অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয়: পাকিস্তান : রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও বৈষম্য
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৩.০১. পাকিস্তানের প্রাদেশিক কাঠামো ও এর কার্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, পাকিস্তানের প্রাদেশিক কাঠামো ও এর কার্যাবলি বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় সকল বিষয়ে বৈষম্য দেখা দেয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্নক্ষেত্রে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান হতে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী পাচার করে পূর্ব পাকিস্তানকে আর্থিকভাবে দুর্বল করা হয়।
তাই এসব বৈষম্যের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের পাশাপাশি প্রাদেশিক শাসন কাঠামো গড়ে তোলা হয়। যাতে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য দূরীকরণ সহজ হয়।
পাকিস্তানের প্রাদেশিক কাঠামো ও এর কার্যাবলি : নিম্নে পাকিস্তানের প্রাদেশিক কাঠামো ও এর কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. গভর্নর জেনারেল : স্বাধীন পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রদেশগুলোতে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। প্রত্যেক প্রদেশের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত হয় গভর্নরের ওপর ।
গভর্নর প্রেসিডেন্ট কর্তৃক পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ প্রাপ্ত হতেন। তবে তিনি প্রেসিডেন্টের সন্তুষ্টিতে ৫ বছর সময়কাল গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত থাকতেন। গভর্নর অবশ্যই একজন মুসলমান এবং কম পক্ষে ৪০ বছর বয়স্ক হতেন
গভর্নরকে যেক্ষেত্রে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয় সেক্ষেত্র ব্যতীত তিনি মন্ত্রিসভার পরামর্শমতো দায়িত্ব পালন করতেন। প্রাদেশিক আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন এমন ব্যক্তিকে গভর্নর পদে নিয়োগ করতেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শমতো গভর্নর অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ দিতেন।
গভর্নর প্রদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে লোক নিয়োগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন। গভর্নর প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা, স্থগিত করা কিংবা পরিষদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। গভর্নরের সুপারিশ ব্যতীত কোনো অর্থ বিল পরিষদে উত্থাপনের সুযোগ ছিল না।
২. মন্ত্রিসভা : পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রতিটি প্রদেশে একটি মন্ত্রিপরিষদের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন আছে এমন ব্যক্তিকে গভর্নর নিয়োগ করতেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে অন্যান্য মন্ত্রীকেও গভর্নর নিয়োগ দান করতেন।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা প্রাদেশিক পরিষদের নিকট যৌথভাবে দায়ী থাকতেন। গভর্নরের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে মন্ত্রিসভার সুপারিশ ছাড়া গভর্নর কিছু করার ক্ষমতা রাখতেন না।
গভর্নরের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ছিল সীমিত। সে অর্থে মন্ত্রিপরিষদ ছিল সকল ক্ষমতার অধিকারী মন্ত্রিপরিষদের সভার সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের সভার সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব পালন করতেন।
৩. আইন পরিষদ : পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশে একটি এক কক্ষ বিশিষ্ট প্রাদেশিক আইন পরিষদ ছিল। এর আসন সংখ্যা ছিল ৩০০।
তবে পরবর্তী দশ বছরের জন্য আরও দশটি মহিলা আসন সংরক্ষিত ছিল। পরিষদের মেয়াদ সাধারণত পাঁচ বছর ছিল। প্রাদেশিক আইন পরিষদ ছিল প্রদেশে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। প্রদেশের জন্য সংরক্ষিত তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের অগাধ ক্ষমতা ছিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের।
প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ যেকোনো প্রকার কাজের জন্য প্রাদেশিক পরিষদের নিকট দায়ী ছিল। প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হতো। কোনো ব্যক্তি একই সময়ে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল না।
৪. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : তৎকালীন পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে যে প্রাদেশিক আইন পাস করা হয় তা পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
যাতে করে প্রাদেশিক সরকার স্বাধীনভাবে শাসনকার্য সম্পাদন করতে পারে এবং জনগণের উন্নয়ন ও সেবা দ্রুততর হয়। ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হবেন এবং সকল নির্বাচন হবে প্রাপ্তবয়স্কদের অংশগ্রহণ এবং সরাসরি ভোটে।
৫. ক্ষমতা বণ্টন : ১৯৫৬ সংবিধান অনুসারে পাকিস্তান ছিল একটি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। সে অনুসারে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের আইন প্রণয়নের ১৪৩টি বিষয় তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
যথা : ১. ফেডারেল তালিকা, ২. প্রাদেশিক তালিকা এবং ৩, সহ তালিকা। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যুদ্ধ, মুদ্রা, সামরিক বাহিনীর পূর্ত সাজ, প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত শিল্প, পারমাণবিক শক্তি ও তার উপাদানের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদ এবং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক উৎপাদনের বিষয়গুলো ইত্যাদি ছিল।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
ফেডারেল তালিকাভুক্ত। অতএব হিসাব করলে দেখা যাবে যে ফেডারেল তালিকায় মাত্র ৩০টি আইটেম অন্তর্ভুক্ত করা হলেও দেশের সিংহভাগ আর্থিক বরাদ্দ কেন্দ্রের হাতে ছিল।
৬. রাজস্ব : পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজস্বের বড় বড় উৎস যেমন বহিঃশুল্ক, আবগারি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক, আয়ব্যয় কর, ক্রয়-বিক্রয় কর, নৌ-বিমানবন্দর টারমিনাল কর, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর কর ইত্যাদি কেন্দ্রের হাতে রাখা হয়।
প্রদেশের হাতে যে রাজস্ব উৎস রাখা হয় তার তালিকা দীর্ঘ কিন্তু তা থেকে আয় খুব অল্প। যেমন কৃষিভূমি থেকে আয়সমূহ প্রদেশের হাতে রাখা হয়। আর এসব আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বেশি ছিল। আর এসব আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বেশি ছিল।
এ খাত প্রদেশকে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। দেশের ভিতর ও বাহির থেকে ঋণ সংগ্রহের ক্ষমতা কেবলমাত্র কেন্দ্রের হাতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আর এ ধরনের বৈষম্যমূলক আর্থিক বণ্টনে পূর্ব পাকিস্তান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
৭. মুদ্রা ব্যবস্থা : পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের জন্য দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করা হয়। আর এ ব্যবস্থা চালু করার পর মুদ্রা ব্যবস্থায় কমবেশি থাকে না। কেন্দ্র হতে আঞ্চলিক সরকারের হাতে এসে জমা হয় কারেন্সি। দুই অঞ্চলের জন্য চালু হয় দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় ব্যাংক।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে দেওয়া হয়। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সাথে সাথে ফেডারেল তহবিলে স্বাভাবিকভাবে জমা হয়। এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের ওপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে সংযুক্ত করা হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকায় প্রাদেশিক সরকাররা তাদের পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন না।
যেহেতু প্রাদেশিক সরকারকে নিয়োগ দান করেন কেন্দ্রীয় সরকার, তাই প্রাদেশিক সরকার মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণীত আদেশই বাস্তবায়ন করে। ফলে বৈষম্য বিলোপের আশায় কার্যত পরিপূর্ণ বিভাজিত প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক কাঠামো তা লাভ করতে পারেনি ।
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ৩
৩.০২ ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও উভয় প্রদেশের জন্য প্রথম সংবিধান রচিত হয় ১৯৫৬ সালে।
অর্থাৎ দীর্ঘ ৮ বছরের মধ্যে পাকিস্তান জনগণকে কোনো সংবিধান দিতে পারেনি। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হওয়ায় গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ তা ভেঙে দিয়ে ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠন করলেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং ২৩ মার্চ হতে তা বলবৎ করা হয়।
১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য : ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত পাকিস্তান সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচিত হলো :
১. লিখিত সংবিধান : ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান ছিল একটি লিখিত সংবিধান। এ সংবিধানের সকল অনুচ্ছেদ লিখিত আকারে ছিল।
২. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান : ১৯৫৬ সালের সংবিধান ছিল একটি দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান। জাতীয় পরিষদের সাধারণ দ্বারা সংশোধনী বিল উত্থাপন করা গেলেও তা পাস করতে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটের দরকার হতো।
৩. প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান : এ সংবিধানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান প্রেসিডেন্ট ছিলেন নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান ।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন। এতে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়।
৫. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা : এ সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলেও এতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিধান রাখা হয়।
৬. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা : ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে পাকিস্তানে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা ও অন্যান্য নির্বাচিত সংস্থার সদস্য নির্বাচনের বিধান রাখা হয়।
৭. মৌলিক অধিকার : এ সংবিধানে সমগ্র পাকিস্তানের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত করা হয়। নাগরিকদের অনুরোধক্রমে আদালতকে এসব অধিকার বলবৎ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
৮. মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের কেন্দ্র ও প্রদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রবর্তন করা হয় এবং মন্ত্রিপরিষদকে আইন পরিষদের নিকট দায়ী রাখার বিধান করা হয়।
৯. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত প্রবর্তন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় পাকিস্তান সর্বোচ্চ আদালত।
১০. সর্বজনীন ভোটাধিকার : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
১১. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানে প্রদেশ দুটিতে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হলেও প্রাদেশিক শাসনবিভাগ সংশ্লিষ্ট আইনসভার নিকট দায়ী থাকত।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
১২. ইসলামি প্রজাতন্ত্র : ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী কোনো অমুসলমান রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না এবং সব আইন অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হবে।
১৩. জরুরি বিধান : এ সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট প্রাদেশিক ক্ষমতা নিজে নির্বাহ করতে পারতেন।
১৪. সমতার নীতি : ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানে সমতার নীতি বাস্তবায়ন করে এর দুটি অংশের মাঝে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য রোধ করা হয় এবং সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
১৫. দুটি রাষ্ট্রভাষা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। এতে সাময়িকভাবে ইংরেজি কার্যকর থাকে।
১৬. বিচার বিভাগ : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছিল। একটি সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যেক প্রদেশের জন্য একটি করে হাইকোর্ট এবং নিম্নতর পর্যায়ে অন্যান্য অধস্তন আদালত প্রতিষ্ঠা করার বিধান রাখা হয়।
১৭. সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের আদর্শ গ্রহণ করা হলেও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্বাধীনতার দীর্ঘ নয় বছর পরে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাতিল হয়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে উক্ত সংবিধানের অধীনে কোনো নির্বাচন হওয়ার পূর্বেই এ সংবিধানকে বাতিল করে দেন। ফলে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থতায় পতিত হয়।
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ১
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ২
- অনার্স ১ম পর্ব (২১১৫০১-২য় অধ্যায়) রচনামূলক পর্বঃ৩
৩.০৩. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন কেমন ছিল? আলোচনা
অথবা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনতান্ত্রিক কাঠামো আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। এ নতুন রাষ্ট্র তার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়।
ব্রিটিশ আমলে ভারতের মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরি, প্রশাসনিক দক্ষতা, ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে ছিল। তবুও এ পিছিয়ে। পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে পাকিস্তান তার যাত্রা শুরু করে এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান রচনা করে।
এ সংবিধানে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং শাসনতান্ত্রিক অবকাঠামো সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন : পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল । যথা : কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা। নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. কেন্দ্রীয় শাসনতান্ত্রিক কাঠামো : পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ছিল ব্যাপক বৈষম্যপূর্ণ। ক্ষমতা বণ্টনে ব্যাপক পক্ষপাতিত্ব লক্ষ করা যায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কাঠামো গড়ে উঠেছিল। এখানে কেন্দ্রীয় সরকার ছিল ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন।
২. গভর্নর জেনারেলের ব্যাপক ক্ষমতা : ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুসারে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলকে ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। উক্ত আইন অনুসারে গভর্নর জেনারেলকে আইনের বিধিবিধান বাতিল ও পরিপূরণ করার ক্ষমতা ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রয়োগ করার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
এভাবে পাকিস্তানের প্রারম্ভে তার গভর্নর জেনারেলকে ব্যাপক সাংবিধানিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। পাকিস্তানের উপযোগী করে গৃহীত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের ওপর ন্যস্ত করা হয় ।
৩. মন্ত্রিসভা গঠন : গভর্নর জেনারেলকে তার কাজে সহায়তা করার জন্য তিনি একটি মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। মন্ত্রীগণ তার সন্তুষ্টি মতো সময়কাল অবধি তাদের পদে বহাল থাকবেন।
গভর্নর জেনারেল মন্ত্রীগণের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন বলে প্রত্যাশা করা হলেও আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। বিধান রাখা হয়, মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব আইনসভার আস্থা ভোটের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
৪. দপ্তর বণ্টন : গভর্নর জেনারেলের হাতে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিবিধ কার্যাবলি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বণ্টনের নিয়মকানুন প্রণয়নের ক্ষমতা ছিল। মন্ত্রীগণের মধ্যে ইচ্ছামতো দপ্তর বন্টনের ক্ষমতা তার ছিল।
তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা, অধ্যাদেশ জারি প্রভৃতি ক্ষমতাও লাভ করেন। তবে অধ্যাদেশগুলো পরবর্তী সময় কেন্দ্রীয় আইনসভায় অনুমোদন নিতে হতো, না হলে তা বাতিল হয়ে যেত।
৫. জেনারেলের একক নিয়ন্ত্রণ : পাকিস্তানের প্রদেশসমূহে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও প্রদেশসমূহে গভর্নর জেনারেলকে সীমাহীন কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। প্রাদেশিক গভর্নরকে নিয়োগ দান করতেন গভর্নর জেনারেল। গভর্নরের চাকরির স্থায়িত্বকাল নির্ভর করতো গভর্নর জেনারেলের মর্জির ওপর।
প্রকৃতপক্ষে, প্রাদেশিক গভর্নরগণ গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট হিসেবেই কাজ করতেন। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাও গভর্নর জেনারেলের ছিল।
যদি তিনি মনে করতেন যেকোনো প্রাদেশিক সরকার প্রচলিত আইনের বিধান অনুযায়ী চলতে পারছে না তাহলে তিনি উক্ত প্রাদেশিক সরকার ঘোষণার মাধ্যমে ভেঙে দিতে পারতেন এবং তার পক্ষ থেকে প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করতে প্রাদেশিক গভর্নরকে নির্দেশ প্রদান করতেন।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
৬. ‘বিল’ নিয়ন্ত্রণ : প্রাদেশিক আইনসভায় গৃহীত কোনো বিলে গভর্নর জেনারেল সম্মতি দিতে পারতেন, সম্মতি দানে বিরত থাকতে পারতেন কিংবা প্রাদেশিক আইনসভায় পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে গভর্নরকে নির্দেশ দিতে পারতেন। এভাবে প্রাদেশিক আইনসভায় গৃহীত যেকোনো বিলের বিষয় গভর্নর জেনারেল প্রাদেশিক গভর্নরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
৭. মন্ত্রণালয়ের গঠন কাঠামো : গভর্নর জেনারেল ছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তার একজন সহকারী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতেন। মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টনে তার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকত।
গভর্নর জেনারেলের প্রথম মন্ত্রণালয় গঠনকালে কিছু নতুন দপ্তর সৃষ্টি করেন। যেমন- রাজ্য ও সীমান্ত অঞ্চল মন্ত্রণালয়, বাস্তুত্যাগী ও শরণার্থী মন্ত্রণালয়। তবে গভর্নর জেনারেলগণ প্রথমে মন্ত্রণালয়গুলো নিজের অধীনেই রাখতেন।
৮. সামরিক বাহিনী : সামরিক বাহিনী থাকত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। দেশরক্ষা, বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগ মোকাবিলায় সামরিক বাহিনী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দায়িত্ব পালন করতেন। আর এসব সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
৯. গণপরিষদ গঠন : মাউন্টব্যাটেনের ১৯৪৭ সালে ৩ জুন পরিকল্পনায় পাকিস্তান সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হলে পাকিস্তানের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন অপরিহার্য হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নির্বাচিত যেসব সদস্য সংসদীয় এলাকা পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে পড়ে তাদের ভোটে গণপরিষদ সদস্য মনোনীত হন।
দশ লক্ষ লোকের জন্য একজন গণপরিষদ সদস্য এ হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৯ জন। ১৯৪৭ সালে যোগেন্দ্রনাথকে সভাপতি করে পরিষদের কাজ শুরু হয়।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সূচনা থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করতো। কেন্দ্রীয় সচিবালয় স্থাপন এবং নতুনভাবে প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তুলত। কেন্দ্র থেকেই পরিচালনা করা হতো শাসন কাঠামো। কেন্দ্রীয় সরকার ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ছিল।
কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপক ক্ষমতা তাদেরকে স্বৈরাচারী করে তোলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যদি প্রাদেশিক কার্যক্রমে তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাত তাহলে পাকিস্তান বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকত ।
৩.০৪. পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব বর্ণনা কর।
অথবা, পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : বহুভাষী এবং ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী ও ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাদের মধ্যে এক জাতি এক রাষ্ট্র’ এ চেতনাবোধ সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রের যাত্রালগ্নেই ঘটে এক অংশের প্রতি অন্য অংশের অবিশ্বাস ও সন্দেহ।
এ সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করার জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অস্বাভাবিক আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বিস্তার করে। তারা সামরিক ও বেসামরিক উভয় বিভাগেই প্রভাব বিস্তার করার পায়তারা করে।
পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব : পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অস্বাভাবিক প্রভাব বিস্তার করে। নিম্নে সামরিক আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বর্ণনা করা হলো :
১. সামরিক আমলাতন্ত্র : ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তান এক সুশৃঙ্খল সামরিক আমলা গোষ্ঠী লাভ করে। ব্রিটিশ আমলে এ আমলা গোষ্ঠীই ছিল প্রশাসনের সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।
দেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল আমলা গোষ্ঠী। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ শ্রেণি প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং তারা সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
২. পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস : ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির সময়ে পাকিস্তানের মুসলমান আইসিএস (ওঈঝ) অফিসারদের এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন পাঞ্জাবি, অবশিষ্টরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত অবাঙালি মুসলমান।
আর এদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস। তারা পাকিস্তান প্রশাসনের উচ্চতম পদগুলো দখল করেন। স্বভাবতই স্বাধীনতার সূচনালগ্নেই পাকিস্তান প্রশাসনে অবাঙালি মুসলমানদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে।
৩. সামরিক শাসনে সামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য : সামরিক শাসন জারির পর পাকিস্তানে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সামরিক আমলাদের প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যায়। সামরিক শাসনের সময় ৭৯০ জন জুনিয়র গ্রেড কর্মচারী নিয়োগ করা হয়।
যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিল মাত্র ১২০ জন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সময়কালের মধ্যে ১৪ জন সামরিক কর্মকর্তাকে বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি ।
৪. প্রতিরক্ষা বিভাগে আধিপত্য বিস্তার : স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিভাগের সকল শাখার সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রতিরক্ষা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোও ছিল সেখানে। প্রতিরক্ষা বিভাগে নাম লেখাতেই চলে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তাছাড়া রিক্রুটিং বোর্ডগুলো গঠিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে।
সৈনিক পদে নিয়োগের জন্য যে দৈহিক মাপ ও গঠন নির্ধারণ করা হয়েছিল তা খুব কম বাঙালির ছিল। ফলে প্রতিরক্ষা বিভাগে একমাত্র প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক আমলারা।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
৫. সামরিক বাহিনী : তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানি সামরিক আমলাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলো সেনাবাহিনী। আর এ সেনাবাহিনী ছিল প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনে যেখানে বাঙালিদের খুব কমই চাকরি দেওয়া হতো।
১৯৬৬ সালে দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সামরিক অফিসারদের মধ্যে ৫% ছিলেন বাঙালি আর বাকি ৯৫% ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫০ হাজার সদস্যের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ২০ হাজার। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি প্রশাসনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ পায় পশ্চিম পাকিস্তানি আমলারা।
৬. নৌবাহিনী : নৌবাহিনীতে ব্যাপক বৈষম্য ছিল। বিশেষ করে নিয়োগের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে টেকনিক্যাল লোক ছিল ১৯% বাঙালি এবং বাকি ৮১% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি নন টেকনিক্যাল লোকের মধ্যে বাঙালি ছিলেন ৯%।
৭. বিমান বাহিনী : পাকিস্তানের বিমান বাহিনীতে মাত্র ১১% বাঙালি পাইলট অফিসার এবং ১.৭% বাঙালি টেকনিশিয়ান ছিলেন। পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের মোট ৭২৮০ জন লোকের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ২৮০ জন এবং পিআইএ’র ১০ জন পরিচালকের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন এবং ৫ জন এরিয়া ম্যানেজারের সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি।
পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের ১০৩ জন বিমানবালার মধ্যে মাত্র ৪ জন ছিলেন বাঙালি এখানেও সামরিক আমলারা প্রভাব বিস্তার করতে থাকে ।
পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব : পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে বেসামরিক আমলারাও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন। নিম্নে বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বর্ণনা করা হলো :
১. অবাঙালি বেসামরিক আমলাদের প্রভাব : পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালের ৬ অক্টোবর এক আদেশে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তনের আদেশ জারি করেন।
কিন্তু এ আদেশ সত্ত্বেও প্রশাসনিক পদে পশ্চিম পাকিস্তানি ও পাঞ্জাবিদের প্রভাব বাড়তেই থাকে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২,০০০ কর্মচারী কর্মকর্তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২,৯০০ ।
২. গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক পদে নিয়োগ : প্রথমবারের মতো ১৯৬৫ সালে দুজন বাঙালিকে জাতীয় পরিষদ সচিবালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব করা হয়।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
১৯৬৬ সালে ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন শুরু হলে আরও চারজন বাঙালিকে সচিব নিযুক্ত করা হয়। তবে এবার বাঙালিদের স্বরাষ্ট্র, অর্থ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিযুক্ত করা হয়নি।
সম্পদের ভাগাভাগিতে বাঙালিদের অধিকার সম্বন্ধে যেন কেউ কোনো কথা বলতে না, পারে এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হতো না। আর এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা একক প্রভাব বিস্তার করতো।
৩. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে পাকিস্তানি আমলা : পাকিস্তানের বেসামরিক উচ্চপদে বাঙালি প্রতিনিধি কম থাকার কারণে তাদের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতাও কম ছিল । বেসামরিক আমলা অনুযায়ী ১৩টি কর্পোরেশনের মধ্যে মাত্র একটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাঙালি । অন্যদিকে, ১৯৬৩ সালের এক হিসাব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মাত্র ৩.৪% বাঙালি নিযুক্ত ছিলেন।
অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)*
পাকিস্তান রেলওয়ের ৮ জন বোর্ড ডিরেক্টরের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন বাঙালি । কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি এবং এসব বিভাগের সদর দপ্তরগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ।
কেন্দ্রীয় আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের ৮৯ জন এক্সিকিউটিভ অফিসারের মধ্যে মাত্র ১৬ জন ছিলেন বাঙালি এবং ৪৫ জন সহকারী আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ১৫ জন । এসব ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানি বেসামরিক আমলাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কম থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা একক প্রভাব বিস্তার করতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পশ্চিম পকিস্তানি আমলা তথা সামরিক ও বেসামরিক আমলারা পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণিরাও চেয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে সরকারি ও সামরিক কাজের থেকে দূরে রেখে স্বার্থ হাসিল করতে ।
যাতে পূর্ববাংলার জনগণ শাসন কার্যে অংশগ্রহণ করতে না পারে। আর প্রশাসনিকভাবে এ বিভাগগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে বাঙালি চাইলেও সে পদে আসীন হতে না পারে। তাই পশ্চিম পাকিস্তানি আমলারা রাষ্ট্রের সার্বিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতো।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।