HSC | বাংলা ২য় পত্র | গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা ২৬-৩০ | PDF Download: বাংলা দ্বিতীয় পত্র হতে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রবন্ধ রচনা গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্য বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়টির গুরুপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
২৬. কুটিরশিল্প
[য. বো. ১১]
ভ‚মিকা : কুটিরশিল্প বাংলাদেশের গৌরব ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক। যখন কলকারখানা তৈরি হয়নি বা ভারী যন্ত্রপাতি ছিল না তখন কুটিরশিল্প আমাদের জাতীয় জীবনের নানা অভাব দূর করত। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই তখন নিজ হাতে তৈরি করত। অতি প্রাচীনকালেই কুটিরশিল্প লাভ করেছিল বিশ্বখ্যাতি।
আজ বাংলার সেই স্বর্ণময় গৌরবের দিন ইতিহাসের দূস্তরতায় হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ঢাকাই-মসলিন। বাংলার কৃষিজীবনে ভাঙনের কারণে ভাঙন ধরেছে কুটিরশিল্পেও। কুটিরশিল্পী এখন তার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে ক্লান্ত-প্রাণ, হতোদ্যম।
কুটিরশিল্প কী : ‘কুটির’ শব্দের অর্থ পত্র নির্মিত ছোট ঘর আর ‘শিল্প’ অর্থ গৃহকার্যে ব্যবহার্য সুন্দর সামগ্রী। কুটিরশিল্প বলতে মূলত বোঝায় পরিবারভিত্তিক বা পরিবারের ক্ষুদ্রাকার ও সামান্য মূলধনবিশিষ্ট শিল্প-কারখানা। এর উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রধানত স্থানীয় কাঁচামাল এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কারিগরি দক্ষতা ও সহজ দেশজ প্রযুক্তিনির্ভর দ্রব্যাদি। কুটিরশিল্প গ্রাম ও শহর উভয় এলাকাতেই বিদ্যমান।
কুটিরশিল্পের বৈশিষ্ট্য : কুটিরশিল্পের কতকগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এতে অল্প খরচে দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে পুঁজি কম লাগে এবং খরচ কম বলে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যও কম। তাছাড়া ঘরে বসেই কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা যায়। কুটিরশিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে শিল্পপ্রতিভার ছাপ মেলে। শিল্পীর স্বহস্তে তৈরি দ্রব্য দেখতে সুন্দর এবং টেকেও বেশি দিন।
কুটিরশিল্পের পরিচিতি : কুটিরশিল্পের পরিচয় বিস্তৃত। ঘরে বসে বোনা তাঁতের কাপড়, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পিতলের বাসন-কোসন, বাঁশ বেত, খেলনার জিনিস, সোনা-রুপার গয়না, সুতি শিল্প, শীতল পাটি, মোড়া, চাটাই ইত্যাদি সামগ্রী আমাদের উল্লেখযোগ্য কুটিরশিল্প। আমাদের কুটিরশিল্পের মধ্যে এক সময় মসলিন কাপড় ছিল বিশ্ববিখ্যাত।
নিচে আমাদের উল্লেখযোগ্য কুটিরশিল্পের পরিচয় তুলে ধরা হলো :
তাঁত শিল্প : ঢাকার মসলিন কাপড়ের একসময় দুনিয়াজোড়া খ্যাতি ছিল। বর্তমানেও আমাদের দেশের তাঁতিরা লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, গেঞ্জি, বিছানার চাদর, মশারির কাপড় প্রভৃতি উৎপাদন করে থাকে। তাছাড়া পাবনা ও টাঙ্গাইলের শাড়ি, মিরপুরের জামদানি, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর সিল্ক গুণগত মানের দিক থেকে খুবই উন্নত।
মৃৎশিল্প : তাঁতশিল্পের পরেই আমাদের দেশে মৃৎশিল্পের অবস্থান। এ দেশের গ্রামের মানুষ এখনো মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, বাস-কোসন, কলস ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। আগে শৌখিন দালান, মসজিদ, মন্দির প্রভৃতিতে টেরাকোটার কাজ খুব চোখে পড়ত। এখন টেরাকোটা বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে মাটির তৈরি গৃহসজ্জার সামগ্রী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ঢাকা, কুষ্টিয়া, খুলনা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলায় মৃৎশিল্পের ব্যাপক সুনাম রয়েছে।
বাঁশ ও বেতশিল্প : সিলেটের বেতের চেয়ার, সোফা, শীতল পাটি ও অন্যান্য হস্তশিল্প আমাদের দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী ছাড়া গ্রামীণ জীবন অচল। তাছাড়া বাঁশ দিয়ে আরও নানা ধরনের কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী তৈরি করা হয়।
ধাতুশিল্প : তামা, কাঁসা, পিতল, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতু দিয়ে নিত্যব্যবহার্য, হাঁড়ি, পাতিল, জগ, গøাস প্রভৃতি তৈরি করা হয় আমাদের দেশে। পিতলের ধাতু দিয়ে তৈরি গৃহসজ্জামূলক জিনিসগুলো এখানো জনপ্রিয়তা হারায়নি। এগুলোর গুণগত মান ভালো।
চামড়াশিল্প : বাংলাদেশের কুটিরশিল্পের মধ্যে চামড়াশিল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চামড়ার তৈরি জুতা, সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও এ সকল পণ্যের সমান চাহিদা রয়েছে।
অন্যান্য কুটিরশিল্প : বাংলাদেশে অন্যান্য কুটিরশিল্পজাত পণ্যের মধ্যে নকশিকাঁথা, ঝিনুকের তৈরি সামগ্রী, চুড়ি, পুতুল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
কুটিরশিল্পের সোনালি অতীত : এ দেশের কুটিরশিল্পের অতীত ইতিহাস গৌরবময়। ইউরোপে আঠারো শতকে শিল্পবিপ্লবের আগে কুটিরশিল্পই ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি। এ দেশে ইংরেজদের আগমনের আগে কুটিরশিল্প যে বাজার ও সুনাম অর্জন করেছিল তা ইতিহাসে স্বীকৃত। ঢাকাই মসলিনের সুনাম ছিল পৃথিবীজোড়া। আজকের দিনে তা স্মৃতি হয়ে আছে।
কুটিরশিল্পের বর্তমান অবস্থা : আঠারো শতক থেকে শুরু হয় ইউরোপে শিল্পবিপ্লব। দিকে দিকে ঘটল তার কালকারখানা স¤প্রসারণ। বৃহৎ যন্ত্রশিল্পের সঙ্গে ক্ষীণপ্রাণ কুটিরশিল্প অসম প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিল। রাজনৈতিক চক্রান্ত, হীন ব্যবসায়-বুদ্ধি দিনের পর দিন আমাদের কুটিরশিল্পকে বিধ্বস্ত করেছে।
বৃহদায়তন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যন্ত্রের সাহায্যে কম সময়ে বেশি দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে মূল্যও কম পড়ে। তাছাড়া কারখানায় তৈরি পণ্য নিখুঁত হয়। তার জন্য কারখানায় তৈরি পণ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
কুটিরশিল্পের প্রতিযোগিতা : আমাদের মতো দরিদ্র দেশে কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। কুটিরশিল্প তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য বৃহদায়তন শিল্পের পাশে অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার রাখে। হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি জনসাধারণের যেমন চাহিদা পূরণ করতে পারে তেমনি বিদেশি দ্রব্যাদির আমদানি কমিয়ে স্বনির্ভর হতে পারে।
তাছাড়া আমাদের দেশের শ্রমিকের অনুপাতে কলকারখানা কম থাকায় কুটিরশিল্প প্রসারে দেশের বেকার নারীÑপুরুষের কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে। তাই দেশের আর্থিক সংকট দূর করতে হলে আমাদের কুটিরশিল্পের উন্নতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
কুটিরশিল্পকে বাঁচানোর জন্য গৃহীত পদক্ষেপ : কুটিরশিল্পের উপযোগিতা বিবেচনা করে কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয় উৎকর্ষ সাধানের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্রায়তন ও বৈচিত্র্যময় কুটিরশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দান, উৎপাদন প্রক্রিয়ার উৎকর্ষ সাধন, বাজার ব্যবস্থাপনা, মূলধন সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আরও একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে শুধু কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবনই সব নয়, প্রয়োজন পণ্য-বৈচিত্র্য ও উৎপাদন-উৎকর্ষের সাধনা।
উপসংহার : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কুটিরশিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। ইতোমধ্যে আমাদের কুটিরশিল্প বিশ্ববাজারে কৌত‚হলী ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। তাছাড়া জনবহুল বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও কুটিরশিল্পের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। কুটিরশিল্পের সঙ্গে আমাদের লাখ লাখ দরিদ্র জনগণের ভাগ্য জড়িত। তাই কুটিরশিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই আমাদের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ জন্য দরকার সরকার ও জনগণের সম্মিলিত ঐকান্তিক চেষ্টা। মোট কথা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনে কুটিরশিল্পের প্রয়োজন ও গুরুত্ব অপরিসীম।
২৭. খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা
[য. বো. ১৪, চ. বো. ১২, সি. বো. ১২]
ভ‚মিকা : মানুষ চায় সকল একঘেয়েমি দূর করে জীবনকে আনন্দে ভরে তুলতে। খেলাধুলা এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সুস্থ দেহেই বাস করে সুস্থ মন। আর দেহকে সুস্থ ও সুঠামরূপে গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। খেলাধুলা থেকে যে নির্মল বিনোদন লাভ হয় তা মানসিক প্রফুল্লতার পথকে প্রশস্ত করে। এর ফলে মানুষ বলবান ও উদ্যমী হয় এবং যেকোনো কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য অফুরন্ত প্রেরণা খুঁজে পায়।
খেলাধুলার উদ্ভব : প্রাচীনকাল থেকেই মানুষকে সুস্থদেহী, সবল ও কর্মক্ষম করে রাখার জন্য বিভিন্ন খেলার প্রচলন ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ বছর আগে থেকে প্রাচীন মিশরের খেলা ছিল ডালকুকুর নিয়ে শিকার। কুস্তি খেলার প্রথম সূচনা হয় ইরাকে, ৪০০০ বছরেরও বেশি আগে।
এছাড়া মুষ্টিযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ, দৌড়-ঝাঁপ ইত্যাদির ইতিহাসের সূচনাও প্রায় ৪০০০ বছর আগে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেশে শারীরিক সামর্থ্য পরীক্ষার জন্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়েজিত হতো। খেলাধুলার ইতিহাসে অনন্য ঘটনা খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পিক খেলার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে খেলাধুলার জগতে নৌকা চালনা, বক্সিং, স্কেটিং, পোলো, সাঁতার, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি অসংখ্য খেলার উদ্ভব হয়েছে এবং আরও নতুন নতুন খেলা উদ্ভাবিত হচ্ছে।
বিভিন্ন বয়সে খেলাধুলা : শিশুকাল থেকেই মানুষ খেলাধুলার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ অনুভব করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দৌড়-ঝাঁপ আর বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরের শ্রমের চাহিদা পূরণ করতে হয়। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলা করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, কারণ এটাই শরীর গঠনের প্রকৃষ্ট সময়। কৈশোর থেকে যৌবনে পৌঁছতে পৌঁছতে খেলাধুলার উপকরণ অনেক বদলে যায়।
মানসিক উন্নয়নে খেলাধুলা : মানসিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্যও খেলাধুলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ও আনন্দময় পরিবেশে বেড়ে উঠলে শিশুর মন হয় উচ্ছল ও প্রাণবন্ত। মনের সতেজতা ও প্রাণময়তা বৃদ্ধিতে খেলাধুলার ভ‚মিকা যথেষ্ট।
তাই দেখা যায়, শিশুদেরকে পুতুল খেলতে না দিয়ে যদি বয়স্কদের জগতে আবদ্ধ করে রাখা হয় তবে তাদের মানসিক বিকাশ হয় না। বরং তারা অভিমানী, অস্থির ও বদমেজাজি হয়ে ওঠে। খেলাধুলা অনেক ক্ষেত্রে মানসিক দুশ্চিন্তা লাঘবের উপায়। তাছাড়া দাবা, তাস ইত্যাদি চিন্তামূলক খেলা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে বিকশিত করে।
শিক্ষায় খেলাধুলা : ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যাশিক্ষাকে চিত্তাকর্ষক করতে এবং পাঠ্য বিষয়ের প্রচণ্ড চাপ লাঘব করতে শিক্ষার সাথে সাথে খেলাধুলাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেখা গেছে, ক্লাস করতে করতে শিক্ষিকা হঠাৎ করে ছাত্রছাত্রীদের ব্যায়াম করার নির্দেশ দিলেন। এতে অঙ্ক কষায় ছাত্রছাত্রীদের একঘেয়েমি কেটে যায়। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে টেবিল টেনিস, ব্যায়াম, দাবা, বাস্কেটবল ইত্যাদি খেলার ব্যবস্থা থাকে।
মানব মৈত্রী গঠনে খেলাধুলা : খেলাধুলা দেশে-দেশে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করায়ও ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের কথা। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট বা হকি উভয় দেশের মধ্যে মৈত্রী স্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে।
তবে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শান্তি ও মৈত্রী স্থাপনের সবচেয়ে বড় সম্মেলন অলিম্পিক গেমস্। এই বিশাল ক্রীড়া সম্মেলনে সারা বিশ্বের প্রায় সব দেশের হাজার হাজার খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেন। প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ উপলব্ধি করেন যে মানবজাতি এক এবং অবিচ্ছিন্ন। অলিম্পিক ছাড়াও বহু খেলার আসর আন্তর্জাতিক স¤প্রীতি রক্ষায় সহায়তা করে।
স্বাস্থ্যোন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধে খেলাধুলা : স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উচ্ছল পরমায়ু।” জীবনকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সবার আগে নিজের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হবে।
আর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। শরীরের কোষগুলোর পুষ্টিসাধন, সহজ ও স্বাভাবিক রক্তচালনা, পরিপাক যন্ত্রকে কর্মক্ষম রাখা প্রভৃতির জন্য প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো শারীরিক খেলায় অংশ নেওয়া বা ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করা। একজন সুস্থ সবল নাগরিক তার দেশের ও জাতির জন্য যে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে তা একজন অসুস্থ ও রুগ্ণ নাগরিকের দ্বারা অসম্ভব।
চরিত্র গঠনে খেলাধুলা : খেলাধুলা মানুষের চরিত্র গঠনেও সাহায্য করে। খেলাধুলার নিয়মকানুন মেনে চলতে গিয়ে মানুষ শেখে নিয়মানুবর্তিতা। খেলাধুলা মানুষকে করে সুশৃঙ্খল। দলপতি, কোচ ও রেফারির কথা মেনে চলে, দলপতির অধীনে দলবদ্ধ হয়ে খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়রা সকলে মিলেমিশে কাজ করার শিক্ষা পায়।
এভাবে যৌথ পরিকল্পনা, যৌথ কাজ ও যৌথ শ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ নৈতিকভাবে সবল হয়ে ওঠে। তাছাড়া সাঁতার, ফুটবল ইত্যাদি খেলা মানুষকে সময় সচেতন করে তোলে। এভাবে খেলাধুলা মানুষের চরিত্রকে আরও উন্নত ও মহৎ করে।
উপসংহার : খেলাধুলায় প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষকে দৃঢ়সংকল্প করে, চলার পথে দেয় সহিষ্ণুতার দীক্ষা, অনমনীয় পৌরুষকে দীপ্ত করে, ছিন্ন করে সংকীর্ণতার আবরণ। জয়ে-পরাজয়ে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় সেখানে মানুষ লাভ করে এক সুশৃঙ্খল জীবনবোধ।
খেলার মাঠও মানুষের অন্তহীন সাধনার পীঠস্থান। বর্তমানে আমাদের দেশেও সার্বিক প্রগতির জন্য প্রয়োজন দেহ-মনের স্বাভাবিক বিকাশের পথ উন্মুক্ত করা। প্রয়োজন সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া।
খেলাধুলার অঙ্গনে নতুন প্রতিভার সাদর আমন্ত্রণ, পরিচর্যা এনে দেবে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার প্রতিশ্রæতি। তবেই দেশ নবজাগরণের চেতনায় আবার উদ্বুদ্ধ হয়ে ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব, পারবে সাফল্যের বিজয়মালা ছিনিয়ে আনতে।
২৮. সততা
ভূমিকা : সততাই শ্রেষ্ঠ নীতি। মানব চরিত্রের অন্যতম একটি মহৎ গুণ হলো সততা। এই গুণ অর্জনের চেষ্টা ও চর্চা একজন মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে মর্যাদা ও গৌরবের শ্রেষ্ঠতম শিখরে। নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলস অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি তার নৈতিক উৎকর্ষতা বাড়িয়ে এই গুণ অর্জন করতে পারে। সততার গুণ না থাকলে কেউ আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সততাই মানব চরিত্রের অলংকার এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১-৫ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ৬-১০ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১০-১৫ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | প্রতিবেদন রচনা ১৬-২১ | PDF Download
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১-১০ | PDF Download
সততা কী : মানবচরিত্রে অনেক সদগুণের সমষ্টিই সততা। সত্যের অনুসারী মানুষের সৎ থাকার প্রবণতার মধ্য দিয়ে সততার প্রকাশ ঘটে। অন্যায়, অবৈধ কাজ না করে ন্যায় ও সত্যের পথে জীবন পরিচালনা করাই সততার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সৎ চিন্তা ও সৎ কাজের মধ্য দিয়েই সততার মহৎ গুণের বিকাশ ঘটে। যারা পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়তে চায় সেই সব মানুষ সততার চর্চা করে সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে।
সততার সুফল : সততার সুফল শতদলের মতো শত ধারায় বিকশিত। জীবনকে সুন্দর, সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে সততার বিকল্প নেই। সৎ গুণসম্পন্ন মানুষ কখনও অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকতে পারে না। সততার অলংকার ছাড়া কোনো মানুষ চরিত্রবান ও মহৎ হতে পারে না।
সততার আলোকরশ্মি দেশ সমাজে ছড়িয়ে পড়লে সমাজ থেকে অন্যায়ের কুৎসিত অন্ধকার দূর হয়। সৎ লোক সমাজে সবার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকেন। যে সমাজে এমন বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা যত বেশি সেই সমাজ তত সমৃদ্ধ। সমাজের নেতৃত্ব সততার গুণে গুণান্বিত লোকদের হাতে থাকলে মানুষের জান, মাল, মান, সম্পদ নিরাপদ থাকে। তাই মানুষ চায় তাদের নেতা সৎ, সাহসী ও যোগ্য হোক।
মানুষের নৈতিক উন্নতি এবং মুক্তির বাণী নিয়ে পৃথিবীতে যত ধর্ম এসেছে তার সবগুলোতেই সততা, সত্যবাদিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ধর্মের মূল কথাই হলো সততা।
সততার প্রভাব : সত্য হলো আলো আর মিথ্যা অন্ধকার। সত্যের আলোর প্রভাবে মিথ্যা দূর হয়। মিথ্যার সাথে জড়িয়ে থাকা পাপও দুর্বল হয়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। সততার প্রভাব উপলব্ধি করার জন্য সত্যসাধক হতে হবে। কারণ এর জ্যোতির্ময়তা অজ্ঞ লোকদের চোখে ধরা পড়ে না। কারণ তারা চোখ থাকতেও অন্ধ।
তাদেরকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে একজন সৎ লোকের সততার আলো শুধু তাকে নয়, তার সংস্পর্শে আসা অন্যরাও উপকৃত হয়।
সৎ লোকের সততার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে অসৎ-মন্দলোক ও জীবনের গতি বদলে যায়।
সত্যের অনুসারী ব্যক্তির চিন্তায়, বিশ্বাসে ও প্রকাশে যে অভিব্যক্তি সেই সততাই মানবজীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চারিত্রিক দিক। এটি দুটি মানবীয় গুণ যাদের মূল্যবোধে ছড়িয়ে আছে, তারা কেবল মানুষ-ই নয়, বলা যায় মহামানুষ। বিশ্বাসের দৃঢ়তায় তারা বলিষ্ঠ, জগতে তাদেরই জয়-জয়কার। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করতে পেরেছি যে একমাত্র সততা ও ভালোবাসা দ্বারা পৃথিবীকে জয় করা যায়।’
মহৎ মানুষের জীবন সততার দৃষ্টান্ত : মহামানবগণ সত্যের অনুসরণে তাঁদের জীবনের মহান সাধনাকে সফল করেছেন। মহৎ ও বরণীয় মানুষ মাত্রই সততার মূর্ত প্রতীক। সত্যবাদিতার জন্য যেমন তাঁরা লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যলাভ করেছেন, তেমনি সত্যের বলে বলীয়ান হয়ে তাঁরা প্রবল শত্রæকেও পরাজিত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছেন।
সর্বকালের মহামানব, মহাপুরুষ, মানব মুক্তির অগ্রদূত হযরত মুহম্মদ (সা.) সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সমস্ত জীবন নানা দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে কঠোর সাধনা মগ্ন ছিলেন। সত্যের সাধনার বলেই তিনি সবার কাছে আল-আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভ‚ষিত হন।
সত্যের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন যিশুখ্রিস্ট। সত্যকে সমুন্নত রাখতে হেমলক বিষপানে জীবন দিতে হয়েছে জ্ঞানপ্রেমিক দার্শনিক সক্রেটিসকে। এমনি করে সত্যের সাধনায় মহাপুরুষগণ জীবনকে যেভাবে গৌরবান্বিত করে গেছেন তেমনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন সততার মহান আদর্শ।
বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সততার মূল্যায়ন : সততা বাস্তব জীবনের একটি মহত্তর দিক হলেও বাস্তব জীবনে বিশেষত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারছে না। সততা পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে। ফলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে নানা রকমের অত্যাচার, অনাচার ও দুর্নীতি করে চলেছে। অসততার প্রতি মানুষের তেমন প্রতিবাদ বা বিরূপতা দেখা যাচ্ছে না।
ফলে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। আমাদের যুবসমাজ প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। একদিকে রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব-কলহ, অন্য দিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করছে। সমাজে সমাজবিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞান, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়।
বিবেক সেখানে বিবর্জিত। আজ তাই মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও গৌণ হয়ে উঠেছে। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে সততা, সত্যবাদিতা ও মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যুবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে।
আমাদের কর্তব্য : জীবনকে অবশ্যই সততার মাধুর্যে মণ্ডিত করতে হবে। অন্যায়ের মাধ্যমে বা অবৈধ উপায়ে কেউ যতই বিত্তশালী হোক না কেন তা যে পাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসত্যের পরাজয় আসবেই ও ন্যায়ের পথ চির উজ্জ্বল থাকবেই। সৎ ব্যক্তি নৈতিক শক্তির বলে বলীয়ান। পরোপকারই তার জীবনের ব্রত।
কখনো সে অন্যের ক্ষতির চিন্তা করেন না। মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় সততার গুণে। যে সমাজে সত্য ও সততার মূল্যায়ন নেই, সেই সমাজে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেই সমাজ ক্রমে নানা পাপাচারে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে।
সেজন্য সততা ও সত্যবাদিতার অনুশীলন করতে হবে এবং জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে হবে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমাজে আজ সৎ মানুষের প্রয়োজন খুব প্রকট। তাই আমাদের সকলের প্রয়োজন সত্যের সাধনা।
উপসংহার : সততা সুন্দর, সততা মহান। আমাদের চরিত্রকে মহিমান্বিত করার জন্য, জীবনকে সফলতায় ভরে দেওয়ার জন্য সততার চর্চা অপরিহার্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সততার পরিচয় দিতে ছোটবেলা থেকেই সৎ থাকার অভ্যাস গঠন করতে হবে। সততার অনুশীলন করতে হবে।
২৯. অধ্যবসায়
[কু. বো. ১৫, চ. বো. ১৫, দি. বো. ১৫, ব. বো. ১৫, রা. বো. ১৪,ঢা. বো. ১৩, সি. বো. ১২]
সূচনা : সকল ক্ষেত্রেই সফলতা মানুষের পরম আকাক্সিক্ষত। কিন্তু অনেকেই সব কাজে একবারে সফল হয় না। সফলতার জন্য বার বার চেষ্টা করতে হয়। কোনো কাজে সাফল্য লাভের জন্য বারবার এই চেষ্টার নামই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় ছাড়া জীবনে উন্নতি লাভ করা যায় না। কঠোর অধ্যবসায় ব্যক্তিকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। অধ্যবসায়ই হচ্ছে মানবসভ্যতার অগ্রগতির চাবিকাঠি।
অধ্যবসায় কী : অধ্যবসায় শব্দের আভিধানিক অর্থ অবিরাম সাধনা, μমাগত চেষ্টা। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবিরাম সাধনা বা μমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াকে বলে অধ্যবসায়। ব্যর্থতায় নিরাশ না হয়ে কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্যের সাথে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্যেই অধ্যবসায়ের সার্থকতা নিহিত।
অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা : ব্যর্থতাই সফলতার প্রথম সোপান। ব্যর্থতা থেকে সাধনার শুরু, আর সফলতার মাধ্যমে তার শেষ। তাই মানবজীবনে সাধনা বা অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। অধ্যবসায়ী মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। এমনকি অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে পারে। তাই মানবজীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায় : ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কেননা ছাত্রজীবনই ভবিষ্যৎ গড়ার উপযুক্ত সময়। এ সময় ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ মানবজীবনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যে ছাত্র অধ্যবসায়ী, সাফল্য তার হাতের মুঠোয়। অলস ছাত্র-ছাত্রী মেধাবী হলেও পড়াশোনায় কখনো সফল হতে পারে না। ছাত্রজীবনেই এই সত্য উপলব্ধি করে নিজেকে অধ্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষের বিখ্যাত উক্তি :
পারিব না একথাটি বলিও না আর,
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার,
একবার না পারিলে দেখ শতবার।
অধ্যবসায় ও প্রতিভা : অধ্যবসায় প্রতিভার চেয়ে অনেক বড়। অধ্যবসায়ের জোরেই নিজেকে প্রতিভাবান হিসেবে সকলের মাঝে তুলে ধরা যায়। মনীষী ভল্তেয়ারের ভাষায়, ‘প্রতিভা বলে কোনো কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।’ ডালটন বলেছেন, ‘লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে; কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া আর কিছু জানি না।
’ বিজ্ঞানী নিউটনের উক্তি, ‘আমার আবিষ্কার প্রতিভা-প্রসূত নয়, বহু বছরের অধ্যবসায় ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনার ফল।’ এ থেকেই বোঝা যায়, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম ছাড়া শুধু প্রতিভার কোনো মূল্য নেই। প্রতিভাবান ব্যক্তিরা অধ্যবসায় দ্বারাই নিজের কাজকে সুসম্পন্ন করে তোলেন। আবার অধ্যবসায়ের দ্বারা অনেকে প্রতিভাবান হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।
অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত : পৃথিবীতে যেসব মনীষী সাফল্যের উচ্চ শিখরে অরোহণ করে অমরত্ব লাভ করেছেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন অধ্যবসায়ী। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস ও ফ্রান্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কার্লাইল অধ্যবসায়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। রবার্ট ব্রুস বারবার ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়েও যুদ্ধ-জয়ের আশা ও চেষ্টা ত্যাগ করেননি। ষষ্ঠবার পরাজিত হয়ে তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।
একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়ে বিশ্রামের সময় দেখতে পেলেন একটি মাকড়সা বারবার কড়িকাঠে সুতা বাঁধার চেষ্টা করছে এবং ব্যর্থ হচ্ছে। এইভাবে ছয়বার ব্যর্থ হয়ে সপ্তমবারে মাকড়সাটি সফল হলো। এই দেখে রবার্ট ব্রুসও সপ্তমবার যুদ্ধ করে ইংরেজদের পরাজিত করেন এবং স্কটল্যন্ডের ওপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। মনীষী কার্লাইল তাঁর লেখা ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি এক বন্ধুকে পড়তে দিয়েছিলেন।
বন্ধুর বাড়ির কাজের মহিলা সেটিকে বাজে কাগজ ভেবে পুড়িয়ে ফেলেন। কার্লাইল এতে একটুও দমে যাননি। তিনি আবার চেষ্টা করে বইখানা লিখে বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। সম্রাট নেপোলিয়ান, আব্রাহাম লিংকন, μিস্টোফার কলম্বাস প্রমুখ মনীষীর জীবনও অধ্যবসায়ের এক বিরাট দৃষ্টান্ত।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অধ্যবসায়ের গুণেই আজ বিশ্ববিখ্যাত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা বাঙালিমাত্রই তাঁদের জন্য গর্বিত।
উপসংহার : সফলতা লাভে অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। অধ্যবসায় হচ্ছে জীবনসংগ্রামের মূল প্রেরণা। এ সংগ্রামে সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে অধ্যবসায়ী মানুষ জীবনের সব ব্যর্থতাকে সাফল্যে পরিণত করতে পারে। ব্যর্থতায় হতাশ না হয়ে চেষ্টা ও অধ্যবসায় চালিয়ে গেলে সাফল্য একসময় ধরা দেবেই। যুগে যুগে এ ধরনের অধ্যবসায়ীরাই অমরত্ব পেয়েছেন।
৩০. শিষ্টাচার
[য. বো. ১১]
ভূমিকা : আচরণে ভদ্রতা ও সুরুচিবোধের যৌক্তিক মিলনের নাম শিষ্টাচার। শিষ্টাচার আমাদের মনের সৌন্দর্যের মহৎ উপস্থাপনা। অন্যকথায় সুন্দর আচরণ বা ব্যবহারই হলো শিষ্টাচার। সে আচরণÑকথাবার্তায়, কাজকর্মে, চলনে-বলনে, রীতিনীতিতে সর্বোপরি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
যাকে বলে আদব-কায়দা মেনে চলা বা ভদ্র ব্যবহার ও সৌজন্যবোধ দেখানো; তাই মূলত শিষ্টাচার। বস্তুত সত্যিকারের মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় তার সুন্দর, সংযত ও বিনয়ী ব্যবহার অর্থাৎ, শিষ্টাচার প্রদর্শনে।
মানবজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব : দেহের সৌন্দর্য অলংকার কিন্তু আত্মার সৌন্দর্য শিষ্টাচার। মানুষ যত দিন অরণ্যচারী ছিল, তত দিন সে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ প্রকাশের প্রয়োজনবোধ করেনি। যখন থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ হলো, তখন থেকে শিষ্টাচার ও ভদ্রতাবোধের প্রয়োজন অনুভ‚ত হয়। শিষ্টাচার শুধু আমাদের ব্যক্তিজীবনের সৌন্দর্যই নয়, আমাদের সমাজজীবনেরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।
শিষ্টাচারের গুণেই মানুষের সঙ্গে মানুষের যেকোনো সম্পর্ক রাখা সম্ভবপর হয়। বড় ও বয়স্কদের সম্মান করা, সকলকে আচরণে তুষ্ট করা, ঔদ্ধত্যকে পরিহার করা এবং সবার সঙ্গে প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে তোলাই মানবিক বৈশিষ্ট্য। মার্জিত রুচি ও সুন্দর মনের পরিচয় দিতে হলে কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে আমাদের হওয়া উচিত নম্র ও বিনয়ী।
আচরণে যে জাতি যত বেশি সভ্য সে জাতি তত বেশি সুশৃঙ্খল ও উন্নত। কেবল পশুপাখির মতো বেড়ে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য নয়। আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ও জাতীয় জীবনে কোনো-না-কোনো ভাবে অবদান রাখা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আর তা করতে হলে শিষ্ট আচরণের অনুশীলন ছাড়া বিকল্প নেই।
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব : ছাত্রজীবন হলো মানুষের প্রস্তুতিপর্ব। এরই ওপর নির্ভর করে সফলতা ও ব্যর্থতা, ভবিষ্যৎ জীবনের গতি-প্রকৃতি। এ সময়ই হলো তার শিষ্টাচারও সৌজন্য শিক্ষার যথার্থ কাল। শিষ্টাচার ও সৌজন্যের ছোঁয়াতেই ছাত্র হয় বিনীত, ভদ্র। শিষ্টাচার ও সৌজন্য শিক্ষা তার মনুষ্যত্ব অর্জনেরই সোপান। এরই মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তোলার মহাশক্তি।
জ্ঞানার্জনে নিষ্ঠা, অভিনিবেশ আর শৃঙ্খলাবোধের পাশাপাশি শিষ্টাচার অনুশীলন খুবই জরুরি। নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষের জন্য ছাত্রজীবনেই ব্যবহারে ভদ্রতা আর শিষ্টতার সম্মিলন ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞানের সাথে শিষ্টাচারের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। একজন ছাত্র যদি শিষ্টাচার বর্জিত হয় তবে সে সকলের কাছেই নিগৃহীত হয়।
ফলে একদিকে সে যথার্থ শিক্ষা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে তেমনি ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হয়। শিষ্টাচার-বিবর্জিত ছাত্র দুর্বিনীত হয়ে থাকে। সে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় কাজের সাথে যুক্ত হতে পারে। যা শুধু তার নিজের জন্যই নয় অনেকেরই ক্ষতির কারণ হতে পারে।
শিষ্টাচার অর্জনের উপায় : মহত্ত¡ মানুষকে উদার করে। মানুষের মাঝে এই মহত্তে¡র পরিশীলিত প্রকাশই শিষ্টতা। সাধারণভাবে চালচলন, কথাবার্তায় যে ভদ্রতা, শালীনতা আর সৌজন্যের পরিচয় পাওয়া যায় তা-ই শিষ্টতা। আচরণে যদি মানুষ শিষ্ট না হয় ব্যবহারে উগ্রতা যদি পরিহার না করে তবে কখনো শিষ্টাচারী হওয়া সম্ভব নয়।
স্বভাবে কৃত্রিমতা পরিহার করতে না পারলে কখনো পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া যায় না। ঔদ্ধত্য আর উচ্ছৃঙ্খলতা শিষ্টাচারের কাছে পরাজিত হয়। অহংকার অন্যকে ছোট ভাবতে শেখায়। শিষ্টতা বিপরীতভাবে মানুষকে সম্মান করতে শেখায়।
কদর্যতা আর অশ্লীলতা শিষ্টাচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কাজেই শিষ্টাচারী হতে গেলে ব্যক্তিকে হতে হয় আচরণে মার্জিত, বক্তব্যে সৎ, সরল আর স্পষ্ট। বিনয় মানুষকে ছোট করে না, বরং পরায় সম্মানের কুকুট। এই বিনয় শিষ্টতার অঙ্গভ‚ষণ।
শিষ্টাচারহীন জীবনের কুফল : শিষ্টাচারের গুণেই ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠে সহজ-সরল, স্পষ্ট, সৎ ও মার্জিত। আজ সমাজের নানা ক্ষেত্রেই অশিষ্টাচার ও সৌজন্যহীনতার নিষ্ঠুর চিত্র। দিন দিন মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতা বাড়ছে। বাড়ছে তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে বিরোধ।
শিষ্টাচারের অভাবে সমাজ অন্তঃসারশূন্য, বিবেকহীন হয়ে পড়ছে। চারদিকে আজ বিত্তবানের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য, প্রবলের সীমাহীন অত্যাচার। আজ শিষ্টাচার ও সৌজন্য দুর্বলের ভীরুতারই অসহায় প্রকাশ যেন। দুর্ব্যবহার ও দুর্মূখতাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের সৌন্দর্য হারিয়ে মানুষ আজ নিঃস্ব, হৃদয়হীন।
উপসংহার : শিষ্টাচার অসংখ্য মানবিক গুণের সমষ্টি। প্রত্যেকেরই এ গুণের অধিকারী হওয়া উচিত। কারণ শিষ্টাচারের গুণের মধ্যে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের কল্যাণ নিহিত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যদি এ গুণের অধিকারী হয় তাহলে সমাজ ও জাতিকে সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছতে খুব কম সময় লাগবে। মানুষ সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করবে। তাই বলা যায়, শিষ্টাচার উন্নত জীবনের সিঁড়ি।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।