবার একাদশী’, গিরিশ চন্দ্র ঘোষের ‘হারানিধি’, ‘বলিদান’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’, নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিম’, সাইদ আহমদের ‘কালো বেলা’ ইত্যাদি।
গ. কাব্য নাটক : কাব্য ও নাটকের উভয়ের শর্ত পূরণ করে যে নাটক রচিত হয়, তাকে কাব্য নাটক বলা হয়। অর্থাৎ কাব্য গুণ ও নাট্যগুণের সমন্বয়ে রচিত হয় কাব্য নাটক। বাংলা সাহিত্যে এ ধারার সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ ‘বিসর্জন’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য নাটক। বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী তরঙ্গিনী’ ও ‘কাল সন্ধ্যা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুল’ দীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি উলেখযোগ্য কাব্য নাটক।
ঘ. গীতি নাট্য : নাচ, গান ও নাটকএ তিন সুকুমার শিল্পের সমন্বিত রচনাকে গীতি নাট্য বলে। এখানে নাচের মাধ্যমে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আর গানের মাধ্যমে কাহিনি এগিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের খেলা’, ‘অচলায়তন’ ইত্যাদি এ পর্যায়ের নাটক।
ঙ. রূপক সাংকেতিক নাটক : যখন কোনো বাস্তব ঘটনা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করা যায় না, তখন রূপকের প্রয়োজন হয়। বিশেষ কোনো তত্ত¡ প্রকাশ বা অত্যন্ত গভীরতর কোনো তত্ত¡কে সত্য প্রকাশ করার জন্য নাট্যকার যখন রূপকের আশ্রয়ে নাটক রচনা করেন। তখন তাকে রূপক-সাংকেতিক নাটক বলে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’, ‘ডাকঘর’ ইত্যাদি রূপক সাংকেতিক নাটক।
নাটকের রসগত দিক থেকে নাটককে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। এ জাতীয় নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে তীব্র বেদনায় ও বিরহে, এ নাটক বিয়োগান্ত ।
যেমন:
ক. ট্রাজেডি : ট্রাজেডি নাটকের মূলে থাকে ব্যক্তি ও আত্মার দ্ব›দ্ব, বিক্ষুব্ধ, তীব্র যন্ত্রণা ও হাহাকার। যেমন, ‘অদি পাউস’, ‘ম্যাকবেথ’, হ্যামলেট প্রভৃতি।
খ. কমেডি : এ নাটকের পরি সমাপ্তি আনন্দ বা মিলনে।
গ. মেলোভূমা : এক ধরনের অতি নাটক। এটিও বিয়োগান্ত নাটক।
ঘ. ট্রাজিকমেডি : এ নাটক ট্রাজেডি ধর্ম হাস্য রসের নাটক।
ঙ. প্রহসন : ব্যক্তি ও সমাজের অসঙ্গতি দেখানোর জন্য ব্যঙ্গ বিদ্রূপের নাটক।
বাংলা নাটকের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পালাগান ও যাত্রা বাংলা নাটকের প্রাচীন উৎস। তবে আধুনিক বাংলা নাটকের উদ্ভব ঘটে ইংরেজি নাটকের প্রভাবে। আর এর সূত্রপাত ঘটে আঠার শতকে। একজন রুশ নাগরিকের হাতে বাংলা নাটকের সূচনা। তাঁর নাম হেরাসিম লেবেদেফ।
তিনি মুনশী গোলকনাথ দাসের সহযোগিতায় দুটো ইংরেজি প্রহসন বাংলায় অনুবাদ করেন। আর এগুলো কলিকাতায় মঞ্চায়ন হয় উনিশ শতকের মধ্য ভাগে। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে শেকসপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর ভাবানুবাদ, তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ এবং রাম নারায়ণের ‘কুলীন কুল সর্বস্ব’ বাংলা নাটকের প্রথম পর্যায়ের উলেখযোগ্য নাটক।
আধুনিক বাংলা নাটকের জনক হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’ ইত্যাদি তাঁর সার্থক নাটক। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ তাঁর দুটো সার্থক প্রহসন।
সামাজিক নাটক প্রবর্তন করেন দীনবন্ধু মিত্র তাঁর রচিত ‘নীলদর্পণ’, ‘নবীন তপস্বিণী’ ‘সধবার একাদশী’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’, ‘বসন্ত কুমারী’ এবং প্রহসন ‘এর উপায় কি’ ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের সার্থক নাটক।
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরুবিক্রম’, ‘সরেজনি’ ইত্যাদি নাটক এবং ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’, ‘হঠাৎ নবাব’, দায়ে পড়ে দারগ্রহ’ ইত্যাদি প্রহসন বিশেষ উলেখযোগ্য।
এরপর বাংলা নাটকের হাল ধরেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অমৃতলাল বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল প্রমুখ প্রতিভাধর নাট্যকারগণ। তাঁদের প্রতিভায় বাংলা নাটক সাফল্যের প্রাপ্ত সীমায় পৌঁছে। আজ বাংলা নাটকের গতিধারাবহতা নদীর মতো গতিশীল।
বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সাতচলিশ পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্য-সাহিত্যে যারা সবচেয়ে তৎপর ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন, আকবর উদ্দিন, ইব্রাহিম খাঁ,
নূরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, মুনীর চৌধুরী, আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, সাইদ আহমদের নাম উলেখযোগ্য।
উলিখিত নাট্যকারগণ সামাজিক ও ঐতিহাসিক নাটক রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শাহাদাৎ হোসেনের ‘সরফরাজ খাঁ, ‘নবাব আলীবর্দ্দী’, ‘আনারকলি’; আকবর উদ্দিনের ‘নাদির শাহ’, ‘সিন্ধু বিজয়’; ইব্রাহিম খাঁর ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’ এ যুগের ঐতিহাসিক নাটক।
নূরুল মোমেনের ‘নমেসিস’, ‘নয়াখান্দান’, ‘রূপান্তর’; আসকার ইবনে শাইখের ‘তিতুমীর’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘রক্তপদ্ম’; ‘এপার ওপার’; মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’, ‘নষ্ট ছেলে’; ‘মানুষ’; ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’; ‘দণ্ডকারণ্য’; শওকত ওসমানের ‘আমলার মামলা’,
‘কাঁকর মণি’; সৈয়দ ওয়ালীউলাহর ‘বহিপীর’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তরঙ্গতঙ্গ’; আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ইহুদীর মেয়ে’, ‘মায়াবী প্রহর’, ‘মরক্কোর যাদুকর’; আনিস চৌধুরীর ‘মানচিত্র’, ‘এ্যালবাম’ এবং সিকান্দার আবু জাফরের ‘মহাকবি আলাওল’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ইত্যাদি নাটক বাংলাদেশের নাট্য সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের বিষয়-প্রকরণ ও আঙ্গিক পরিচর্যা পরিবর্তিত হয়। এ পর্বের নাট্যকারগণ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিষয় করে প্রধানত নাটক রচনা করেছেন।
সারা দেশে বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়মিত নাটক প্রদর্শন, নাটক ও মঞ্চ সম্পর্কিত পত্রপত্রিকা প্রকাশের ফলে একটি নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ সময়ে বেশ কিছু প্রতিভাবান নাট্যকার আবির্ভূত হন।
তাঁরা রচনা করেন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ এবং দর্শক-নন্দিত নাটক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের উলেখযোগ্য নাটক হচ্ছেমমতাজ উদ্দীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘বর্ণচোর’, ‘হরিণ চিতা চিল’, ‘প্রেম বিবাহ সুটকেস’, ‘হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’; আব্দুলাহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখনই সময়’, ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘দ্যাশের মানুষ’,
‘কোকিলারা’; মামুনুর রশীদের ‘ওরা কদম আলী’, ‘এখানে নোঙর’, ‘ইবলিশ’, ‘ওরা আছে বলেই’, সেলিম আল দীনের ‘সর্প বিষয়ক গল্প’, ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘শকুন্তলা’; সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুলদীনের সারা জীবন’, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি। এসব নাটক বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফরের জন্ম ১৯১৮ সালে তেঁতুলিয়া, সাতক্ষীরা, খুলনা। খুলনা তালা বি.ডি. উচ্চ ইংরেজি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করার পর তিনি কলকাতার রিপন (সুরেন্দ্রানাথ) কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪১ সালে তিনি শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কলকাতার ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতে খড়ি।
পরে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক মিলাত’ পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫৩ পর্যন্ত রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্মরণীয় অবদান রাখেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক ‘অভিযান’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। তাঁর রচিত ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। এদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সিকান্দার আবু জাফর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
সিকান্দার আবু জাফর রচিত সাহিত্য কর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে কাব্য : ‘প্রসন্ন প্রহর’ (১৯৬৫), ‘বৈরী বৃষ্টিতে’ (১৯৬৫), ‘তিমিরান্তিক’ (১৯৬৫), ‘বৃশ্চিক লগ্ন’ (১৯৭১), ‘বাংলা ছাড়’ (১৯৭২), ‘পূরবী’ (১৯৪৪), ‘নূতন সকাল’ (১৯৪৬)।
নাটক: ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৬৫), ‘মাকড়সা’ (১৯৬০), ‘শকুন্ত উপাখ্যান’ (১৯৬২), ‘মহাকবি আলাওল’ (১৯৬৬)। পাঠ্যপুস্তক: ‘নবী কাহিনী’ (১৯৫১), ‘আওয়ার ওয়েলথ’ (১৯৫১)। নাট্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৬ সালে তাঁকে ‘বাংলা একাডেমি’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৫ সালে ৫ আগস্ট সিকান্দার আবু জাফর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের পটভূমি, চরিত্র-চিত্রণ ও সার্থকতা
বাংলা বিহার উড়িষ্যার তরুণ নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যশাসনের কাল এক বছর ষোল দিন (১৯ জুন ১৭৬৫ থেকে ২ জুলাই ১৭৫৭)। এই সময় পরিসরে নানা প্রতিক‚ল ঘটনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ষড়যন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকটি রচিত হয়।
এ নাটকে চার অঙ্কে মোট বারোটি দৃশ্যে কাহিনিকে সাজিয়েছেন নাট্যকার। সংঘটিত ঘটনাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে উলেখ করে কাহিনির মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য গতি দান করার চেষ্টা করেছেন লেখক, যা নাটকটিকে ঐতিহাসিক সত্যের খুব নিকটবর্তী করেছে।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে প্রধান-অপ্রাধান মিলে প্রায় চলিশটিরও বেশি চরিত্র আছে। চরিত্রের সংলাপ ও গতিবিধি বাস্তবানুগ করে চিত্রিত করা হলেও একথা সত্যি যে, নাটকের চরিত্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক চরিত্রের হুবহু মিল থাকার কথা নয়। বাস্তবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলায় কথা বলতেন না এবং রবার্ট ক্লাইভও ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতেন কিনা সন্দেহ।
উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগম, রাজবলভ এ নাটকে যেভাবে পদচারণা করেছে, বাস্তবে তাদের আচরণ হয়ত ঐ রকম ছিল না। সিকান্দার বলতে গিয়ে নাট্যকার যথেষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ তিনি নাটকের বশ, ইতিহাসের দাস নন। সিকান্দার আবু জাফর ইতিহাসের সত্যকে অবিকৃত রেখে ঐতিহাসিক চরিত্রের অনাবিষ্কৃত ও অনুদঘাটিত সত্য ও সৌন্দর্যকে সংস্থাপিত করেছেন।
কারণ, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ চরিত্র নিয়ে বিচিত্র জনশ্র“তি প্রচলিত রয়েছে। এসব জনশ্র“তির প্রভাব এড়িয়ে প্রকৃত সত্যেকে নতুনতর শিল্পমাত্রায় রূপ দান করা সত্যি দুরুহ।
এই দুরুহ কাজটিকে সিকান্দার আবু জাফর আপন প্রতিভার ঔদার্যে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন। নাট্যকার নিজেই ভূমিকাতে বলেছেন
১. সিরাজউদ্দৌলাকে আমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি।
২. প্রকৃত ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে এবং প্রতি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে আমি সিরাজউদ্দৌলার জীবন নাট্য পুনঃনির্মাণ করেছি।
৩. ধর্ম ও নৈতিক আদর্শে সিরাজউদ্দৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস ও তাঁর চরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদ্গুণ এই নাটকে প্রধানত সেই আদর্শ এবং মানবীয় গুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।
সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজ’ তাই একাধারে দেশপ্রেমিক, জাতীয় বীর, সাহসী যোদ্ধা, প্রেমময় স্বামী, স্নেহশীল পিতা, একনিষ্ঠ ধার্মিক প্রভৃতি মহৎ গুণের অধিকারী।
‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মূল বিষয় যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে স্বয়ং সিরাজই নায়ক। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে তিনি ইংরেজদের তাড়িয়েছেন। ইংরেজরা প্রাণভয়ে সেখানে থেকে পালিয়েছেন। সিরাজের আপন খালা ঘসেটি বেগমকে মতিঝিল প্রাসাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে দূরে রাখার জন্য নিজ প্রাসাদে উঠিয়ে এনেছেন। কিন্তু সম্মানিতা আত্মীয়ের প্রতি তিনি অশ্রদ্ধা দেখান নি।
খালাতো ভাই এবং রাজনৈতিক শত্র“ শওকত জংকে তিনি পরাজিত ও নিহত করেছেন। তাঁর এক বছর ষোল দিন শাসন কালে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তিনি কখনো যুদ্ধ ভয়ে ভীত হন নি। পলাশীর যুদ্ধ প্রান্তরেও সিরাজ স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন।
নিজেই সেনাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন প্রভূত দেরি হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক চক্রান্তকারীরা সিরাজ চরিত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যেসব কলঙ্ক লেপন করেছেন তার বিপরীতে সিরাজ চরিত্রের নানা সদ্গুণাবলির আলোকে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয় বীর সিরাজকে নবনির্মাণ করেছেন সিকান্দার আবু জাফর। কাহিনি, সংলাপ, চরিত্র-চিত্রণ ও দৃশ্য পরিকল্পনার দিক থেকে বিচার করলে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটককে সার্থক ঐতিহাসিক নাটক না বলা গেলেও একটি শিল্পসার্থক নাটক বলা যায়।
চরিত্রলিপি
সিরাজউদ্দৌলা ওয়াট্স
মিরজাফর ক্লেটন
রাজবলভ কিলপ্যাট্রিক
উমিচাঁদ জর্জ
জগৎশেঠ মার্টিন
রায়দুর্লভ হ্যারী
মোহনলাল লুৎফুন্নিসা
মিরমর্দান ঘসেটি বেগম
মিরন আমিনা বেগম
মানিকচাঁদ ইংরেজ মহিলা
রাইসুল জুহালা
মোহাম্মদি বেগ লবণ বিক্রেতা
সাঁফ্রে কমর বেগ
ক্লাইভ
ড্রেক ওয়ালী খান
হলওয়েল
নর্তকী, পরিচারিকা, নবাব সৈন্য, ইংরেজ সৈন্য, প্রহরী, নকীব, বার্তাবাহক ও নাগরিকবৃন্দ।
সংক্ষেপে নাটকের কাহিনি
প্রথম অঙ্ক : প্রথম দৃশ্য
১৭৫৬ সাল। ১৯ জুন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব কলকাতার ইংরেজ কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করেছেন। নবাব সৈন্যের দুর্বার আক্রমণে দুর্গের অভ্যন্তরে ইংরেজদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে।
তবু তাদের যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই। ক্যাপ্টেন ক্লেটন দুর্গের একাংশ থেকে মুষ্টিমেয় গোলন্দাজ সৈনিক নিয়ে কামান দাগাচ্ছেন। ইংরেজ সৈনিকেরা নিস্তেজ, আতঙ্কগ্রস্ত।
অধিনায়ক পিকার্ডের পতন হয়েছে। পেরিন্স পয়েন্টর সমস্ত ছাউনি তছনছ করে ভাবি ভাবি কামান নিয়ে দুর্গের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে নবাব-সৈন্য। নবাবের পদাতিক বাহিনী দমদমের সরু রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হয়ে বন্যাস্রোতের মতো প্রবেশ করছে নগরে, গোলন্দাজ বাহিনী শিয়ালদহের মারাঠা খাল পেরিয়ে অগ্রসর হচ্ছে অমিত বিক্রমে; বাধা দেবার কেউ নেই। ক্যাপ্টেন মিন্ চিন দমদমের রাস্তায় নবাব-সৈন্যের গতিরোধ করতে সাহস পান নি।
তিনি কাউন্সিলার ফ্রাঙ্কল্যান্ড আর ম্যানিংহ্যামকে নিয়ে নৌকাযোগে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। হলওয়েল প্রবেশ করে ক্লেটনকে বলেন, কামান চালিয়ে কোনো ফল হবে না। তিনি তাঁকে পরামর্শ দেন গভর্নর ড্রেকের সাথে পরামর্শ করে নবাব বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে।
হলওয়েলের প্রস্তাব শুনে ক্লেটন বলেন, আত্মসমর্পণ করলেও নবাবের জুলুম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। তিনি হলওয়েলকে দাঁড় করিয়ে ছুটে যান গভর্নর ড্রেকের কাছে। হলওয়েলের হুকুমে বন্দি উমিচাঁদকে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়। নবাব-সৈন্যদের যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। কিন্তু উমিচাঁদ কঠোর স্বরে বলে, সে গভর্নর ড্রেকের ধ্বংস দেখতে চায়।
এমন সময় জর্জ এসে জানায় যে, গভর্নর ড্রেক আর ক্যাপ্টেন ক্লেটন নৌকাযোগে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুনে উমিচাঁদ দুঃখিত হয়; কারণ ড্রেক তার হাত ছাড়া হয়ে গেলো। সে বিদ্রূপাত্মক ভাষায় হলওয়েলকে বলে, ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিয়েছে, এ বড় লজ্জার কথা। হলওয়েল হতাশায় ভেঙে পড়েন। তিনি উমিচাঁদের পরামর্শ চান।
আবার প্রচণ্ড গোলার আওয়াজ ভেসে আসে। উমিচাঁদ মানিকচাঁদের কাছে চিঠি লিখতে চলে যায়; বলে যায় হলওয়েল যেন দুর্গ-প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দেন। জর্জ এসে খবর দেয় একদল সৈন্য গঙ্গার দিকে ফটক ভেঙে পালিয়ে গেছে আর সে-পথ দিয়ে নবাবের পদাতিক বাহিনী হুড়হুড় করে প্রবেশ করেছ দুর্গের ভেতরে। হলওয়েলের আদেশে জর্জ সাদা নিশান উড়িয়ে দেয়।
এমনি সময় প্রবেশ করেন নবাব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাজা মানিকচাঁদ আর মিরমর্দান। মানিকচাঁদের আদেশে হলওয়েল তাঁর দলবল নিয়ে হাত তুলে দাঁড়ান। এমন সময় প্রবেশ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। হলওয়েল রাতারাতি কোম্পানির সেনাধ্যক্ষ বলে গেছেন দেখে নবাব অবাক হন। হলওয়েল বলেন, নবাব যেন তাঁদের ওপর অন্যায় জুলুম না করেন।
সিরাজ বলেন, ঘৃণ্য আচরণের জবাবে তাদের ওপর সত্যিকার জুলুম করতে পারলে তিনি সুখী হতেন, আর তাঁর আক্রমণের কথা শুনেই ড্রেক প্রাণভয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তবু তার আচরণের জন্য যেকোনো একজনকে অবশ্যই কৈফিয়ৎ দিতে হবে। বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের স্পর্ধা ইংরেজ পেলো কোথায়, তিনি তা জানতে চান।
হলওয়েল বলেন, ইংরেজরা যুদ্ধ করতে চান নি, শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। নবাব শ্লেষাত্মক স্বরে তাকে বলেন, আত্মরক্ষার জন্য কাশিমবাজারে কুঠিতে তারা অস্ত্র আমদানি করছিল।
খবর পেয়ে তাঁর হুকুমে কাশিমবাজার কুঠি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, বন্দি করা হয়েছে ওয়ট্স্ আর কলেটকে। তিনি বন্দিদের তাঁর সামনে হাজির করতে হুকুম দেন রায়দুর্লভকে। বন্দিদের আনা হলে নবাব ওয়াট্সকে বলেন, তিনি জানতে চান, তাদের অশিষ্ট আচরণের জবাবদিহি কে করবে।
কাশিমবাজারে তারা গোলাগুলি আমদানি করছে, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম তারা দখল করে নিচ্ছে, দুর্গ সংস্কার করে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে, তাঁর নিষেধ অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণবলভকে আশ্রয় দিয়েছে, বাংলার মসনদে বসার পর তারা তাঁকে নজরানা পর্যন্ত দেয় নি। এসব উলেখ করে তিনি জানান যে, ইংরেজদের এসব অনাচার সহ্য করবেন না।
ওয়াট্স জানান, তাঁর নবাবের অভিযোগ তাঁদের কাউন্সিলে পেশ করবেন। উত্তরে নবাব বলেন, ইংরেজদের ধৃষ্টতার জবাবদিহি না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের বাণিজ্য করার অধিকার তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। ওয়াট্স তাঁকে বলেন, বাণিজ্যের অধিকার নবাব দেন নি, দিয়েছেন দিলীর বাদশাহ।
নবাব বলেন, বাদশাহকে তারা ঘুষের টাকায় বশীভূত করে রেখেছে, তিনি তাদের অনাচার দেখতে আসেন না। হলওয়েল সবিনয়ে বলেন, নবাব আলিবর্দী তাদের বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছেন।
ওয়াট্স বলেন, তারা বাংলায় এসেছেন বাণিজ্য করতে, রাজনীতি করতে নয়; টাকা রোজগারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। নবাব উষ্ণ হয়ে বলেন, তারা বাণিজ্য করেন না, করেন লুন্ঠন; বাধা দিতে গেলই শাসন-ব্যবস্থায় আনতে চান ওলট-পালট; কর্ণাটকে, দক্ষিণাত্যে তাঁরা শাসন-ক্ষমতা করায়ত্ত করে লুটতরাজের পথ পরিষ্কার করেছেন। বাংলাতেও তা-ই করতে চান তারা।
তাঁর নিষেধ সত্তে¡ও তারা কলকাতার দুর্গ সংস্কার বন্ধ রাখেননি। ওয়াট্স অজুহাত দেখান যে, তাঁরা ফরাসি ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চান। নবাব বলেন, ফরাসিরা ডাকাত আর ইংরেজ খুব সজ্জন নয়। ওয়াট্স বলেন, ইংরেজরা অশান্তি চায় না।
নবাব কঠোর কণ্ঠে রায়দুর্লভকে হুকুম করেন,গভর্নর ড্রেকের বাড়িটা যেন কামানের গোলায় উড়িয়ে দেয়া হয় এবং গোটা ফিরিঙ্গি পাড়ায় আগুন ধরিয়ে যেন ঘোষণা করা হয় যে, ইংরেজরা যেন অবিলম্বে কলকাতা ছেড়ে চলে যান।
আশপাশের গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয়া হোক কেউ যেন ইংরেজের কাছে তাদের সওদা না বেচে, আর এ নিষেধ অমান্যকারীকে ভোগ করতে হবে ভয়ঙ্কর শাস্তি।
নবাব কলকাতার নাম আলীনগর রেখে রাজা মানিকচাঁদকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন এবং তাঁকে প্রত্যেকটি ইংরেজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নবাব তহবিলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। তিনি জানিয়ে দেন যে, কলকাতা অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করতে হবে কোম্পানির প্রতিনিধিদের আর কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট কলকাতার প্রত্যেকটি ইংরেজকে।
ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরে একটা মসজিদ তৈরি করতে নবাব হুকুম দিলেন মিরমর্দনকে। উমিচাঁদের কাঁধে হাত রেখে নবাব তাঁকে মুক্তি দিলেন। মিরমর্দানকে বললেন, রাজা রাজবলভের সাথে তাঁর একটা মিটমাট হয়ে গেছে, তাই কৃষ্ণবলভকে মুক্তি দেবার ব্যবস্থা যেন করা হয়।
তিনি হলওয়েলকে বলেন, তাঁর সৈন্যদের তিনি মুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু হলওয়েল তাঁর বন্দি। রায়দুর্লভকে হুকুম দিলেন কয়েদি হলওয়েল, ওয়াট্স আর কলেটকে নবাবের সাথে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। মুর্শিদাবাদে ফিরে তাঁদের বিচার করবেন।
প্রথম অঙ্ক : দ্বিতীয় দৃশ্য
১৭৫৬ সাল, ৩ জুলাই। ভাগীরথী নদীতে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজ। পলাতক ড্রেক, হ্যারী, মার্টিন প্রমুখ ইংরেজ পুঙ্গবেরা দলবলসহ আশ্রয় নিয়েছে সে জাহাজে। চরম দুরবস্থা তাদের। আহার্য দ্রব্য তারা পায় না। যৎসামান্য পায় চোরাচালানের মাধ্যমে। পরনে বস্ত্র নেই বললেই চলে। সবারই এক কাপড় সম্বল। জাহাজের ডেকে ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক ও দুজন ইংরেজ তরুণ পরামর্শ করছেন।
ড্রেক বলেন, মাদ্রাজ থেকে কিলপ্যাট্টিক খবর এনেছেন, প্রয়োজনীয় সাহায্য আসছে, কিন্তু হ্যারী বলে, তার আগেই তাদের দফা শেষ হয়ে যাবে। মার্টিন বলে যে, কিলপ্যাট্রিক এসেছেন মাত্র আড়াইশ সৈন্য নিয়ে; এ নিয়ে একটা দাঙ্গা করাও সম্ভব নয়, যুদ্ধ করে কলকাতা পুনরাধিকার করা যাবে না।
হ্যারী বলে, লোকবল বিশেষ বাড়ে নি, কিন্তু দুর্লভ আহার্যের অংশীদার বেড়েছে। ড্রেক তাদের আশ্বাস দেন যে, আহার্যের জোগাড় কোনো রকমে করা যাবেই। মার্টিন কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
সে বলে, কাছে হাটবাজার নেই। নবাবের হুকুমে কেউ কোনো জিনিস ইংরেজদের কাছে বেচে না, চার গুণ দাম দিয়ে সওদাপাতি করতে হয় গোপনে। সে আরও বলে যে, তাদের এ দুর্দশার জন্য দায়ী গভর্নর ড্রেক। ড্রেক নবাবকে উদ্ধত ভাষায় চিঠি লিখেছে, নবাবের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষ্ণবলভকে আশ্রয় দিয়েছেন।
উত্তরে ড্রেক বলেন যে, সব ব্যাপারে সবার নাক গলানো সাজে না। হ্যারী শ্লেষাত্মক ভাষার বলে, কৃষ্ণবলভের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ খাবেন ড্রেক, তাতে তাদের মাথা ঘামানো অবশ্যই উচিত নয়।
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১-৮ | PDF
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ৯-১৭ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১৮-২৫ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ২৬-৩১ | PDF
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১১-২০ | PDF Download
তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, ঘুষের অঙ্ক খুব মোটা হওয়াতেই নবাবের ধমকানি সত্তে¡ও ড্রেক কৃষ্ণবলভকে পরিত্যাগ করতে পারেন নি। মার্টিন অভিযোগ করে, ড্রেক তাঁদের ভাগ্যবিপর্যয় সম্পর্কে কাউন্সিলের কাছে মিথ্যা রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। টেবিলে ঘুষি মেরে ড্রেক তাঁকে ধমক দেন।
ড্রেক আরও বলেন, ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃত্ব তখনো তাঁর হাত ছাড়া হয় নি, ও জাহাজটাই তখন তাঁদের দুর্গ। একযোগে কাজ করার পরামর্শের জন্য তাঁদের ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তারা তেমন মর্যাদার পাত্র নন। মার্টিন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়, তাঁরা ড্রেকের কর্তৃত্ব মানবে না।
ড্রেক ক্ষেপে ধঢ়ড়ষড়মু দাবি করেন মার্টিনের কাছে, নতুবা তাকে কয়েদ করা হবে। ড্রেকের কথায় ইংরেজ মহিলা ছুটে এসে ড্রেককে বলেন, তিনি মেয়েদের নৌকায় কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছেন, তাঁর এমন দম্ভ শোভা পায় না। ড্রেক তাকে বোঝাতে চান যে, তারা তখন কাউন্সিলে বসেছেন।
রমণী উত্তেজিত হয়ে বলেন, প্রাণ বাঁচাবার কোনো ব্যবস্থা নেই, অথচ কাউন্সিলে বসছেন, কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন, প্রত্যহ শোনান কিছু একটা করা হচ্ছে, অথচ হচ্ছে শুধু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া। ড্রেক তাকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করেন।
রমণী প্রবোধ মানেন না। তিনি বলেন, এক প্রস্থ জামা-কাপড়ই সম্বল। ছেলে-বুড়ো সবাইকে তা খুলে রেখে রাতে ঘুমাতে হয়, কোনো আব্র“ নেই।
এমন সময় হলওয়েল আর ওয়াট্স এসে উপস্থিত। হলওয়েল বলেন, মুর্শিদাবাদ পৌঁছে নবাব তাঁদের মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তি পেতে তাঁদের নানা ওয়াদা করতে হয়েছে, নাকে কানে খৎ দিতে হয়েছে। ওয়াট্স বলেন, কলকাতায় এখন ফেরা যাবে না, তবে ধীরে ধীরে একটা ব্যবস্থা হয়তো হয়ে যাবে, অর্থাৎ মেজাজ বুঝে যথাসময়ে একটা উপঢৌকনসহ হাজির হয়ে আবার একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
হলওয়েল বলেন, একটা ব্যাপার সুস্পষ্ট যে, নবাব ইংরেজদের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করতে চান না, তা চাইলে তখন কলকাতায়ও তাঁরা নিশ্চিত থাকতে পারবেন না। তাঁরা নবাবের সাথে যোগাযোগের কিছুটা ব্যবস্থাও করে এসেছেন।
তা ছাড়া উমিচাঁদ নিজের থেকেই ইংরেজদের সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। শুনে ড্রেক উলাস-ধ্বনি করেন। ওয়াট্স বলেন, মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবলভ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও নবাবের কানে কথাটা তুলবেন।
ড্রেক তখন হ্যারী আর মার্টিনকে বলেন, তিনি আশা করেন, তাদের মেজাজ কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে। তিনি তাদের বুঝিয়ে বলেন, তাদের মিলেমিশে থাকতে হবে, একযোগে কাজ করতে হবে। হ্যারী আর মার্টিন বলে যে, তারা ঝগড়া করতে চায় না, তারা তাদের ভবিষ্যৎ জানতে চায়, একটা নিশ্চিত ফলাফল দেখতে চায়।
যে জায়গায় পলাতক ইংরেজরা আস্তানা গেড়েছেন তা নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর। মশার উপদ্রব অত্যন্ত বেশি। ম্যালেরিয়ায় ভুগে ইতোমধ্যে কেউ কেউ মরেও গেছে। তবে সামরিক দিক দিয়ে জায়গাটার গুরুত্ব আছে। সমুদ্র কাছেই, কলকাতাও চলিশ মাইলের মধ্যে। প্রয়োজনমতো যেকোনো দিকে ধাওয়া করা যাবে।
কিলপ্যাট্রিকের মতে, কলকাতায় ফেরার আশায় বসে থাকতে হলে ফলতা জায়গাটাই সবচেয়ে নিরাপদ; নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল, সেদিক দিয়ে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। বিপদ যদি আসেই তবে আসবে কলকাতার দিক থেকে এবং সতর্ক হবার মতো সুযোগ পাওয়া যাবে। হলওয়েল জানায়, কলকাতার দিক থেকে তখনকার মতো বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই।
উমিচাঁদ কলকাতার দেওয়ান মানিকচাঁদকে হাত করেছে। তাঁর অনুমতি পেলে ইংরেজরা জঙ্গল কেটে ফলতায় হাট-বাজার বসিয়ে দেবে। ড্রেক দুঃখ করেন, নেটিভরা তাদের সাথে ব্যবসা করতে চায়, কিন্তু ফৌজদারের ভয়ে তা করতে পারছে না।
এমন সময় একটা লোক এসে ড্রেকের হাতে উমিচাঁদের পত্র দেয়। উমিচাঁদ লিখেছে, সে চিরকালই ইংরেজদের বন্ধু এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব সে অক্ষুণœ রাখবে। মানিকচাঁদকে সে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। সে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। এজন্যে তাঁকে নজর দিতে হয়েছে বারো হাজার টাকা।
টাকাটা উমিচাঁদ নিজের তহবিল থেকে দিয়ে দেওয়ানের স্বাক্ষরিত হুকুমনামা হাতে হাতে সংগ্রহ করে পত্রবাহক মারফত পাঠিয়েছে। সে বারো হাজার টাকা ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ যা ন্যায্য বিবেচিত হয় তা পত্রবাহকের মারফত পাঠিয়ে দিলে উমিচাঁদ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। সে পারিশ্রমিক বাবদ পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার আশা রাখে।
হলওয়েল আর ওয়াটসের মতে, অনেক টাকার বিনিময়ে হলেও উমিচাঁদের সাহায্য হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। ড্রেক বলেন, উমিচাঁদের লাভের অন্ত নেই, মানিকচাঁদের হুকুমনামার জন্য সে সতেরো হাজার টাকা দাবি করেছে। তিনি হলফ করে বলতে পারেন যে, সে টাকার মধ্যে দু’হাজারের বেশি মানিকচাঁদের পকেটে যাবে না, বাকিটা যাবে উমিচাঁদের তহবিলে। তিনি টাকাটা দিয়ে উমিচাঁদের লোকটাকে বিদায় করতে চলে যান।
ওয়াট্স বলেন যে, টাকার ব্যাপারে একা উমিচাঁদই দোষী নয়; মিরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবলভ, মানিকচাঁদ সবাই হাত পেতে রয়েছে। কিলপ্যাট্রিকের মতে, দশ দিকের দশটি খালি হাত ভর্তি করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ইংরেজ, ডাচ আর ফরাসিরা।
ড্রেক আবার প্রবেশ করে জানান, আরেকটা জরুরি খবর আছে উমিচাঁদের চিঠিতে। সে লিখেছে, শওকতজঙ্গের সাথে সিরাজের সংঘর্ষ আসন্ন। সে সুযোগ নেবেন মিরজাফর, জগৎশেঠ আর রাজবলভের দল। তাঁরা সমর্থন করবেন শওকতজঙ্গকে।
ওয়াটসের মতে, তাঁদের শওকতজঙ্গকে সমর্থন করাটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ শওকতজঙ্গ নবাব হলে সবার উদ্দেশ্য হাসিল হবে। ভাং খেয়ে নর্তকীদের নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকবেন শওকতজঙ্গ; উজির-ফৌজদাররা তখন যাঁর যা খুশি করতে পারবেন। ড্রেকের মতে, আগেভাগেই শওকতজঙ্গের কাছে ইংরেজদের ভেট পাঠানো উচিত।
হলওয়েল আর ওয়াট্স সদ্য কয়েদমুক্ত হয়ে এসেছেন। তারা বাতি চান, পেগ ভর্তি মদ চান। এ সময় নেপথ্য থেকে কে বলে ওঠে সমুদ্রের দিক থেকে জাহাজ আসছে। দুখানা, তিনখানা, চারখানা, পাঁচখানা জাহাজ আসছে কোম্পানির। নিশ্চয়ই মাদ্রাজ থেকে সবাই নিজ নিজ গ্লাসে মদ ঢেলে নেয়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।