অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২ এর সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয়: অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস ও উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৪৭
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
২.০৫. লাহোর প্রস্তাব কী? এর বৈশিষ্ট্যসমূহ লেখ।
অথবা, লাহোর প্রস্তাব বলতে কী বুঝায়? এই প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অন্যতম। মুসলিম লীগের তৎকালীন সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়লাহোর প্রস্তাব : ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে “মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এটি লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত মুসলিম লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক। তিনি জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস নতুন খাতে অগ্রসর হয় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির দাবিই মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের ব্যাপারে মুসলিমদের চিন্তাধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।
আরোও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও তা বাঙালি জাতি প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়।
এছাড়াও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি হতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর পাকিস্তানে নানা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং একপর্যায়ে পাকিস্তান ভেঙে বর্তমান বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে।
লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য : ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ এ. কে. ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা : ১৯৪০ সালে প্রবর্তিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করে যে, ১৯৩৫ সালের আইনের যে সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা করা হয়েছে তা ভারতের উদ্ভূত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত অসংগত ও অকার্যকর।
তাই ভারতীয় মুসলমানগণের নিকট ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য হয়নি ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২ *
২. শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মুসলমানদের সম্মতি : লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভারতে মুসলমানদের সম্মতি ব্যতীত কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না।
এতে প্রয়োজনে সীমানার পুনর্বিন্যাস সাধন ও ভৌগোলিক দিক থেকে নিকটবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর সমন্বয়সাধনসহ ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে হবে।
৩. অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিতকরণ : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পাশাপাশি সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে বা এলাকাসমূহকে অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
৪. মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন : ১৯৪০ সালে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
৫. মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ : লাহোর প্রস্তাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে বলা হয় যে, লাহোর প্রস্তাবে যে সকল বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো পরবর্তীতে দেশের ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক বা শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা থেকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২ *
৬. মুসলিমদের অনুমোদন ও সম্মতি সংবলিত সংবিধান : লাহোর প্রস্তাবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে বলা হয় যে, প্রণীত সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা করতে হবে, নতুবা মুসলমানগণ অসন্তুষ্ট হবে।
আর ভবিষ্যতে যে সংবিধান রচিত হবে তাতে অবশ্যই মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি থাকতে হবে। তা না হলে কোনো সংশোধিত পরিকল্পনা মুসলমানদের নিকট অগ্রহণযোগ্য হবে।
৭. সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ : শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক তার লাহোর প্রস্তাবে বলেন যে, নতুনভাবে গঠিত রাষ্ট্রসমূহের বাইরে ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানে মুসলমানদের সাথে পরামর্শক্রমে তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার এবং স্বার্থ সংবিধানে সংরক্ষণে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮. সংখ্যালঘুদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত : লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়, নতুনভাবে গঠিত অঙ্গরাজ্যসমূহে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শাসনসংক্রান্ত অধিকার রক্ষা করার জন্য ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানে বিভিন্ন রকম রক্ষাকবচ উল্লেখ থাকতে হবে এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
৯. মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর সীমানা পরিবর্তন : ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর জন্য প্রয়োজনে পূর্বের সীমানার পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়।
১০. স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন অঙ্গরাজ্য : লাহোর প্রস্তাবের অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে বলা হয় যে, মুসলমানদের জন্য যেসব স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে তাদের সকল প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন প্রকৃতির।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুস্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, লাহোর প্রস্তাব মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল । ভারতীয় মুসলমানগণ বিভিন্ন সময়ে হিন্দুদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, পৃথক আবাসভূমি ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প কোনো পথ নেই।
মুসলমানদের এ চিন্তাধারার ফলতিই হচ্ছে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। লাহোর প্রস্তাবই মূলত স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের বীজ বপন করেছিল।
২.০৬. ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব ও ফলাফল আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য ও ফলাফল ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে তার মধ্যে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অন্যতম। এটি ছিল অনুন্নত মুসলমান সমাজের ভাগ্যোন্নয়নের এক অপূর্ব চাবিকাঠি।
বিশেষ করে লাহোর প্রস্তাবেই মুসলমানরা সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধভাবে জোরালো কণ্ঠে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি তথা স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানান। অবশ্য তাদের এ স্বতন্ত্র চিন্তাধারা অন্য কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের লোকের জন্য হুমকিস্বরূপও ছিল না। পরবর্তীতে লাহোর প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব : সকল দিক থেকে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা লাহোর প্রস্তাব পরবর্তীতে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক গুরুত্ব : লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার উদ্ভব ঘটায়। এতদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে দুটি রাজনৈতিক দল থাকলেও সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো একপক্ষীয়ভাবে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের রাজনীতি সমানভাবে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যার ফলে রাজনীতি নতুন ধারায় অগ্রসর হয়।
২. মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়। এতদিন হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পর মিলেমিশে চলত এবং নিজেদেরকে একই জাতীয়তাবোধের অধীন বলে মনে করতো।
কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুসলিম ঐক্যবোধের সূত্রে আবদ্ধ হয় এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়।
৩. মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এতদিন অনেক মুসলমান কংগ্রেসের অধীনস্থ ছিল কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানদের নিকট ‘কংগ্রেস হিন্দুদের দল’ এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে সকল মুসলমানই মুসলিম লীগের ছায়াতলে আশ্রয় নেয় ।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২ *
৪. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের প্রভাব : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। কেননা এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ মোট ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮টি আসন লাভ করে । অথচ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের আগে মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাত্র ১০৯টি আসন লাভ করতে সক্ষম হয় ।
৫. ভারত স্বাধীনতা আইন পাস : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থগত চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যার ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায় ।
এরূপ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার অনুধাবন করতে পারে যে, ভারতবর্ষের বিভক্তি ছাড়া সমস্যা সমাধানের আর কোনো পথ নেই। তাই লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করেই ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন রচনা করা হয়।
৬. পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সকল বন্ধনকে ছিন্ন করে ও সমস্ত বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যার ফলে লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাস্তব রূপ লাভ করে । মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি রচনামূলক প্রশ্নোত্তর সাজেশন
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর সাজেশন
৭. স্বাধীন বাংলার বীজ বপন : লাহোর প্রস্তাবই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিল। কেননা লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে পরবর্তীকালে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একাধিক জায়গায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয়।
কিন্তু বাংলার মুসলমানরা সর্বদাই লাহোর প্রস্তাবের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন করতে থাকে। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বলা হয়, বাংলার স্বাধীনতা অনেকাংশে লাহোর প্রস্তাবেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফল ।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল অলোচনা করা হলো :
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২ *
১. মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলমানদের ধ্যানধারণার মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। মুসলমানরা এখান থেকেই অনুভব করেন যে তাদের সাংবিধানিক নিরাপত্তার দরকার নেই। তারা সাংবিধানিক নিরাপত্তার পরিবর্তে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্বের দাবি জানায়।
১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে।
তারা ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হিসেবে পালন করে। এককথায় মুসলমানরা মনেপ্রাণে নিজস্ব রাষ্ট্রের আন্দোলনে মনোনিবেশ করে।
২. হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া : লাহোর প্রস্তাব হিন্দুদের জন্য প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ বলে সমালোচনা করেন। এককথায় হিন্দুরা লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রাখে ।
৩. ভারতবর্ষের বিভক্তি লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতবর্ষ বিভক্তির পথ অনেকটাই সুগম হয়ে যায়। এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগ পর্যন্ত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ মূলত অখণ্ড ভারতের জন্য যৌথভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন।
কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে তার ছেদ পড়ে। ব্রিটিশ সরকারও লাহোর প্রস্তাবের ফলে উপলব্ধি করেন যে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় রাখা হবে নির্বুদ্ধিতার শামিল। অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাব অখণ্ড ভারতের ধারণায় চির ধরায়।
৪. হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট : ব্রিটিশ ভারতে যদিও হিন্দু মুসলমানদের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব মৌলিক, তবুও হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ মোটামুটি ঐক্যবদ্ধভাবে অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন পরিচালনা করে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর হিন্দু ও মুসলমানদের এই ঐক্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়ে যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অসামান্য। এ প্রস্তাব অবহেলিত মুসলমানদের অধিকার আদায় ও আন্দোলনরত মুসলমান জাতির মধ্যে এক নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। তাই বলা যায়, যদি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত না হতো তাহলে হয়ত পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্র শুধু স্বপ্নই থেকে যেত।
প্রশ্ন ২.০৭ লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কী ছিল? এ প্রস্তাবের তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
অথবা, লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয় কী ছিল? এ প্রস্তাবের প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে লাহোর প্রস্তাব একটি। লাহোর প্রস্তাবই হচ্ছে একমাত্র প্রস্তাব যেখানে মুসলমানরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সর্বপ্রথম পৃথক আবাস ভূমির দাবি তোলে ।
এতদিন পর্যন্ত ভারতে যেসব রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল তা ছিল মোটামুটি হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধতার ভিত্তিতে রচিত। লাহোর প্রস্তাব এ ঐক্যের ভিত্তি ছিন্ন করে দেয় ।
লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় : লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ অধিবেশনের সুনিশ্চিত অভিমত এই যে, কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকর করা যাবে না বা মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যদি তা নিম্নরূপ মূলনীতির ওপর পরিকল্পিত না হয় । যথা :
ক. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসমূহকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
খ. এসব অঞ্চলকে প্রয়োজনমতো সীমা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে ভারতবর্ষে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যেসব স্থানে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সে অঞ্চলসমূহে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।
গ. স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম প্রকৃতির।
এছাড়া এ প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয়, “এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং ঔ অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে যথোপযুক্ত কার্যকর ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে করতে হবে।
ভারতবর্ষে মুসলমানগণ যেসব স্থানে খানে তাঁর সংখ্যালঘু সেসব স্থানে তাদেরও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করে যথোপযুক্ত কার্যকর ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে সংযুক্ত করতে হবে।”
লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য : সকল দিক থেকে লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য অত্যধিক । কেননা লাহোর প্রস্তাব পরবর্তীতে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হলো :
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২ *
১. রাজনৈতিক গুরুত্ব : লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার উদ্ভব ঘটায় । এতদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে দুটি রাজনৈতিক দল থাকলেও সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো একপক্ষীয়ভাবে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের রাজনীতি সমানভাবে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যার ফলে রাজনীতি নতুন ধারায় প্রবাহিত হয় ।
২. মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়। এতদিন হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পর মিলেমিশে চলত এবং নিজেদেরকে একই জাতীয়তাবোধের অধীন বলে মনে করতো।
কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুসলিম ঐক্যবোধের সূত্রে আবদ্ধ হয় এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করে।
৩. মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এতদিন অনেক মুসলমান কংগ্রেসের অধীনস্থ ছিল কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানদের নিকট ‘কংগ্রেস হিন্দুদের দল’ এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে মুসলমানরা মুসলিম লীগের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
৪. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের প্রভাব : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। কেননা এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ মোট ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮টি আসন লাভ করে ।
অথচ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের আগে মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাত্র ১০৯টি আসন লাভ করে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে।
৫. ভারত স্বাধীনতা আইন পাস : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থগত চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যার ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। এরূপ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার অনুধাবন করতে পারে যে, ভারতবর্ষের বিভক্তি ছাড়া সমস্যা সমাধানের আর কোনো পথ নেই।
তাই লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করেই ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন প্রণয়ন হয় ।
৬. পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সকল বন্ধনকে ছিন্ন করে ও সমস্ত বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় যার ফলে লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাস্তব রূপ লাভ করে। মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যতা লাভ করে।
অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২ *
৭. নবদিগন্তের সূচনা : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে এক নবদিগন্তের সূচনা করে। কেননা এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ভারতবর্ষ তার হাজার বছরের ইতিহাস ছিন্ন করে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় ।
৮. স্বাধীন বাংলার বীজ বপন : লাহোর প্রস্তাবই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিল। কেননা লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে পরবর্তীকালে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একাধিক জায়গায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয় ।
কিন্তু বাংলার মুসলমানরা সর্বদাই লাহোর প্রস্তাবের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন করতে থাকে । নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এটি সহজেই প্রতীয়মান হয় বাংলার স্বাধীনতা অনেকাংশে লাহোর প্রস্তাবেরই ফল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা লাহোর প্রস্তাব ভারতের পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই পরিবর্তন করে ফেলে।
এ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে মুসলমানরা তাদের প্রাণের দাবি স্বরূপ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে বাঙালিদের নানা আন্দোলনের প্রেরণাও ছিল এ ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব । এর প্রেক্ষাপটেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টি হয়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।