স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত) প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয় : জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধিকার আন্দোলন
বিষয় কোড: ২১১৫০১
খ-বিভাগঃ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর
০১. জাতীয়তাবাদ বলতে কী বুঝ?
অথবা, জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা : আধুনিককালে জাতীয়তাবাদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আদর্শ । জাতীয়তার চেতনায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে একত্রে বসবাস করে। তারা যদি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ছায়ায় আসে তখন তাদের বলা হয় জাতি।
বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই প্রায় জাতি রাষ্ট্র। এগুলো ধর্মীয়, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত চেতনার দ্বারা সৃষ্টি। তবে সভ্যতা ও ভাষার মিল জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান ।
জাতীয়তাবাদ : জাতীয়তাবাদ হলো এমন ঐক্যবোধ যা মানুষকে এক সুতোর বন্ধনে আবদ্ধ করে। কিছু মানুষের মধ্যে যখন বিভিন্ন দিক থেকে মিল থাকে, যা তাদেরকে অন্যদের চেয়ে পৃথক মনে করায় এবং একত্রিত হয়ে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়, তখন সেই মিলের দ্বারা গঠিত চেতনাকে জাতীয়তাবাদ বলে ।
তারা নিজেদেরকে একটি জাতি হিসেবে দেখতে চায়। সাধারণত কোনো জনসমষ্টির নিজের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন গড়ে তোলার মানসিকতাকে জাতীয়তাবাদ বলে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
অধ্যাপক প্যাডেলফোর্ড ও লিংকন (Padelford and Lincoln) এর মতে, “জাতীয়তাবাদ দুটি উপাদানের সংমিশ্রণ বিশেষ । এর একটি উপাদান হচ্ছে জাতীয়তার ধারণা সম্পর্কিত কোনো আদর্শবাদ এবং অপরটি হচ্ছে জাতীয় রাষ্ট্রের ভিতর ঐ আদর্শবাদকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপদান।”
আবার অধ্যাপক লয়েড (Lloyd) বলেন, “জাতীয়তাবাদকে একটি ধর্ম বলে অভিহিত করা যায়, কারণ এর উৎস মানুষের গূঢ়তম প্রবৃত্তির মধ্যে নিহিত আছে।”
অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ মূলত প্রত্যেক জাতি গোষ্ঠীর নিজ বাসভূমি; নিজেদের সাদৃশ্য অন্যের সাথে নিজেদের বৈসাদৃশ্য, বংশগত বন্ধন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।”
আরনল্ড জে. টয়নবি (Arnold J. Toynbee) এর মতে, “জাতীয়তাবাদ কোনোরূপ বস্তুগত বা যান্ত্রিক অনুভূতি নয়; বরং এক প্রকার আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি।”
বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ হলো একটি সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি, যা পরস্পরকে ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়।”
অধ্যাপক স্নাইডার (Snyder) জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইতিহাসের কোনো অধ্যায়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিগত উপাদানের ফল । এটি একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী জনগণের একটি মানসিকতা, অনুভূতি ও আবেগ।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ গঠনে যে উপাদানগুলো কাজ করে, তার সবগুলোই জাতি গঠনে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। তবে আমাদের অবশ্যই উগ্র জাতীয়তাবাদী হওয়া উচিত নয়। এতে বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টি হয়। আমাদের আদর্শ জাতীয়তাবাদ অনুসরণ করা দরকার।
০২. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ধারা আলোচনা কর ।
অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ বর্ণনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ জারি করেন। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে।
দ্বিতীয় অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয় এ সংবিধান প্রণয়ন কমিটি যে চারটি মূলনীতি প্রণয়ন করেন জাতীয়তাবাদ তার মধ্যে অন্যতম।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ধারা : নিম্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের ধারাগুলো বর্ণনা করা হলো :
১. ভাষা আন্দোলন : পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন লোকের মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে শতকরা ৮ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার হীনচক্রান্তকে রুখতে গিয়ে বাঙালি যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে তাতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।
যার চূড়ান্ত পরিণতি প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আন্দোলনের মাধ্যমে।
২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন : ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং মুসলিম লীগের পরাজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবোধ আরও জোরদার হয়। এ নির্বাচনে কেন্দ্রের বিমাতাসুলভ শাসনের প্রতি বাঙালিদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
আর যুক্তফ্রন্টের জয়লাভের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ক্রমশ বিকশিত হয় ।
৩. ১৯৬৬ সালের ৬ দফা : স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা কর্মসূচির ঘোষণা করেন। সারা বাংলায় ব্যাপক গণসংযোগের মাধ্যমে তিনি বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন।
ঐ ঐক্যবদ্ধতার ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আরও সুদৃঢ় হয় এবং দৃঢ়ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ পরবর্তীকালে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।
৪. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বিশেষভাবে স্মরণীয়। পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনসহ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকদের দাবি সংবলিত এগারো দফার পরিচালিত ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান বাঙালির জাতীয় চেতনাকে আরও সংগ্রামী রূপ দান করে।
৫. ১৯৭০ সালের নির্বাচন : পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালেই প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়লাভ করে। নির্বাচনের ফলাফল একথাই প্রমাণ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরও সুদৃঢ় করে।
৬. স্বাধীনতা যুদ্ধ : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি । সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় । গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালিরা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে । স্বীরদর্পে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। জয় হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যখন কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের জনগণ নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন গড়ে তোলার মানসিক অনুভূতি ও ভাবাবেগকে একত্রিত করে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় তখন তাকে জাতীয়তাবাদ বলা হয় । জাতীয়তাবাদ যেকোনো জাতির জন্য একটি মৌলিক বিষয়। জাতীয়তাবাদ প্রবল হলেই একটি জাতির জন্ম হয় ।
০৩. ৬ দফা কী?
অথবা, ৬ দফা আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ।
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান নানাভাবেই বৈষম্যের শিকার হয়। লাহোর প্রস্তাবানুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেক্ষিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান নির্ভর কেন্দ্রীয় শাসন জগদ্দল পাথরের মতো পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চেপে বসে।
এ প্রেক্ষিতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
৬ দফা : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ ও নির্যাতন।
পূর্ব পাকিস্তান ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জন্য কাঁচামালের যোগানদাতা একটি কলোনি বা উপনিবেশে পরিণত হয়। হাতেগোনা যে কয়টি শিল্পকারখানা পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অধিকাংশের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিগণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
এসব শিল্পকারখানা থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ তারা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করতো। ফলে খুব দ্রুত পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে এবং বাঙালি জনগণের মনে হতাশা ঘনীভূত হয়।
এসবের পাশাপাশি সামরিক দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় অবস্থা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করেন।
এরপর তিনি তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেন । এ কর্মসূচিকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানিদের বাঁচার দাবি বলে অভিহিত করেন। ফলে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ৬ দফা কর্মসূচি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ৬ দফা ছিল বাঙালির জন্য ম্যাগনাকার্টা, বাঙালির অস্তিত্বের সনদস্বরূপ। ৬ দফা ছাড়া জাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্য কোনোরূপ বিকল্প ছিল না বাঙালিদের । বাঙালি জাতির দুঃখ আর স্বপ্নকে ৬ দফা আক্ষরিক ও বাস্তবিক রূপ দিয়েছে। তাই রাজনৈতিক ইতিহাসে ৬ দফার গুরুত্ব অপরিসীম।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
০৪. ১৯৬৬ সালের ৬ দফার ধারাগুলো আলোচনা কর।
অথবা, ৬ দফা কর্মসূচি কী ছিল?
উত্তরঃ ভূমিকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির ভূমিকা অসাধারণ। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করে। ৬ দফা ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক
১৯৬৬ সালের ৬ দফার ধারা : নিম্নে ১৯৬৬ সালের ৬ দফার ধারাগুলো আলোচনা করা হলো :
প্রথম দফা—সাংবিধানিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নপূর্বক পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে- সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হবে সংসদীয় প্রকৃতির এবং সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাগুলোর সার্বভৌমত্ব থাকবে।
দ্বিতীয় দফা—ক্ষমতা বণ্টন : ফেডারেল (কেন্দ্রীয়) সরকারের হাতে কেবল দুটি বিষয়ের ক্ষমতা থাকবে। যথা— দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত, অবশিষ্ট বিষয়ের ক্ষমতা পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকবে ।
তৃতীয় দফা—মুদ্রা ব্যবস্থা : মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করে যেকোনো একটিকে গ্রহণের দাবি করা হয়। বলা হয় (ক) পাকিস্তানের দুঅঞ্চলের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
দুঅঞ্চলের দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। অথবা, (খ) দুঅঞ্চলের জন্য অভিন্ন মুদ্রা থাকবে তবে সংবিধানে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান হতে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে।
পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুঅঞ্চলের জন্য দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
চতুর্থ দফা-রাজস্ব কর ও শুল্কসংক্রান্ত ক্ষমতা সকল প্রকার কর, খাজনা ধার্য এবং আদায় করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।
পঞ্চম দফা—বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমতা : এ দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নোক্ত সাংবিধানিক বিধানের সুপারিশ করা হয়—
ক. দুঅঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব থাকবে।
খ. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে।
গ. ফেডারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমানভাবে অথবা সংবিধানে নির্ধারিত হারে আদায় হবে
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
ঘ. দেশজ দ্রব্যদি বিনা শুল্কে দুঅঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করা চলবে। ঙ. ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে।
ষষ্ঠ দফা—আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন : এ দফায় উল্লেখ করা হয় যে, অঙ্গরাজ্যগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কার্যকরী অংশগ্রহণের সুযোগ দান এবং আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কৰ্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে ।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ৬ দফা ছিল মূলত বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবি। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বাঁচার দাবি। এ ৬ দফার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
০৫. ৬ দফা কর্মসূচির প্রথম দফাটি কী ছিল? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ৬ দফা কর্মসূচির প্রথম দফাটি সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির ভূমিকা অসাধারণ। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করে ।
৬ দফা ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ৬ দফাতে পাকিস্তানকে ভাঙতে চাওয়া হয়নি, চাওয়া হয়েছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ।
৬ দফা কর্মসূচির প্রথম দফা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবির প্রথম দফাটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি : পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির। এর ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব । উভয় অঞ্চলকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আইনসভা হবে সার্বভৌম প্রকৃতির ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ৬ দফা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার আদায়ের দাবি। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বাঁচার দাবি থাকা সত্ত্বেও এ দফাটি অন্যতম গুরুত্বের দাবিদার।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
০৬. ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচির লক্ষ্য কী ছিল?
অথবা, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচির লক্ষ্যসমূহ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে যেসব আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে ৬ দফা অন্যতম প্রধান। একটি শোষণহীন জুলুম ও নিপীড়নমুক্ত জাতি গঠন করা ছিল ৬ দফা কর্মসূচির প্রধানতম লক্ষ্য ।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচির লক্ষ্য : নিম্নে ৬ দফা কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলো :
১. জুলুম, শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিনির্মাণ,
২. রাষ্ট্রে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা,
৩. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে সামরিক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন,
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
৪. পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা,
৫. ব্যবসা বাণিজ্য এবং বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংকল্প,
৬. পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জন নিশ্চিত করা, ৭. মুদ্রা পাচার রোধ করা ও ৮. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের দাবির সমন্বয় করা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি জাতির প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মূলমন্ত্র হিসেবে ৬ দফাকে সে অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সাজানো হয়েছিল তা পরবর্তীকালের সকল আন্দোলনকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল ।
৬ দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং এরই মাধ্যমে বাংলাদেশ এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে।
০৭. ৬ দফা আন্দোলনের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, ৬ দফা আন্দোলনের গুরুত্ব/তাৎপর্য বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : বাঙালি জাতির ইতিহাসে ৬ দফা দাবি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ৬ দফাকে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলা হয়ে থাকে। ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এটি ছিল তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি যৌক্তিক দাবি।
স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত ৬ দফা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় । বাঙালি জাতি ৬ দফা আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে। ৬ দফার মধ্যেই বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের দাবি নিহিত ছিল ।
৬ দফা আন্দোলনের গুরুত্ব : নিম্নে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি পরবর্তীতে ৬ দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. স্বাধিকার আন্দোলন : ৬ দফা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন। এ আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করেই জনগণ স্বাধিকার আন্দোলনে যাওয়ার প্রেরণা পায়।
২. জনগণের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বাংলার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৬ দফার সপক্ষে মিছিল, সভা শোভাযাত্রা করে। ইতিপূর্বে এদেশের কোনো আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এত লোক অংশগ্রহণ এবং এত প্রাণহানি ঘটেনি ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুসংহতকরণ : ৬ দফা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দৃঢ় হয় এবং ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্য আরও বেগবান হয়। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে ৬ দফা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
৪. বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নির্যাতন ও অবিচারের বিরুদ্ধে ৬ দফা ছিল বাঙালির মুক্তিসনদস্বরূপ।
বঙ্গবন্ধু বলেন যে, “৬ দফা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা গোটা বাঙালির মুক্তিসনদ এবং বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত পদক্ষেপ।” অতএব বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে এর গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
৫. উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণা : ৬ দফা কর্মসূচি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাঙালি স্বাধিকার আন্দোলনের এ কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করেই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে।
উনসত্তরের গণআন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৬. স্বৈরশাসকের পতন : ৬ দফা ছিল আপামর জনসাধারণের ন্যায্য দাবি। স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এ কর্মসূচি নিরাশার আঁধারে নিক্ষিপ্ত বাঙালি জাতিকে জুগিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ম্যাগনাকার্টা যেমন উজ্জ্বল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা । আন্দোলনের ইতিহাসে ৬ দফা তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ।
৬ দফাভিত্তিক আন্দোলনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল ।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
০৮. “৬ দফার মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল ।” ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ৬ দফায় কি বাঙালির স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল?
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে পূর্ববাংলার মানুষের ওপর শোষণ, অবিচার ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল ।
এরই ফলশ্রুতিতে বাঙালিরা এ অবিচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন ও দাবি পেশ করেছে। এগুলোর মধ্যে ৬ দফা ছিল অন্যতম যা পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
“৬ দফা আন্দোলনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।” – ব্যাখ্যা :
৬ দফা ঘোষণার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে গবেষকগণ একমত হয়েছেন যে, যদিও এটি স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল, তবু এটি পরবর্তীতে জাতিকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করতে সক্ষম হয়।
কেননা ৬ দফা দমন করার জন্য পাকিস্তান সরকার প্রচণ্ড দমননীতি গ্রহণ করলে জনগণের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুভূতি প্রবল আকার ধারণ করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
আগরতলা মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়ার চক্রান্ত করলে তাকে মুক্তির জন্য যে আন্দোলন শুরু হয় তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্ররা এগারো দফা দাবি উত্থাপন করে। অতঃপর ৬ দফা ও এগারো দফার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন দেশে ঘটায়।
স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের পতন ঘটে। নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান জনতার দাবির মুখে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেন এবং নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফাকে তাদের নির্বাচনি ইশতাহার হিসেবে প্রচারণা চালায়। নির্বাচনে জয় লাভ করার জন্য আওয়ামী লীগ যখন ৬ দফার আলোকে সংবিধান প্রণয়নের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সুতরাং এটি সহজেই বুঝা যাচ্ছে যে, ৬ দফা অস্ত্রের মাধ্যমে মোকাবিলা করার পাকিস্তানি পদক্ষেপের ফলেই বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরে এসে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যাকে পরোক্ষভাবে স্বাধিকারের দাবি বললেও অত্যুক্তি হবে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ৬ দফা দাবির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি। তারপরও ৬ দফার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল।
কারণ ৬ দফা আন্দোলনের সফলতা স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল ।
০৯. ৬ দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বা ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলা হয় কেন?
অথবা, ছয় দফা কর্মসূচিকে কেন বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলা হয়?
উত্তরঃ ভূমিকা : ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘ম্যাগনাকার্টা’ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাসে ৬ দফা তেমনি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।
‘ম্যাগনাকার্টা’কে যেমন ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের বাইবেল বলা হয় তেমনি ৬ দফা কর্মসূচিকেও বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ৬ দফাকে “আমাদের বাঁচার দাবি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ।
৬ দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলার কারণ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ৬ দফা কর্মসূচি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে । নিম্নে ৬ দফা কর্মসূচিকে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির সনদ বলার কারণসমূহ বর্ণনা করা হলো :
১. বাঙালির মুক্তির সনদ : পাকিস্তানি শাসকচক্রের অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৬ দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ৬ দফা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা গোটা বাঙালির মুক্তির সনদ এবং বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত পদক্ষেপ। সুতরাং বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
২. বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ়ীকরণ : ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়। ৬ দফার ওপর ভর করেই বাঙালি জাতি ৬৬-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ।
৩. স্বাধিকার আন্দোলন : ৬ দফা বাঙালি জাতিকে তাদের স্বাধিকার আদায়ে প্রেরণা জুগিয়েছে। যেসব লক্ষ্য ও শর্তকে সামনে রেখে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তার একটিও বাস্তবায়িত না হওয়ায় ৬ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
৪. সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচিকে তাদের নির্বাচনি ম্যানিফেস্টো হিসেবে দাঁড় করায়। আর এ দফার ভিত্তিতেই গণরায় লাভ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
৫. স্বাধীনতা আন্দোলন : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে মূলত প্রেরণা দিয়েছে ৬ দফা কর্মসূচি। ৬ দফার ওপর ভিত্তি করে পূর্বের সব আন্দোলন সফল হওয়ার পর বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হয়।
ফলে তারা পাকিস্তানিদের সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার, শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিজেদেরকে পাকিস্তানি কুচক্রীদের হাত থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ৬ দফা দাবি ছিল পূর্ববাংলার জনগণের মুক্তির সনদ। যাকে ম্যাগনাকার্টার সাথে তুলনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা কর্মসূচিকে বাঙালিদের বাঁচার দাবি বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা দাবি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ এবং বাঙালিদের প্রাণের দাবি।
৬.১০ আগরতলা মামলা কী? অথবা, আগরতলা মামলা বলতে কী বুঝ?
উত্তর ভূমিকা : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হলো আগরতলা মামলা। আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে নির্মূল এবং বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই নস্যাৎ করতে পাকিস্তানি শাসকচক্র এ ষড়যন্ত্রমূলক মামলার আশ্রয় গ্রহণ করে।
৬ দফা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। এরই প্রেক্ষাপটে আগরতলা মামলা দায়ের করার নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়।
আগরতলা মামলা : ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি যখন ব্যাপক আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আন্দোলনকে দমন করার এক ঘৃণ্য পন্থা আবিষ্কার করেন।
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা ১৯৬৭ সালে ডিসেম্বর মাসে ভারতের আগরতলায় এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং ভারতীয়দের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা করেন।
অভ্যুত্থান সফল করার লক্ষ্যে তারা ভারতীয়দের নিকট থেকে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে এ মর্মে অর্থ ও অস্ত্রের ওপর একটি তালিকাও প্রকাশ করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
কয়েকদিনের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেফতারকৃত আসামিরা নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন এবং এ ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে।
আসামিদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান জনগণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভিযোগ এনে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে পূর্বের ২৮ জনসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।
যা আগরতলা মামলা নামে খ্যাত। মামলাটির সরকারি নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য’ । ৩৫ জন ছাড়াও আরও ১১ জনকে আসামি করা হয় কিন্তু তারা রাজসাক্ষী হতে চাইলে সরকার তাদের মুক্তি দেন ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
উপর্যুক্ত আসামিদের প্রথমে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । তারপর ১৮ জানুয়ারি দেশরক্ষা আইন হতে মুক্তি দিয়ে ‘আর্মি নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে’ পুনরায় গ্রেপ্তার করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, আগরতলা মামলা ছিল একটি প্রহসনমূলক মামলা । কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আইয়ুব সরকার এ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিল তা স্পষ্ট।
কিন্তু বাঙালির প্রচণ্ড আন্দোলনের সামনে তা খড়কুটার মতো উড়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে আইয়ুব সরকার এ মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে এবং ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় ।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।