স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয়: ভাষা আন্দোলন ও বাঙ্গালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৪.০৫. পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের ১২ দফা কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনা কর ।
অথবা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের ১২ দফা কর্মসূচি লেখ ।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পর পূর্ববাংলায় নতুন যে রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। স্বাধীনতা লাভ করার মাত্র একমাস পর এ রাজনৈতিক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এ রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিল সাধারণত পূর্ববাংলার তরুণ যুবক রাজনৈতিক কর্মীদল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের ১২ দফা কর্মসূচি পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর। এ দলের সভাপতি নির্বাচিত হন তসাদ্দুক আহমদ চৌধুরী।
পূর্ববাংলার তরুণ যুবক কর্মীদল তাদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রকে নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে উক্ত দলটি গঠিত হয়েছিল। আর উক্ত দলটি গঠিত হওয়ার পরই দলটি বারো দফা কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে তার মতামত পেশ করে। কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ১২ দফা দাবির প্রথমটি ছিল, অনতিবিলম্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে নাকচ করে পূর্ণ আজাদীকে সুপ্রতিষ্ঠিত, করতে হবে। আগামী অক্টোবরে ব্রিটিশদের যে সম্মেলন হবে তাতে অংশগ্রহণ করা যাবে না। ব্রিটিশ আমলের ইংরেজ অফিসারের পেনশনের ভার পাকিস্তান সরকার বহন করবে না। পাকিস্তানের সমস্ত পাওনা ১৯৪৮ সালের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
কোনো প্রকার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির সাথে আপস করা যাবে না।
২. প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের ভোট গ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যা দুই (২) নং দাবিতে বলা হয়েছিল ।
৩. ভাষার ওপর ভিত্তি করে আত্মনিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক প্রদেশ গড়তে হবে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে যা তিন (৩) নং দাবির আওতাভুক্ত কর্মসূচি ছিল ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
৪. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সার্বিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যা চার (৪) নং দাবির আওতাভুক্ত ছিল ।
৫. জনগণের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়সমূহ উক্ত বারো (১২) দফা দাবির পাঁচ (৫) নং দাবিতে স্পষ্ট হয়েছে ।
৬. জমিদারি প্রথার অবসান ঘটিয়ে কৃষকদের বিনা ক্ষতিপূরণে তাদের প্রাপ্য জমি বুঝিয়ে দিতে হবে। কৃষকদের যাবতীয় ঋণ মওকুফ করতে হবে এবং খেত মজুরদের তাদের প্রাপ্য যথোপযুক্ত মজুরি বুঝিয়ে দিতে হবে।
৭. সাত (৭) নং দাবিতে বলা হয়েছে যে, জনগণের কল্যাণসাধনের জন্য এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান, বড় বড় ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানিসমূহকে জাতীয়করণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের কার্যকাল ৮ ঘণ্টা করতে হবে এবং যথোপযুক্ত মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
এ বিষয়সমূহ সম্পর্কে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
৮. আট (৮) নং দাবিতে বলা হয়েছে যে, ব্যাংক, চা-বাগান, খনি ইত্যাদি বড় বড় ব্যবসাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে বিদেশি মূলধন নিয়োজিত আছে। উক্ত বিদেশি মূলধন সরকারের অধীনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
যেকোনো প্রকার স্বার্থবিরোধী শর্তে কোনো বিদেশি মূলধন বা মার্শাল প্ল্যান গ্রহণযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করতে হবে। আর এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
৯. ১২ দফা দাবির নয় (৯) নং দাবিতে উল্লেখ করা হয়েছে, নারী- -পুরুষ নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের সরকারকে অকাতরে এগিয়ে আসতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
১০. পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের দশ (১০) নং দাবিতে উল্লেখ করা হয় যে, সরকারের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জনগণের সংখ্যার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকারকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে হবে।
১১. পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের এগারো (১১) নং দাবিতে বলা হয়েছে যে, সামরিক ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেকের জন্য সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আর জনগণের মধ্যে সামরিকবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য জনগণকে সামরিক শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সামরিক স্কুল, কলেজ ইত্যাদি স্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
১২. ১২ দফা দাবির সর্বশেষ দাবিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করতে হবে।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পাকিস্তান যুবলীগের ১২ দফা কর্মসূচি ছিল এর রাজনৈতিক কর্মীদের একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির সেক্রেটারি মোহাম্মদ একরামুল হক একটি ইশতাহার উত্থাপন করেন যা উপস্থিত সকল প্রতিনিধিগণের সম্মতিক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারপরেও ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে পুলিশের অমানবিক আচরণ এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের শুভাকাঙ্ক্ষীদের অত্যাচার, অনাচারের মুখে পড়ে পূর্ববাংলা থেকে এ রাজনৈতিক সংগঠনটির বিলুপ্তি ঘটে।
৪.০৬. ছাত্রলীগের দাবিসমূহ সম্পর্কে লেখ।
অথবা, ছাত্রলীগের দাবিসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গঠিত হয়। তৎকালীন সময়ে এই নব সংগঠনটি ব্যাপক প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কালক্রমে এ সংগঠনটি একক বৃহত্তম দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আত্মপ্রকাশ করে।
পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা পায় এবং কালক্রমে এসব ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ভাঙন শুরু হয়। কিছু কিছু সংগঠন বিলুপ্তও হয়ে যায় কিন্তু ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের মধ্যে যে একতা ছিল সে কারণেই তারা দৃঢ়ভাবে টিকেছিল ।
ছাত্রলীগের দাবি : পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৫৩ সালের এক কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
তখন থেকে এ ছাত্র সংগঠনটি ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয়। উক্ত সংগঠনটি তৎকালীন সময় থেকে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছিল সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. ছাত্রলীগ ১ নং দাবিতে বলেছিল যে আজাদী লাভ করার ওপর ভিত্তি করে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা এবং পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন সাধন করতে হবে।
২. ২ নং দাবিতে উল্লেখ করে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সংকীর্ণতাকে দূরীভূত করতে হবে এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন ঘটাতে হবে ও অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
৩. ৩ নং দাবিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল সামরিক শিক্ষাকে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক করতে হবে; পূর্ব পাকিস্তানে যুবকদের নৌ, বিমান এবং স্থল সামরিক শিক্ষা প্রদান করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে, পাকিস্তান নৌবিভাগের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. ৪ নং দাবি ছিল কারিগরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, ধাত্রীবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।
৫. ৫ নং দাবিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, অল্প খরচে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাহায্য প্রদান করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
পল্লি অঞ্চলে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিক ছাত্রাবাসগুলোতে ফ্রি স্টুডেন্টশিপের ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠাগার বা লাইব্রেরিগুলোতে ইসলামিক ঐতিহ্যের গ্রন্থের সমাবেশ ঘটাতে হবে এবং বাড়তি বইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
যাতে করে পাঠাগারগুলোতে বইয়ের কোনো ঘাটতি না পড়ে এছাড়াও প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের চিকিৎসার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রত্যেক ছাত্রের আবাসস্থলের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. ছাত্রলীগের ছয় (৬) নং দাবিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, নারীদের জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং নারী সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। নারী শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
৭. সাত (৭) নং দাবিতে যে বিষয়সমূহ উল্লেখ করা হয়েছিল সেগুলো হলো— পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলকলেজসমূহে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান পদ্ধতি চালু করতে হবে। এছাড়াও বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৮. আট (৮) নং দাবিতে বলা হয়েছ যে, প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বায়ত্তশাসিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। ছাত্রদের কল্যাণের জন্য স্বায়ত্তশাসনমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অবর্ণনীয় ।
৯. নয় (৯) নং দাবির আওতাভুক্ত ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং ছাত্রাবাসগুলোতে স্বায়ত্তশাসিত ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রত্যেক ছাত্রের স্বাধীনভাবে স্ব স্ব মতামত প্রকাশের অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
১০. দশ (১০) নং দাবি অর্থাৎ সর্বশেষ দাবিতে উল্লেখ করা হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পুলিশের অন্যায় হস্তক্ষেপ এবং ছাত্রদেরকে অযথা হয়রানির নীতি বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পবিত্রতা রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সকল আন্দোলনে ছাত্রলীগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের মাধমে এসব আন্দোলনকে সফল করেছে। প্রকৃতপক্ষে দেশে রাজনৈতিক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ছাত্রলীগ এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে সকল ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত একমাত্র ছাত্রলীগ গ্রহণ করেছে।
৪.০৭. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারণসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, ভাষা আন্দোলনের কারণসমূহ চিহ্নিত কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি আলোচিত ঘটনা। এ আন্দোলনের পটভূমি সূচিত হয় দেশ বিভাগের পূর্বেই এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর এ আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র হতে থাকে। বস্তুত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর পূর্ববাংলার জনগণ নানাভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হয়।
নব গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে চলে গেলে তারা পূর্ববাংলার জনগণের ওপর নির্যাতনের প্রথম হাতিয়ার হিসেবে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারণ : নিম্নে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ : ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কারণ মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ। মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের পর থেকে দেশ পরিচালনায় অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক পন্থা অবলম্বন করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে— এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তানের উভয় অংশের ভাষার ব্যবহারের কথা বিবেচনা না করে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পূর্ববাংলার জনগণ মুসলিম লীগের এ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
২. বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষার প্রবর্তন : বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তানের উভয় অংশে উর্দু ভাষার প্রবর্তন ভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সর্বপ্রথম ভাষার পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্যাতন শুরু করে । পাকিস্তান সরকার ইসলামি রাষ্ট্রের পবিত্রতা রক্ষার্থে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
দেশ বিভাগের পরই পাকিস্তানের নিত্যব্যবহার্য খাম, ডাকটিকেট, রেলগাড়ির টিকিট প্রভৃতি ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখা শুরু হয়। এভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উর্দুকে গ্রহণ করে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করা হলে পূর্ববাংলার আপামর জনগণ ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৩. করাচি শিক্ষা সম্মেলন : করাচির শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। করাচি শিক্ষা সম্মেলন ছিল মূলত বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে নিবর্তনের উদ্দেশ্যে একটি ষড়যন্ত্রমূলক সম্মেলন। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত এ শিক্ষা সম্মেলনে প্রথমবারের মতো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এর মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষার ওপর প্রথম আঘাত আসে। ফলে করাচি শিক্ষা সম্মেলনের প্রতিবাদে পূর্ববাংলায় শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। এ বিক্ষোভে ছাত্রদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমনকি কর্মচারীরাও অংশগ্রহণ করে।
৪. বাংলা ভাষার সংস্কার : ১৯৪৭ সালের শেষ পর্যায়ে আবার হরফে বাংলা লেখার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসময় বয়স্ক ছাত্রদের বিনামূল্যে আরবি হরফে লেখা বই পড়ানো শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য প্রাদেশিক সরকার একটি ভাষা পরিষদ গঠন করে। দেড় বছর পর ভাষা পরিষদ বাংলা বর্ণমালা থেকে কয়েকটি বর্ণ বাতিলের সুপারিশ করে।
এ বর্ণগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো এগুলো সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃত যেহেতু হিন্দুদের ভাষা তাই ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে এসব ভাষা গ্রহণযোগ্য নয়। পরবর্তীতে বাংলা ভাষাকে রোমান হরফে লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এভাবে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বর্ণমালার বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাঙালি সংস্কৃতির মূলে আঘাত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
ফলে বাঙালি জাতি মাতৃভাষা বাংলার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত করার লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।
৫. তমদ্দুন মজলিস গঠন : পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ক্রমাগত আঘাত হানলে তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পূর্ববাংলার মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র ও শিক্ষকের সমন্বয়ে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস গঠন করা হয় সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা ও সভা-সমিতির আয়োজন করে একটি পুস্তিকা প্রণয়নের মাধ্যমে তমদ্দুন মজলিস শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়।
৬. ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব : ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের কার্যক্রমের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজি নির্ধারণ করা হয়। পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যতম সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এসময় উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করেন।
কিন্তু মুসলিম লীগ সদস্যগণ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলে পূর্ববাংলার ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলনের গতি তীব্র আকার ধারণ করে ।
৭. জিন্নাহর ঘোষণা : পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দান কালে বলেন, “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তার বক্তব্যের জবাবে ছাত্ররা না না ধ্বনি উচ্চারণ করে।
২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ছাত্রসমাজের এক সমাবেশে একই উক্তির পুনরাবৃত্তি করলে ছাত্ররা না না ধ্বনিতে কার্জন হল এলাকা প্রকম্পিত করে তোলে। শুরু হয় বিক্ষোভ জিন্নাহর ভাষণের প্রতিবাদে পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস(অধ্যায়৪)রচনামূলক-২ *
৮. সাংস্কৃতিক কারণ : ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভাষার ওপর আঘাত করে। মূলত বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। তাই বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণি শুরুতেই সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন । এসব প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৯. অর্থনৈতিক কারণ : বাংলা ভাষা আন্দোলনের পিছনে অর্থনৈতিক কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ববাংলার অধিকাংশ মানুষ ছিল একভাষী ।
তাদের অনেকে চাকরিরত এবং চাকরি প্রত্যাশী ছিল সমাজের বিকাশমান এ মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভাষাজনিত জটিলতার কারণে নিজেদের অবস্থান হারানোর আশঙ্কায় ছিল এ কারণে তাদের মধ্যে যে সচেতনতা জাগ্রত হয় তা ভাষা আন্দোলনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। পূর্ববাংলার এ মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভাষা আন্দোলনের সাথে শামিল হয়ে ভাষা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং পূর্ববাংলার শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ভাষা আন্দোলনের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত।
এ আন্দোলনের মাধ্যমে বীর বাঙালি দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, যার মাধ্যমে বিকাশ ঘটে জাতীয়তাবোধের। এ জাতীয়তাবাদী চেতনাই বাঙালিকে মুক্তি আন্দোলনের দিকে আহ্বান জানাতে থাকে। এ কারণে ভাষা আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ধাপ বলা হয়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।