স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয় : মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৯.০১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখ।
অথবা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বর্বর পাকবাহিনীর কাছে হারাতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ, অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত এবং অপরিমিত ধনসম্পদ। তবুও অর্জিত হয়েছে বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
তাই বাংলার মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর নির্যাতিত ও পরাধীনতার গ্লানিতে দগ্ধ মুক্তিপাগল মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : নিম্নে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ উল্লেখ করা হলো :
১. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি : ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর বিমাতাসুলভ আচরণ। করতে থাকে।
তারা প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাতৃভাষার অবমাননা করে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও তারা বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়। তাদের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শুরু হয় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন’ ।
শুধু ভাষার অধিকার কেড়ে নিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি; বরং কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য এবং চাকরিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি তারা বৈষম্য প্রদর্শন করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এরূপ বৈষম্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা পশ্চিমাদের প্রতি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, যার ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে শিক্ষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিসংগ্রাম।
২. মুক্তিযুদ্ধের সূচনা : পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে হিংস্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঢাকার পিলখানা, ইপিআর হেড কোয়ার্টার্স, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালায় মূলত তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। শুরু হয় দেশব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলন। এদেশের ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিক সকলেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
স্বাধীন বাংলা বেতারের জাতীয় সংগীত, সংবাদ বুলেটিন এবং চরমপত্র অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
৩. মুক্তিবাহিনী গঠন : মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অবিচার থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীর নেতৃত্বে সাবেক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবক, শ্রমিক প্রভৃতি সম্প্রদায় থেকে যুদ্ধে গমনেচ্ছুক লোকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়।
তাদের অনেকেরই যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যাপারে পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত সরকার তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। এভাবে মাত্র কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব অসুবিধা কাটিয়ে বাঙালি ছাত্র ও যুবকরা রণকৌশল শিখে নেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হওয়ার পর তারা অধিকৃত বাংলাদেশের বনে-জঙ্গলে, গ্রামে-গঞ্জে, শহর- বন্দরে ঢুকে পড়ে পাকবাহিনীর ওপর গেরিলা পদ্ধতিতে য় এবং প্রয়োজনে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারা আক্রমণ চালায় এবং এভাবে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করেছে। এসময় তাদেরকে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ বিভিন্নভাবে সহায়তা করে ।
৪. রাজনৈতিক দলসমূহের অবদান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। তাই দেশের সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এতে যোগ দেয়। অবশ্য এ সংগ্রামের সব রাজনৈতিক দলের সমান ভূমিকা ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাঙালি জনগণের যথার্থ প্রতিনিধি হওয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠন করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সার্বিক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মুজিবনগর সরকারকে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়ার জন্য ১৯৭ জন্য ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়।
এতে তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং আওয়ামী লীগের দুজন প্রতিনিধি ছাড়াও মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মনিসিং এবং কংগ্রেস দলীয় শ্রী মনোরঞ্জন ধরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৫. ভারতের সহায়তা ও সমর্থন : ভারত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার মানসে ভারতের বিরুদ্ধে ডিসেম্বর বিমান হামলা চালায় এবং মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে পরিণত করে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও ফায়দা লুটার চক্রান্ত করে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
কিন্তু তার সে চক্রান্ত সফল হয়নি। সাবেক সোভিয়েত রশিয়া ভেটো প্রয়োগ করে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। অতঃপর ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানে বিমান হামলার পর ৬ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করেন ।
৬. স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম : বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। এ সংঘবদ্ধ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়ে।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪-৩০ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজী পূর্বাঞ্চলের কমান্ডারের পক্ষ থেকে ৯৩ হাজার সৈন্যসহ মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে । এভাবে মাত্র কয়েক মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্বাধীনচেতা বাঙালি জাতি কখনও অপরের পরাধীনতা স্বীকার করে নেয়নি । পলাশির যুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর থেকে তারা বার বার স্বাধীনতা আদায়ের চেষ্টা করেছে। তাদেরকে বহুবার নির্যাতনের স্বীকারও হতে হয়েছে, কিন্তু তাই বলে থেমে যায়নি।
অবশেষে নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ও অশেষ আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটে। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা ।
৯.০২. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের কারণ আলোচনা কর।
অথবা, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ কী ছিল?
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রতিরোধে মধ্য দিয়ে শরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অবিশ্বাস্যভাবে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পরাজিত করে যুদ্ধে জয়লাভ করে। তুলনামূলক ছোট প্রতিপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করে বিজয় ছিনিয়ে আনে।
তবে বাংলাদেশের এ বিজয়ের পিছনে বেশকিছু উপাদান সক্রিয় ছিল, যার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ বিজয়ী হয় এবং স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের কারণ : নিম্নে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাংশের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১২০০ মাইল তিনদিকে শত্রুভাবাপন্ন ভারতীয় রাষ্ট্রসীমা দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান পরিবেষ্টিত। পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, যেখানে সহজেই ভারতীয় নৌবাহিনী প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। শুধু দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে বার্মার দিকে একটি ছোট মুখ খোলা আছে ।
কিন্তু অত্র অঞ্চলে কোনো সামরিক অপারেশন সম্ভব নয়। উপরন্তু বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া অসংখ্য নদনদী পাকিস্তান বাহিনীর জন্য ছিল আতঙ্ক। এ ধরনের ভৌগোলিক অবস্থা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। ফলে ভৌগোলিকভাবে যুদ্ধে পাকিস্তান পিছিয়ে ছিল। ও এর চেয়ে বেশি স্বেচ্ছাসেবক।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
এরূপ বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের মানসিকভাবে এগিয়ে দিয়েছিল যা যুদ্ধে জয়ের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ।
২. সৈন্যাধিক্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান বাংলাদেশে ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্য নিয়োজিত করেছিল। অপরপক্ষে, বাংলাদেশের ছিল ৭ কোটি মানুষ যাদের মধ্যে কিছু আবার সামরিক বাহিনীর সদস্য। বাকিরা সাধারণ নাগরিক হলেও যুদ্ধে পরোক্ষভাবে নিয়োজিত ছিল ।
তাছাড়া যুদ্ধে ভারত নিয়োজিত করে ১ লাখ ৯৫ হাজার সৈন্য । বাংলাদেশের ছিল ১ লাখ প্ৰশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
৩. আধুনিক রণকৌশল : যুদ্ধকৌশলের দিক থেকেই ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়ে এগিয়ে ছিল । বিমান শক্তিতে দেখা যায় ভারতীয় দশ স্কোয়াড্রনের টাস্কফোর্স গঠন করে। অথচ আগস্ট মাস থেকে নৌকমান্ডোদের অভিযানের জবাব দেওয়ার মতো পাকিস্তানের কার্যত কোনো নৌশক্তি ছিল না।
ভারতের যুদ্ধ কৌশলের সঙ্গে যোগ হয়েছে সোভিয়েত পরামর্শকের পরামর্শ। শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তাই বেশিক্ষণ পাকিস্তান টিকে থাকতে পারেনি। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই পর্যুদস্ত হয়ে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
৪. পাকিস্তানিদের মানসিক দুর্বলতা : পাকিস্তানি বাহিনী দীর্ঘদিন যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণে নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলে তারা দীর্ঘ ৮ মাস যাবৎ যুদ্ধে নিয়োজিত। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছে না। তাছাড়া দীর্ঘদিন এসব সৈন্য পরিবারের বাইরে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে মানসিকভাবে অনেক সৈন্য ভেঙে পড়েছিল, যার প্রভাব পড়েছিল রণাঙ্গনে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
৫. বাংলাদেশের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা চালায় তাতে সারা বিশ্বের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও সেদেশের জনগণ, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন।
ভারত, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনমত গড়ে ওঠে। জাতিসংঘও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এ বিশাল জনসমর্থন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে এবং একই সাথে পাকিস্তানি বাহিনী বিবেকের দংশনে দংশিত হতে হয়।
৬. প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অবদান স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান, ১ কোটি শরণার্থীদের আশ্রয় ও ত্রাণ ব্যবস্থায় সহযোগিতা, মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলাদের প্রশিক্ষণ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এ সরকারের বহির্বিশ্বে ব্যাপক তৎপরতার ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি জাগতে থাকে। এর ফলে যুদ্ধের শেষদিকে জাতিসংঘ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে ।
৭. বাঙালিদের গেরিলা যুদ্ধ : বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধের চেয়ে গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধে পারদর্শী ছিল । তাই তারা সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। বাংলাদেশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এ পদ্ধতি প্রয়োগে পারদর্শী ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
যেহেতু বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রাম এবং তা বনজঙ্গল, পাহাড়, মাঠ, নদী দ্বারা আকীর্ণ, সেহেতু গেরিলা পদ্ধতি প্রয়োগ করে সহজেই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয় ।
৮. সর্বাত্মক যুদ্ধ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং বাঙালির বিজয়ের আরেকটি কারণ উল্লেখ করা যায় মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি গণযুদ্ধ। এ যুদ্ধে কতিপয় ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী ছাড়া প্রায় সবাই বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, রসদ সরবরাহসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। এমনকি মহিলা, শিশু, কিশোররা এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নেয়। সমগ্র বাঙালি জাতি দুর্জয় দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করে। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ, নৃশংসতা ও পাশবিকতাকে আশ্রয় করে লক্ষ্যহীন যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
ফলে যুদ্ধে বাঙালির জয় আর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটে।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নয় মাস ধরে চলা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের একাগ্রতা, দেশপ্রেম সাধারণ মানুষের সাহায্য ও অনুপ্রেরণা, যুদ্ধকৌশল, ভারতীয় বাহিনীর উন্নত রণকৌশল, বিশ্ব জনমতের প্রভাব, পাকিস্তানের পরাজয় এবং বাংলাদেশের বিজয়ের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল।
তাছাড়া বাঙালির মানসিক চেতনা গড়ে উঠেছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, ঐতিহ্যগত সমৃদ্ধি থেকে এবং সুদীর্ঘ ইতিহাস চেতনা থেকে। যার ফলে প্রবল দেশপ্রেমে উজ্জীবিত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-অতিসংক্ষিপ্ত)
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-সংক্ষিপ্ত)
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-১
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-২
- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
৯.০৩. পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার বিবরণ দাও ।
অথবা, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার বিবরণ দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ নয় মাস দীর্ঘ ত্যাগ তিতিক্ষা, হত্যা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ প্রভৃতি ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ন্যক্কারজনক দিক হলো হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর গণহত্যা পরিচালনা।
গণহত্যাকে ইংরেজিতে বলে জেনোসাইড। ১৯৪৪ সালে জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহার করা হয়। গণহত্যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত যার কোনো ক্ষমা নেই ।
পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা : ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে গণহত্যা সংঘটিত করে। নিম্নে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরা হলো
১. অপারেশন সার্চলাইট : বাঙালিদের ওপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারটায় ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়। সে রাত ছিল। বাঙালিদের জন্য একটি ভয়ংকর ভীতিপ্রদ রাত। রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকহানাদার বাহিনী নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ট্যাংক, মেশিনগান ও মর্টার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ভীতসন্ত্রস্ত জনগণ আর্তনাদ শুরু করলে বুলেটের আঘাতে তাদেরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। ২৫ মার্চের মধ্যরাত্রি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত শহরে নির্বিচারে গণহত্যা ও অগ্নি সংযোগ চলে ১৮ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে তৈরি হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীল নকশা অনুযায়ী আরম্ভ হয়।.
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
এ সামরিক অভিযান। একমাত্র ২৫ মার্চ রাতে প্রায় লক্ষাধিক বাঙালিকে হত্যা করে রক্তাক্ত ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়।
২. গণহত্যার সম্প্রসারণ : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত হানাদারদের গণহত্যা চলতে থাকে। রাজাকার, শান্তিবাহিনী সংগঠিত হওয়ার পর গণহত্যার কার্যক্রম আরও পরিকল্পিতভাবে চলতে থাকে । বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই গণহত্যা চালানো হয়েছিল । অনেক জায়গায় একসঙ্গে মৃতদেহ গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়েছে যেগুলোকে আমরা গণকবর বলি।
এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় নিয়েও মানুষ হত্যা করে ফেলে রাখা হতো, যা বর্তমানে বধ্যভূমি নামে পরিচিত। যেমন- ঢাকার রায়েরবাজার বা শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমি। এরূপ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই গণহত্যার নিদর্শনস্বরূপ গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যাবে। জরিপে ১০০০ এর বেশি গণকবর ও বধ্যভূমির নাম ওঠে এসেছে।
৩. চুকনগরে সংঘটিত গণহত্যা : চুকনগরে সংঘটিত গণহত্যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যা। যেখানে এক দিনে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল । চুকনগর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত। এখানে অধিকাংশ জমি ছিল নিচু, বিল-ডোবায় ভর্তি। তবে চুকনগর থেকে সাতক্ষীরা সড়ক ধরে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার পথ আছে।
১৯৭১ সালে এ পথ ধরেই মানুষ বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে যেতে চেয়েছিল। ১৮/১৯ মে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষজন চুকনগরে রওয়ানা হয় এবং ২০ তারিখে চুকনগর এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ২০ মে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সবাই যাত্রার আয়োজন করছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
কিন্তু সকাল ১০টার দিকে হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে এসে পৌঁছায় এবং ট্রাক থেকে নেমেই গুলি করা শুরু করে। চুকনগর পরিণত হয় এক মৃত নগরীতে। মুহূর্তে বহু বাঙালি লাশ হয়ে যায়। ভদ্রা নদীর পানিতে বয় রক্তের নহর। অধিকাংশ লাশই ভদ্রা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
৪. ১৪ ডিসেম্বরের গণহত্যা : স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আরও একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর রাতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে রায়ের বাজারে হত্যা করা হয়।
পরাজয়ের পূর্বাভাস পেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মেধা সম্পদ বিনষ্ট করার নিমিত্তে এদেশীয় দোসরদের দ্বারা শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, নাগরিক সমাজের সদস্যবৃন্দ প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীদের গোপনে নামের তালিকা তৈরি করে এবং ১৪ ডিসেম্বর রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে।
সেদিন অগণিত বুদ্ধিজীবীকে রায়ের বাজারে নিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে উক্ত অঞ্চলকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে স্বাধীনতার পর রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গণহত্যার সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত ছিল এটি।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যাই গণহত্যা নামে পরিচিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাংলার মানুষ এ ভয়ঙ্কর । অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল।
পাক হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যে গণহত্যা শুরু করেছিল তার শেষ হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে। হানাদার বাহিনী নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। প্রায় ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। এখনো বাংলাদেশে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়।
৯.০৪. মুক্তিযুদ্ধকালীন নারী নির্যাতন সম্পর্কে যা জান লেখ ।
অথবা, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে নারীনির্যাতনের বিবরণ দাও ।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা আজ পুরো বিশ্বে আলোচিত। কারণ যুদ্ধে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা বিশ্বের বুকে চিরস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবলা নারীগণও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
নিজের সর্বস্ব দিয়ে তারা স্বাধীন করেছে এদেশকে। তাদের সম্ভ্রম আর ত্যাগের কারণেই আজকে স্বাধীন বাংলাদেশ। এসব নির্যাতিতা নারীরা আমাদের কারো মা, কারো বোন, আবার কারো স্ত্রী। সুতরাং এসব নির্যাতিতা শহিদ নারীদের গভীর শ্রদ্ধাভরে আমাদের স্মরণ করা উচিত । আর জীবিতদের সাহায্যার্থে আমাদের হাত প্রসারিত করা অবশ্য কর্তব্য ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীনির্যাতন : মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক নারী নির্যাতিত হয়। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধকালীন নারী নির্যাতনের সব দিক তুলে ধরা হলো :
১. নারীনির্যাতনের কারণ : পাকিস্তানের নির্মম সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তারা এদেশীয় দালালদের দ্বারা বাংলার নারীদেরকে পাকিস্তানি পশুদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদের শিবিরে ধরে নিয়ে যায়। পাকহানাদার বাহিনীর দালালরা এসব নারীদেরকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে যেত ।
কারণ পরবর্তীতে দালালরা সুযোগ সুবিধা পাবে। এদেশীয় দালালদের দ্বারাই এদেশীয় নারীরা নির্যাতিতও কম হতো না। স্বামী সন্তান যুদ্ধে গিয়েছে এ সুযোগে পাকিস্তানি হানাদাররা ও এদেশীয় দালালরা সুযোগ বুঝে অসহায় সেই নারীদের নির্যাতন করতো। তাছাড়া প্রিয় ব্যক্তিকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে নারীদের নির্যাতন চালানো হতো ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
২. নারীনির্যাতনের প্রকৃতি : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা ব্যাপক হারে নির্যাতিত হয়েছে তা প্রায় সকলেই অবগত, তারপরও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনলে গা শিউরে ওঠে। বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কাজকর্মের সাথে জড়িত অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, “আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না।
অনেক ক্যাম্পে নাকি মেয়েরা গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাই আমাদের পরনে শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ । যেমন ময়লাযুক্ত তেমনি আবার ছেঁড়া, মাঝে মাঝে দোকান থেকে খাবার এনে আমাদের মাঝে ঢালাওভাবে ছুড়ে দিতো। আমাদেরকে দল বেঁধে ধর্ষণ করতো।
এক মেয়ের সামনে আরেক মেয়েকে ধর্ষণ করতো। আমাদের সম্মান বলতে কিছু ছিল না।” ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতনের এ ধরনের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায় ।
৩. নির্যাতিত নারীদের সংখ্যা নির্ণয় : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়ান ডা. জিও ডেভিসের প্রতিবেদন হতে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তিনি নির্যাতিত নারীদের সেবাদানের জন্যই বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার হিসাব মতে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা কম নয়।
সরকারি হিসাব মতে ধর্ষিতা মহিলাদের আনুমানিক সংখ্যা ২ লাখ। অন্তঃসত্ত্বা মহিলা ২ লাখ ছিলেন বলে ড. ডেবিস মত প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তৈরিকৃত এক বিদেশি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখের মতো।
ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসির মামুন তার ‘বীরাঙ্গনা ১৯৭১’ শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যতিত নারীর সংখ্যা আনুমানিক ৬ লাখের কাছাকাছি।
৪. নির্যাতিত নারীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভক্তি ক্স ১৯৭১ সালে নির্যাতিত নারীদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার অভিভাবক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বীরাঙ্গনাদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা বিনষ্ট করে ফেলুন, কারণ সমাজ এদের গ্রহণ করবে না।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৯ম-রচনামূলক)পর্বঃ১ *
তিনি বুঝতে পেরেছেন মুক্তিযুদ্ধ হলেও সমাজের মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত নারীদের মর্যাদা দিতে চাইলেও তিনি সফল হননি। তবে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন।
৫. ‘৭১ এর নির্যাতিত নারীদের বর্তমান অবস্থা : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব নারীরা নির্যাতিত হয়েছে, যারা ইতোমধ্যে মারা গিয়েছে, বলা যায় সমাজের চাপ থেকে তারা রক্ষা পেয়েছে। যারা বেঁচে আছে তারা প্রতিনিয়ত সমাজে অপমানিত হচ্ছে। সমাজ তাদেরকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে, পরিবারে তাদের কোনো আশ্রয় নেই।
এমনকি এমন নির্যাতিতা মহিলারা আছে তাদেরকে বীরাঙ্গনা বলে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার এসব নির্যাতিতা মহিলাদের পুনর্বাসন ও তাদের সাহায্যের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, আর যারা জীবিত আছে তারা আমাদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্রী, কিন্তু যেসব মহিলারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সম্মান হারিয়েছে আমরা তাদের হেয় চোখে দেখি। মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো নারীদের প্রতি আমাদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। কারণ তারা দেশের জন্য সম্ভ্রম হারিয়েছেন। তাদের এ ত্যাগ জাতি কখনও ভুলবে না।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।