স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১ সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিষয়: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
অধ্যায় ১: দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয়
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
১.০১. বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি বর্ণনা দাও?
অথবা, বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তর: ভূমিকা: পৃথিবীর একক বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। পশ্চিম-উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে একযোগে এ সুবিশাল ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে।
সীমিত উচ্চভূমি ছাড়া সমগ্র দেশ এক বিস্তীর্ণ সমভূমি। এদেশের সমভূমি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু। ফলে এ দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী এবং উপনদী শাখাগুলো উত্তর দিক হতে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে পতিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য : বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ভুুমির পার্থক্য ও গঠনের দিক বিবেচনা করে তিনটি প্রধান প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ: রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম সিলেট মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার পাহাড়গুলো টারশিয়ারি যুগের। ধারণা করা হয় তার টারশিয়ারি যুগের হিমালয় পর্বত গঠিত হওয়ার সময় মায়ানমারের দিক থেকে আগত গিরিজনি আলোড়ন এর ধাক্কায় ভাজগ্রস্ত হয়ে এসব পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে।
তাই এদের টারসিয়ারী পাহাড় বলা হয়। এই পাহাড়ি অঞ্চল কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ক. উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ ও খ. দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
ক. উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ: এ অঞ্চলের অন্তর্গত পাহাড় গুলো হল ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা জেলার উত্তরাংশ ,সিলেট জেলার উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশে এবং মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এর দক্ষিণাংশের ছোট-বড় বিচ্ছিন্ন পাহাড়গুলো। শেরপুর ও ময়মনসিংহের উত্তর সীমানা কিছু কিছু পাহাড় রয়েছে যার মধ্যে চিকনাগুল, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া উল্লেখযোগ্য।
সিলেট জেলার পাহাড়ি অঞ্চল সিলেট শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে ১৮৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ দক্ষিণ সীমানায় অবস্থিত পাহাড়ের ঢালগুলো এবং উপরিভাগ অসমান এদেরকে ত্রিপুরা পাহাড় বলে।
খ. দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ: এ অঞ্চলের অন্তর্গত হল খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং চট্গ্রামের অংশবিশেষ। এ পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ২৭০ ফুট। বান্দরবানে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ তাজিংডং (বিজয়) যার উচ্চতা ৪,০৩৯ ফুট। এবংদ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং যার উচ্চতা ৪,০৩৫.৪৩ ফুট।
বান্দরবানের অপরদিকে উচ্চতর পাহাড়চূড়া হচ্ছে মোদকমুয়াল ১০০০ মিটার ও পিরামিড ৯১৫ মিটার । এসব পাহাড় বেলে পাথর , শিল কর্দম দ্বারা গঠিত।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
২. প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ চত্বরভূমি: প্রায় ২৫ হাজার বছর পূর্বে প্লাইস্টোসিনকালের শতাংশ অথবা চত্বরভূমি আন্ত বরফ গলা পানিতে প্লাবিত হয়ে গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এ অঞ্চলের মাটির রং লাল ও ধূসর।নিচে প্লাইস্টোসিনকালের সোপান বা চত্বরভূমির বর্ণনা দেওয়া হল:
ক. বরেন্দ্রভূমি: প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে প্রাচীনতম ভূমি বরেন্দ্রভূমি। রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৯৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত। প্লাবন সমভূমি থেকে এর উচ্চতা ৬ থেকে ১২ মিটার। বঙ্গ অববাহিকার সর্ববৃহৎ প্লাইস্টোসিনকালের উচু ভূমি। এলাকার ভূমি অসমতল এবং কাঁকরময়।
খ. মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়: মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এর বিস্তৃতি উত্তরের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে দক্ষিনে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত অর্থাৎ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর অঞ্চলজুড়ে এর মোট আয়তন ৪১০৩ বর্গ কিলোমিটার। মাটির মিশ্রীত ও লাল।
প্লাবন সমভূমি থেকে এর পূর্ব ও দক্ষিণ অংশের উচ্চতা ৬ মিটার কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর দিকের উচ্চতা ৩০ মিটার। মধুপুর গড়ের অঞ্চলটি পাহাড়ের ক্ষয়িত অংশবিশেষ।
গ. লালমাই পাহাড়: লালমাই পাহাড় কুমিল্লা শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিনে লালমাই থেকে ময়নামতি পর্যন্ত বিস্তৃত। লালমাই পাহাড়ের আয়তন প্রায় ৩৪ বর্গ কিলোমিটার এবং গড় উচ্চতা এক মিটার লালচে এবং বালু ও কঙ্কর দ্বারা গঠিত।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
৩. সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি: টারশিয়ারি যুগের পাহাড় সমূহ এবং প্লাইস্টোসিনকালের সোপান সমূহ ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ নদীবিধৌত এক বিস্তৃর্ণ সমভূমি এ সমভূমির আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার ২৬৪ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের উত্তরাংশ থেকে সাগর উপকূলের সমভূমির ঢাল ক্রমনিম্ন সুন্দরবন অঞ্চলে সমুদ্র সমতলে অবস্থিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন:
ক. কুমিল্লা সমভূমি: কুমিল্লা,চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধিকাংশ এবং লক্ষীপুর, নোয়াখালী , ফেনী ও হবিগঞ্জ জেলার কিছু অংশ জুড়ে অবস্থিত কুমিল্লা সমভূমির মোট আয়তন ৭৪০৪ বর্গকিলোমিটার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে হতে উচ্চতা ৩.৬ মিটার ৬ মিটার ভূমির বন্ধুরতা এবং বর্ষাকালে প্রায় ডুবে থাকে।
খ. সিলেট অববাহিকা: এ অঞ্চলের গঠিত সিলেট সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার অধিকাংশ এবং কিশোরগঞ্জ নেত্রকোনা জেলার পূর্ব দিকের সামান্য অংশ নিয়ে এটি সংশ্লিষ্ট প্লাবন সমভূমি হতে অপেক্ষাকৃত নিচু সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে অববাহিকার উচ্চতা প্রায় ৩মিটার।
গ. পাদদেশীয় পলল সমভূমি : এ সমভূমি বিস্তৃত বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বৃহত্তম রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অধিকাংশ স্থান জুড়ে হিমালয় পর্বত থেকে আগত পলল দ্বারা এ অঞ্চল গঠিত। তিস্তা, আত্রাই, করতোয়া প্রভৃতি নদীবাহিত পলি জমা হয়ে ঢালু ভূমি সৃষ্টি হয়েছে। এ সমভূমি পাদদেশীয় সমভূমি পলল নামে পরিচিত।
ঘ. গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা প্লাবন সমভূমি: এ প্লাবন সমভূমির বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলের অংশবিশেষ নিয়ে বিস্তৃত। এ অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানেই বর্ষার পানিতে ডুবে যায়। এটাই বাংলাদেশের মূলত প্লাবন সমভূমি। পদ্মা নদীর উত্তরে প্লাবন সমভূমির বাকি অংশে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার প্লাবন সমভূমি নামে পরিচিত।
ঙ. বঙ্গভূমি অঞ্চলীয় সমভূমি : সাধারণত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে সমভূমিকে বদ্বীপ বলা হয়। এ বদ্বীপ অঞ্চলটির যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চলে সমুদয় অংশ এবং রাজশাহী পাবনা ও ঢাকা অঞ্চলের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত। এ বদ্বীপ অঞ্চলটি পদ্মা এবং এর শাখাগুলো দ্বারা বিধৌত।
চ. স্রোতজ সমভূমি: শ্রুত সমভূমি হল বাংলাদেশের বদ্বীপ অঞ্চলের সমভূমির দক্ষিণ ভাগ এর যে অংশে বঙ্গোপসাগরে জোয়ার ভাটার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় সে অংশ। অঞ্চলের ছোট নদী নালা আছে অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এ সমভূমি অঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের বনভূমি রয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
এ বনভূমি সুন্দরবন নামে সুপ্রসিদ্ধ।
ছ. চট্টগ্রামের উপকূলীয় সমভূমি: ফেনী হতে কক্সবাজারের কিছু দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সমভূমি কর্ণফুলি, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, বাশখালি নদীবাহিত পলল দ্বারা গঠিত। এছাড়া সমুদ্রতটে বালু, সৈকত, বালিয়াড়ি, কর্দম, ভূমি ইত্যাদি উপকূলীয় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট সমুহ এখানে বিদ্যমান।
উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্য এদেশের বিরাজ করে আর এদেশের মানুষের জীবনধারা ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ভূ-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে । এ দেশের ভৌগলিক অবস্থান সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ।
জল সম্পদের উপর স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সামুদ্রিক বন্দর যা অর্থনীতির মূল পাইপলাইন। ভূ-প্রকৃতি এ সামান্যতম বিপর্যয় ঘটলে সামগ্রিকভাবে এ জনপদের মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয় ফলে প্রকৃতিকে রক্ষায় আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি রচনামূলক প্রশ্নোত্তর সাজেশন
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর সাজেশন
১.০২. বাংলাদেশের সমাজ ও জনগোষ্ঠীর ওপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের আধিবাসীদের আর্থসামাজিক জীবনধারায় ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : মানুষের সাথে প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য ও অকৃত্রিম সম্পর্ক রয়েছে। এই প্রকৃতির ছায়াতলে মানুষ জন্মগ্রহন করে, বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং জীবনজীবিকা অতিবাহিত করে।
আর এ ভূপ্রকৃতি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। প্রকৃতির প্রভাবের কারণেই কোনো অঞ্চলের মানুষ হয় সাহসী, উদ্যমী ও কর্মঠ আবার কোনো অঞ্চলের মানুষ হয় অলস ও অকর্মণ্য।
বাংলাদেশের সমাজ ও জনগোষ্ঠী ওপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব : নিম্নে বাংলাদেশের সমাজ ও জনগোষ্ঠীর ওপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা করা হলো :
১. মানুষের জীবনধারা : মানুষের জীবনধারার সাথে ভূপ্রকৃতির এক গভীর মিল আছে। মানুষের সার্বিক জীবনধারার ওপর ভূপ্রকৃতি প্রভাব বিস্তার করে। ভূপ্রকৃতির প্রভাবের ফলে পাহাড়ি বা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।
আবার এ ভূপ্রকৃতির প্রভাবেই ফলেই সমতল ভূমির লোকেরা অনেকটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। আবার এসব অঞ্চল বসবাসের উপযোগী হওয়ায় জনবসতি খুব ঘন।
২. জীবিকানির্বাহ : সমভূমি ও পাহাড়ি এলাকার মানুষের জীবিকানির্বাহ ভূপ্রকৃতির প্রভাবের কারণে বিপরীতমূখী হয়ে পড়েছে। সমতল ভূমিতে খুব সহজেই ভালো ফসল জন্মে এবং এলাকার ফসল ফলানো বেশ কঠিন হওয়ায় তাদের অনেক কষ্ট করে জীবিকানির্বাহ করতে হয়। এ কারণে তারা খুব পরিশ্রমী ।
৩. নগরায়ণ ও শিল্পায়ণ : বাংলাদেশে নগরায়ন, শিল্পায়ণ ও শিল্পকলকারখানার স্থান নির্বাচনে ভূপ্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।এদেশের শহরগুলো সাধারণত নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামে, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট এ কারনেই বন্দর বা শিল্পনগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
সিলেট অঞ্চলের ছোট ছোট পাহাড় এবং সেই সাথে প্রচুর বৃষ্টিপাত চা শিল্পের জন্য উপযোগী। আবার রাজশাহীর রেশম শিল্প ঐ অঞ্চলের গুটিপোকা চাষের উপযোগী ভূপ্রকৃতির জন্যই গড়ে উঠেছে।
৪. অর্থনৈতিক কর্মকান্ড : বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রীত করে থাকে। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বঙ্গোসাগর থেকে আগত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এসব পাহাড়ে বাধা পেয়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটায়। এ বৃষ্টির ফলে বাংলাদেশের কৃষিকার্যে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। যার ফলে শীতকালে ব্যপক রবি শস্য ফলে।
এছাড়া অধিক বৃষ্টিবহুল পাহাড়ি অঞ্চলে বনভূমি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এসব বনভূমি হতে প্রচুর মূল্যবান কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া পাহাড়ের ঢালে চা, রাবার, আনারস ইত্যাদির চাষ হয়। মধুপুর অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানেই কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য পরিবহণ ইত্যাদি সহজলভ্য হয়েছে।
এখানে সমতল ভূমিও বহু নদনদী থাকায় সড়ক , রেল ও জনপথে পরিবহন বেশ সুবিধাজনক। দক্ষিণ-পশ্চিমে উপকূলীয় সমভূমির লবণাক্ত ভূমির প্রভাবে বিশাল ম্যানগ্রোভ বনভূমির সৃষ্টি হয়েছে। এ বনভূমির অর্থনৈতিক গুরুত্ব খুবই বেশি। কারণ দেশের মোট উৎপাদিত কাঠের ৬০% এ বনভূমি থেকে সংগ্রত করা হয়।
এছাড়া ভগ্ন উপকূলের প্রভাবে এদেশে দুটি স্বাভাবিক সামুদ্রিক বন্দর গড়ে উঠেছে যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের কৃষি , শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যে সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করছে।
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আর এ কারণে এখানকার নিচু অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান নৌকা, লঞ্চ, ষ্টীমার ইত্যাদি। এসব অঞ্চল দিয়ে নৌপথে পণ্য পরিবহন বেশি হয়। সমতল অঞ্চলের নদীগুলোর ওপর সেতু নিমার্ণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের পাহাড়িয়া অঞ্চল যোগাযোগ ব্যবস্থর জন্য মোটেই অনুকুল নয়। তাই এখানকার কোনো কোনো অঞ্চলে সড়ক পথ ও রেলপথ নিমার্ণ করা কষ্টসাধ্য ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
৬. শিক্ষার ওপর প্রভাব : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও ভূপ্রকৃতির প্রভাব ফেলে। পাহাড়ি অঞ্চলের লোকেরা শিক্ষার প্রতি কম গুরুত্ব দেয়। কেননা তারা অনেক কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করে বিধায় শিক্ষায় সময় দিতে পারে না । পক্ষান্তরে, সমতল ভূমি অঞ্চলের লোকেরা কম পরিশ্রম করার কারণে তারা সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান ইত্যাদি চর্চার সুযোগ পায়।
৭. সাস্কৃতিক প্রভাব : বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির প্রভাব এদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনেও পড়ে। ভূপ্রকৃতির ফলে পাহাড়ি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক চর্চা আরেক উপায়ে হয়ে থাকে। মোটকথা ভৌগোলিক অবস্থান বাঙালির একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতির পরিচয় দান করে।
৮. চারিত্রিক প্রভাব : মানুষের জীবনধারার ওপর ভূপ্রকৃতি পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করে। আর এর একটি আদর্শিক উদাহরণ মানুষের চারিত্রিক ভিন্নতা, আর একটি ভূপ্রকৃতির কারণেই হয়ে থাকে।
পার্বত্য অঞ্চলের আধিবাসিরা সাধারণত বলিষ্ঠ, সাহসী, পরিশ্রমী, উৎসাহী, কষ্টসহিষ্ণু হয়। এ পরিবেশ তাদের দেহমান ও চরিত্রের ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। পার্বত্য কর্মীদের প্রায়ই বন্যজন্তুর সম্মখীন হতে হয় বলে তারা খুবই সাহসী। অন্যদিকে, সমভূমি অঞ্চলের লোকেরা তুলনামূলকভাবে কম সাহসী ও কম পরিশ্রমী হয়ে থাকে।
৯. অপরাধপ্রবণতার ওপর প্রভাব : গবেষনায় দেখা গেছে সমতল অঞ্চলে তুলনামুলকভাবে অপরাধপ্রবণতা কম। অপরদিকে, পার্বত্য অঞ্চলে অপরাধপ্রবণতার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি। উদাহরণস্বরুপ, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়।
পাহাড়ঘেরা দুর্গম এলাকায় লুকিযে থাকা সহজ বলে অপরাধীরা খুন, ধর্ষণ, হত্যা, লুন্ঠন ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ করে পালিয়ে থাকতে পারে।
১০. ভাষাগত প্রভাব : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মধ্যে একটি স্বকীয়তা বিদ্যমান। আর এটি ভূপ্রকৃতির বিভিন্নতায় একেক রকম। যেমন- পাহাড়ি অঞ্চলের ভাষা এবং সমভূমি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভাষার প্রভেদ রয়েছে।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে ভূপ্রকৃতির পার্থক্যের কারনে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। তেমনি বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির পার্থক্যের প্রভাব মানুষের সামগ্রিক জীবনধারা পরিচালিত করে।
সুতরাং ভূপ্রকৃতির বিরূপ আচরণ যেমন মানুষের জীবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছাতে পারে তেমনি সমতলে যাতায়াত ও যোগাযোগ, উন্নত ভূমি মানুষের জীবন ধারনের পথ সহজ ও সহায়ক করে দেয়।
১.০৩. বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব লেখ।
উত্তর : ভূমিকা : মানুষের জীবনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক জীবন প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতির সাথে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের সম্বন্ধে অবিচ্ছেদ্য ও অকৃত্রিম। অর্থাৎ মানুষের জীবনজীবিকা প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি খুবই বৈচিত্রময়। একটি দেশের ভূপ্রকৃতি সে দেশের অর্থনীতিতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এদেশের নদ নদী, পাহাড়-পর্বত ও সমতল ভূমি অর্থনীতিতে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতির প্রভাব অনস্বীকার্য। নি¤েœ এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মানুষের জীবনধারার ওপর প্রভাব : মানুষের জীবনধারার সাথে ভূপ্রকৃতির এক গভীর মিল আছে। মানুষের সার্বিক জীবনধারার ওপর ভূপ্রকৃতি প্রভাব বিস্তার করে। ভূপ্রকৃতির প্রভাবের ফলে পাহাড়ি বা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। আবার এ ভূপ্রকৃতির প্রভাবের ফলেই সমতল ভূমির লোকেরা অনেকটা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে।
আবার এসব অঞ্চল বসবাসের উপযোগী হওয়ায় জনবসতি খুব ঘন।
২. জীবিকানির্বাহের ওপর প্রভাব : সমভূমি ও পাহাড়ি এলাকার মানুষের জীবিকানির্বাহ ভূপ্রকৃতির প্রভাবের কারণে বিপরীতমূখী হয়ে পড়েছে। সমতল ভূমিতে খুব সহজেই ভালো ফসল জন্মে এবং সহজে জীবিকার্নিবাহ করা যায় বলে এরা অলস। আবার পাহাড়ি এলাকার ফসল ফলানো বেশ কঠিন হওয়ায় তাদের অনেক কষ্ট করে জীবিকানির্বাহ করতে হয়।
এ কারণে তারা খুব পরিশ্রমী।
৩. অর্থনৈতিক কার্যাবলির ওপর প্রভাব : বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বঙ্গোপসাগর থেকে আগত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এসব পাহাড়ে বাধা পেয়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটায় । এ বৃষ্টির ফলে বাংলাদেশের কৃষিকার্যে ব্যাপক উন্নতি ঘটে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
যার ফলে শীতকালে ব্যাপক রবি শস্য ফলে। এছাড়া অধিক বৃষ্টিবহুল পাহাড়ি অঞ্চলে বনভূমি সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। এসব বনভূমি হতে প্রচুর মূল্যবান কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যায়। এছ্ড়াা পাহাড়ের ঢালে চা, রাবার, আনারস ইত্যাদির চাষ করে। মধুপুর অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানেই কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহণ ইত্যাদি সহজলভ্য হয়েছে।
এখানে সমতল ভূমি ও বহু নদনদী থাকায় সড়ক , রেল ও জলপথেই পরিবহণ বেশ সুবিধাজনক। দক্ষিণ-পশ্চিমে উপকূলীয় সমভূমির লবণাক্ত ভূমির প্রভাবে বিশাল ম্যানগ্রোভ বনভূমির সৃষ্টি হয়েছে। এ বনভূমির অর্থনৈতিক গুরুত্ব খ্বুই বেশি। কারণ দেশের মোট উৎপাদিত কাঠের ৬০% এ বনভূমি থেকে সংগ্রহ করা হয়।
এছাড়া ভগ্ন উপকুলের প্রভাবে এদেশের দুটি স্বাভাবিক সামুুুদ্রিক বন্দর গড়ে উঠেছে যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বাংলাদেশের কৃষ্,ি শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্য সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করছে।
৪. নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ওপর প্রভাব : বাংলাদেশে নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও শিল্পকলকারখানার স্থান নির্বাচনে ভূপ্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এদেশের শহরগুলো সাধারণত নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট এ কারণেই বন্দর বা শিল্পনগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
সিলেট অঞ্চলের ছোট ছোট পাহাড় এবং সেই সাথে প্রচুর বৃষ্টিপাত চা শিল্পের জন্য উপযোগী। আবার রাজশাহীর রেশম শিল্প ঐ অঞ্চলের গুটি পোকা চাষের উপযোগী ভূপ্রকৃতির জন্যই গড়ে উঠেছে।
৫. ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভাব : বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি এদেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এদেশের ভূপ্রকৃতি ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য অনুকূল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
নদীপথে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রীর লেনদেন, সমতল ভূমির কারণে সহজে গড়ে উঠা যাতায়াত ব্যবস্থা, শিল্পক্ষেত্রে কাঁচামালের পর্যাপ্ততা প্রভৃতি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এভাবে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের মাধ্যমে এদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতি ব্যাপক অবদান রাখে।
৬. উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রভাব : বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি এদেশের উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সমতল ভূমির কারণে এদেশে কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন বেশি হয়। আর কৃষিজাত দ্রব্যের এক বৃহৎ অংশ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিধায় এদেশে শিল্পপণ্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া আমাদের দেশের ভূপ্রকৃতি বসবাসের উপযোগী বিধায় শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখে। স্বল্প মজুরিতে এখানে শ্রমিক পাওয়া যায়, যা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে এবং দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
৭. শ্রমের গতিশীলতার ক্ষেত্রে প্রভাব : শ্রমের গতিশীলতা বলতে শ্রমিকদের এক পেশা থেকে অন্য পেশায় গমনের সুযোগকে বুঝায় । বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি বৈচিত্র্যময় বিধায় এদেশের শ্রমিকরা খুব সহজেই এক কাজ থেকে অন্য কাজে যোগ দিয়ে সহজেই অর্থোপার্জন করতে পারে।
এতে করে শ্রমিকরা বছরের সব সময়ে কাজে ব্যস্ত থাকে এবং সহজে জীবিকানির্বাহ করতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে সহায়তা করে।
৮. বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি : বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি বসবাস ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য উপযোগী বিধায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এদেশে শিল্পে বিনিয়োগ করে থাকে। এতে এদেশে আয় প্রবাহ সৃষ্টি হয় এবং দেশের অর্থনীতিতে তা সুফল বয়ে আনে ।
৯. জাতীয় আয় বৃদ্ধি : বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উপযোগী বিধায় এসব খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আর উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তা দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। কেননা উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর সংখ্যাকে তার বাজার দাম দিয়ে গুণ করলেই জাতীয় আয় পাওয়া যায় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূপ্রকৃতি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ভূপ্রকৃতির ওপর ভিত্তি করেই মানুষের অর্থনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে। অথচ আমরা তা বিনামূল্যে প্রাকৃতিকভাবেই পেয়ে থাকি, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যথেষ্ট সহায়ক।
১.০৪. প্রাচীন বাংলার জনপদসমূহের বিবরণ দাও ।
অথবা, প্রাচীনকালে বাংলা কোন কোন অঞ্চলে বিভক্ত ছিল তা আলোচনা কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : প্রাচীনকালে পূর্বভারতের যে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে “একদিকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল আজকের বাংলাদেশ তার একটি অংশ। বাংলার অবস্থান সম্পর্কে নীহাররঞ্জন রায় বলেন, উচ্চ পর্বত, দুই দিকে কঠিন শৈলভূমি আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র মাঝখানে সমভূমির সাম্য এটিই বাঙালি ভৌগোলিক অবস্থান।”
প্রাচীনকালে এই ভৌগোলিক অবস্থান বিভিন্ন অঞ্চলে বা জনপদে বিভক্ত ছিল ।
প্রাচীন বাংলার জনপদসমূহ : প্রাচীনকালে বাংলা অঞ্চল এখনকার মতো একক রাষ্ট্র ছিল না । তখন বাংলার বিভিন্ন অংশ অনেকগুলো ছোট ছোট অঞ্চল বা এলাকায় বিভক্ত ছিল। এলাকার বা অঞ্চলের শাসক যার যার মতো করে শাসন করতেন ।
প্রাচীন বাংলার এই অঞ্চল বা এলাকাগুলোকে জনপদ বলা হয়। প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর মধ্যে গৌড়, বঙ্গ, পুণ্ড্র, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ, তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রদ্বীপ, রাঢ়, সুহ্ম ও দণ্ডভুক্তি অন্যতম। নিম্নে জনপদসমূহের বিবরণ দেওয়া হলো :
১. বঙ্গ : সর্বপ্রথম বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ নামক গ্রন্থে। বঙ্গের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিম বলেন যে, “বঙ্গ” নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ‘রিয়াজ উস-সালাতিন’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, নুহ (আ.) এর ছেলে হাম এর এক পুত্র ছিল হিন্দ, হিন্দ এর এক পুত্র ছিল বঙ্গ । এ থেকে ‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি।
বৌধায়নের ‘ধর্মসূত্র’ গ্রন্থে বঙ্গ জনপদটিকে কলিঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী বলা হয়েছে। ‘মহাভারত’ এর আদিপর্বে বঙ্গ জনপদের উল্লেখ আছে। পাল বংশ যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন বঙ্গ জনগণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর বঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গ নামে পরিচিত হয়। বঙ্গ অঞ্চল বলতে বর্তমান ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীকে বুঝায় ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
২. গৌড় : গৌড় জনপদ কোন অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। পাণিনির ব্যাকরণ, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ ও বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ নামক গ্রন্থে গৌড়ের সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। হর্ষবর্ধনের অনুশাসনসমূহ থেকে জানা যায় যে, মৌখরিরাজ ঈশান বর্মণ গৌড়বাসীকে পরাজিত করে সমুদ্র পর্যন্ত বিতাড়িত করেন।
পুরাণে গৌড়ের স্থান নির্দেশ করেছে আধুনিক উত্তরে এবং পদ্মার দক্ষিণে। বরাহমিহিরের ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে দেখা যায় যে, গৌড় অন্যান্য জনপদ অপেক্ষা একটি আলাদা জনপদ ।
৩. পুণ্ড্র : পুণ্ড্র নামে এক প্রাচীন জাতির উল্লেখ বৈদিক গ্রন্থে এবং রামায়ণ ও মহাভারতে পাওয়া যায়। এরা উত্তর বাংলার অধিবাসী ছিল বলে এ অঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধন নামে খ্যাতি ছিল মহাভারতের দিগ্বিজয় পর্বে বলা হয়েছে যে, গঙ্গা নদীর পূর্বভাগে পুন্ডুদের রাজ্য বিস্তৃত ছিল । এর রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর। পরবর্তীকালে এর নামকরণ করা হয় পুন্ড্রবর্ধন ।
৪. সমতট : সমতটের অবস্থান ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বঙ্গের প্রতিবেশী জনপদ হিসেবে। এ অঞ্চলটি ছিল আর্দ্র নিম্নভূমি কেউ কেউ মনে করেন সমতট বর্তমান কুমিল্লার প্রাচীন নাম। আবার কেউ কেউ মনে করেন কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে সমতট গঠিত হয়েছিল। সাত শতক থেকে বারো শতক পর্যন্ত বর্তমান ত্রিপুরা জেলা ছিল সমতটের অন্যতম অংশ।
একসময় এ জনপদের পশ্চিম সীমা চব্বিশ পরগনার খাড়ি পরগনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কুমিল্লা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড়কামতা নামক স্থানটি সাত শতকের সমতটের রাজধানী ছিল। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীর থেকে শুরু করে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলকেই সমতট হিসেবে বিবেচনা করা হতো ।
৫. রাঢ় : ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরের জনপদকে রাঢ় বলা হয় । এ অঞ্চলের রাঢ় উপজাতিদের নামানুসারে এ জনপদের নামকরণ করা হয় রাঢ় । রাঢ়ের দুই অংশ সুহ্ম ভূমি ও বজ্ৰভূমি । অজয় নদ ছিল রাঢ়ের দুই অংশের সীমারেখা ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনামূলক পর্ব-১*
৬. চন্দ্রদ্বীপ : চন্দ্রদ্বীপ জনপদ বর্তমান বরিশাল জেলায় অবস্থিত ছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, চন্দ্রদ্বীপ মধ্যযুগের একটি নামকরা জায়গা। ‘আইন ই আকবরি’ গ্রন্থের বাকলা পরগনার বাকলা (বর্তমান বৃহত্তর বরিশাল) এবং চন্দ্রদ্বীপকে একই স্থান বলে মনে করেন। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, চন্দ্রদ্বীপ ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জ অঞ্চল ।
৭. পাহাড়পুর : বর্তমানের নওগাঁ জেলায় অবস্থিত পাহাড়পুর। পালবংশীয় রাজা ধর্মপালের আমলে এটি সোমপুর বিহার নামে পরিচিত ছিল । সম্ভবত অষ্টম শতকে এখানে পাল রাজত্বের রাজধানী গড়ে উঠেছিল এবং তা উপমহাদেশের মুসলিম শাসকদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
৮. বরেন্দ্র : অনেক ইতিহাসবেত্তা মনে করেন বরেন্দ্র ছিল পুণ্ড রাজ্যের একটি অংশবিশেষ। ভারতীয় সাহিত্য ও বিভিন্ন শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, আধুনিক রাজশাহী, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার অধিকাংশ এলাকাই এ বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। বাংলায় পাল শাসনামলে গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে বরেন্দ্র
৯. তাম্রলিপ্ত : প্রাচীন বাংলার একটি বিখ্যাত বন্দর ছিল তাম্রলিপ্ত । মহাভারতে তাম্রলিপ্তর উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান মেদিনীপুর জেলায় এই বন্দরটি অবস্থিত । নৌচলাচলের জন্য জায়গাটি ছিল উত্তম। প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌবাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সিংহল, জাভা দ্বীপ, চীন প্রভৃতি দেশের সাথে বাণিজ্যিক আদানপ্রদান চলত এ বন্দর নগরী থেকে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রাচীনকালে অর্থাৎ প্রাক মুসলিম আমলে বাংলা ছিল গৌড়, বঙ্গ, সমতট, পুণ্ড্র, হরিকেল প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত। প্রতিটি জনপদ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ছিল।
গৌড়রাজ শশাঙ্ক সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদকে একত্রিত করে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেষ্টা করেন। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলায় পাল ও সেন শাসনামলে সে চেষ্টা অব্যাহত থাকে। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি পরিপূর্ণতা পায়।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।