স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩ প্রশ্নোত্তর ও সাজেশন সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিভাগ: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
বিষয় : জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধিকার আন্দোলন
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
৬.০৮. বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৬ দফার গুরুত্ব আলোচনা কর ।
অথবা, বাঙালির জাতীয় জীবনে ৬ দফার তাৎপর্য উল্লেখ কর
উত্তরঃ ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের তথা বাঙালিদের অনেক ত্যাগ করতে হয়েছিল। এসময় বাঙালিরা যথার্থ সংযমের পরিচয় দেয়।
কিন্তু পরবর্তীকালে বাঙালিরা তাদের ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে কিছুই পায়নি; বরং দীর্ঘদিন ধরে তারা যে করুণার শিকার হয়ে আসছিল তার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়।
এসময় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শুরু করে সকল প্রকার অন্যায় ও অবিচার থেকে মুক্তি দিতে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৬ দফার গুরুত্ব : জাতীয়তাবাদ বলতে এমন এক ধরনের ব্যবস্থাকে বুঝায় সেখানে একটি অঞ্চলের জনগণ সকল প্রকার ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত বিভেদ ভুলে সম্পূর্ণ দেশপ্রেমের ভিত্তিতে একই আদর্শে উজ্জীবিত হয়।
আর এ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৬ দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিম্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৬ দফা দাবির গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণতা লাভ : ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় ৬ দফা আন্দোলন সেই জাতীয়তাবাদকে অনেকাংশে পূর্ণতা দান করে।
কেননা ভাষা আন্দোলনের পর ৬ দফা আন্দোলনই হচ্ছে একমাত্র আন্দোলন যেখানে, বাংলার সকল শ্রেণি পেশার লোক অংশগ্রহণ করে ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
বাঙালিরা তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয় এবং ৬ দফা কর্মসূচির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে বিকশিত করার প্রয়াস পায় ।
২. জাতীয় অধিকার আদায়ের সনদ : বাঙালি জনগণের জাতীয় অধিকারের সনদস্বরূপ ছিল ৬ দফা। লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে বাঙালি যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টিতে সে স্বপ্ন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায় ।
পূর্ববাংলার জনগণ নানাভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসন, শোষণ ও বঞ্ছনার শিকার হয় । পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হরণ করে বাংলার মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার।
ঠিক এসময়ে ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হলে বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে সাড়া দেয় এবং তাদের জাতীয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়।
৩. বাঙালিদের মুক্তির সনদ : ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালির ম্যাগনাকার্টা। এ আন্দোলনের পিছনে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি কর্মকর্তা ও ছাত্র-জনতার সমর্থন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
কেননা ৬ দফায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থেকে শুরু করে জনগণের ভোটাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়। তাই ৬ দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরও সুসংগঠিত করে।
৪. বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন : মূলত ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ।
পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতো।
তারা বাংলার মানুষকে সুশাসন তো উপহার দেয়নি; বরং জনগণের সকল প্রকার মৌলিক অধিকার হরণ করে । এমন সময় ৬ দফা আন্দোলন বাংলার জনগণের কাছে আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে দেখা দেয়।
সব বাঙালি উপলদ্ধি করতে পারে যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ টিকিয়ে রাখতে ৬ দফার কোনো বিকল্প নেই।
৫. ঐক্যবদ্ধ চেতনার বহিঃপ্রকাশ : বাঙালিদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনাবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৬ দফা দাবির প্রবক্তা ৬ দফা ঘোষণা করেই শুধু বসে থাকেননি বরং তিনি এটিকে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনে পরিণত করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
এসময় বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বঙ্গবন্ধু সফর করেন এবং ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তিনি বাংলার জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হন যে ৬ দফাই হচ্ছে বাংলার মুক্তির সনদ এবং কেবলমাত্র ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই তা আদায় করা সম্ভব।
যার ফলে ৬ দফা আন্দোলন এমন ঐক্যবদ্ধ রূপ ধারণ করেছিল যে, পরবর্তীতে সরকারের ব্যাপক দমননীতি বাংলার জনগণকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
৬. নতুন আন্দোলন সৃষ্টিতে প্রেরণা দান : ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিদের জাতীয়তাবোধ এতটাই বিকশিত হয় যা পরবর্তীতে নতুন আন্দোলন সৃষ্টিতে প্রেরণা জোগায়। ১৯৬৯ সালে যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় তার মূল প্রেরণা ছিল ৬ দফা আন্দোলন ।
তাছাড়া ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফাকে তাদের নির্বাচনি ইশতাহার হিসেবে ঘোষণা করে। জনগণ ৬ দফায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় এবং ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ।
আওয়ামী লীগের এ বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবোধকে আরও এক ধাপ অগ্রসর করে ।
৭. সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি : বাংলার জনমনে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ তৈরি করে ৬ দফা আন্দোলন। যখন ৬ দফা দাবিতে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিচ্ছিল ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি সরকার বাংলার জনগণের ওপর ব্যাপকভাবে চড়াও হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
শুরু হয় ধরপাকড় ও নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলার জনগণ পিছু হটেনি । আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ মুজিব থেকে শুরু করে প্রথম সারির সকল নেতা গ্রেফতার হলেও আন্দোলন থেমে থাকেনি।
বাংলার জনগণ তখন সংগ্রামী মনোভাবে পুরোপুরিভাবে নিজেদের অধিষ্ঠিত করে।
৮. স্বাধীনতার চেতনার জন্ম : বাঙালি জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টি হয় ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে এমনকি ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের দাবি এক সময় স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়।
৬ দফা ছিল বাঙালি জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ও সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তি লাভের প্রেরণার বাতিঘর।
তাই ৬ দফা একসময় গণমুখী আন্দোলনে পরিণত হয়। এ ৬ এ ৬ দফার ওপর ভিত্তি করেই জনগণ সকল সরকারের দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
৯. চূড়ান্ত জনগণ তাদের জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ ঘটায় এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও চরম জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ অকুতোভয় বীর বাঙালিদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালির পরম আরাধ্য স্বাধীনতা ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ৬ দফা দাবির গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
৬ দফা দাবি বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের যে বিকাশ ঘটিয়েছিল এবং জনগণকে আন্দোলনের সাথে একাত্ম করেছিল তারই ভিত্তিতে এক সময় আমরা লাভ করি স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই একথা সহজেই বলা যায় যে, ৬ দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ ।
৬.০৯. ৬ দফা কর্মসূচির বর্ণনা দাও। তুমি কি মনে কর ৬ দফার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল?
অথবা, ৬ দফা কর্মসূচির বিবরণ দাও। ৬ দফার মধ্যেই কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল?
উত্তরঃ ভূমিকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির ভূমিকা অনন্য সাধারণ। এ কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করে।
৬ দফা ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক । ৬ দফাতে পাকিস্তানকে ভাঙতে চাওয়া হয়নি, চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে। ৬ দফা ছিল বাঙালির প্রাণের দাবি
৬ দফা কর্মসূচি : তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে লাহোরে নিম্নলিখিত দাবিগুলো উত্থাপন করেন । যথা :
প্রথম দফা—সাংবিধানিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নপূর্বক পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে— সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হবে সংসদীয় প্রকৃতির এবং সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাগুলোর সার্বভৌমত্ব থাকবে।
দ্বিতীয় দফা—ক্ষমতা বণ্টন : ফেডারেল (কেন্দ্রীয়) সরকারের হাতে কেবল দুটি বিষয়ের ক্ষমতা থাকবে। যথা— দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রসংক্রান্ত, অবশিষ্ট বিষয়ের ক্ষমতা পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
তৃতীয় দফা-মুদ্রা ব্যবস্থা : মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করে যেকোনো একটিকে গ্রহণের দাবি করা হয়। বলা হয় (ক) পাকিস্তানের দুঅঞ্চলের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক অথচ প সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে।
দুঅঞ্চলের দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। অথবা, (খ) দুঅঞ্চলের জন্য অভিন্ন মুদ্রা থাকবে তবে সংবিধানে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান হতে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে।
পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুঅঞ্চলের জন্য দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১)
- অনার্স ১মঃ ৩য় অধ্যায় রচনামূলক প্রশ্নোত্তর (২১১৫০১) (পর্ব-১)
চতুর্থ দফা—রাজস্ব কর ও শুল্কসংক্রান্ত ক্ষমতা : সকল প্রকার কর, খাজনা ধার্য এবং আদায় করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।
পঞ্চম দফা—বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমতা : এ দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নোক্ত সাংবিধানিক বিধানের সুপারিশ করা হয়—
ক. দুঅঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব থাকবে।
খ. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে।
গ. ফেডারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমানভাবে অথবা সংবিধানে নির্ধারিত হারে আদায় হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
ঘ. দেশজ দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে দুঅঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করা চলবে।
ঙ. ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে।
ষষ্ঠ দফা-আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন : এ দফায় উল্লেখ করা হয় যে, অঙ্গরাজ্যগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ দান এবং আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য।
সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে ৬ দফার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল কি না : ৬ দফা ছিল বাঙালির ম্যাগনাকার্টা।
৬ দফা ঘোষণার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে গবেষকগণ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, যদিও এটি ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি, কিন্তু পরবর্তীতে এটি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের দিকে ধাবিত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
কেননা ৬ দফা দমন করার জন্য পাকিস্তান সরকার প্রচণ্ড দমননীতি গ্রহণ করলে জনগণের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুভূতি প্রবল আকার ধারণ করে এবং বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন তাদের আশা- আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক।
১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়ার চক্রান্ত করলে তাকে মুক্তির জন্য যে আন্দোলন শুরু হয় তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্ররা এগারো দফা দাবি উত্থাপন করে। এ এগার দফার মাধ্যমে ৬ দফাকেও অনুমোদন করা হয়েছিল।
অতঃপর ৬ দফা ও এগারো দফার সমন্বিত আন্দোলন দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটায় এর ফলে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন ঘটে।
নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান জনতার দাবির মুখে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেয় এবং নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফাভিত্তিক নির্বাচনি ইশতাহার ঘোষণা করে ।
নির্বাচনে জনগণ ৬ দফার পক্ষে রায় দেয় আর ৬ দফার বিরোধিতাকারী দলগুলোর শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
নির্বাচনে জয় লাভ করার জন্য আওয়ামী লীগ যখন ৬ দফার আলোকে সংবিধান প্রণয়নের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এদেশের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ৬ দফা কেন্দ্রিক আন্দোলন দমন করার পাকিস্তানি পদক্ষেপের ফলেই বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরে এসে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যেখানে ৬ দফা কর্মসূচির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ৬ দফা দাবির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি। ৬ দফার দাবিগুলো ছিল বাংলার আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি। তবে ৬ দফার মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি ছিল তা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়।
তারপরও দফার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল। ৬ দফাভিত্তিক কর্মসূচির পথ বেয়েই বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
৬.১০. আগরতলা মামলার কারণ কী ছিল? এ মামলার উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, আগরতলা মামলার কারণ উল্লেখ কর। এ মামলার উদ্দেশ্যসমূহের বিবরণ দাও ।
উত্তরঃ ভূমিকা : আগরতলা মামলা ছিল পাকিস্তানি শাসনামলের সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও প্রহসনমূলক ঘটনা।
১৯৬৬ সালে উত্থাপিত হয় ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে যখন গণআন্দোলন জোরদার হতে থাকে তখনই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আন্দোলনকে স্তিমিত করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উৎখাতের জন্য প্রহসনমূলক এ মামলা দায়ের করেন।
পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব শূন্য করে এ অঞ্চলে আইয়ুব খানের ক্ষমতা ও প্রভাব সুদৃঢ় করার সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনকেই বলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ।
আগরতলা মামলার কারণ : আগরতলা মামলা ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। যার পিছনে বেশকিছু কারণ বিদ্যমান ছিল। নিম্নে আগরতলা মামলার কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. প্রচার মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ : আইয়ুব খান সরকার সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যা প্রচার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের একটি অপপ্রয়াস ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
জনগণের মতামত প্রকাশের পথ বন্ধ এবং মৌলিক অধিকার হরণ করে, যার ফলে তীব্র গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয় যা দমনের জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।
২. ৬ দফার আন্দোলনকে নস্যাৎ : ৬ দফার আন্দোলন থামানো ছিল এ মামলার প্রধান উদ্দেশ্য। ৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ। বাঙালির বেঁচে থাকার দাবি ছিল ৬ দফা।
৬ দফা দাবির ফলে যে গণআন্দোলন শুরু হয় তা দমন করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। পাকিস্তান সরকার ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও পাকিস্তান ভাঙনের দাবি বলে ঘোষণা করে।
দফা দাবি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক উপেক্ষিত হলে পূর্ববাংলার আপামর জনতা তীব্র আন্দোলন শুরু করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়।
৩. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন : পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতির ফলে। যা আইয়ুব সরকারকে ভাবিয়ে তোলে।
এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করার জন্য আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়, যা চক্রান্ত ছাড়া কিছুই নয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
৪. শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত : শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করা ছিল আগরতলা মামলার অন্যতম কারণ। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা ।
শেখ মুজিব সকল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সুদৃঢ় করে, যা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য অস্বস্তিকর ছিল । যা আগরতলা মামলার অন্যতম কারণ ছিল।
৫. শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা : আগরতলা মামলা ছিল পাকস্তানিদের শাসন ও শোষণ পাকাপোক্ত করার একটি হাতিয়ার।
এসময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এমন একটি ধারণা তৈরি হয় যে, শেখ মুজিবকে দমন করতে না পারলে তাদের অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সবই বন্ধ হয়ে যাবে।
এমতাবস্থায় আগরতলা মামলা দায়ের করে তারা শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখতে চায়।
৬. গণআন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত : ৬ দফাভিত্তিক গণআন্দোলন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন যখন সর্বস্তরে প্রসার লাভ করেছিল তখনই সরকার রবীন্দ্রসংগীত ও পহেলা বৈশাখ নিষিদ্ধ এবং আরবি হরফে বাংলা চালুর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যার ফলে আন্দোলনের গতি বহুগুণে বেড়ে যায়।
এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান ৬ দফা আন্দোলন এক গণআন্দোলনে পরিণত হয়। সরকার এ গণআন্দোলনের দাবিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়।
আগরতলা মামলার উদ্দেশ্য : আগরতলা মামলা ছিল ষড়যন্ত্রমূলক মামলা এর পিছনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মূলত উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ :
১. আন্দোলন দমনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অবদমিত করা ।
২. পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রতি এ মনোভাব সৃষ্টি করা যে বাঙালিরা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে বিভেদ ও ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দেওয়া।
৪. শেখ মুজিবকে রাজনীতির ময়দান হতে বিতাড়িত করা ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস (৬ষ্ঠ-রচনামূলক)-৩
৫. আসামিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা প্রচার করে রায় প্রদত্ত হলে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক উত্থান প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং গণসমর্থন সরকারের পক্ষে চলে আসবে । এর ফলে পরবর্তী নির্বাচনে আইয়ুব খান ও তার কনভেনশন মুসলিম লীগের বিজয় সুনিশ্চিত হবে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, । আগরতলা মামলার পর বাংলার জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তিকে পূর্ণভাবে পদদলিত করতে শেখে।
তাছাড়া বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, আসামিদের সাহসিকতা ও সরকারের দুর্বল অভিযোগ জনগণকে আরও উত্তেজিত ও সাহসী করে তোলে ।
এসময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেওয়ায় আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব গ্রহণ করে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ। অবশেষে সরকার বাধ্য হয়ে ১৬৬৯ বাধা সালের ২২ মার্চ এ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।