HSC | সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | চরিত্র আলোচনা ১ | PDF : বাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক হতে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্যবাংলা প্রথম পত্রের সিরাজউদ্দৌলা নাটক নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
চরিত্র আলোচনা
সিরাজউদ্দৌলা:
ভূমিকা : সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নায়ক সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। এ তরুণ নবাবকে স্বার্থান্ধ স্বদেশী ষড়যন্ত্রকারী এবং ক্ষমতা ও অর্থলোভী বিদেশি চক্রান্তকারীদের সম্মিলিত শঠতা, দুরভিসন্ধি ও শক্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এ মোকাবেলা প্রচেষ্টার কাহিনি ও তাঁর করুণ পরিণতিই বিধৃত হয়েছে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। তাঁর চরিত্রে সমাবেশ ঘটেছিল বহু বিরল গুণের। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা, নীতিবান, সাহসী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিবেচক, ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও সর্বোপরি স্বদেশপ্রেমিক।
আপসকামী : সিরাজ মসনদে আরোহণ করার সময় চিরাচরিত প্রথায় নজরানা পাঠানো থেকে বিরত থাকলেও তিনি বার বার ইংরেজদের সাথে আপস করার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি জানতেন যে, ঘসেটি বেগম তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন।
কিন্তু নবাবের আপোসকামিতা অর্থলোভী ইংরেজ কোম্পানির লোকদের স্পর্ধা বাড়াতে থাকে। তারা কাশিমবাজার কুঠিতে গোপনে অস্ত্র আমদানি করে, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম দখল করে, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং নবাবের আদেশ লঙ্ঘন করে কৃষ্ণবলভকে আশ্রয় দেয়। এভাবে ধৃষ্টতা ও অনাচার যখন চরমে পৌঁছে তখন নবাব কোম্পানির বিরুদ্ধে সামরিক দেওয়ান নিযুক্ত করেন, মুক্তি দেন উমিচাঁদকে এবং কোম্পানির কর্মচারী হলওয়েল, ওয়াট্স ও কলেটকে রাজধানীতে পাঠাবার নির্দেশ দেন।
কৌশলী : গভর্নর ড্রেক, ক্যাপটেন ক্লেটন প্রমুখ ইংরেজ পালিয়ে সঙ্গীদেরসহ ভাগিরথী নদীবক্ষে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং শোচনীয় জীবনযাপন করতে থাকেন। অর্থলোভী উমিচাঁদ ঘুষের বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতক মানিকচাঁদের কাছ থেকে কলকাতার ইংরেজদের ব্যবসার অনুমতি আদায় করে তা ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে পাঠিয়ে দেয়। নবাব এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।
ওদিকে নবাবও নানা ওয়াদা আদায় করে হলওয়েল ও ওয়াটসকে মুক্তি দেন। নবাবের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করা ও তাদের ক্ষমতা খর্ব করা, তাদের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করা নয়; তাই তিনি বন্দিদের মুক্তি দেন।
তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী : উভয় স্বার্থান্বেষী পক্ষ অপদার্থ শওকতজঙ্গকে মসনদে বসাতে তৎপর হয়। ঘসেটি বেগমের মতিঝিলের প্রাসাদে যখন সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে আসে তখন মোহনলালকে নিয়ে নবাব সেখানে উপস্থিত হন।
তিনি জানান, শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে অভিযানের আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি ঘসেটি বেগমকে তাঁর নিজ প্রাসাদে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। মতিঝিলের ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ভেঙে যায় এবং এরপর শওকতজঙ্গ পরাজিত ও নিহত হয়। সিরাজের তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার ফলে একটা বিপদের অবসান হয়।
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১-৮ | PDF
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ৯-১৭ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১৮-২৫ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ২৬-৩১ | PDF
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১১-২০ | PDF Download
ধৈর্যশীল : ষড়যন্ত্র তখন নতুন খাতে বইতে থাকে, বিজ্ঞ সিরাজ তখন ইংরেজদের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে তাঁর অমাত্যদের বিবেক ও স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে তিনি দেখিয়ে দেন তাদের পরামর্শের ভ্রান্তি। কিন্তু নির্যাতিত লবণ-প্রস্তুতকারীকে উপস্থিত করার ব্যাপারটাকে তাঁরা তাঁদের প্রতি অপমান বলে গণ্য করে ক্ষুব্ধ হন। মিরজাফর প্রচ্ছন্ন ভীতি প্রদর্শন করতেও কুণ্ঠিত হন না।
সিরাজ তাঁদের শিষ্ট আচরণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন যে, দেশকে বাঁচাতে হলে সিপাহ্সালার, জগৎশেঠ, রাজবলভ, উমিচাঁদ প্রমুখকে কয়েদখানায় আটক রাখা উচিত। তাঁর এ মন্তব্যে তাঁর বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণাই প্রকাশ পায়। কিন্তু ধৈর্যশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নবাব একতাবদ্ধভাবে দেশের কল্যাণ প্রচেষ্টার পথ অনুসরণ করাকে শ্রেয় মনে করেন।
তিনি ইংরেজদের বিদ্রোহমূলক কার্যকলাপের কথা উলেখ করে সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত স¤প্রীতির ভিত্তিতে কল্যাণের পথে অগ্রসর হবার আহŸান জানান। তিনি সেনাপতি ও অমাত্যদের কাছে তাঁকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভ্রান্ত না করারও অনুরোধ জানান।
দূরদর্শী : স্বার্থান্ধদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। মিরজাফর মসনদ লাভের আকাক্সক্ষায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। অন্যান্যরাও নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে বদ্ধ-পরিকর। মিরনের বাড়িতে দেশি ষড়যন্ত্রকারী ও বিদেশি ক্ষমতালিপ্সুদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
নবাব সব খবরই রাখতেন। তিনি ইংরেজদের রাজধানী আক্রমণ করার সুযোগ না দিয়ে ইংরেজদের মোকাবেলা করার জন্য পলাশির প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। মিরজাফর, রায়দুর্লভ প্রমুখ সেনাপতিরা তাঁর পক্ষে লড়বেন না জেনেও দূরদর্শী নবাব তাঁদের সাথে নিয়ে যান যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজধানী দখল না করতে পারে। উলেখ্য যে, সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের আশঙ্কায় তাঁদের পদচ্যুত করাও সম্ভব ছিল না।
দেশপ্রেমিক : নবাব ছিলেন অনন্যসাধারণ দেশপ্রেমিক। তাই তিনি আশা করতেন, দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লুৎফ খাঁদের অন্তরে শেষ মুহূর্তে দেশপ্রেম জেগে উঠতে পারে। উচ্চ চিন্তার অধিকারী নবাব জানতেন না স্বার্থবোধ মানুষকে কত নিচে নামাতে পারে। নবাবের ক্ষীণ আশা পূর্ণ হয়নি। পলাশির প্রান্তরে যুদ্ধের অভিনয় হলো; মিরমর্দান, বদ্রী আলী প্রমুখ প্রাণ দিলেন, কিন্তু বিপর্যয় এড়ানো গেল না।
প্রবল মনোবল : চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তেও নবাব আশা না হারিয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৈরি হতে লাগলেন। অবিলম্বে মোহনলাল এসে পরাজয়ের খবর জানিয়ে নবাবকে মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়ে রাজধানী রক্ষা করার চেষ্টা করতে পরামর্শ দিলেন। তিনি দ্রুত ফিরে এসে জনগণকে দেশরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তখন তিনি পতিগত-প্রাণা লুৎফুন্নেসাকে সাথে নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করলেন।
ধৃত হয়ে বন্দিবেশে তাঁকে রাজধানীতে ফিরে আসতে হলো। ঘাতকের আঘাতে দেশের ও সাধ্বী-স্ত্রী লুৎফুন্নেসার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা জানিয়ে কালেমা পড়তে পড়তে নবাব প্রাণ ত্যাগ করেন।
উপসংহার : নবাব চরিত্রে একটি মাত্রই দুর্বলতা দেখা যায় কিন্তু তাঁর উৎসও একটি মহৎ গুণ। এ দুর্বলতা হচ্ছে দয়া-মমতার আধিক্য। তিনি একটু কঠোর হতে পারলে হয়তো শেষ রক্ষা করতে পারতেন। তবে ষড়যন্ত্র ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে তিনি যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তাতে তার দক্ষতা, মানবিকতা, প্রজাদরদি ও নির্ভেজাল দেশপ্রীতির পরিচয় ফুটে উঠেছে।
মিরজাফর
ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত প্রতীক মিরজাফর। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিপাহ্সালার, সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। দেশরক্ষার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তার ওপর। তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন নি। নিজের স্বার্থের জন্য বিদেশি বণিক-চক্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে তিনি দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে বসেছিলেন বাংলার মসনদে। তাই মিরজাফর বাংলার ইতিহাসে সর্বাধিক ঘৃণিত, ধিকৃত আর অভিশপ্ত ব্যক্তি।
মসনদলোভী : সিপাহ্সালারূপে বাংলার নবাবের প্রতি তার আনুগত্য ছিল না। তিনি আজীবন স্বপ্ন দেখতেন বাংলার নবাবীর। “একটা দিন, মাত্র একটা দিনও যদি ওই মসনদে মাথা উঁচু করে আমি বসতে পারতাম।” এ লোভই তাকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা থেকে স্খলিত করেছিল।
ওয়াদাভঙ্গকারী : মসনদে বসার পর থেকে সিরাজ মিরজাফরকে সঙ্গত কারণেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন, তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। তবু দেশের জনগণের কল্যাণের খাতিরে তিনি তাকে অনুরোধ করেছেন, তিনি যেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত না করেন। জবাবে মিরজাফর দেশের স্বার্থের জন্য পবিত্র কোরান ছুঁয়ে ওয়াদা করলেন আজীবন নবাবের আজ্ঞাবহ হয়েই থাকবেন। অথচ তাঁর স্বার্থবোধ ধর্মবোধকে গলা টিপে মেরেছে, করেছে নিষ্ক্রিয়।
হীন স্বার্থপর : মিরজাফরের মতো দুর্জনের ছলের অভাব নেই। নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার ব্যাপারে এ লোকটা ছিলেন সদা তৎপর। নিজের কার্যকলাপের কথা ভুলে গিয়ে তিনি প্রকাশ্যে বলে বেড়াতেন সিরাজ তাঁকে মর্যাদা দেন না। প্রকাশ্য দরবারে মোহনলালের তরবারি নিষ্কাশনে তিনি অপমানিত বোধ করেন। অথচ এই মর্যাদা-অভিমানী সিপাহ্সালার অন্তরের অন্তস্থলে ছিল ঘৃণ্য কাপুরুষতা। মোহনলালের উন্মুক্ত তরবারি তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। ক্লাইভের কাছে কৃতজ্ঞতায় তিনি লজ্জাজনকভাবে নতজানু।
ধূর্ত : ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মিরজাফর ছিলেন সবচেয়ে ধূর্ত। ধরা পড়বার ভয়ে গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করতেন খুবই কম। ক্লাইভের দাবি দেশের আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অযৌক্তিক জেনেও তিনি তা মেনে নিতে ষড়যন্ত্রের সাথিদের অনুরোধ করেন।
তিনি রাজা রাজবলভকে বলেন, “আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি রাজা রাজবলভ। ও কথা আর এখন ভাবলে চলবে না। সকলের স্বার্থের খাতিরে ক্লাইভের দাবি মেটাবার যা হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।”
তার সাংগঠনিক বুদ্ধিও ছিল প্রচুর। তিনি বিভিন্ন স্বার্থের পূজারী একদল বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্রকারীকে এক জোটে কাজ করার প্রেরণা যুগিয়েছেন, তাদের মধ্যে ঐক্য রক্ষার দুঃসাধ্য কাজে সফলতা অর্জন করেছেন।
ক্ষীণ দেশপ্রেম : এমন যে স্বার্থান্ধ দেশদ্রোহী, তাঁর প্রাণেও দেশের জন্য ভালোবাসা ছিল। ক্লাইভের সাথে ভবিষ্যতের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দেবার পূর্ব মুহূর্তে তিনিও বিবেকের দংশন অনুভব করেছেন, কল্পনায় অমঙ্গলসূচক মরাকান্না শুনেছেন। তার সে সময়ের অস্বস্তি চতুর ক্লাইভের দৃষ্টি এড়ায় নি। এ জন্য ক্লাইভ তাকে ‘পড়ধিৎফ’ আখ্যা দিয়েছেন।
তা সত্তে¡ও কলম হাতে নিয়েও মিরজাফর বলেছেন, “কিন্তু রাজবলভ যেমন বলেন, সবাই মিলে সত্যিই আমরা বাংলাকে বিক্রি করে দিচ্ছি না তো?” কিন্তু চতুর ক্লাইভ লোকটার আসল দুর্বলতার খোঁজ রাখতেন। তাই প্রচণ্ড উত্তেজনায় মিরজাফর শেষ পর্যন্ত সে ঐতিহাসিক ঘৃণ্য দলিলে স্বাক্ষর করেন।
চক্রান্তকারী : পলাশির রণক্ষেত্রে মিরজাফরের চক্রান্ত চরমে ওঠে। তিনি তার বিরাট বাহিনী নিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মিরমর্দানের দুর্বার আক্রমণে ইংরেজ সৈনিকেরা যখন লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল, তখন এলো বৃষ্টি।
সিপাহ্সালার হিসেবে তখন মিরজাফর যুদ্ধরত নবাব বাহিনীকে হুকুম দেন যুদ্ধ বন্ধ করতে। তারা বিশ্রামের জন্য শিবিরের দিকে ফিরছে এমন সময় কিলপ্যাট্রিক আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ক্লাইভের সাথে হাত মিলিয়ে মিরজাফর প্রবেশ করেন নবাবের শিবিরে।
অন্যের হাতের পুতুল : ইংরেজের সেবাদাস মিরজাফর নবাব হয়ে প্রথম দরবারে ক্লাইভ না আসা পর্যন্ত মসনদে বসেন নি। ক্লাইভ এলে তিনি গদগদ কণ্ঠে সিংহাসনের জন্য ক্লাইভের কাছে প্রকাশ্য দরবারে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং তাঁর হাত ধরে মসনদে আসন গ্রহণ করেন।
তিনি ক্লাইভকে বার্ষিক চার লাখ টাকা আয়ের চব্বিশ পরগণার জমিদারীর স্থায়ী মালিকানা প্রদান করেন। তিনি প্রকৃত নবাব হন নি, হয়েছিলেন ক্লাইভের হাতের পুতুল। ইতিহাসে এ কারণে তাঁকে বলা হয়েছে ‘ক্লাইভের গর্দভ’।
উপসংহার : মিরজাফর নবাব হবার পরও সিরাজ সম্পর্কে তার অন্তরের ভীরু সঙ্কোচ ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। তিনি চেয়েছিলেন সিরাজকে রাজধানীতে না এনে বাইরে কোথাও আটকে রাখতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের চাতুর্যের কাছে তাকে হার মানতে হয়। ক্লাইভের কথায় তিনি ঘোষণা করেন সিরাজের বিচার হবে এবং কেউ ভূতপূর্ব নবাবের প্রতি অনুকম্পা দেখালে তার শাস্তি হবে। এ ঘোষণা তার অন্তর থেকে বেরোয়নি, ক্লাইভই তাঁকে দিয়ে কথাগুলো বলিয়েছেন।
সিরাজকে রাজপথে অপমানিত করার যে প্রস্তাব ক্লাইভ করেছিলেন মিরজাফর তা মেনে নেন নি। নাট্যকার মিরজাফরকে কিছুটা মানবিক গুণে গুণান্বিত করে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। তাই মিরজাফরকে পুরোপুরি হৃদয়হীন টাইপ চরিত্র বলা চলে না।
মিরজাফর দুরাকাক্সক্ষী, মিরজাফর লোভী, কিন্তু তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ, সংবেদনশীল চরিত্র। তিনি কিছুতেই সিরাজের হত্যার আদেশে স্বাক্ষর করতে পারেন নি, তার মুরুব্বি ক্লাইভের পরোক্ষ ইঙ্গিতেও তা তিনি করেন নি। এ মানবিক গুণটি বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত-প্রতীক মিরজাফরকে দোষে-গুণে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
রাজবলভ
ভূমিকা : দেশীয় প্রভাবশালী জমিদার রাজবলভ ছিলেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু তিনি তার ব্রাহ্মণত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের মনিব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
দূরদর্শী : রাজবলভ ঘসেটি বেগমের অনুগ্রহভাজন। শওকতজঙ্গকে বাংলার নবাব করার ষড়যন্ত্র সফল হলে ঘসেটি বেগম হতেন সত্যিকার নবাব এবং ঘসেটির নামে শাসনকার্য চালাতেন রাজবলভ। কিন্তু তাঁর সে ষড়যন্ত্র সফল হয় নি। কিন্তু তাই বলে এ উদ্যোগী পুরুষ হতাশ হননি। তিনি মিরজাফরের সমর্থক হিসেবে কোম্পানির কর্মচারীদের সাথে ষড়যন্ত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন।
রাজবলভ ক্লাইভের সাথে সম্পাদিত দলিলে স্বাক্ষর করেছেন। তবে তিনি সন্ধির পেছনে ক্লাইভের যে অভিসন্ধি ছিল তা ঠিকই ধরে ফেলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এই সন্ধি অনুসারে সিপাহ্সালার শুধু মসনদে বসবেন। কিন্তু রাজ্য চালাবে কোম্পানি।”
সন্ধিতে কোম্পানির কর্মচারীদের যে ক্ষতিপূরণ ও পুরস্কারের শর্ত ছিল তাও তিনি সমর্থন করতে পারেন নি। চুক্তি পড়ে তিনি বলেছিলেন, “নবাবের তহবিল দুবার লুট করলেও তিন কোটি টাকা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।”
তবু এ লোকটিই শেষ পর্যন্ত মিরজারকে সেই মারাত্মক দলিলে সই করতে প্ররোচিত করেছিলেন। কখনো বিবেকের উদয় হলেও রাজবলভের সিরাজের প্রতি বিদ্বেষ ছিল প্রখর। কারণ সিরাজ তাকে অর্থ আত্মসাতের দায়ে বন্দি করেছিলেন। তাই তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করতে।
সাবধানী অথচ রসিক : রাজবলভ অত্যন্ত সাবধানী লোক। মন্ত্রীসভায় রাইসুল জুহালার প্রবেশকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখেন। তবে তিনি রসিক লোক। রাইসুল জুহালার কৌতুক অভিনয় তিনি উপভোগ করেন। কিন্তু দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি পূর্ণ সচেতন।
নর্তকীদের কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম দিয়ে তিনি কাজের কথা সেরে নিতে চান। আলোচনার প্রারম্ভেই সবাই তর্ক জুড়ে দিলে তিনি তাদের বারণ করেন। তিনি ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা সংক্ষেপে সারতে চেয়েছেন। ক্লাইভের চুক্তিনামাটাও তিনি আগে পড়ে দেখতে চান। কারণ তিনি সতর্ক স্বভাবের ব্যক্তি।
আত্মসম্মানবোধ : সিরাজ তাঁর সভাসদদের প্রকৃত পরিচয় জানতেন বলে তাঁদের সাথে আলোচনা করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না; তাতেও রাজবলভ ক্ষুব্ধ ছিলেন। একবার সিরাজ জরুরি বিষয়ের মীমাংসার জন্য তাদের দরবারে ডেকেছেন বলে রাজবলভ তাঁর মুখের ওপর বলেন: “বেয়াদবি মাপ করবেন জাঁহাপনা।
দরবারে আজ পর্যন্ত কোনো জরুরি বিষয়ের মীমাংসা হয়নি।” রাজবলভের আত্মসম্ভ্রম-বোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর। অত্যাচারিত লবণ প্রস্তুতকারীকে দরবারে হাজির করলে তিনি নবাবকে বলেছিলেন, “কিন্তু প্রকাশ্যে দরবারে এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনায় আমাদের অপমান না করলেও চলতো।”
প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক : রাজবলভ প্রতারক, রাজবলভ বিশ্বাসঘাতক। তামা-তুলসী-গঙ্গাজল হাতে নিয়ে প্রকাশ্য দরবারে শপথ করেও তিনি নবাবের অর্থাৎ সমগ্র দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নবাব তাদের প্রকৃত পরিচয় জানেন এবং উপযুক্ত সময়ে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিলুপ্তি ঘটাবেন।
তাই তিনি সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য অবিলম্বে কর্মপন্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। তিনি মিরজাফরকে অপদার্থ জেনেও তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, ইংরেজরা বেনিয়ার জাত। টাকা ছাড়া তারা আর কিছুই বোঝে না।
তারা জানে যে, সিরাজের কাছ থেকে তাদের সুবিধা আদায়ের কোনো আশা নেই। কাজেই তারা তাদের সেবাদাস মিরজাফরকে মসনদে বসাবার জন্য সর্বপ্রকার সাহায্য করবে। ষড়যন্ত্র সফল করবার জন্য রাজবলভ অতিমাত্রায় উৎসাহী।
স্পষ্টভাষী : রাজবলভ ছিলেন স্পষ্টভাষী। তিনি ক্লাইভকেও ছেড়ে কথা বলেন নি। ক্লাইভ গাল ফুলিয়ে বড়ো কথা বললে তিনি তার মুখের ওপর বলেছিলেন, “তোমাকে ধরে বস্তাবন্দি হুলো-বেড়ালের মতো পানা-পুকুরে দুচারদিট চুবুনি দিতে বাদশাহের ফরমান যোগাড় করতে হবে নাকি?”
রাজবলভ রসিক পুরুষ। মিরজাফর বাংলার মসনদে বসবার প্রথম দিন আসতে দেরি করায় তিনি রসিকতা করে বলেছেন, “দর্জি নতুন পোশাকটা নিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছে কিনা কে জানে।”
উপসংহার : মিরজাফরের প্রথম দরবারে ক্লাইভ নবাবকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলে রাজবলভ বলেছেন, “রাজকার্য পরিচালনায় কাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে তাও মোটামুটি জানা দরকার।” এতে বোঝা যায় সরকারি পদমর্যাদা লাভের জন্য রাজবলভের একটা মোহ ছিল।
উমিচাঁদ
ভূমিকা : উমিচাঁদ লাহোরের শিখ ব্যবসায়ী। অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে সে বাংলায় এসেছিল। নিজের স্বার্থসিন্ধির জন্য সে নবাবের শাসন-ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে। এ স্বার্থান্ধ বণিক নিজের মতলব হাসিলের জন্য নবাবের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়, কিন্তু কোনো পক্ষের প্রতিই সে পুরোপুরি বিশ্বস্ত ছিল না। স্বার্থের পালা যেদিকে ভারি দেখেছে, সেদিকেই সে ঝুঁকে পড়েছে। দু’নৌকায় পা দিয়ে চলেছিল বলে শেষ পর্যন্ত তার ভরাডুবি হয়েছে।
ইংরেজ তোষণ : উমিচাঁদ এক সময় কলকাতায় ইংরেজদের হাতে বন্দি হয়। নবাব কলকাতা জয় করলে হলওয়েল তাকে মুক্তি দেন। ছাড়া পেয়ে সে ইংরেজের বিপদ মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। তার রসিকতাও বেশ উপভোগ্য। কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে ক্যাপ্টেন ক্লেটন পালিয়ে গেছেন শুনে সে রসিকতা করে হলওয়েলের মুখের ওপর বলেছিল, “ব্রিটিশ সিংহ ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিলেন, এ বড় লজ্জার কথা।”
সে আরও বলেছিল, “ক্যাপ্টেন কর্নেলরা সব পালিয়ে গেছেন, এখন ফাঁকা ময়দানে হাসপাতালের হাতুড়ে সার্জন জন জেকানিয়া হলওয়েল সর্বাধিনায়ক। “আপনিই এখন কমান্ডার-ইন-চীফ।” হলওয়েল ব্যাকুলভাবে উমিচাঁদের সাহায্য চাইলে ধূর্ত উমিচাঁদ রাজা মানিকচাঁদের কাছে চিঠি লিখবে বলে আশ্বাস দেয়। দুর্গের পতনের মুখে দুর্গ-প্রাকারে সাদা নিশান উড়িয়ে দিতে সে হলওয়েলকে পরামর্শ দেয়।
স্বার্থান্বেষী : স্বার্থান্বেষী উমিচাঁদ নিজের স্বার্থের সন্ধানে সেই দুর্যোগের দিনে প্রভাবশালী সবার সাথেই যোগাযোগ রেখে চলত। তাকে কেউই পুরোপুরি বিশ্বাস করতো না; সেও সবসময় মনে করতো তাকে সবাই ঠকাচ্ছে। ঘসেটির বাড়িতে তাই সে রায়দুর্লভকে বলেছে, “আপনারা সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফ শুকনো রাখেন, আর আমি দুধের হাড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাড়ির কালি মেখে গুলবাঘা বনে যাই।”
ভিজেবেড়াল : উমিচাঁদ ভিজেবেড়াল। সিরাজের পতন হলে কে কী পদ পাবেন তা নিয়ে আলোচনার সময় উমিচাঁদ বলেছে তার কোনো বিষয়ে দাবি-দাওয়া নেই। সে খাদেম। খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই সে নেয়। উমিচাঁদের বুদ্ধির অভাব ছিল না।
সে তখনকার পরিস্থিতিটা ঠিক আঁচ করতে পেরেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, সিরাজ তাকে বিশ্বাস করেন না। সিরাজের নবাবী কায়েম থাকলে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের মতো তারও রক্ষা নেই। তাই সে মনে-প্রাণে সিরাজের পতন কামনা করেছে।
উমিচাঁদের জীবনে টাকার মতো পরম কাম্য অন্য কোনো জিনিস নেই। সে নিজেই বলেছে, “দওলত তার কাছে ভগবানের দাদা মশায়ের চেয়েও বড়ো। সে দওলতের পূজারী।”
কালকেউটে : মিরনের বাড়িতে সিরাজের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র-সভায় উমিচাঁদ ছিল না। জগৎশেঠ বলেছেন উমিচাঁদকে বাদ দিয়ে কোম্পানির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব নয়। কারণ কোম্পানি যেমন এদেশে বাণিজ্য করতে এসে লুটপাট করছে, উমিচাঁদও ব্যবসা করতে এসে অর্থ সংগ্রহ করে চলেছে।
মিরজাফর নিজেও উমিচাঁদকে ভালো করে জানতেন। জগৎশেঠের মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে বলেছেন, উমিচাঁদ একটা আস্ত কালকেউটে। তার দাবিই সবার আগে মেটানো দরকার। তা না হলে, দণ্ড না পেরোতেই সমস্ত খবর পৌঁছে যাবে নবাবের দরবারে।
উপসংহার : ক্লাইভের মতে সে-যুগের সেরা বিশ্বাসঘাতক উমিচাঁদ। উমিচাঁদ ইংরেজদের গোপন অভিসন্ধি নবাবকে জানিয়ে দিয়েছে। তারপর আবার একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তাদের কাছে। উমিচাঁদ ত্রিশ লক্ষ টাকা দাবি করেছে। উমিচাঁদ ধড়িবাজ, কিন্তু ক্লাইভও কম ছিলেন না। তাই ক্লাইভ জাল দলিল করে উমিচাঁদকে ফাঁকি দিয়েছে।
সিরাজের পতনের পরে উমিচাঁদ তার ত্রিশ লক্ষ টাকা না পেয়ে টাকার শোকে পাগল হয়ে যায়। উন্মাদের মতো নতুন নবাবের দরবারে প্রবেশ করে চিৎকার করে ফরিয়াদ জানায়। ক্লাইভ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে বলেন, তার বয়স হয়েছে, তাই মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে।
তিনি তাকে তীর্থ করতে আর ঈশ্বরের ভজনা করতে উপদেশ দেন। কিলপ্যাট্রিক তাকে টেনে নিয়ে যায় দরবারের বাইরে। সে টাকা টাকা বলে অবিরাম চিৎকার করতে থাকে। তার উক্তি অর্থলোভী শাইলককে মনে করিয়ে দেয়।
জগৎশেঠ
ভূমিকা : জৈন জগৎশেঠ তৎকালীন বাংলার ধনকুবের ছিলেন। স্বয়ং নবাবও মাঝে মাঝে টাকার জন্য তার কাছে হাত পাতেন। ঘসেটি বেগমের বাড়িতে নাচ-গানের জলসায় তার সাথে পাঠকের প্রথম পরিচয়। তিনি লোভী, অর্থটাই তার জীবনের পরমার্থ। তিনি বুদ্ধিমান ও বহুদর্শী। ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্র সফল হলে কার কী লাভ হবে তিনি সঠিকভাবে আঁচ করতে পেরেছিলেন।
তাই তিনি ঘসেটি বেগমকে স্পষ্ট বলেছিলেন, “শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাং-এর গেলাস আর নর্তকী ছাড়া তিনি আর কিছুই জানেন না। তিনি নবাব হলে আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগম সাহেবার হাতে। তখন বেগমের নামে শাসনকার্য চালাবেন তার অনুগ্রহভাজন রাজা রাজবলভ।”
কাজেই শওকতজঙ্গের আমলে জগৎশেঠের স্বার্থ কিছুতেই নির্বিঘœ হবে না। অতএব তার জন্য সে ক্রান্তিলগ্নে নগদ কারবারই ভালো। তাই তিনি বলেন যুদ্ধের ব্যয় বাবদ তিনি শওকতকে সাধ্যমতো সাহায্য করবেন, কিন্তু আসল আর লাভ মিলিয়ে বেগম সাহেবা তাঁকে একটা কর্জনামা লিখে দিলে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন।
সিরাজভীতি : জগৎশেবের ধারণা ছিল সিরাজ তাদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা টের পেয়েছেন। তিনি যে-কোনো সময় তাদের বন্দি করতে চান। কাজেই সিরাজ স্থির হয়ে মসনদে বসতে পারলে তাদের নিষ্কৃতি নেই। তিনি নিজের ধনসম্পদ নবাবের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অজস্র অর্থ ব্যয়ে সেনাপতি ইয়ার লুৎফা খাঁর অধীনে দু’হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের একটা দল পুষতেন।
বুদ্ধিমান : বুদ্ধিমান জগৎশেঠের কোনো আস্থা ছিল না তৎকালীন বাংলার গুপ্তচরদের ওপর। তার মতে, গুপ্তচররা মূল চিঠি হয়তো আসল জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু তার আগে সে চিঠির একটা নকল নবাব-দরবারেও পাচার করে দিচ্ছে। তবে বাংলার তৎকালীন বিশৃঙ্খল অবস্থায় গুপ্তচরদের সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে এক পা-ও অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
দ্বিধা-দ্ব›দ্ব : ইংরেজের ওপর জগৎশেঠ পুরোপুরি আস্থা স্থাপন করতে পারেন নি। তিনি ক্লাইভকেও তার মুখের ওপর স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “ভগবানের দিব্যি, কর্নেল সাহেব, তোমরা বড় বেহায়া। এই সেদিন কলকাতায় যা মার খেয়েছো এখনো তার ব্যথা ভোলার কথা নয়।” তিনি বলেছেন, ইংরেজরা তাদের ব্যবসায়ের স্বার্থ রক্ষা করুক; কিন্তু তারা যেন দেশের শাসন-ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ না করে। শাসন-ব্যবস্থায় বিদেশিদের অনুপ্রবেশ সম্বন্ধে তার এ স্পষ্ট ভাষণ প্রণিধানযোগ্য।
উপসংহার : মিরজাফরের ওপরও জগৎশেঠের আস্থা পুরোপুরি ছিল না। মিরজাফর নবাব হয়ে প্রথমে দরবারে আসতে দেরি করায় তিনি রসিকতা করে বলেছেন, “খাঁ সাহেব ঢাল-তলোয়ার ছেড়ে নবাবী লেবাস নিচ্ছেন, তাই দেরি হচ্ছে। তা ছাড়া চুলে নতুন খেজাব, চোখে সুরমা, দাড়িতে আতর, এসব তাড়াহুড়ার কাজ নয়।”
অর্থপিশাচ এই ধনকুবের রসিক-পুরুষও ছিলেন।
রায়দুর্লভ
ভূমিকা : কায়স্থ রায়দুর্লভ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম সেনাপতি। নবাব ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করে অধিকার করেছিলেন। সে- অভিযানে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন রায়দুর্লভ। তিনি প্রথম জীবনে নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতিই ছিলেন।
শেষ দিকে ষড়যন্ত্রকারীদের খপ্পরে পড়ে সিপাহসালার হবার প্রলোভনে তাদের সাথে হাত মিলিয়েছেন। শওকতজঙ্গের বিরুদ্ধে সিরাজের সার্থক অভিযানের প্রাক্কালে রায়দুর্লভ গোপনে শওকতকে সমর্থন করেন কিন্তু বিনা স্বার্থে তিনি তা করেন নি। শওকত নবাব হলে তাঁকে পদাধিকারের একটা একরারন্যামা সই করে দেবার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
লোভী : রায়দুর্লভের হৃদয় থেকে দেশপ্রেম একেবারে শুকিয়ে যায় নি। নবাব তাঁর প্রকাশ্য দরবারে কুঠিয়াল সাহেবদের দ্বারা নির্মমভাবে উৎপীড়িত একজন হতশ্রী লবণ-প্রস্তুতকারককে হাজির করালে রায়দুর্লভ তার দুর্দশায় সাতিশয় ব্যথিত হয়ে ক্ষোভে-রোষে তরবারি নিষ্কাশন করে বলেছেন, “একি! এর এই অবস্থা কে করলো?”
তিনিও তামা, তুলসী ও গঙ্গাজল স্পর্শ করে শপথ করেছিলেন, সর্বশক্তি নিয়ে তিনি নবাবের অনুগামী থাকবেন, কিন্তু তিনিও লোভ দমন করতে পারেন নি। সিরাজের পতন হলে তিনি সিপাহসালার হবেন, এ প্রলোভন তাঁকে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করে। তিনি সম্ভবত এ লোভেই মিরজাফর তোষামোদ করে চলতেন। প্রকাশ্য দরবারে সিরাজ সভাসদদের অপমান করলে এ সুযোগসন্ধানী সেনাপতি বলেছিলেন, “সিপাহ্সালারের অপমানটাই আমার বেশি বেজেছে।”
রসিক : স্বার্থপর রায়দুর্লভের মধ্যেও রসিকতার অভাব ছিল না। মিরনের বাড়িতে নৃত্য-গীতের আসরে মন্ত্রণাসভা বসবার পূর্ব মুহূর্তে তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। তার সে আকস্মিক আবির্ভাবে মিরন বিস্ময় প্রকাশ করলে রায়দুর্লভ বলেন, “আমাকে আপনি নৃত্য-গীতের সুধারসে একেবারে নিরাসক্ত ধরে নিয়েছেন।” তিনি বলেছেন, অহরহ অশান্তি আর অব্যবস্থার মধ্যে থেকে তার জীবন বিস্বাদ হয়ে উঠেছে।
ধূর্ত : রায়দুর্লভ ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত ও ধুরন্ধর। তিনি ইচ্ছে করেই গোপন সভায় উপস্থিত থাকেন নি। তার পক্ষে অধিকক্ষণ বাইরে থাকা তিনি নিরাপদ মনে করেন নি। তিনি ভয় করেছেন, কখন কী কাজে নবাব তাকে তলব করে বসেন তার ঠিক নেই।
তলবের সাথে সাথে হাজির না পেলে নবাবের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। তবুও বিপদ ঘাড়ে করে তিনি মিরনের সাথে বৈঠকের আগে দেখা করতে এসেছেন শুধু তার সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করা হলো তা জানার জন্য। মিরন তাকে প্রধান সেনাপতিত্ব প্রাপ্তির আশ্বাস দেয় এবং তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে প্রস্থান করেন।
দ্ব›দ্ব-সন্দেহ : দুক‚ল বজায় রেখে চলেছেন কায়স্থ সেনাপতি রায়দুর্লভ। তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের সাফল্যটা নিশ্চিত বলে ধরে নিতে পারেন নি। তিনি মিরনকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, চারদিকের অবস্থা দেখে যদি তিনি বুঝতে পারেন যে, ষড়যন্ত্রকারীদের সাফল্য লাভের কোনো আশা নেই, তাহলে তারা যেন তার সহায়তার আশা না করেন। অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্রের ধুম্রজালে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি তার সঠিক কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারেন নি।
বিশ্বাসঘাতক : রায়দুর্লভ মাসে মাসে রাজবলভের কাছ থেকে যে-মোটা বেতন পেতেন এ তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি প্রকৃত অর্থে নবাবের অনুগত ছিলেন না। তবে আনুগত্যের মুখোশটা রক্ষা করতে তিনি বেশি তৎপর ছিলেন। মিরজাফরের কথায়, রায়দুর্লভ ছিলেন ক্ষুদ্র শক্তিধর। তবু ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে প্রয়োজনের সময় নবাবের বিরুদ্ধে তার বিশ্বাসঘাতকতার গুরুত্বও ছিল যথেষ্ট।
উপসংহার : পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে মিরজাফরের মতো তিনিও যুদ্ধ করেন নি। তিনি ইংরেজের সাথে হাত মিলিয়েছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার মনে অনুশোচনা জেগেছিল কি না তা বলা দুষ্কর। তিনি সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন নি। মিরজাফরের নবাবী আমলের প্রথম দরবারেও তাকে দেখা যায় না।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।