স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয় : ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৮.০১. ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি আলোচনা কর ।
অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। এ নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে এ নির্বাচনের প্রভাব অসামান্য।
কেননা এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো নিজেদের সম্মিলিত শক্তি প্রদর্শন করার সক্ষমতা অর্জন করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, ঘটনা, আন্দোলন, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে সংঘটিত হয় এই সাধারণ নির্বাচন। সর্বোপরি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি : নিম্নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি আলোচনা করা হলো :
১. ১৯৫৬ সালের সংবিধানে গৃহীত প্রস্তাব ১৯৫৬ সালের সংবিধানে গৃহীত প্রস্তাবের মধ্যে নিহিত ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ব্যর্থ হলেও ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয়। সেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয় এবং পূর্ব ইউনিটে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার স্বীকৃত হয়। যদিও কেন্দ্রের হাতে তখনো ব্যাপক ক্ষমতা পুঞ্জীভূত ছিল।
ফলে জনগণের মধ্যে অবাধ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের অভিপ্রায় পরিলক্ষিত হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া সরকার সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
২. ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি : ১৯৫৮ সালে জারিকৃত সামরিক আইন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয় তা পুরোপুরি কার্যকর হতে না হতেই ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সামরিক শাসন জারি করেন।
সংবিধান ও সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন। আইয়ুব খানের শাসনামল ১৯৬০ ও ১৯৬২ সালে দুইবার বিরোধী দলবিহীন এবং ১৯৬৪ সালে সর্বদলীয় নির্বাচনের নামে প্রহসন চালানো হয়।
এতে করে জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয় এবং নেতা নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করা হয়। ফলে জনগণ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধাচারণ করে সাধারণ নির্বাচন ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি করতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
৩. ৬ দফা আন্দোলন : ৬ দফা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট তৈরি করে। পাকিস্তানে চলমান সামরিক শাসন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির, মৌলিক অধিকার ও পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ৬ দফা পেশ করেন।
জেনারেল আইয়ুব ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নবাদী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এবং ধ্বংসাত্মক বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করেন। এ কর্মসূচি সমগ্র বাঙালির চেতনাসূত্রে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং অবাধ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
৪. আইয়ুব খানের পতন : আইয়ুব খানের পতন ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র তৈরি করে। ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাভ করায় তা নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নেয়।
এরই প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামক মিথ্যা মামলা দায়ের করে এবং ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করতে থাকে। কিন্তু এর প্রতিবাদে পূর্ববাংলার জনগণ ১৯৬৯ সালে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মুখে জেনারেল আইয়ুব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং একই বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ।
ফলে আইয়ুব খানের পতনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বীজ জাগ্রত হতে থাকে।
৫. ইয়াহিয়া খানের প্রতিশ্রুতি : ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন।
একই বছর ১৯৬৯ সালের ২৮ জুলাই তিনি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেন এবং এক মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি এক ভাষণে দেশে পুনরায় সর্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন।
যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষিত হয়।
৬. আইনগত কাঠামো আদেশ জারি : ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া খান রাওয়ালপিন্ডিতে নির্বাচন সংক্রান্ত আইনগত কাঠামো আদেশ ঘোষণা করেন। উক্ত আদেশে নির্বাচন ও জাতীয় পরিষদ গঠন এবং এর কার্যাবলি কেমন হবে তা ঘোষণা করা হয়।
এ আদেশের ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি রচিত হয়। এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি অনুসারে প্রত্যেক প্রদেশকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব প্রদান করা হয় এ আদেশে। এছাড়া প্রত্যক্ষ ভোটে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হবেন বলা হয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
সাধারণ নির্বাচন হবে নির্বাচনি এলাকায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে। তবে নারী আসনে প্রত্যেক প্রদেশের নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরা সদস্য নির্বাচন করবেন। এভাবে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি রচনার পথকে আরও প্রশস্ত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন আইনগত কাঠামো আদেশ জারির মাধ্যমে।
৭. বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নির্বাচনি প্রচারণা জমে উঠতে না উঠতে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ববাংলায় জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয়। এতে এ অঞ্চলের মানুষ ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
মওলানা ভাসানীসহ কতিপয় নেতা নির্বাচন পিছানোর দাবি তুললেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অটল ছিলেন । যার ফলে পূর্ববাংলায় ৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আর বন্যাকবলিত ৯টি আসনে ১৭ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়তা না দেখালে হয়তো এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিত ।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার বীজ পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে নিহিত ছিল ।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ এর ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং আইয়ুব খানের পতন, ইয়াহিয়া খানের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ ও নির্বাচন ঘোষণা প্রভৃতি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি রচিত হয়।
যা আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে ইয়াহিয়া খানের আইনগত কাঠামো আদেশ জারির মধ্য দিয়ে।
৮.০২. ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণগুলো চিহ্নিত কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন ছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের ৭ তারিখ পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ২৯১ টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের ২৭৯টি আসনে, ১৭ জানুয়ারিতে উপকূলীয় এলাকায় ৯টি জাতীয় পরিষদের ও ২১টি প্রাদেশিক পরিষদের আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে।
আওয়ামী লীগের এ বিপুল বিজয়ের পিছনে নানা কারণ বিদ্যমান ছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণগুলো : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকে পূর্ববাংলার মানুষের ওপর যে জুলুম, নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চনা করেছিল, নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে পূর্ববাংলার মানুষ এর জবাব দেয়।
২. ৬ দফাভিত্তিক নির্বাচনি ইশতাহার ঘোষণা : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহার ছিল ৬ দফাভিত্তিক যা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে এ অঞ্চলের আপামর জনতার প্রাণের দাবি প্রতিফলিত হওয়ায় তারা এর দ্বারা ।
বিপুলভাবে আকৃষ্ট হয় এবং আওয়ামী লীগের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন ব্যক্ত করে ব্যালটের মাধ্যমে।
৩. ৬ দফা দাবি : ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ তথা ৬ । দফা দাবি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই উত্থাপিত হয়েছিল। দাবি উত্থাপনের পর বাঙালি অধিকার সচেতন হয়ে বাঙালির এ অধিকার সচেতনতা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মূহের মধ্যে মাধ্যমে আরও বেশি পরিপক্বতা লাভ করে।
যার ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে।
৪. বিলম্বিত নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৮. বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল পাকিস্তানের বিলম্বিত নির্বাচন। ১৯৪৭ সালের প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে দীর্ঘ ২৩ বছরে কোনো সাধারণ নির্বাচন না হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এমনিতেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলে যায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
ফলশ্রুতিতে দেশের প্রথম নির্বাচন হিসেবে পূর্ববাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে উৎসবের আমেজ নিয়ে এ নির্বাচনে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে ।
৫. বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পিছনে দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী নেতৃত্ব, অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গুণাবলি এবং ক্ষুরধার প্রাঞ্জল বক্তৃতা মানুষকে সহজেই তার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল ।
ফলে জনতা তার দল আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে প্রকারান্তরে তার প্রতিই সমর্থন জানায়।
৬. পাক-ভারত যুদ্ধ : পাক-ভারত যুদ্ধ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
এ যুদ্ধের পর পূর্ববাংলার জনগণ বুঝতে পারে যে, পশ্চিমারা কখনোই বাঙালির জানমালের নিরাপত্তার চিন্তা করে না। তাদের এ চিন্তাচেতনাও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ।
৭. অন্যান্য দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা : অন্যান্য দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা আওয়ামী লীগের বিজয়ে অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর যেসব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সাংগঠনিক দিক দিয়ে তার কোনোটিই আওয়ামী লীগের মতো এতটা শক্তিশালী ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে খুব সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
৮. ইসলামি আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন : বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি প্রচারণায় ইসলামি আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে ।
৯. আগরতলা মামলা : আগরতলা মামলা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের অন্যতম কারণ। তৎকালীন পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবসহ আরও ৩৪ জনকে মিথ্যা আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করে।
পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবসহ অন্যান্য সকল নেতাকে এ মামলা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে ।
১০. গণঅভ্যুত্থান : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে গণঅভ্যুত্থান, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালে লৌহ মানব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে যে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সেটি গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত ।
মূলত এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বাঙালি পাকিস্তানকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। বাঙালির এই মানসিক চেতনা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে বাস্তব রূপ লাভ করে। যার ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের জুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালি সর্বদাই সংগ্রাম করেছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষতি হয়।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার তৎরতা এবং ত্রাণ কাজে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে সমগ্র বাংলার মানুষের পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ঘৃণার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে।
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-অতিসংক্ষিপ্ত)
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-২
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
৮.০৩. ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব/ তাৎপর্য
অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক মাইলফলক। কেননা এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো নিজেদের সম্মিলিত শক্তি প্রদর্শন করার সক্ষমতা লাভ করে।
যার ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কেননা ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের ইতিহাসে একমাত্র সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।
ভূমিকা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক মাইলফলক। কেননা এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো নিজেদের জেই সম্মিলিত শক্তি প্রদর্শন করার সক্ষমতা লাভ করে।
যার ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । কেননা ১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের ইতিহাসে একমাত্র সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব/তাৎপর্য : নিম্নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব/ তাৎপর্য আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে জাতীয়তাবাদের বিজয় মিথ্যা সূচিত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
২. বাঙালির রাজনৈতিক ঐক্য : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী ক এ লীগের বিপুল বিজয়ের ফলে বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য দশের ও সংহতি দৃঢ়তর হয় এবং তারা নতুন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে ।
৩. ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির চেতনা : ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটায়। বাঙালি জাতি মুক্তির চেতনায় এমনভাবে জাগ্রত হয় যে, তা চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।
৪. রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সৃষ্টি হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। আর এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন।
৫. সংগ্রামী মনোভাব জাগ্রত : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় বাঙালিদের মধ্যে সংগ্রামী মনোভাব জাগ্রত করে। আর এ সংগ্রামী মনোভাবের দ্বারাই সাধারণ জনতা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস অর্জন করে।
৬. পাকিস্তান বিভক্তির বার্তাবাহক ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তান বিভক্তির বার্তাবাহক। কেননা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসন লাভ করেনি। তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপিপিও পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসন লাভে সক্ষম হয়নি ।
এতে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানের এক অংশের জনগণ অপর অংশের জনগণকে সমর্থন করে না। যা পাকিস্তান বিভক্তকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
৭. জাতীয় অনৈক্যের প্রকাশ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে, ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে পাকিস্তানের কোনো ভিত্তি নেই । এ নির্বাচনে অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উত্থান হয়। এতে জাতীয় অনৈক্য প্রকট হয়।
৮. ৬ দফা দাবির বৈধতা : ১৯৬৬ সালে প্রণীত ৬ দফাকে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতাহার হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণ ব্যাপকভাবে ভোটদানের মাধ্যমে ৬ দফাকে স্বাগত জানায়। ফলে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা এ নির্বাচনের ফলাফলে প্রমাণিত হয়।
৯. পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব খর্ব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত করলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে থাকে। তাই অসহযোগ আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নির্দেশে পূর্ববাংলা পরিচালিত হতে থাকে ।
১০. প্রথম সাধারণ নির্বাচন : বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বশাসন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবি আদায় করার সুযোগ পেয়েছিল।
১১. শাসনতন্ত্র প্রণয়ন : একটি দেশ পরিচালনার জন্য শাসনতন্ত্র বা সংবিধান প্রয়োজন । ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হন।
১২. আত্মশক্তি বৃদ্ধি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ নিশ্চিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
এ নির্বাচনের ফলাফল ছিল পাকিস্তান বিভক্তির বার্তাবাহক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্মলাভের পিছনে এ নির্বাচন এর ফলাফল এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা মুখ্য ভূমিকা রেখেছে । পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম ও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ।
৮.০৪. স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচন কী প্রভাব রেখেছিল? [জা.বি. ২০১৫, ‘১৮] অথবা, স্বাধীনতা অর্জনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর ।
উত্তর ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি যে স্বাধীনতা অর্জন করে তার প্রথম সূত্রপাত ঘটে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ।
এ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির পরাজয় এবং আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মূলত ১৯৭০ সালের নির্বাচন আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে সহজতর করে দেয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রভাব : নিম্নে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ‘৭০ এর নির্বাচনের প্রভাব আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালির জাগরণ সৃষ্টি : বাঙালিদের জাগরণের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল মূল চালিকাশক্তি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বাঙালিদের ক্ষেত্রে।
বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের বিপুল বিজয়ে উদ্দীপনা ও উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায় এবং তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা লাভ করে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
২. দুঃশাসনের অবসান : ১৯৭০ সালের নির্বাচন দীর্ঘদিনের দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকৃতপক্ষে, আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় পাকিস্তানে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসন ও অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতি মুক্তি লাভ করে ।
৩. স্বায়ত্তশাসনের দাবি অর্জন : পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচনই সর্বপ্রথম স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালিরা স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি করে আসছিল তা অর্জনে সক্ষম হয় ।
৪. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ নিঃশব্দ ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধিকারের সপক্ষে রায় দেয় । তাদের দাবির মূল লক্ষ্য ছিল দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।
৫. ৬ দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে ৬ দফা কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা। আর বাংলার আপামর জনসাধারণ এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পক্ষে রায় দেয়। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত হয় ।
৬. শাসনতন্ত্র প্রণয়ন : আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচির ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সিদ্ধান্তের কার্যকর রূপ প্রতিফলিত হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ।
সে সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়ন করা।
৭. বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব : ৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব জোরালো ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে শেখ মুজিব জনগণের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, “আমাদের জনগণ এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে।”
আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল পূর্ববাংলার মানুষের বিজয়। এ বিজয়ের ফলে শেখ মুজিব জাতির কান্ডারি হিসেবে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করেন এবং বাঙালি জনগণ তার সাহসী নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে থাকে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
৮. রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন বাঙালিদের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। স্বাধিকারের দাবিতে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ওঠে। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এ রাজনৈতিক ঐক্য প্রেরণার ও শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
আর এ রাজনৈতিক ঐক্য থেকেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আগমনী বার্তা ধ্বনিত হয়।
৯. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় : ১৯৭০ সালের এ নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার বিজয় সূচিত হয়। ফলে তারা পাক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং সর্বশক্তি নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে ।
১০. পাকিস্তানের শেষ পরিণতি : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির পরাজয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন নিশ্চিত করে। এ নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে।
শেখ মুজিব আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলেও ইয়াহিয়া খান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শেষ পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১১. মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণাশক্তি : ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মূল প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে পূর্ববাংলার আপামর জনগণের মাঝে। এ নির্বাচনে জয়ের ফলে তারা স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৮ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
১২. বাংলাদেশের অভ্যুদয় : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয় লাভের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং আপামর জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জনগণের জাতীয়তাবোধ চেতনার পক্ষে রায় প্রতিফলিত হয় । ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।
আর এ কারণেই বলা হয় ‘বাংলাদেশের জন্ম হতো না যদি ‘৭০ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হতো।’ ‘৭০ -এর নির্বাচন বাংলার জনগণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের মূল একথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।