লালসালু | সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ | বিস্তারিত আলোচনা ২ | PDF: বাংলা প্রথম পত্রের লালসালু উপন্যাসটি হতে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্যবাংলা প্রথম পত্রের লালসালু উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
লালসালু’ উপন্যাসে প্রতিফলিত সমাজচিত্র
‘লালসালু’ উপন্যাসটি যদিও বিশ শতকের প্রথমার্ধে রচনা, তবু সামগ্রিক বিবেচনায় এই উপন্যাসটি সব কালেই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার প্রধান কারণ এই যে, এ উপন্যাসে কাল খুব একটা স্পষ্ট রেখায় অঙ্কিত হয়নি, যতটা স্পষ্ট করে অঙ্কিত হয়েছে সমাজ ও জীবনের রূপায়ণ।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে গ্রামীণ বাংলার সমাজ ও জীবনের যে-চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচন করেছেন, তা আমাদের অনেক চেনা; বলা যায়, আবহমান কাল ধরে চেনা, এবং এই চেনা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাংলার সমাজ ও জীবন যে গত পাঁচ শ বছরে খুব একটা বদলেছে এমন নয়গ্রামীণ পটভূমিতে তো নয়ই।
তাই, এ কথা আমরা দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি, ‘লালসালু’ উপন্যাসে ছায়াপাতে আবহমান কালের গ্রামীণ বাংলার জনজীবন ও সমাজের রূপায়ণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যথেষ্ট সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এমন একটি সমাজের চিত্র অঙ্কন করেছেন, যেটি স্মরণাতীত কাল থেকে কুসংস্কারের জটাজালে আচ্ছন্ন। লালসালু কাপড় দিয়ে মাজার ঢেকে রেখে যেমন ধর্মব্যবসায়ীরা যুগের পর যুগ ধর্মপ্রাণ অশিক্ষিত মানুষদের ধোঁকা দিয়ে আসছে এবং কুসংস্কারের ভারী চাদরে মোড়ানো গ্রামীণ বাংলাদেশের সমাজের পরতে পরতে অন্ধত্ব ও প্রথাবদ্ধতা কী রকম অশুভ ছায়া বিস্তার করেছিল, সেটাই মূলত ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর এ মহান উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
লেখকের মূল অবলম্বন হচ্ছে কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। ধর্মব্যবসায়ের সে-ই হোতা। তাকে আপাতভাবে সহায় সম্বলহীন হিসেবে অঙ্কন করলেও সে অত্যন্ত ধুরন্ধর, শঠ ও নিপীড়ক। এ উপন্যাসের সমাজচিত্র অঙ্কনে লেখক মজিদ চরিত্রের মনোজাগতিক অনুভব ও তার চিন্তারাশিকেই মূল সহায় হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
অন্যভাবে আমরা বলতে পারি, মজিদই এ উপন্যাসে লেখকের প্রতিনিধি চরিত্রপ্রতিনিধি এই অর্থে, লেখক মজিদের চোখেই মহব্বতনগর ও আওয়ালপুরের গ্রামের জনজীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন, অনুভব করেছেন সে কালের মানুষের হৃদস্পন্দন আপন হৃদয়ে।
মজিদ নিঃসন্দেহে একটি নেতিবাচক চরিত্র; তবু সে ‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সমাজ ও জীবনের অভিজ্ঞতার ফসলঅপপুত্র হলেও মজিদ ওয়ালীউল্লাহ্র মানস সন্তান।
‘লালসালু’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথম উপন্যাস। আমরা জানি, তিনি আজন্ম শহরে থেকেছেন, অভিজাত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। নাগরিক রুচি ও মননের অধিকারী হলেও তিনি শহরকেন্দ্রিক কোনো উপন্যাস লেখেননি।
মাত্র তিনটি উপন্যাস তিনি রচনা করেছেন। তিনটির পটভূমিই গ্রামে সংস্থাপিত। এর কারণ হিসেবে সমালোচকগণ জানিয়েছেন, গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতির মর্মমূলে যুগ যুগ ধরে যে কুংসংস্কার গ্রোথিত আছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মূলত সেই কুসংস্কারের শিকড় উপড়ে ফেলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন।
শওকত আলী বলেছেন:
“তাঁর উপন্যাসের পটভূমি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং তার সমাজ-চরিত্র, একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু শোষিত দরিদ্র গ্রামবাসী; অন্যদিকে শঠ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক ভূস্বামী। তাঁর উপন্যাসের বিষয় যুগ যুগ ব্যাপী শিকড়-গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাক্সক্ষার দ্ব›দ্ব।”
‘লালসালু’তে আমরা গ্রামীণ বাংলাদেশকে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি। নাগরিক বিদগ্ধ লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এক মুহূর্তে আমাদের ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যান, যে জগৎ তাঁর বাস্তব পরিচিত ছিল কিনা জানি না, কিন্তু আমাদের অপরিচিত নয়। এমন এক গ্রাম মহব্বতনগর। সবাই সেখানে সব কাজের মধ্যে দৈব শক্তির লীলা দেখতে পায়।
এ দৈব শক্তি আবার এমন দৈব শক্তি যা কিনা আবার মাজারের ভেতরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন একজন মোদাচ্ছের পীর। পীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে শেষ করবার মতো নয়। পীরের মাজারের যিনি খাদেম, তিনিও কম যান না। তাকেও কেবল দণ্ডমুণ্ডের কর্তাই কেবল ভাবা হয়নি, প্রাণসংহারক এমনকি প্রাণদাতাও কল্পনা করা হয়েছে।
রহিমার মাধ্যমে হাসুনির মা যখন আর্জি পেশ করে, “ওনারে কইবেন, আমার যেন মওত হয়” অথবা খ্যাংটা বুড়ী মাজারে এসে তার সর্বস্ব আনা পাঁচেক পয়সা মজিদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আর্তনাদ করে বলে, “সব দিলাম আমি, সব দিলাম।
পোলাটার এইবার জান ফিরাইয়া দেন।” তখন আমাদের বুঝতে কোনো কষ্টই হয় না যে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ এতটাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে, তারা মনে করে মজিদ চাইলে যে কারও মৃত্যুর ব্যবস্থা করে দিতে পারে, অথবা চাইলেই মৃত মানুষকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা রাখে।
অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের চাদরে মোড়ানো সে সমাজ যে সমাজের প্রতিভূ ধর্মব্যবসায়ী মজিদ এবং ভূস্বামী খালেক ব্যাপারী হাতে হাত মিলিয়ে দুঃশাসন চালিয়ে গেছে। এদের কাছে যারা মাথা নত করে নি, তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যেমন তাহের-কাদেরের বাবাকে গৃহত্যাগ করতে হয়েছে, আওয়ালপুরের পীর সাহেবকে পিছু হঠতে হয়েছে, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠা সফল হয়নি।
সুতরাং, আমরা বলতেই পারি, ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা এমন এক সমাজের সাথে পরিচিত হই, যে সমাজ আবহমান কালের কুসংস্কারের তামাসায় আচ্ছন্ন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন।
“……..যুগ যুগ ধরে এ নরম মাটির ধর্মভীরু মানুষের মনটিও নরম; এ মাটির শাসক-শোষক শ্রেণির অন্যতম হলো ধর্ম-ব্যবসায়ী স¤প্রদায়, তাদের কাছে মানুষের দুর্বলতাই বড় পুঁজি। ‘লালসালু’র কাহিনিটি ওপরে ওপরে এমনি একটি ভুঁইফোড় মাজার কেন্দ্রিক গল্প কিন্তু ভিতরে-ভিতরে গ্রামের বাঙালি মুসলমান সমাজ জীবনের আলেখ্য।”
তবে এর বিপরীত চিত্রও ‘লালসালু’তে বিদ্যামান। মজিদের চাপিয়ে দেওয়া কুসংস্কারভিত্তিক প্রথাধর্মের আবরণ ভেদ করে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ প্রায়শই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। সেটা তাদের স্বতঃর্স্ফূত প্রাণধর্মের বিকাশ। এমনিতে তারা ধর্মকর্ম বিশেষ একটা করে না, যতটা মগ্ন থাকে আনন্দ ফ‚র্তিতে।
খরার দিনে জমিতে যখন ফাটল ধরে, তখন আলাহর নাম নেয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাসে প্রথাধর্মের সাথে প্রাণধর্মের চিরন্তন দ্ব›দ্ব দেখিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণধর্মের পক্ষ নিয়ে তার জীবন নিশ্চিত করেছেন।
‘লালসালু’ উপন্যাসে বিধৃত সমাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটি বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হয় না। প্রথমটি হচ্ছে, লেখকের আক্রমণের লক্ষ্য কী ছিল? ধর্ম, নাকি ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার? দ্বিতীয়টি হলো, সমাজপতি খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি এরূপে অঙ্কিত হয়েছে কেন? এটি কি লেখকের পরিকল্পিত ইচ্ছাকৃত কোনো সম্পাদিত বাস্তবতা, নাকি গ্রামীণ সমাজ ও জীবন সম্পর্কে লেখকের অনভিজ্ঞতার অভাবে এমনটি হয়েছে?
যেহেতু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এমন এক সমাজের গল্প বলেছেন, যে সমাজে ‘শস্যের চেয়ে টুপী বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি’ সুতরাং, তার আক্রমণের লক্ষ্য ধর্ম নয়, ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার। ধর্ম চিরদিনই মানুষকে সত্য সুন্দর ও কল্যাণের পথ দেখিয়ে এসেছে কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থকে হাসিল করার অসৎ উদ্দেশ্যে ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে কুসংস্কার, মাজার-পূজা ও অন্ধবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে এসেছে এবং তারা তা বাস্তবায়ন করার জন্য নিরন্তরভাবে করে যাচ্ছে নানা ছলাকলা, কায়দা-কানুন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আঘাত করেছেন এই শ্রেণিটিকেধর্মকে নয়। তবে বিতর্ক এই কারণে ওঠে যে, তার উপন্যাসে শুদ্ধ ধার্মিক কোনো চরিত্র মর্যাদার সঙ্গে অঙ্কিত হয়নিধর্ম ও ধর্মসংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলো সবই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
খালেক ব্যাপারী, স্পষ্টতই লেখকের বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে যতটা সম্পর্কিত, তার পরিকল্পনার স্বাক্ষর ততটা বহন করে না। সমাজপতি এবং সেই সমাজের ধর্মীয় নেতার স্বার্থ অভিন্ন হয়এটি অর্থতত্তে¡ বলে, সমাজবিজ্ঞানে বলে, ইতিহাসে আছে।
খালেক ব্যাপারী ও মজিদের স্বার্থ অভিন্ন। তারা দুজন একে অপরের পরিপূরক, কিন্তু সমাজপতি কখনই ধর্মীয় নেতা দ্বারা পরিচালিত হয় না। কারণ, অর্থ সমাজের অবকাঠামো নির্মাণ করে, ধর্ম হচ্ছে যার ক্ষুদ্র একটি বহির্কাঠামো মাত্র।
কাজেই খালেক ব্যাপারী চরিত্র নির্মিতিতে ব্যর্থতার পেছনে অর্থশাসিত সমাজবিশেষ করে গ্রামীণ সমাজ, বাস্তব জীবনে লেখক যে সমাজকে খুব কাছে থেকে দেখেননি, তার অনভিজ্ঞতা একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাহিনি-সংক্ষেপ
দেশটাই যেন কেমন। ফসল একদম ফলে না অথচ অনেক মানুষের সেখানে বসবাস। ঘরে খাবার নেই। ঘরে অভাব থাকলে যা হয়সারাক্ষণ এলাকার মানুষ ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে, কখনও খুনখারাবিও। তাই তারা ছোটে। এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। আশাই তাদের দেশ থেকে বাহিরে নিয়ে আসে। খিদে সহ্য করতে না পেরে তারা ঘর ছাড়া। এদের একজনই মজিদ ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র।
শ্রাবণ মাসের শেষ দিক। মহব্বতনগর গ্রামের দুই যুবক তাহের ও কাদের কোচ জুতি নিয়ে ধানক্ষেতে নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করছিল। তারাই প্রথমে মজিদকে দেখে। দেখে মজিদ মতিগঞ্জের সড়কের ওপরে আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মজিদের এমন নাটকীয়তার কারণ এই যে, সে জানে গ্রামের মানুষ স্বাভাবিক কোনো ঘটনা পছন্দ করবে না।
তার আগমন যতটা নাটকীয় বানানো যায়, সেটা সে করার চেষ্টা করেছে। এর অংশ হিসেবে সে খুঁজে বের করে গ্রাম থেকে একটু বাইরে একটা বড় বাঁশ-বাগান। বাঁশ-ঝাড়ের ওধারে পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে ভাঙা একটি প্রাচীন কবর। ইটগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। ভেতরে সুড়ঙ্গের মতো। শেয়ালের বাসা হবে হয়তো। সেই কবরটিকে সে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে দাবি করে।
মহব্বতনগর গ্রামে ঢুকে সে সোজা চলে যায় গ্রামের মোড়ল খালেক ব্যাপারীর বাড়ি। সবাইকে চিৎকার করে সে ‘জাহেল’, ‘বেএলেম’ ‘আনপাড়াহ্’ বলে বিস্তর গালমন্দ করে জানায় যে, এ-রকম একজন কামেল পীরের মাজারকে এভাবে অযতেœ ফেলে রেখে এরা মহাপাপ করেছে।
গ্রামবাসী তো বটেই মোড়ল খালেক ব্যাপারী, মাতাব্বর রেহান আলীও লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকে। মজিদ তাদের জানায়, সে গারো পাহাড়ে খুব শান্তিতে ছিল, কিন্তু এখানে সে ছুটে এসেছে তার কারণ এক দৈবস্বপ্ন। স্বপ্নে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মহব্বতনগরে চলে আসার জন্য। তাই তার এ আগমন।
জঙ্গল পরিষ্কার করে ফেলা হলো। কবর নতুন করে বাঁধানো হলো। আগরবাতির গন্ধে, মোমবাতির আলোয় সৃষ্টি হলো নতুন এক পরিবেশ। কবরের ওপরে টানিয়ে দেওয়া হলো লালসালু কাপড়। এ গ্রাম ও গ্রাম থেকে লোকজন আসে। তাদের নানা আশার কথা, নানা কষ্টের কথা লালসালু কাপড়ে ঢাকা কবরে শুয়ে থাকা ব্যক্তিকে শোনায় আর যাবার সময় দিয়ে যায় টাকা-পয়সা। শুরু হলো মজিদের ব্যবসা।
মজিদের ঘরবাড়ি উঠতে বেশিদিন লাগে না। জমিজমা হলো। তারপর সে একদিন তার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়েও করে। পাত্রীর নাম রহিমা। লম্বা-চওড়া, শক্তিশালী হলেও সে স্বামীর খুব অনুগামী। গ্রামের মানুষ মজিদকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে, খালেক ব্যাপারীকে হয়তো ভয়ই কেবল পায় অথবা এড়িয়ে চলে।
মেয়ে-মহলে রহিমার আলাদা একটা কদর। মহিলারা তো আর মজিদের বরাবর তাদের আর্জি পেশ করতে পারে না, তাই রহিমাই তাদের অবলম্বন। রহিমার মাধ্যমেই তারা তাদের ফরিয়াদ জানায়।
তাহের-কাদেরের বাবা-মার বয়স হয়েছে, কিন্তু ঝগড়াঝাটি করার অভ্যাস তো কমেইনি বরং দিনদিন তা অশ্লীল গালাগালিতে গিয়ে পৌঁছেছে। বুড়ো এক কালে মারপিটে ওস্তাদ ছিল, এখন বয়স হয়ে গেছে বলে হাতের সেই জোরটা নেই, কিন্তু বুড়ির বয়স হলে হবে কি, মুখের ধারটা যেন আরও বেড়েছে।
সে যা বলে, তা শুনে পাড়া-পড়শি তো বটেই, তার বিধবা মেয়েও আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসে। বুড়ির বক্তব্য একটিই তার পেটে যে ছেলেমেয়েগুলো জন্মেছে, এগুলো বুড়োর নয়বুড়োর আবার ওই ক্ষমতা ছিল নাকি কোনো কালে? ঝগড়া তো নয় সে এক এলাহি কাণ্ড! তাহের-কাদেরের বাবা কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েকেহাসুনির মাকেপিটিয়েছিল।
মজিদ ভর মজলিশে তাহের-কাদেরের বাবাকে অপমান করে, যার দুঃখ সহ্য করতে না পেরে বৃদ্ধ লোকটি এক সন্ধ্যায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সে আর বাড়ি ফেরে না। যে বুড়ি প্রতিদিন তাকে নানা গালমন্দ করতো, সে-ও স্তব্ধ হয়ে যায়; শিশুর মতো ডাকতে থাকে: ‘আলা আলা ……..’ হাসুনির মা বিধবা।
রহিমার কাছে সে জানিয়েছে যে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মানুষ নয়। বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছে। ভাইয়েরা অকর্মণ্য, অপদার্থ। সে তো একাও নয়, সঙ্গে আছে তার শিশুপুত্র। তাই সে কাজ নেয় মজিদের বাড়িতে। রহিমাকে ঘর গেরস্থালিতে সাহায্য করা।
হাসুনির মা মজিদের বাড়িতে কাজ করতে এলে মজিদের কুদৃষ্টি তার ওপর পড়ে। মুখে যদিও সে হাসুনির মাকে ‘বিটি’ (মেয়ে) সম্বোধন করেছে, কিন্তু তার চেপে রাখা আদিম আবেগ শেষ পর্যন্ত চাপা থাকেনিনা হাসুনির মার কাছে, না রহিমার কাছে। যদিও প্রতিবাদ করেনি দুজনের কেউই, বরং দুজনই বুঝে তা না বোঝার ভান করেছে।
দিন ভালোই যাচ্ছিল মজিদের। হঠাৎ পাশের গ্রাম আওয়ালপুরে তাশরিফ নিলেন এক বয়স্ক পীর সাহেব। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মতলুব খাঁ তার পুরানো মুরিদ। সেখানেই তিনি উঠেছেন। উর্দু ভাষাটা তার আয়ত্তে। তাঁর বোলচালে আওয়ালপুরের বাসিন্দা মুগ্ধ, দিওয়ানা। মজিদ দেখলো যে তার একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষ‚ণœ হতে চলেছে, তাই সে তার প্রতিদ্ব›দ্বীকে হঠাতে নিজেই আওয়ালপুরে গিয়ে উপস্থিত হয়।
সেখানে গিয়ে দেখে ওই পীর সাহেব এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছেন। বিচিত্র সুরে তিনি ফারসি ভাষায় ওয়াজ করছেন। উপস্থিত উত্তাল জনতা তার অর্থ না বুঝেই হাউ মাউ করে কাঁদছে। পীর সাহেব সেদিন দফায় দফায় ওয়াজ করছেন, ওদিকে জোহরের নামাজের সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। হুজুরের মুরিদরা একবাক্যে মেনে নিয়েছে তাদের পীর-এ কামেল সূর্যকে ধরে রাখবার ক্ষমতা রাখেন।
তিনি যতক্ষণ না সূর্যকে হুকুম দেবেন, সূর্য এক আঙ্গুলও নড়তে পারে না। অবেশেষে আসরের নামাজের সময় যখন জোহরের নামাজ পড়ার জন্য সবাই কাতারবদ্ধ হয়, মজিদ চিৎকার করে প্রতিবাদ করে, “যতসব শয়তানী, বেদাতী কাজ কারবার। খোদার সঙ্গে মস্করা।” উলেখ্য, একই কাজ এতদিন সে নিজে করে এসেছে, কিন্তু আজ যখন মাঠে তার প্রবল প্রতিদ্ব›দ্বী উপস্থিত, তার মুখে শোনা যায় উল্টো কথা।
এরপর পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে মজিদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। অবশেষে মজিদ এলাকার লোকজনকে সাথে করে মহব্বতনগর গ্রামে ফিরে আসে-যদিও গ্রামবাসী দোটানায় ছিল। একদিন তাদের মনে ছিল মোদাচ্ছের পীরের প্রতি ভয় তথা মজিদের প্রতি আনুগত্য। অন্যদিকে আওয়ালপুরে আগত উর্দু-ফারসিভাষী বয়স্ক পীর সাহেবের প্রতি কৌতূহল ও মোহ। তবু তারা গ্রামে ফেরে বরং বলা চলে ফিরতে হয়।
গ্রামে ফেরার পর ওই রাতেই গ্রামবাসীকে একত্র করে খালেক ব্যাপারীকে নিয়ে মজিদ এক জরুরি বৈঠক বসালো। যেখানে সে পাশের গ্রামে আগত পীর সাহেবকে ‘মনোমুগ্ধকর শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করে তার কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সভায় সাব্যস্ত হলো: অন্তত এ গ্রামের কোনো মানুষ আওয়ালপুরের পীর সাহেবের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না। এই কড়া নিষেধাজ্ঞার পরেও মহব্বতনগর গ্রামের কয়েকজন যুবক পাশের গ্রামে পীর সাহেবের সভায় গিয়েছিল। আওয়ালপুরবাসী তাদের উত্তম মধ্যম দিয়েছিল। ফলে তাদের করিমগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
খালেক ব্যাপারীর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর নাম আমেনা বিবি, দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম তানু বিবি। আমেনা বিবি তের বছর বয়সে স্বামীর ঘরে এসেছেন আজ তার বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেছে। কোনো সন্তানাদি তার হয়নি। অথচ সতীন তানু বিবি বছর বছর ছেলেপুলে জন্ম দিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কত আর সহ্য হয়?
এদিকে লোকজন বলাবলি করছে: আওয়ালপুরে যে পীর সাহেব এসেছেন, উনি খুব কামেল মানুষ, তার ‘পানি পড়া’ খেলেই পেটে বাচ্চা আসবে। এদিকে আওয়ালপুরে তো যাওয়া বারণ। সেখানকার পীর সাহেবের সাথে মজিদের নাকি কী সমস্যা হয়েছে। কিন্তু আমেনা বিবি এসব শুনতে নারাজ। তার ‘পানি পড়া’ চাই-ই চাই। খালেক ব্যাপারী গোপনে রাজী হয়।
আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছ থেকে ‘পানি পড়া’ নিয়ে আসার দায়িত্ব খালেক ব্যাপারী দিল তার সম্বন্ধী ধলা মিঞাকে। ধলা মিঞা তানু বিবির বড় ভাই। সে খালেক ব্যাপারীর বাড়িতেই থাকে। খায় দায় ঘুমায় কোনো কাজকর্ম করে না। বাইরে থেকে তাকে বোকা কিসিমের মানুষ মনে হলেও সে আসলে ধুরন্ধর ও প্রতারক। সে তার ভগ্নিপতিকে জানায় যে আওয়ালপুরে গিয়ে ‘পানি পড়া’ এনে দেবে কিন্তু সে তা করে না।
সে সোজা মজিদের কাছে চলে যায় এবং তাকেই পানি পড়ে দিতে বলে। মজিদ এতে অপমানিত হয় এবং সরাসরি টাকার ইঙ্গিত দেওয়ার পরেও সে ‘পানি পড়া’ দেয় না। ধলা মিঞা যে আওয়ালপুরের পীরের কাছে গেল না এটি মজিদের প্রতি তার আনুগত্য নয় বরং সে ছিল অলস, অকর্মণ্য ও শঠ প্রকৃতির মানুষ।
তার উপর দুই গ্রামের মাঝখানে ছিল একটা মস্ত তেঁতুল গাছ সবাই ওটাকে ভুতুড়ে গাছ বলে রাত বিরেতে এড়িয়ে চলতো। ধলা মিঞাকে রাতের বেলা ওই গাছতলা দিয়েই যেতে হতো, ভীতু প্রকৃতির মানুষ ছিল বলে সে তা কৌশলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে।
এ ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে খালেক ব্যাপারীর সঙ্গে মজিদের কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তখন খালেক ব্যাপারী মজিদকেই এ ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহŸান জানায়। মজিদ তখন একটা কৌশলের আশ্রয় নেয়। সে বলে, আমেনা বিবির পেটে বেড়ী পড়েছে বলেই তো সন্তানাদি হচ্ছে না। পেটে নানা মাপের বেড়ী পড়তে পারে। পেটে একুশ পর্যন্ত বেড়ী মজিদ দেখেছে বলে জানায়। সাত বেড়ী পর্যন্ত খোলা যায়, তার বেশি সম্ভব নয়।
তার স্ত্রী রহিমার পেটেও তো চৌদ্দ প্যাঁচ আছে, তাই বাচ্চা-কাচ্চা হচ্ছে না তাদের। এ ক্ষেত্রে মজিদ কেন কারুরই কিছু করণীয় নেই। আমেনা বিবির পেটে যদি সাত বেড়ীর বেশি না পড়ে যাকে, তাহলে মজিদ খুলে ফেলতে পারবে মজিদ বলে। এজন্য আমেনা বিবিকে মজিদের পড়া পানি খেয়ে মোদাচ্ছের পীরের মাজার সাত পাক ঘুরতে হবে।
নির্ধারিত দিনে আমেনা বিবি রোজা রাখে। উদ্বেগে-ভয়ে-ক্ষুধায় তার দেহ-মন দুর্বল। সে মাজার সাত পাক ঘুরে আসতে সমর্থ হয় নাতিন পাক ঘুরতেই সে জ্ঞান হারিয়ে মাজার প্রাঙ্গণে এলিয়ে পড়ে। ধূর্ত মজিদ জানায় আমেনা বিবি অসতী, তাই এমনটি ঘটেছেএমন স্ত্রীকে সে যেন আর ঘরে ঠাঁই না দেয়। মজিদের হাতের পুতুল খালেক ব্যাপারী সেই কথা মতো আমেনা বিবিকে তালাক দেয়।
এদিকে হাওয়ায় কদিন ধরে একটা কথা ভাসছে। মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস নাকি গ্রামে একটা স্কুল বসাবে। আক্কাস বহুদিন বিদেশে ছিল। করিমগঞ্জের স্কুলে নাকি কিছুদিন পড়াশুনাও সে করেছে। তারপর কোথায় পাটের আড়তে না তামাকের আড়তে চাকরি করে কিছু পয়সা কামিয়েছে। কোথায় গিয়ে সে শিখে এসেছে যে স্কুলে না পড়লে মুসলমানদের মুক্তি নেই। সে স্কুলের জন্য চাঁদা তুলতে লাগলো। স্কুলের জন্য সাহায্য চেয়ে সরকারের কাছে একটা দরখাস্তও পাঠিয়ে বসে।
মজিদ আর বরদাস্ত করতে পারে না। গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে নবীন প্রজন্মের চোখ-কান খুলে যাবে। এতে তার ধর্মব্যবসার সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে সে আক্কাসকে ঠেকাতে উঠে পড়ে লাগে। ঠেকিয়েও দেয়। এক সন্ধ্যার পর বৈঠক ডাকা হলো। তলব করা হলো আক্কাসের বাবা মোদাব্বের মিঞাকে।
ভর মজলিসে ঠাস করে চড় মারার ভঙ্গিতে মজিদ তাকে প্রশ্ন করে বসে, ‘তোমার দাড়ি কই মিঞা? ….. তুমি না মুসালমানের ছেলেদাড়ি কই তোমার?” খালেক ব্যাপারী বলে: “হে নাকি ইংরাজি পড়ছে। তা পড়লে মাথা কি আর ঠান্ডা থাকে?” সভায় সিন্ধান্ত হয়: গ্রামে পাকা মসজিদ দেওয়া হবে।
গ্রামবাসী এতে সাধ্যমতো চাঁদা দেবে। সভায় আক্কাস তার স্কুল প্রতিষ্ঠার কথাটা উত্থাপন করলে তা চাপা পড়ে যায়, এমনকি তার বাবাই বলে ওঠে“চুপ কর ছ্যামড়া, বেত্তমিজের মতো কথা কইসনা।” আক্কাস অগত্যা সভা থেকে আস্তে আস্তে উঠে বের হয়ে যায়।
এদিকে মজিদকে নেশায় পেয়ে বসেছে। সে নেশা জীবনকে উপভোগের নেশা। সে আবার বিয়ে করতে চায়। রহিমাকে নানা উসিলা দেখায়। কখনও বলে: “বিবি আমাগো যদি পোলাপাইন থাকতো।” কখনও খোলাসা করে বলে: “বিবি, আমাগো বাড়িটা বড়ই নিরানন্দ। তোমার একটা সাথী আনুম?” রহিমা কী বলবে? তার মতে কী আসে যায়?
নতুন বউ হয়ে এলো যে বালিকাটি নাম তার জমিলা। জমিলাকে প্রথম দিন থেকেই রহিমা সতীন হিসেবে না দেখে মেয়ে হিসেবে দেখেছে। আদর-যতœ করে তাকে খাওয়ায় পাশে পাশে রাখে। জমিলা খুব হাসিখুশি মেয়ে।
রহিমাকে একদিন সে বলেই বসলো: বিয়ের দিন সে মজিদকে ভেবেছিল শ্বশুর আর এখানে এসে রহিমাকে দেখে মনে করেছিল এ মহিলাটি নিশ্চয়ই তার শাশুড়ি। তারপর তার প্রাণখোলা হাসি। রহিমা তাকে হাসতে বারণ করে। মজিদের বাড়িতে হাসা নিষিদ্ধ। মেয়েদের তো বটেই, কোনো মানুষের হাসি সহ্য করতে পারে না মজিদ।
মজিদ খুব কঠোর প্রকৃতির লোক। সে আড়ালে আবডালে হয়তো লক্ষ করে থাকবে যে তার বালিকা-বধূ জমিলা নামাজ পড়ে না। তাই রহিমার মাধ্যমে জমিলাকে সে নামাজ পড়ার তাগিদ দেয়। রহিমা মজিদকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে জমিলা নামাজ জানে এবং পড়বে ধীরে সুস্থে।
সন্ধ্যা হতে না হতেই জমিলার ঘুম পেয়ে যায়। মজিদ বলা কওয়াতে সে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু প্রায়ই তার এশার নামাজ পড়া হয় না। আজ সে মাগরিবের নামাজ পড়ার পর থেকেই ঘুমে ঢুলছিল, তবু নামাজ পড়ার জন্য সে বসেছিল।
এশার নামাজ পড়েই সে সোজা বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মজিদ ঘরে এসে হাঁকডাক শুরু করে, টান মেরে বিছানা থেকে তাকে তুলে বসায়, কিন্তু সে বলেও না যে সে এশার নামাজ পড়েই শুয়েছিল।
এরপর মজিদ শুরু করে নির্যাতন। নির্যাতন করে চলে এবং ক্রমশ তার মাত্রা বৃদ্ধি করে। সহ্য করতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে জমিলা একদিন মজিদের মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দেয়। এবার মজিদের ভ্যাবাচেকা খাওয়ার পালা।
উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি: জমিলাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য একাকী ঝড়ের রাতে মাজারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সারা রাত ভয়ঙ্কর শিলাবৃষ্টি হলো। মেয়েটা একা একা পড়ে থাকে মাজারের খোলা প্রাঙ্গণে। সকালে এসে দেখা গেল, কবরের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জমিলা। তার একটা পা কবরের গায়ে লেগে আছে। তখনও জীবিত সে।
এরপর দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যায়। যে রহিমা এতদিন তার অনুগত ছিল, সে ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করে। বলা যায় শুরু করেছিল আরও আগে থেকেই, কিন্তু জমিলাকে মাজারে বেঁধে রেখে আসার পর থেকেই এবার সে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন হলো। মজিদ দেখতে পাচ্ছে: হাতে সব ধরনের অস্ত্র থাকার পরেও সে পরাজিত হচ্ছে। সমাজে সে রাজাধিরাজ হতে পারে, কিন্তু নিজের ঘরে সে উদ্বাস্তু, গৃহহীন, অনাথ।
লালসালু উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা
নামকরণের সাথে যেকোনো শিল্পের রসপরিণতির একটা সরাসরি সম্পর্ক থাকে কেননা, তাতে শিল্পীর পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। সুতরাং, উইলিয়াম শেকসপিয়র কথিত ‘নামে কিবা আসে যায়’ কথাটি অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে খাটে না; খাটে না বলেই তিনি তাঁর চরিত্রপ্রধান নাটকের নাম রেখেছেন চরিত্রের নাম অনুসারে, যেমন: ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’ ও ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘ম্যাকবেথ’ ইত্যাদি।
অথচ, বিষয় অনুসারে তিনি যে নামকরণ করেননি এমন নয় যেমন: ‘মিড সামার নাইটস ড্রিম’, ‘দা টেম্পেস্ট ইত্যাদি। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে মূল চরিত্রের নাম অনুযায়ী উপন্যাসের নামকরণ করবার প্রচলনটা পুরনো। যেমন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’।
দ্বিতীয় ধারা হিসেবে আসে বিষয়বস্তু অনুযায়ী নামকরণ করার আগ্রহ। এই আগ্রহটাও অনেকটাই সেকেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাসুনী বাঁকের উপকথা’র নামকরণ এই পদ্ধতিতে করা হয়েছে।
নামকরণের তৃতীয় সে পদ্ধতি সেটিই এখন পর্যন্ত সর্বাধুনিক। এটি বিষয়বস্তু নয় তবে তার ব্যঞ্জনা থেকে নামকরণ করা হয়ে থাকে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসের নামকরণ ব্যঞ্জনার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করেছিলেন বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। ঔপন্যাসিক যদি কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামে উপন্যাসটির নামকরণ করতে চাইতেন, তবে এ উপন্যাসের নাম দিতে পারতেন ‘মজিদ’। কিন্তু তিনি পুরনো পথে হাঁটেননি। বিষয়বস্তু অনুযায়ী নামকরণের পক্ষপাতীও যে তিনি ছিলেন না, তার প্রমাণ আমরা পাই।
এ উপন্যাসের বিষয় পীরমাহাত্ম্য, মাজার পূজা, ধর্মের নামে প্রচলিত অন্ধ কুসংস্কার। লক্ষণীয়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বিষয়নির্ভর নামকরণ করলে তাঁর উপন্যাসের নামের স্টাইল ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘অনল প্রবাহ’, ‘মহাশ্মশান’, ‘জমীদার দর্পণ’ ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’কে স্মরণ করিয়ে দিত। ওয়ালীউল্লাহ্ সেই সেকেলে পথেও হাঁটেননি। তিনি বেছে নিলেন ব্যঞ্জনা আধুনিক পদ্ধতি।
তিনি তাঁর উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘লালসালু’। ‘সালু’ শব্দের অর্থ ‘লাল কাপড়’। সুপ্রাচীন কাল থেকে যুক্তিরহিত কারণ ছাড়াই এই সালু কাপড় পীরদের মাজারে টানানো থাকে। এ দেশের প্রচলিত হাজার হাজার কুসংস্কারের ভেতর এটিও একটি কুসংস্কার। এই সালু কাপড়ের নিচে ঢাকা পড়ে আছে হাজার বছরের বাঙালির মুক্তবুদ্ধি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সেটি টান মেরে ফেলে দিতে চেয়েছেন।
লালসালু কাপড়ে ঢাকা মানুষগুলোর আসল চেহারাগুলোও তিনি তাঁর উপন্যাসে দেখিয়ে দিয়েছেন। এ উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি: জমিলার মেহেদি মাখা একটি পা মাজারের গায়ে লেগে আছে। এটি প্রতীকায়িত।
লেখক জমিলাকে দিয়ে ভুয়া মাজার ও ভুয়া ধর্মব্যবসাকে তথা যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রবহমান কুসংস্কারকে লাথি মেরেছেন। এ উপন্যাসের শেষে মজিদের পরাক্রম ক্ষুণœ হয়েছে। লেখক লালসালুর দৌরাত্ম্য যেকোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না উপন্যাসের কাহিনিবিন্যাস তা-ই প্রমাণ করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে লালসালু কাপড়ে ঢাকা তথাকথিত মাজারকেন্দ্রিক সমাজ ও মানুষগুলোর আসল চেহারা আমাদের দেখাতে চেয়েছেন; অতঃপর টান মেরে ওই অশুভ লাল-সালু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুভ-সুন্দর-মুক্ত আলোয় কুসংস্কারহীন আলোকিত সমাজ গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি তাঁর উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘লালসালু’। এই নামকরণ শিল্পসফল, সার্থক।
চরিত্র আলোচনা
মজিদ
‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। এ উপন্যাস আপাততভাবে সে কুসংস্কার, শঠতা ও প্রতারণার প্রতীক। সে প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এই কারণে যে প্রথা টিকে না থাকলে তার প্রভুত্ব টিকে থাকবে না।
মহব্বতনগর গ্রামে নিজের পরাক্রম টিকিয়ে রাখার জন্য এমন কোনো কর্ম নেই, যা সে না করেছে তাহের-কাদেরের বাবাকে শাস্তি, আওয়ালপুরের প্রতিদ্ব›দ্বী পীরকে হঠানো, গ্রামবাসীকে সব সময় খোদাভীতির কথা বলে নিজের অনুগত করে রাখা, খালেক ব্যাপারীর ওপর কড়া নজরদারি, আমেনা বিবিকে তালাক দানে বাধ্য করা, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বানচাল করে দেওয়া, পরিশেষে জমিলাকে শায়েস্তা করা।
তবে অন্য সব ক্ষেত্রে মজিদ আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করলেও জমিলাকে সে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনিবরং বলা যায়, পুরোপুরি সে ব্যর্থ হয়েছে।
শীর্ণদেহের এই মানুষটি মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐশী শক্তির প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য, ভয় ও শ্রদ্ধা, ইচ্ছা ও বাসনা-সবই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই চরিত্রকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন; বার বার অনুসরণ করেছেন এবং তার ওপরই আলো ফেলে পাঠকের মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন।
উপন্যাসের সকল ঘটনার নিয়ন্ত্রক মজিদ। তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আর তাই মজিদের প্রবল উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে মহব্বতনগর গ্রামের সামাজিক পারিবারিক সকল কর্মকাণ্ডে।
আপাতদৃষ্টিতে মজিদ একটি চরিত্র; শুধু চরিত্র নয়, উপন্যাসটির একদম কেন্দ্রীয় চরিত্র অথচ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে যারা জানেন, তাঁর দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যাঁদের কমবেশি পরিচয় আছে, তাঁরা সবাই জানেন, মজিদ মূলত একটি প্রতীক।
কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের মূর্তিমান প্রতীকও সে। প্রচলিত বিশ্বাসের কাঠামো ও প্রথাবদ্ধ জীবনধারাকে সে টিকিয়ে রাখতে চায়, ওই জীবনধারার সে প্রভু হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে। এজন্য সে যেকোনো কাজ করতেই প্রস্তুত, তা যতই নীতিহীন বা অমানবিক হোক।
‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রাণধর্ম ও প্রথাধর্মের চিরন্তন দ্ব›দ্বকে দেখিয়েছেন। মজিদ ধর্মের নামে প্রচলিত প্রথাধর্ম তথা কুসংস্কারের প্রতীভূ। সে প্রাণধর্মের প্রবল বিরোধিতায় তৎপর থেকেছে পুরো উপন্যাস জুড়ে। কারণ, সে জানে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ জেগে উঠলে তার ধর্মব্যবসা লাটে উঠবে।
ফলে ফসল ওঠার সময় গ্রামবাসীরা যখন আনন্দে গান গেয়ে ওঠে, তখন সে থামিয়ে দেয়; হিন্দুপাড়ায় ঢোল বাজলে নিষ্ফল ক্রোধে ছটফট করে কেননা, ওই সমাজে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তার মোদাচ্ছের পীরের দোহাই তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। রহিমা উঁচু গলায় কথা বললে কিংবা শব্দ করে হাঁটলে সে খোদার ভয় দেখায়; জমিলা প্রাণোচ্ছ¡ল হাসি হাসলে সে নিষ্ঠুরভাবে ওই হাসি বন্ধ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যায়।
মজিদ প্রতিষ্ঠাকামী। যেকোনোভাবেই হোক, সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। চালচুলোহীন মজিদ অল্পদিনের মধ্যেই মহব্বতনগরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিল, সেটি তার এই যোগ্যতা বলে। তবে তার এই প্রতিষ্ঠাপর্বে শোষণের আশ্রয় নিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে তার হাতিয়ার ছিল কথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার।
অপরাধবোধ মানুষের নিঃসঙ্গবোধ জাগিয়ে তোলে। মজিদকেও আমরা চূড়ান্ত রকম নিঃসঙ্গবোধে আক্রান্ত থাকতে দেখি। তার মন সবসময়ই বিচলিত ছিল। একবারই রহিমার কাছে তার প্রকাশ ঘটেছে। রহিমার কাছে সমর্পিত মজিদ যখন বলে, “কও বিবি কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে জানি কুলায় না। তোমারে জিগাই, তুমি কও?” তখন তার অন্তর্শায়িত হতাশা, নিঃসঙ্গতাকে আমরা প্রত্যক্ষ করি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পাশ্চাত্য অস্তিত্ববাদী দর্শন দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মজিদ চরিত্রটির মাধ্যমে তিনি এই অস্তিত্ববাদী দার্শনিক তত্ত¡টিকে মূর্ত করে তুলেছেন।
অস্তিত্বের সঙ্কটে নিপতিত মানুষের ক্রমশ অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠা এবং তারপর অশুভ শক্তিতে পরিণত হয়ে নিজেই অন্যের অস্তিত্বের সঙ্কট সৃষ্টি করার এক অপূর্ব বৃত্ত মজিদ চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এই অর্থে, মজিদ একই সঙ্গে মানুষ এবং একই সঙ্গে তত্ত¡। সে অশুভ কিন্তু লেখকেরই অন্তরশায়িত অপপুত্র।
জমিলা
জমিলা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। সীমিত আয়তনের এ উপন্যাসের দ্বিতীয়ার্ধে কিশোরী এ মেয়েটির আগমন; যে-কিনা নিতান্তই হতদরিদ্র একটি পরিবারের কন্যা। কিন্তু তার প্রভাবে প্রবল মজিদ বিচলিত, উন্মূলিত হয়ে পড়ে।
জমিলা যে দারিদ্র লাঞ্ছিত, সাধারণ একটি গ্রামীণ পরিবারের মেয়ে, সেটি খুব সহজেই আমরা কল্পনা করতে পারি এই সূত্রে যে, তার বাবা পৌঢ় এবং বিবাহিত মজিদের সাথে কন্যার বিবাহ দিতে কোনো রকম দ্বিধা করেনি বরং আমাদের সংগত অনুমান: কন্যাদায়গ্রস্ত হতভাগ্য পিতার কাছে এটি সৌভাগ্যের ব্যাপার বলেই গণ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি লক্ষযোগ্য, সেটি হলো: জমিলাও এটি অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার বলে মনে করেনি শুধু একটু কৌতুক অনুভব করেছিল। স্বামীগৃহে আসার পর সতীন রহিমাকে একদিন পরিহাস করে সে বলেছিল, প্রথম দেখায় মজিদকে সে শ্বশুর মনে করেছিল, আর রহিমাকে দেখে ভেবেছিল শাশুড়ি।
এই পরিহাসের তরল স্রোতের মধ্যে হয়তো অন্তর্লীন হয়ে আছে একটুখানি হতাশা, দুঃখ, গ্লানিও; তবে তার মধ্যে বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার প্রবল একটা ব্যাপার ছিল আবহমান কালের সব বাঙালি নারীর ভেতরই যেমন থাকে সব দুর্ভাগ্যের সাথেই নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার একটা দীর্ঘশ্বাসজড়িত বিচ্যুতি।
তাহলে সমস্যা কোথায়? জমিলা তো সব মেনেই নিয়েছিল। পৌঢ় স্বামীর কাছে এসে সে সবকিছু সমর্পণ করেছিল একে একে। সবকিছু দিয়ে দেওয়ার পরেও প্রতিটি মানুষের কিছু কিছু জিনিস থেকেই যায়, যেটা কাউকে দেওয়া যায় না আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য।
জমিলা তার এই হাতের পাঁচগুলো যক্ষের ধনের মতো বুকের মধ্যে আগলে ধরে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু দুর্বার মজিদ সেগুলোও কেড়ে নিতে যখন তৎপর হয়ে উঠলো, তখন জমিলাকে আমরা দেখি নতুন এক রূপেমজিদেরই প্রতিপক্ষ হিসেবে। মহব্বতনগর অঞ্চলে কেউ যা কল্পনাও করতে পারে না, ঘরের ভেতরে থেকে জমিলা করে বসলো তাই। তার আক্রমণটা আসলো ভেতর থেকে। মজিদকে সে ধরাশায়ী করে ফেলে।
প্রশ্ন ওঠতেই পারে, জমিলার হাতিয়ারটি কী? জমিলার হাতিয়ার হচ্ছে (হাতিয়ার না বলে মারণাস্ত্র বলাই ভালো) সহজ প্রাণধর্ম। সে ধর্মের নমে প্রচলিত শাস্ত্রশাসনের অনুগামী নয় বরং মুক্তধর্মে বিশ্বাসী। সে প্রাণোচ্ছ¡ল। মন খুলে সে হাসে, নানা রকম কৌতুককর কথা বলে। ভুয়া মাজারের ভয় তাকে দেখালে সে ভয় পায় না।
মজিদ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেএটা সে মেনে নিতে পারে না, তার সাথে করা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনগুলো সে অকপটে হজম করতে পারে না। ঘুমকাতুরে জমিলা নামাজ পড়েই শুয়েছিলকিন্তু সে এশার নামাজ পড়েছে কিনাএই নিয়ে মজিদ হলা করলে সে হ্যাঁ, না কিছুই বলে না। স্পষ্টতই, মজিদকে সে ঘৃণা করে তাই মজিদের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিতেও সে দ্বিধা করে না।
বিশ শতক পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের আদর্শবাদী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। জমিলা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মানসকন্যা, যথার্থ আদর্শবাদী চরিত্র, যাকে দিয়ে ঘুনেধরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মুখে থুতু দিয়েছিল।
লালসালু কাপড়ে ঢাকা ধর্মব্যবসায়ীর মুখোশ উন্মোচন করেছেন এবং উপন্যাসের শেষে তাঁর এই মানসকন্যাকে দিয়েই তথাকথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজার (শেয়ালের গর্ত)-কে পক্ষাঘাত করেছেন। বলা যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র একটি সাহিত্যিক পরিকল্পনা ছিল, ‘লালসালু’ উপন্যাস রচনা করে জমিলা চরিত্রটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে তার বাস্তবায়ন ঘটেছে।
রহিমা
চরিত্রচিত্রণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় রেখেছেন তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে; যদিও এ কথা আমাদের বিস্মৃত হওয়া সংগত হবে না যে এ উপন্যাসটি চরিত্রপ্রধান উপন্যাস নয়, তাই চরিত্রসৃজন তাঁর লক্ষ নয়- উপলক্ষ মাত্র। কাহিনির দাবিতে এবং বাস্তবতার প্রয়োজনে তিনি অল্প কিছু চরিত্র নির্মাণ করেছেন, রহিমা সেগুলোর মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।
রহিমার বিশিষ্ট হয়ে ওঠার কারণ দ্বিবিধ। প্রথম কারণটি খুব সরল ও স্পষ্ট। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রহিমার মধ্যে দিয়ে শাশ্বত বাঙালি নারীর একটি চেনা মুখকে আঁকবার চেষ্টা করেছেন খুব সচেতনভাবে। স্মরণাতীতকাল থেকেই বাঙালি নারী স্বামীর অনুগত। তারা স্বামীকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করে, স্বামীর সব নির্দেশ বিনা দ্বিধায় মেনে চলে রহিমাও সেই ঘরানার মেয়ে।
তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঔপন্যাসিক বলেছেন,
“নাম তার রহিমা। সত্যি সে লম্বা-চওড়া মানুষ। হাড় চওড়া মাংসল দেহ। শীঘ্র দেখা গেল, তার শক্তিও কম নয়। বড় বড় হাঁড়ি সে অনায়াসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তুলে নিয়ে যায়, গোঁয়ার ধামড়া গাইকেও স্বচ্ছন্দে গোয়াল থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। হাঁটে যখন মাটিতে আওয়াজ হয়, কথা কয় যখন, মাঠ থেকে শোনা যায় গলা।”
এ চির চেনা বাঙালি নারী দৈহিক শক্তিমত্তায় সে যতই প্রবল হোক না কেন, স্বামীর প্রতি ভক্তি তার প্রবল, স্বামীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সে মেনে চলে। সে নম্র ও বিনীত। এ রকম এক নারীরই প্রয়োজন ছিল মজিদের, যে তার সংসার আগলে রাখবে। কঠিন হাতে সামাল দেবে সংসার, কিন্তু স্বামীর সামনে থাকবে সদা নতমস্তকে, বিনীতা, আনুগতা। মজিদের জন্য রহিমাই আদর্শ স্ত্রী।
রহিমার বিশিষ্ট হয়ে ওঠার দ্বিতীয় কারণটি খুব সচেতনপাঠে অনুধাবন করা যায়। দ্বিতীয় কারণটি ঔপন্যাসিকের নিতান্তই পরিকল্পনার অংশ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর সমকালীন সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন এবং এটি তিনি করতে চেয়েছিলেন সমাজের ভেতর থেকেই। তাই তিনি রহিমার মতো খুব চেনা একজন গৃহবধূকে অচেনা করে নির্মাণ করেছেন উপন্যাসের শেষ দিকে।
মজিদ জমিলাকে যখন মাজারে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আসে, তখন থেকে রহিমার এই নতুন রূপ আমরা দেখতে পাই। অনুগতা স্ত্রী রহিমার হঠাৎ করেই স্বামীর প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ শুরু করে। সে স্পষ্টতই জমিলার পক্ষ অবলম্বন করে। এতদিন স্বামীকে সে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছিল কিন্তু এই পর্যায়ে আমরা দেখি সে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, রহিমার চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ধর্মের নামে কুসংস্কার এবং শাস্ত্রধর্মের বিরুদ্ধে প্রাণধর্মের স্বতঃস্ফূর্ত জয় দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং নিঃসন্দেহে তাঁর সেই প্রয়াস সফল হয়েছে।
খালেক ব্যাপারী
‘লালসালু’ উপন্যাসে খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি নানা কারণে আলোচিত, ফলে সাহিত্য সমালোচনায় তা পেয়েছে ভিন্নতর মাত্রা। এ কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা চলে যে, এই চরিত্রটি নিয়ে যত কথা উঠেছে, কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদকে নিয়েও তত কথা ওঠেনি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর এবং উৎপাদন ব্যবস্থা সামন্তবাদী হওয়ার সুবাদে যার জমি যত বেশি, সমাজে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিও তত বেশি হয়এটাই নিয়ম। খালেক ব্যাপারী মহব্বতনগর গ্রামের সমাজপতি। গ্রামীণ সমাজে এ শ্রেণির মানুষকে মোড়ল বা মাতব্বর বলা হয়ে থাকে, যারা গ্রামীণ মানুষের সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
সামন্তবাদী সমাজে ভূমি মালিকদের সাথে ধর্মীয় পুরোহিতদের নিবিড় সখ্য থাকে, যা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাসে দেখিয়েছেন। একপক্ষে আছে খালেক ব্যাপারী, অন্যপক্ষের প্রতিনিধি মজিদ।
চিরায়ত বাস্তবতা এই যে, ভূমি মালিক ও ধর্মীয় পুরোহিতদের স্বার্থ সচরাচর অভিন্ন। তাই তাদের পথ এক, তারা একট্টা হোক তা সজ্ঞানে নতুবা অজান্তে-অনিচ্ছায়। তারা একে অপরের দোসর, পথ চলার সহচর, সঙ্গী। তবে সব সময়ই লক্ষণীয় হলো: সমাজপতিই শেষ পর্যন্ত ধর্মপতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে, উচ্চকণ্ঠ হয়ে থাকে; ফলে সমাজ নেতাই হয়ে যায় একচ্ছত্রধারী।
চিরায়ত এই বাস্তবতার লক্ষণ ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই। খালেক ব্যাপারী গ্রামের মোড়ল কিন্তু ধর্মীয় পুরোহিত মজিদের কথায় সে পরিচালিত। মজিদের সব কথাকে খালেক ব্যাপারী সমর্থন করেছেন, মজিদের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন নির্দ্বিধায়।
আমরা আগেই বলেছি: খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি নির্মিতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাস্তবতা লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু তিনি কেন সেটি করেছেন? এ ব্যাপারে সমালোচকেরা একমত হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেছেন, এটি তিনি করেছেন স্রেফ শিল্পের তাগিদে।
‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদের দাপট দেখাতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতার কারণে তিনি যদি খালেক ব্যাপারীকে যথার্থভাবে নির্মাণ করেন, তাহলে মজিদ গৌণ হয়ে পড়তো। মজিদকে সর্বেসর্বা হিসেবে নির্মাণ করার শিল্প পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই খালেক ব্যাপারীকে গৌণ করে অঙ্কন করার প্রয়াস। কেউ কেউ বলেছেন, এটি লেখকের অসর্তকতাপ্রসূত একটি ব্যাপার, তাই ক্ষমার্হ।
তাঁরা এই যুক্তি দেন যে, ‘লালসালু’ উপন্যাসে খালেক ব্যাপারী দ্বারা আর কোনো চরিত্র দুর্বল সৃষ্টি নয়। তৃতীয় পক্ষের দাবি এই যে: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নগর জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা সবই শহরে। তিনি তাঁর কর্মজীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন বিদেশে, কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামীণ বাংলার জনজীবনের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্টতা ছিল না। যার প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে।
সাহিত্য সমালোচনায় বিভিন্ন মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, তৃতীয় মতটিই আমাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।
আক্কাস
‘লালসালু’ উপন্যাসে আক্কাস খুব গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভাবনাময় একটি চরিত্র। তবে তার সম্ভাবনার সবটুকু ঔপন্যাসিক কার্যকর করতে পেরেছেন এমন মনে হয় না। উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে আমরা আক্কাসের অনুপ্রবেশ লক্ষ করি। তার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য লেখক আমাদের দিয়েছেন,
“মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস নাকি গ্রামে একটা স্কুল বসাবে। আক্কাস বিদেশে ছিল বহুদিন। তার আগে করিমগঞ্জে স্কুলে নিজে নাকি পড়াশোনা করেছে কিছু। তরপর কোথায় পাটের আড়তে না তামাকের আড়তে চাকুরি করে কিছু পয়সা জমিয়ে দেশে ফিরেছে কেমন একটা লাটবেলাটে ভাব নিয়ে ।…….বলে, স্কুল দেবে।
কোত্থেকে শিখে এসেছে স্কুলে না পড়লে নাকি মুসলমানের পরিত্রাণ নেই। …… আক্কাস যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। সে ঘুরতে লাগলো চরকীর মতো। স্কুলের জন্য দস্তুরমতো চাঁদা তোলার চেষ্টা চলতে লাগলো এবং করিমগঞ্জে গিয়ে কাউকে দিয়ে একটা জোরালো গোছের আবেদনপত্র লিখিয়ে এনে সেটা সিধা সে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিল। কথা এই যে, স্কুলের জন্য সরকারের কাছে সাহায্য চাই।”
আক্কাস সম্পর্কে আরও অনেক কথা ঔপন্যাসিক আমাদের বলেছেন, আরও অনেক দীর্ঘ বর্ণনা উপন্যাসে আছে অথচ এই চরিত্রটিকে তিনি শেষ পর্যন্ত পূর্ণভাবে বিকশিত করতে পেরেছেন, এটা আমাদের মনে হয় না। তার কারণ এই যে, যে প্রবল প্রত্যয়ী ‘আক্কাস স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এত কিছু করতে পারে, সেই আক্কাস ধর্মব্যবসায়ী মজিদের প্যাঁচে ঘায়েল হয়ে পিঠটান দেবেএটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, বিশেষত যে আক্কাস ওই আমলে স্কুলে পড়েছে এবং বহুকাল বিদেশে কাটিয়েছে।
মহব্বতনগরের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারাটা সহজ ব্যাপার, কিন্তু স্কুল-পড়–য়া, বিদেশ ফেরত আক্কাসকে নয়। “তোমার দাঁড়ি কই মিঞা” মজিদের এই কথার পালটা কথা কেবল নয়, মজিদ যে মিথ্যার বেসাতি ফেঁদে বসেছে তাদের এলাকায়-এই বলান: “-তয় স্কুলের কথাডা?” ছেলের উত্তর লেখক দেয়ালেন বাবার মুখ থেকেই। “ চুপ কর ছ্যামড়া, বেত্তমিজের মতো কথা কইসনা।”
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১-৮ | PDF
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ৯-১৭ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১৮-২৫ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ২৬-৩১ | PDF
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১১-২০ | PDF Download
তারপর আমরা দেখি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বর্ণনা দিচ্ছেন,
“আক্কাস আস্তে আস্তে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কেউ কেউ দেখে না। কিন্তু তার চলে যাওয়াটা কারো মনে প্রশ্ন জাগায় না।”
সুতরাং, আক্কাস চরিত্রের মধ্যে যে অমিত সম্ভবনা ছিল, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তার অতি ক্ষুদ্রাংশকেই কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছেন।
হাসুনির মা
তার কোনো নাম নেই। সে পরিচিত হয়েছে তার পুত্রের মাতা হিসেবে। তার বাবা-মায়েরও এই একই দশাতাহের-কাদেরের বাপ, মা। সমাজে নিশ্চয়ই এই সব মানুষের নাম থাকে কিন্তু সমাজ তা একীভূত করে দেয় তাদের সন্তানের নামের মধ্যে।
তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো এই যে, সমাজের ওপর তলায় এটি ঘটে না, ঘটে কেবল গ্রামীণ নিম্নবিত্তদের মধ্যে। খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় স্ত্রী তানু বিবি বছর বছর সন্তান জন্ম দিয়েও তার নাম কিন্তু সন্তানের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় না, নাম বিলীন হয়ে যায় হাসুনির মায়ের।
উপন্যাসের শুরুতেই আমরা হাসুনির মাকে দেখি সহজ, সরল, অনাথ এক পরমদুখিনী নারী। বাবার সংসারে নিত্য অভাব। বাবা-মা সারাক্ষণ অকথ্য ভাষায় ঝগড়া এবং মারপিট করে। বিয়েও হয়েছিল তার। স্বামী মারা গেছে।
শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব খারপ বলে সেখানেও সে যেতে চায় না। অথচ পেটে তার ক্ষুধা। ক্ষুধা তো তার একার নয়, সাথে আছে তার শিশুপুত্র হাসুনি। সে যাবে কোথায়? বাবার বাড়িতে ভাত নেই, শ্বশুর বাড়িতে ঠাঁই নেই, কোথায় সে যাবে?
হাসুনির মার কাজ মিললো মজিদের বাড়িতেই। রহিমাকে সে খুব আপনজন বলেই মনে করে। তাই মুখ ফুটে তার কষ্টের কথাগুলো বলে। রহিমার কাছে। সে বলে, “আমার আর্জি এনারে কইবেন আমার যেন মওত হয়।….. জ্বালা আর সহ্য হয় না বুবু। আলাহ যেন আমারে সত্বর দুনিয়া থিকা লইয়া যায়।”
হাসুনির মার প্রতি মজিদের আদিম আবেগ, কামনা-বাসনা এবং তার প্রকাশ হিসেবে শাড়ি উপহার, যা কিনা রহিমা বুঝতে পারে, হাসুনির মাও বুঝতে পারে কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না করতে পারে না। স্মরণাতীত কাল থেকেই বাঙালি নারীকে সংসার করতে হলে সহ্য করতে হয়; আমরা দেখি, রহিমা সহ্য করেছে, হাসুনির মা-ও সব বুঝে না বোঝার ভান করে মজিদের বাড়িতেই দাসিবৃত্তি করে যাচ্ছে না করলে খাবে কী?
তবে কি হাসুনির মা পরিপূর্ণভাবেই একটি দুঃখবাদী চরিত্র? যতই সে নিজের মৃত্যু কামনা করুক, দূরের ধান ক্ষেতের তাজা রং হাসুনির মায়ের মনে পুলুক জাগায়। পাশের বাড়ির তেল চকচকে জোয়ান কালো ছেলেটাকে নিকা করার জন্য তার মন আনচান করে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যে চরিত্র সৃষ্টি করেছেন মানুষের বহির্জগৎ ও তার অন্তর্জগতের সমন্বয়ে হাসুনির মা তার বড় একটি দৃষ্টান্ত।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।