লালসালু | সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ | বিস্তারিত আলোচনা ১ | PDF : বাংলা প্রথম পত্রের লালসালু উপন্যাসটি হতে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় গুলো আমাদের এই পোস্টে পাবেন।
প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বন্ধুরা আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই আছেন । এটা জেনে আপনারা খুশি হবেন যে, আপনাদের জন্যবাংলা প্রথম পত্রের লালসালু উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি ।
সুতরাং সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। আর এইচ এস সি- HSC এর যেকোন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সকল সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
লালসালু | সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
লালসালু’র প্রকাশতথ্য
‘লালসালু’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা-র কমরেড পাবলিশার্স এটি প্রকাশ করে। প্রকাশক মুহাম্মদ আতাউলাহ। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার কথাবিতান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
এরপর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। নওরোজ কিতাবিস্তান ‘লালসালু’ উপন্যাসের দশম মুদ্রণ প্রকাশ করে।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ‘লালসালু’ উপন্যাসের উর্দু অনুবাদ করাচি থেকে প্রকাশিত হয় ‘খধষ ঝযধষঁ’ নামে। অনুবাদক ছিলেন কলিমুলাহ।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’র ফরাসি অনুবাদ। খ’ধৎনৎব ংধহং ৎধপরহং নামে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি অনুবাদ করেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র সহধর্মিণী অ্যান-ম্যারি-থিবো। প্যারিস থেকে এ অনুবাদটি প্রকাশ করে ঊফরঃরড়হ’ং ফঁ ঝবঁরষ প্রকাশনী। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এ অনুবাদটির পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। ‘ঞৎবব রিঃযড়ঁঃ জড়ড়ঃং’ নামে লন্ডনের ঈযধঃঃড় ধহফ রিহফঁং খঃফ. এটি প্রকাশ করেন। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নিজেই এই ইংরেজি অনুবাদ করেন।
পরবর্তীকালে ‘লালসালু’ উপন্যাসটি জার্মান ও চেক ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ-বাস্তবতা
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’। রচনাটিকে একজন প্রতিভাবান লেখকের দুঃসাহসী প্রচেষ্টার সার্থক ফসল বলে বিবেচনা করা হয়। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির ও চঞ্চল।
ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতালিশের মন্বন্তর, সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, আবার নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে তোলার উদ্দীপনা ইত্যাদি নানা রকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আবর্তে মধ্যবিত্তের জীবন তখন বিচিত্রমুখী জটিলতায় বিপর্যস্ত ও উজ্জীবিত। নবীন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, এই চেনা জগৎটাকে বাদ দিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাসের জন্য গ্রামীণ পটভূমি ও সমাজে-পরিবেশ বেছে নিলেন।
আমাদের দেশ ও সমাজ মূলত গ্রামপ্রধান। এদেশের বেশিরভাগ লোকই গ্রামে বাস করে। এই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন দীর্ঘকাল ধরে অতিবাহিত হচ্ছে নানা অপরিবর্তনশীল তথাকথিত অনাধুনিক বৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে। এই সমাজ থেকেই সৈয়দ ওয়ালীউলাহ বেছে নিলেন তাঁর উপন্যাসের পটভূমি, বিষয় এবং চরিত্র।
তাঁর উপন্যাসের পটভূমি গ্রামীণ সমাজ; বিষয় সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রচলিত ধারণা বিশ্বাস, চরিত্রসমূহ একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু, শোষিত,দরিদ্র গ্রামবাসী, অন্যদিকে শঠ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক-ভূস্বামী।
‘লালসালু’ একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। এর বিষয় : যুগ-যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাক্সক্ষার দ্ব›দ্ব। গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণাজাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণে সমৃদ্ধ ‘লালসালু’ উপন্যাস। কাহিনিটি ছোট, সাধারণ ও সামান্য কিন্তু এর গ্রন্থনা ও বিন্যাস অত্যন্ত মজবুত। লেখক সাধারণ একটি ঘটনাকে অসামান্য নৈপুণ্যে বিশ্লেষণী আলো ফেলে তাৎপর্য-মণ্ডিত করে তুলেছেন।
শ্রাবণের শেষে নিরাক পড়া এক মধ্যাহ্নে মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের প্রবেশের নাটকীয় দৃশ্যটির মধ্যেই রয়েছে তার ভণ্ডামি ও প্রতারণার পরিচয়। মাছ শিকারের সময় তাহের ও কাদের দেখে যে, মতিগঞ্জ সড়কের ওপর একটি অপরিচিত লোক মোনাজাতের ভঙ্গিতে পাথরের মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে আছে।
পরে দেখা যায়, ওই লোকটিই গ্রামের মাতব্বর খালে ব্যাপারীর বাড়িতে সমবেত গ্রামের মানুষকে তিরষ্কার করছে? ‘আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ্। মোদাচ্ছের পিরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?’ অলৌকিকতার অবতারণা করে মজিদ নামের ওই ব্যক্তি জানায় যে, পিরের স্বপ্নাদেশে মাজার তদারকির জন্যে তার এ গ্রামে আগমন। তার তিরষ্কার ও স্বপ্নাদেশের বিবরণ শুনে গ্রামের মানুষ ভয়ে এবং শ্রদ্ধায় এমন বিগলিত হয় যে তার প্রতিটি হুকুম তারা পালন করে গভীর আগ্রহে।
গ্রামপ্রান্তের বাঁশঝাড়সংলগ্ন কবরটি দ্রুত পরিচ্ছন্ন করা হয়। ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয় কবর। তারপর আর পিছু ফেরার অবকাশ থাকে না। কবরটি অচিরেই মাজারে এবং মজিদের শক্তির উৎসে পরিণত হয়।
যথারীতি সেখানে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বলে; ভক্ত আর কৃপাপ্রার্থীরা সেখানে টাকা পয়সা দিতে থাকে প্রতিদিন। কবরটিকে মোদাচ্ছের পিরের বলে শনাক্তকরণের মধ্যেও থাকে মজিদের সুগভীর চাতুর্য। মোদাচ্ছের কথাটির অর্থ নাম-না-জানা।
মজিদের স্বগত সংলাপ থেকে জানা যায়, শস্যহীন নিজ অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া মজিদ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আসলে এই প্রক্রিয়ায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বহুকাল ধরে বিদ্যমান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গ্রামীণ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যথাযথভাবেই এখানে তুলে ধরেছেন।
মাজারের আয় দিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মজিদ ঘরবাড়ি ও জমিজমার মালিক হয়ে বসে এবং তার মনোভূমির এক অনিবার্য আকাক্সক্ষায় শক্ত-সমর্থ লম্বা চওড়া একটি বিধবা যুবতীকে বিয়ে করে ফেলে। আসলে স্ত্রী রহিমা ঠাণ্ডা ভীতু মানুষ। তাকে অনুগত করে রাখতে কোনো বেগ পেতে হয় না মজিদের। কারণ, রহিমারও মনেও রয়েছে গ্রামবাসীর মতো তীব্র খোদাভীতি। স্বামী যা বলে, রহিমা তাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে।
রহিমার বিশ্বাস তার স্বামী অলৌকিক শক্তির অধিকারী। প্রতিষ্ঠা লাভের সাথে সাথে মজিদ ধর্মকর্মের পাশাপাশি সমাজেরও কর্তা-ব্যক্তি হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে উপদেশ নির্দেশ দেয়-গ্রাম্য বিচার-সালিশিতে সে-ই হয়ে ওঠে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রধান ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে মাতব্বর খালেক ব্যাপারীই তার সহায়ক শক্তি। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর পারিবারিক জীবনেও নাক গলাতে থাকে সে।
তাহেরের বাপ-মার মধ্যেকার একান্ত পারিবারিক বিবাদকে কেন্দ্র করে তাহেরের বাপের কর্তৃত্ব নিয়েও সে প্রশ্ন তোলে। নিজ মেয়ের গায়ে হাত তোলার অপরাদে হুকুম করে মেয়ের কাছে মাফ চাওয়ার এবং সেই সঙ্গে মাজারের পাঁচ পয়সার সিন্নি দেয়ার। অপমান সহ্য করতে না পেরে তাহেরের বাপ শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়। খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী আমেনা সন্তান কামনায় অধীর হয়ে মজিদের প্রতিদ্ব›দ্বী।
পিরের প্রতি আস্থাশীল হলে মজিদ তাকেও শাস্তি দিতে পিছপা হয় না। আমেনা চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে খালেক ব্যাপারীকে দিয়ে তাকে তালাক দিতে বাধ্য করে মজিদ। কিন্তু তবু মাজার এবং মাজারের পরিচালক ব্যক্তিটির প্রতি আমেনা বা তার স্বামী কারুরই কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয় না।
গ্রামবাসী যাতে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মজিদের মাজারকেন্দ্রিক পশ্চাৎপদ জীবন ধারা থেকে সরে যেতে না পারে, সে জন্য সে শিক্ষিত যুবক আক্কাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়।
মজিদ এমনই ক‚ট-কৌশল প্রয়োগ করে সে আক্কাস গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক গ্রাম, সমাজ ও মানুষের বাস্তব-চিত্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় সংযোজন।
‘লালসালু’র প্রধান উপাদান সমাজ-বাস্তবতা। গ্রামীণ সমাজ এখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থবির, যুগযুগ ধরে এখানে সক্রিয় এই অদৃশ্য শৃঙ্খল। এখানকার মানুষ ভাগ্য ও অলৌকিকত্ব গভীরভাবে বিশ্বাস করে। দৈবশক্তির লীলা দেখে নিদারুণ ভয় পেয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে নয়তো ভক্তিতে আপ্লুত হয়। কাহিনির উন্মোচন-মুহূর্তেই দেখা যায়, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি। যেখানে ন্যাংটা থাকতেই বাচ্চাদের আমসিপারা শেখানো হয়।
শস্য যা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। সুতরাং ওই গ্রাম থেকে ভাগ্যের সন্ধানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে-গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে চায় সেই গ্রামেও একইভাবে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের জয়-জয়কার। এ এমনই এক সমাজ যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেবলই শোষণ আর শোষণ- কখনো ধর্মীয়, কখনো অর্থনৈতিক।
প্রতারণা, শঠতা আর শাসনের জটিল এবং সংখ্যাবিহীন শেকড় জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পরতে পরতে ছড়ানো। আর ওইসব শেকড় দিয়ে প্রতিনিয়ত শোষণ করা হয় জীবনের প্রাণরস। আনন্দ, প্রেম, প্রতিবাদ, সততা-এই সব বোধ এবং বুদ্ধি ওই অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা সমাজের ভেতরে প্রায়শ ঢাকা পড়ে থাকে। এই কাজে ভূস্বামী, জোতদার এবং ধর্মব্যবসায়ী একজন আর একজনের সহযোগী।
কারণ স্বার্থের ব্যাপারে তারা একাট্টা-পথ তাদের এক। একজনের আছে মাজার, অন্যজনের আছে জমিজোত প্রভাব প্রতিপত্তি। দেখা যায়, অন্য কোতাও নয় আমাদের চারপাশেই রয়েছে এরূপ সমাজের অবস্থান। বাংলাদেশের যে-কোনো প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে সমাজের ভেতর ও বাইরের চেহারা যেন এরূপ একই রকম।
আবার এই বদ্ধ, শৃঙ্খলিত ও স্থবির সামাজিক অবস্থার একটি বিপরীত দিকের চিত্রও আছে। তা হলো, মানুষের প্রাণধর্মের উপস্থিতি। মানুষ ভালোবাসে, স্নেহ করে; কামনা-বাসনা এবং আনন্দ-বেদনায় উদ্বেলিত হয়। নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছা ও বাসনার কারণে সে নিজেকে আলোকিত ও বিকশিত করতে চায়।
কোনো ক্ষেত্রে যদি সাফল্য ধরা না-ও দেয় তবু কিন্তু স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বেঁচে থাকে। প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকে তার চাওয়া ও না-পাওয়ার সাংঘর্ষিক রক্তময় হৃদয়ার্তি। এটা অব্যাহত থাকে মানব সম্পর্কের মধ্যে, দৈনন্দিন ও পারিবারিক জীবনে, এমনকি ব্যক্তি ও সমষ্টির মনোলোকেও।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মানবতাবাদী লেখক। মানব-মুক্তির স্বাভাবিক আকাক্সক্ষা তাঁর সাহিত্য সাধণার কেন্দ্রে সক্রিয়। এ দেশের মানুষের সুসংগত ও স্বতঃস্ফ‚র্ত বিকাশের অন্তরায়গুলিকে তিনি তাঁর রচিত সাহিত্যের পরিমণ্ডলেই চিহ্নিত করেছেন; দেখিয়েছেন কুসংস্কারের শক্তি আর অন্ধবিশ্বাসের দাপট।
স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও সমাজ সরল ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্তি ও ভীতির মধ্যে রেখে শোষণের প্রক্রিয়া চালু রাখে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ এবং ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব। তিনি সেই সমাজের চিত্র তুলে ধরেন যেখানে ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি’।
তিনি মনে করেন, ধর্ম মানুষকে সত্যের পথে, কল্যাণের পথে, পারস্পরিক মমতার পথে নিয়ে এসেছে; কিন্তু ধর্মের মূল ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে দিয়েছে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস।
এ কারণে মানুষের মন আলোড়িত, জাগ্রত ও বিকশিত তো হয়ইনি বরং দিন দিন হয়েছে দুর্বল, সংকীর্ণ এবং ভীত। স্বার্থ ও লোভের বশবর্তী হয়ে এক শ্রেণির লোক যে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানা ভণ্ডামি ও প্রতারণার আশ্রয় নেয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র আঘাত তার বিরুদ্ধে। লেখক সামাজিক এই বাস্তবতার চিত্রটিই এঁকেছেন ‘লালসালু’ উপন্যাসে; উন্মোচন করেছেন প্রতারণার মুখোশ।
অত্যন্ত যতœ নিয়ে রচিত একটি সার্থক শিল্পকর্ম ‘লালসালু’ উপন্যাস। এর বিষয় নির্বাচন, কাহিনি ও ঘটনাবিন্যাস গতানুগতিক নয়। এতে প্রাধান্য নেই প্রেমের ঘটনার, নেই প্রবল প্রতিপক্ষের প্রত্যক্ষ দ্ব›দ্বসংঘাতের উত্তেজনাকর ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে চমক সৃষ্টির চেষ্টা।
অথচ মানবজীবনের প্রকৃত রূপ আঁকতে চান তিনি। মানুষের অন্তর্ময় কাহিনি বর্ণনা করাই লক্ষ্য তাঁর। ফলে চরিত্র ও ঘটনার গূঢ় রহস্য, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাঁকে দেখাতে হয়েছে যা জীবনকে তার অন্তর্গত শক্তিতে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করে। যে ঘটনা বাইরে ঘটে তার অধিকাংশেরই উৎস মানুষের মনে লোভ, ঈর্ষা, লালসা, বিশ্বাস, ভয়, প্রভুত্ব কামনাসহ নানরূপ প্রবৃত্তি।
বাসনাবেগ ও প্রবৃত্তি মানুষের মনে সুপ্ত থাকে বলেই বাইরের বিচিত্র সব ঘটনা ঘটাতে তাকে প্ররোচিত করে। ধর্ম-ব্যবসায়ীকে মানুষ ব্যবসায়ী হিসেবে শনাক্ত করতে না পেরে ভয় পায়। কারণ, তাদের বিশ্বাস লোকটির পেছনে সক্রিয় রয়েছে রহস্যময় অতিলৌকিক কোনো দৈবশক্তি।
আবার ধর্ম-ব্যবসায়ী ভণ্ড ব্যক্তি যে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ বোধ করে তা নয়, তার মনেও থাকে সদা ভয়, হয়ত কোনো মানুষ স্বাভাবিক প্রেরণা ও বুদ্ধির মাধ্যমে তার গড়ে তোলা প্রতিপত্তির ভিত্তিটাকে ধসিয়ে দেবে। নরনারীর অবচেতন ও সচেতন মনের নানান ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই এভাবে লেখকের বিষয় হয়ে উঠেছে ‘লালসালু’ উপন্যাস।
চরিত্র-সৃষ্টি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যে অসাধারণ কুশলী শিল্পী তা তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসের চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। ‘লালসালু’ উপন্যাসের শৈল্পিক সার্থকতার প্রশ্নে সুসংহত কাহিনিবিন্যাসের চাইতে চরিত্র নির্মাণের কুশলতার দিকটি ভূমিকা রেখেছে অনেক বেশি। ‘লালসালু’ একদিক দিয়ে চরিত্র-নির্ভর উপন্যাস।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। শীর্ণদেহের এই মানুষটি মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐশী শক্তির প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য, ভয় শ্রদ্ধা, ইচ্ছা ও বাসনা-সবই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আর সমগ্র উপন্যাস জুড়ে এই চরিত্রকেই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন, বারবার অনুসরণ করেছেন এবং তার ওপরই আলো ফেলে পাঠকের মনোযোগ নিবন্ধ রেখেছেন।
উপন্যাসের সকল ঘটনার নিয়ন্ত্রক মজিদ। তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আর তাই মজিদের প্রবল উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে মহব্বতনগর গ্রামের সামাজিক পারিবারিক সকল কর্মকাণ্ডে।
মজিদ একটি প্রতীকী চরিত্র- কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক সে। প্রচলিত বিশ্বাসের কাঠামো ও প্রথাবদ্ধ জীবনধারাকে সে টিকিয়ে রাখতে চায়, ওই জীবনধারার সে প্রভু হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে।
এজন্য সে যেকোনো কাজ করতেই প্রস্তুত, তা যতই নীতিহীন বা অমানবিক হোক। একান্ত পারিবারিক ঘটনার রেশ ধরে সে প্রথমেই বৃদ্ধ তাহেরের বাবাকে এমন এক বিপাকে ফেলে যে সে নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হয়। নিজের মাজারকেন্দ্রিক শক্তির প্রতি চ্যালেঞ্জ অনুভব করে সে আওয়ালপুরের পির সাহেবের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নামে।
ব্যাপারটি রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায় এবং নাস্তানাবুদ পির সাহেবকে শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরন করতে সে বাধ্য করে। সে খালেক ব্যাপারীকে বাধ্য করে তার সন্তান-আকাক্সক্ষী প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে। আর আক্কাস নামের এক নবীন যুবকের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। এভাবেই মজিদ তার প্রভাব এবং প্রতিষ্ঠাকে নিরঙ্কুশ করে তোলে।
মহব্বতনগরে মজিদ তার প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় করলেও এর ওপর যে আঘাত আসতে পারে সে বিষয়ে মজিদ অত্যন্ত সজাগ। সে জানে, স্বাভাবিক প্রাণধর্মই তার ধর্মীয় অনুশাসন এবং শোষণের অদৃশ্য বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। ফলে ফসল ওঠার সময় যখন গ্রামবাসীরা আনন্দে গান গেয়ে ওঠে তখন সেই গান তাকে বিচলিত করে। ওই গান সে বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।
রহিমার স্বচ্ছন্দ চলাফেরায় সে বাধা দেয়। আক্কাস আলিকে সর্বসমক্ষে লাঞ্ছিত অপমানিত করে। মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও নিজের জাগতিক প্রতিষ্ঠার ভিতটিকে মজবুত করার জন্যে এসবই আসলে তার হিসেবি বুদ্ধির কাজ। সে ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তার বিশ্বাস সুদৃঢ় কিন্তু প্রতারণা বা ভণ্ডামির মাধ্যমেই যেভাবেই হোক সে তার মাজারকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এরপরও মাঝে মাঝে তার মধ্যে হতাশা ভর করে।
মজিদ কখনো কখনো তার প্রতি মানুষের অনাস্থা অবলোকন করে নিজের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একেকবার আত্মঘাতী হওয়ার কথা ভাবে। মাজার প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে ক‚ট-কৌশল অবলম্বন করেছে তার সব কিচু ফাঁস করে দিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবে।
প্রতিষ্ঠাকামী মজিদ স্বার্থপরতা, প্রতিপত্তি আর শোষণের প্রতিভূ। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের পর নিঃসন্তান জীবনে সে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একপ্রকার শূন্যতা উপলব্ধি করে। এই শূন্যতা পূরণের অভিপ্রায়ে অল্পবয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে সে। প্রথম স্ত্রী রহিমার মতো দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা ধর্মের ভয়ে ভীত নয়।
এমনকি, মাজারভীতি কিংবা মাজারের অধিকর্তা মজিদ সম্পর্কেও সে কোনো ভীতি বোধ করে না। তারুণ্যের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী তার মধ্যে জীবনের চঞ্চলতা ও উচ্ছলতা অব্যাহত থাকে। মজিদ তাকে ধর্মভীতি দিয়ে আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়।
জমিলা তার মুখে থুথু দিলে ভয়ানক ক্রুদ্ধ মজিদ তাকে কঠিন শাস্তি দেয়। তার মানবিক অন্তর্দ্ব›দ্ব তীব্র না হয়ে তার ক্ষমতাবান সত্তাটি নিষ্ঠুর শাসনের মধ্যেই পরিতৃপ্তি খোঁজে। রহিমা যখন পরম মমতায় মাজার ঘর থেকে জমিলাকে এনে শুশ্র“ষা আরম্ভ করে তখন মজিদের হৃদয়ে সৃষ্টি হয় তুমুল আলোড়ন। মজিদের মনে হয়, ‘মুহূর্তের মধ্যে কেয়ামত হবে।
মুহূর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী যেনো ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম হয়।’ কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হয়। নবজন্ম হয় না তার। মজিদ শেষ পর্যন্ত থেকে যায় জীবনবিরোধী শোষক এবং প্রতারকের ভূমিকায়।
মজিদ একটি নিঃসঙ্গ চরিত্র। উপন্যাসেও একাধিকবার তার ভয়ানক নৈঃসঙ্গ্যবোধের কথা বলা হয়েছে। তার কোনো আপনজন নেই যার সঙ্গে সে তার মনের একান্তভাব বিনিময় করতে পারে।
কারণ, তাঁর সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক কেবলই বাইরের-কখনো প্রভাব বিস্তার বা নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব আরোপের-কখনোই অন্তরের বা আবেগের নয়। সে কখনোই আবেগী হতে পারে না। কারণ তার জানা আছে আন্তরিকতা ও আবেগময়তা তার পতনের সূচনা করবে। আর তাতেই ধসে পড়তে হতে পারে তিলতিল করে গড়ে তোলা তার মিথ্যার সাম্রাজ্য।
এসব সত্তে¡ও মজিদ যে আসলেই দুর্বল এবং নিঃসঙ্গ-এই সত্যটি ধরা পড়ে রহিমার কাছে। ঝড়ের রাতে জমিলাকে শাসনে ব্যর্থ হয়ে মজিদ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কীভাবে তরুণী বধূ জমিলাকে সে নিয়ন্ত্রণে রাখবে সেই চিন্তায় একেবারে দিশেহারা বোধ করে। এরূপ অনিশ্চয়তার মধ্যেই জীবনে প্রথম হয়ত তার মধ্যে আত্মপরাভবের সৃষ্টি হয়।
নিজের শাসক-সত্তার কথা ভুলে গিয়ে রহিমার সামনে মেলে ধরে ব্যর্থতার আত্মবিশ্লেষণমূলক স্বরূপ : “কও বিবি কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে জানি কুলায় না। তোমারে জিগাই, তুমি কও?” ওই ঘটনাতেই রহিমা বুঝতে পারে তার স্বামীর দুর্বলতা কোথায় এবং তখন ভয়, শ্রদ্ধা এবং ভক্তির মানুষটি তার কাছ পরিণত হয় করুণার পাত্রে।
খালেক ব্যাপারী ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র। ভূ-স্বামী ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হওয়ায় তাঁর কাঁধেই রয়েছে মহব্বতনগরের সামাজিক নেতৃত্ব। উৎসব-ব্রত, ধর্মকর্ম, বিচার-সালিশসহ এমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যেখানে তার নেৃতত্বে ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত নয়।
নিরাক-পড়া এক মধ্যাহ্নে গ্রামে আগত ভণ্ড মজিদ তার বাড়িতেই আশ্রয় গ্রহণ করে। একসময় যখন সমাজে মজিদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় তখন খালেক ব্যাপারী ও মজিদ পরস্পর বজায় রেখেছে তাদের অলিখিত যোগসাজশ।
অবশ্য নিয়মও তাই। ভূ-স্বামী ও তথাকথিত ধর্মীয় মোলা-পুরোহিতদের মধ্যে স্ব-স্ব প্রয়োজনে অনিবার্যভাবে গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্য। কারণ দু’দলের ভূমিকাই যে শোষকের। আসলে মজিদ ও খালেক ব্যাপারী দুজনেই জানে : ‘অজান্তে অনিচ্ছায়ও দুজনের পক্ষে উলটা পতে যাওয়া সম্ভব নয়। একজনের আছে মাজার, আরেকজনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।
হাজার বছর ধরেই শোষক শ্রেণির অপকর্মের চিরসাথী ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা সম্মিলিত উদ্যোগে সমাজে টিকিয়ে রাখে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার। শিক্ষার আলো, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও অধিকারবোধ সৃষ্টির পথে তৈরি করে পাহাড়সম বাধা-যাতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত থাকে বিকশিত মানব চেতনা থেকে। এরই ফলে সফল হয় শোষক। শুধু ভূস্বামী শোষক কেন, যে কোনো ধরনের শোষকের ক্ষেত্রে একথা সত্য।
তারা শোষণের স্বার্থে ধর্মব্যবসায়ীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। একারণেই মজিদের সকল কর্মকাণ্ডে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছে খালেক ব্যাপারী। এমনকি মজিদের প্রভাব প্রতিপত্তি মেনে নিয়েছে অবনত মস্তকে; যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিজের একান্ত প্রিয় প্রথম স্ত্রী আমেনা বিবিকে তালাক দেয়া।
‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খালেক ব্যাপারী উপস্থিতি থাকলেও সে কখনোই আত্মমর্যাদাশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা জানি যে, ধর্মব্যবসায়ীরা আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হিসেবে জাহির করে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভুত্ব করে।
ফলে শোষকরাও তাদের অধীন হয়ে যায়। কিন্তু শোষকদের হাতে যেহেতু থাকে অর্থ সেহেতু তারাও ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থের শক্তিতে অধীন করে ফেলে। কিন্তু এখানে খালেক ব্যাপারীর চরিত্রে আমরা সে দৃঢ়তা কখনোই লক্ষ করি না।
বরং প্রায় সব ক্ষেত্রেই মজিদের কথার সুরে তাকে সুর মেলাতে দেখা যায়। ফলে মজিদ চরিত্রের সঙ্গে সে কখনো দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হয়নি। তার অর্থের শক্তি সবসময় মাজার-শক্তির অধীনতা স্বীকার করেছে। তাঁর এই চারিত্রিক দৌর্বল্য ইতিহাসের ধারা থেকেও ব্যতিক্রমী।
মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। লম্বা চওড়া শারীরিক শক্তিসম্পন্না এই নারী পুরো উপন্যাস জুড়ে স্বামীর ব্যক্তিত্বের কাছে অসহায় হয়ে থাকলেও তার চরিত্রের একটি স্বতন্ত্র মাধুর্য আছে। লেখক নিজেই তার শক্তিমত্তাকে বাইরের খোলস বলেছেন, তাকে ঠাণ্ডা ভীতু মানুষ বলে পরিচিতি দিয়েছেন।
তার এই ভীতি-বিহŸল, নরম কোমল শান্ত রূপের পেছনে সক্রিয় রয়েছে ঈশ্বর-বিশ্বাস, মাজার-বিশ্বাস এবং মাজারের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও ভক্তি। ধর্মভীরু মানুষেরা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের কারণে যে কোমল স্বভাবসম্পন্ন হয় রহিমা তারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সমগ্র মহব্বতগরের বিশ্বাসী মানুষদেরই সে এক যোগ্য প্রতিনিদি।
স্বামী সম্পর্কে মাজার সম্পর্কে তার মনে কোনো প্রশ্নের কাজকর্মের পবিত্রতা রক্ষা এবং তার নিজের সকল গার্হস্থ্য কর্ম প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই সে একান্তভাবে সৎ এবং নিয়মনিষ্ঠ। মাজার নিয়ে যেমন রয়েছে তার ভীতি ও শক্তি, তেমনি এই মাজারের প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবেও রয়েছে তার মর্যাদাবোধ। এই মর্যাদাবোধ থেকেই সে গ্রামের মাজার ও মাজারের প্রতিনিধি সম্পর্কে গুণকীর্তন করে, তার শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস তুলে ধরে এবং এভাবে সে নিজেকেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
হাসুনি মায়ের সমস্যা যখন সে তার স্বামীর কাছে জানায় কিংবা আমেনা বিবির সংকট মুহূর্তে তার পাশে গিয়ে অবস্থান নেয় তখন তার মধ্যে মাজার-প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবে গর্ববোধ কাজ করে। এ গর্ববোধ ছাড়াও এখানে সক্রিয় থাকে নারীর প্রতি তার একটি সহানুভূতিশীল মন। রহিমার মনটি স্বামী মজিদের তুলনায় একেবারেই বিপরীতমুখী।
মজিদের কর্তৃত্বপরায়ণতা, মানুষের ধর্মভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রযোগের দুরভিসন্ধি প্রভৃতির বিপরীতে রহিমার মধ্যে সক্রিয় থাকে কোমল হৃদয়ের এক মাতৃময়ী নারী। সেটি জমিলা প্রসঙ্গে লক্ষ করা যায়। তাদের সন্তানহীন দাম্পত্য-জীবনে মজিদ যখন দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব করে তখন রহিমার মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি হয় না।
এর মূলে সক্রিয় তার স্বামীর প্রতি অটল ভক্তি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতার প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং সরল ধর্মনিষ্ঠা। কিন্তু জমিলা যখন তার সতিন হিসেবে সংসারে আসে তখনও সামাজিক গার্হস্থ্য বাস্তবতার কারণে যেটুকু ঈর্ষা সঞ্চারিত হওয়া প্রয়োজন ছিল তাও অনুপস্থিত থাকে তার ওই হৃদয়সংবেদী মাতৃমনের কারণে।
জমিলা তার কাছে সপতœী হিসেবে বিবেচিত হয় না বরং তার মাতৃহৃদয়ের কাছে সন্তানতুল্য বলে বিবেচিত হয়। এ পর্যায়ে জমিলাকে কেন্দ্র করে তার মাতৃত্বের বিকাশটি পূর্ণতা অর্জন করে যখন মজিদ জমিলার প্রতি শাসনের খড়–গ তুলে ধরে।
স্বামীর সকল আদেশ নির্দেশ উপদেশ সে যেভাবে পালন করেছে সেইভাবে জমিলাও পালন করুক সেটি সেও চায় কিন্তু সে পালনের ব্যাপারে স্বামীর জোর-জবরদস্তিকে সে পছন্দ করে না। স্বামীর প্রতি তার দীর্ঘদিনের যে অটল ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এক্ষেত্রে তাতে ফাটল ধরে। এক্ষেত্রে তার ধর্মভীরুতাকে অতিক্রম করে মুখ্য হয়ে ওঠে নিপীড়িত নারীর প্রতি তার মাতৃহৃদয়ের সহানুভূতি।
অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে যাকে মনে হয়েছিল ব্যক্তিত্বহীন, একমাত্র আনুগত্যের মধ্যেই ছিল যার জীবনের সার্থকতা, সেই নারীই উপন্যাসের শেষে এসে তার মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বময় হয়ে ওঠে। রহিমা চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখানেই লেখকের সার্থকতা।
নিঃসন্তান মজিদের সন্তান-কামনাসূত্রে তার দ্বিতীয় স্ত্রীরূপে আগমন ঘটে জমিলার। শুধু সন্তান-কামনাই তার মধ্যে একমাত্র ছিল কীনা, নাকি তরুণী স্ত্রী-প্রত্যাশাও তার মাঝে সক্রিয় ছিল তা লেখক স্পষ্ট করেননি। কিন্তু বাস্তবে আমরা লক্ষ করি তার গৃহে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে যার আগমন ঘটে সে তার কন্যার বয়সী এক কিশোরী।
জমিলার চরিত্রে কৈশোরক চপলতাই প্রধান। এই চপলতার কারণেই দাম্পত্য সম্পর্কের গাম্ভীর্য তাকে স্পর্শ করে না। এমনকি তার সপতœী রহিমাও তার কাছে কখনো ঈর্ষার বিষয় হয়ে ওঠে না। রহিমা তার কাছে মাতৃসম বড়বোন হিসেবেই বিবেচিত হয় এবং তার কাছ থেকে সে তদ্রূপ স্নেহ আদর পেয়ে অভিমান-কাতর থাকে।
রহিমার সামান্য শাসনেও তার চোখে জল আসে। তার ধর্মকর্ম পালন কিংবা মাজার-প্রতিনিধির স্ত্রী হিসেবে তার যেরূপ গাম্ভীর্য রক্ষা করা প্রয়োজন সে-ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো সচেতনতাই লক্ষ করা যায় না ওই কৈশোরক চপলতার কারণে। প্রথম দর্শনে স্বামীকে তার যে ভাবী শ্বশুর বলে প্রতীয়মান হয়েছিল, বিয়ের পরেও সেটি তার কাছে হাস্যকর বিষয় হয়ে থাকে ওই কৈশোরক অনুভূতির কারণেই।
ধর্মপালন কিংবা স্বামীর নির্দেশ পাঅন উভয় ক্ষেত্রেই তার মধ্যে যে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার অভাব তার মূলে রয়েছে এই বয়সোচিত অপরিপক্বতা। মাজার সম্পর্কে রহিমার মতো সে ভীতিবিহŸল নয় কিংবা মাজারের পবিত্রতা সম্পর্কেও নয় সচেতন এবং এই একই কারণে মাজারে সংঘটিত জিকির অনুষ্ঠান দেখার জন্য তার ভিতরে কৌত‚হল মেটাতে কোথায় তার অন্যায় ঘটে তা উপলব্ধির ক্ষমতাও তার হয় না।
সুতরাং স্বামী মজিদ যখন এসবের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তার অনুচিত কর্ম সম্পর্কে তাকে সচেতন করে, তখন সেসবের কিছু তার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় না। সুতরাং তাকে শাসনের ব্যাপারে মজিদের মুখে যে সে থুথু নিক্ষেপ করে সেটাও তার মানসিক অপরিপক্বতারই ফল।
এমনকি মাজারে যখন তাকে বন্দি করে রেখে আসে মজিদ তখন সেই অন্ধকারের নির্জনে ঝড়ের মধ্যে ছোট মেয়েটি ভয়ে মারা যেতে পারে বলে রহিমা যখন আতঙ্কে স্বামীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তখনও জমিলাকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখা যায়। এরূপ আচরণের মূলেও সক্রিয় থাকে তার স্বল্প বয়সোচিত ছেলেমানুষি, অপরিপক্বতা।
অর্থাৎ এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসে একটি প্রাণময় সত্তার উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। শাস্ত্রীর ধর্মীয় আদেশ নির্দেশের প্রাবল্যে পুরো মহব্বতনগর গ্রামে যে প্রাণময়তা ছিল রুব্ধ, জমিলা যেন সেখানে এক মুক্তির সুবাতাস। রদ্ধতার নায়ক যে মজিদ, ঔপন্যাসিক সেই মজিদের গৃহেই এই প্রাণময় সত্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
একদিকে সে নারী অন্য দিকে সে বয়সে তরুণীÑ এই দুটিই তার প্রাণধর্মের এক প্রতীকী উদ্ভাসন। এ উপন্যাসে মজিদের মধ্য দিয়ে যে ধর্মতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছে তার পেছনে পুরুষতন্ত্রও সক্রিয়। সুতরাং নির্জীব ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে সজীব প্রাণধর্মের জাগরণের ক্ষেত্রে এ নারীকে যথাযথভাবেই আশ্রয় করা হয়েছে। জমিলা হয়ে উঠেছে নারীধর্ম, হৃদয়ধর্ম বা সজীবতারই এক যোগ্য প্রতিনিধি।
‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদ ও খালেক ব্যাপারীর পরিবার ছাড়া আরেকটি পরিবারের কাহিনি গুরুত্ব লাভ করেছে। সেটি তাহের-কাদের ও হাসুনির মায়ের পরিবার। এদের পিতামাতার কলহ এবং তাই নিয়ে মজিদের বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে তাহের-কাদেরের পিতা চরিত্রটি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
উপন্যাসের এটিই একমাত্র চরিত্র যে মজিদের আধ্যাত্মিক শক্তির ব্যাপারে অবিশ্বাস পোষণ করেছে, বিচার সভায় প্রদর্শন করেছে অনমনীয় দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্ব। তার নির্ভীক যুক্তিপূর্ণ ও উন্নত-শির অবস্থান নিশ্চিতভাবে ব্যতিক্রমধর্মী।
সে মজিদের বিচারের রায় অনুযায়ী নিজ মেয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে ঠিকই কিন্তু তা মজিদের প্রতি শ্রদ্ধা বা আনুগত্যবশত নয়। মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই সে এ কাজ করেছে। তবে এর পরপরই তার নিরুদ্দেশ গমনের ঘটনায় এই চরিত্রের প্রবল ব্যক্তিত্বপরায়ণতা ও আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় ফুটে ওঠে। এই আচরণের মধ্য দিয়ে মজিদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদও ব্যক্ত হয়েছে।
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১-৮ | PDF
সিরাজউদ্দৌলা | সিকান্দার আবু জাফর | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ৯-১৭ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ১৮-২৫ | PDF
নাটকঃ সিরাজউদ্দৌলা | সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর ২৬-৩১ | PDF
HSC | বাংলা ২য় | সংলাপ রচনা ১১-২০ | PDF Download
‘লালসালু’ উপন্যাসের কাহিনি অত্যন্ত সুসংহত ও সুবিন্যস্ত। কাহিনি-গ্রন্থনায় লেখক অসামান্য পরিমিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাহিনির বিভিন্ন পর্যায়ে নাট্যিক সংবেদনা সৃষ্টিকে লেখক প্রদর্শন করেছেন অপূর্ব শিল্পনৈপুণ্য।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা, ধর্মতন্ত্র ও ধর্মবোধের দ্ব›দ্ব, ধর্মতন্ত্র-আশ্রয়ী ব্যবসাবৃত্তি ও ব্যক্তির মূলীভূত হওয়ার প্রতারণাপূর্ণ প্রয়াস, অর্থনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামোর সঙ্গে ধর্মতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির যোগ প্রভৃতি বিষয়কে লেখক এক স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ভাষায় রূপায়ণ করেছেন।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শেকড়হীন বৃক্ষপ্রতিম মজিদ, ধর্মকে আশ্রয় করে মহব্বনগরে প্রতিষ্ঠা-অর্জনে প্রয়াসী হলেও তার মধ্যে সর্বদাই কার্যকর থাকে অস্তিত্বের এক সূ²তর সংকট। এরূপ সংকটের একটি মানবীয় দ্ব›দ্বময় রূপ সৃষ্টিকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সার্থকতা বিস্ময়কর।
বাংলা উপন্যাসের ধারা
গল্প বলতে ও শোনতে মানুষের ভালো লাগে। অতীতে মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়েছে অনেক কাহিনি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্য নির্ভর। সে-কাব্য নির্ভর সাহিত্যের মঙ্গল কাব্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ও ময়মনসিংহ গীতিকার নীতির মাঝে বাংলা উপন্যাসের বীজ নিহিত ছিল।
উপন্যাসের বাহন পদ্য নয় গদ্য। পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও রচিত হয় প্রথমে কবিতা, পরে গদ্য। ১৮০১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এ কলেজে শুরু হয় বাংলা গদ্য চর্চা। তার পর বাংলা গদ্য দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে। কাল ক্রমে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাজ-কর্মের প্রধান বাহন হয়ে ওঠে বাংলা গদ্য।
এই গদ্যে রচিত হতে থাকে সমাজ পরিস্থিতি। তখন দেশ ছিল ইংরেজ বেনিয়াদের অধীনে। ইংরেজ শাসন ইংরেজি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে এ দেশের সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছিল তখন (১৮৫১ সালের পরে) এক ধরনের সামাজিক উপন্যাস রচিত হতে থাকে।
পরর্বতিতে ভবানীচরণ বন্দ্যোপধ্যায়ের ‘কলিকাতা কমলালয়’, ‘নব বাবু বিলাস’, ‘নব বিবি বিলাস’, কালী প্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ইত্যাদি এ ধরনের রচনা। বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনার প্রয়াস লক্ষ করা যায় হানা ক্যাথারিন মুলেন্সের ‘ফুলমণি’ ও ‘করুণার বিবরণ’ এবং প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রভৃতি গ্রন্থে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁর রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস। এরপর রবীন্দ্রনাথের হাতে উপন্যাসের গতিধারা আরো সার্থক ও সুন্দর হয়। ‘চোখের বালি’, ‘যোগাযোগ’, ‘ঘরে বাইরে’ ইত্যাদি তার সার্থক উপন্যাস।
এর পর বাংলা সাহিত্যের গতিধারায় আসেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে বলা হয়ে থাকে অপরাজেয় কথাশিল্পী। তিনি এ দেশের পারিবারিক ও সমাজিক জীবনকে তার উপন্যাসে অত্যন্ত সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘বড় দিদি’, ‘মেজদিদি’, ‘গৃহদাহ’, ‘দত্তা’, ‘দেনা-পাওনা’ ইত্যাদি তাঁর উলেখযোগ্য উপন্যাস। তাঁর উপন্যাসে নৈতিক সমস্যার কথা না থাকলেও নারী সমস্যার নানা বক্তব্য পেশ করা হয়েছে অত্যন্ত সার্থকভাবে।
স্বর্ণকুমারীদেবী, নিরুপমা দেবী, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন প্রমুখ মহিলা ঔপন্যাসিকও বাংলা উপন্যাসের গতিধারায় বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। পরবর্তী কালে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, নাজিবর রহমান সাহিত্যরতœ, ইমদাদুল হক, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের সাহিত্যকর্মে বাংলা সাহিত্যের বৃদ্ধি হয়।
বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারা
১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে। পাকিস্তান ও ভারত নামে উপমহাদেশ দুভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। আজকের বাংলাদেশের তখন নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালিরা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
তাই বাংলাদেশের সাহিত্য বলতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঊনসত্তর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রকাশিত সাহিত্যকে বোঝায়। এ সুদীর্ঘ কালে ঘটেছে অনেক ঘটনা। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের আমলে রাজনৈতিক পালা বদল ইত্যাদি থেকে বাংলাদেশের উপন্যাসের আঙ্গিক ও বক্তব্যে অনেক পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য এনেছে।
বাংলাদেশের উপন্যাসের গতিধারা ক্রমশ গ্রামীণ জীবন থেকে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের দিকে যাচ্ছে। সমকালীন সমাজজীবন, যুগ যন্ত্রণা ইত্যাদি দিক চিত্রায়নে শিল্পীগণ যথেষ্ঠ সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন।
আবুল মনসুর আহমদের ‘সত্যমিথ্যা’, ‘আবেহায়াত’; আবুল ফজলের ‘চৌচির’, ‘জীবন পথের যাত্রী’, শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ সৈয়দ ওয়ালীউলাহর ‘লালসালু’, আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ শহীদুলাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’,-সারেংবৌ’ জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’ ইত্যাদি উলেখযোগ্য উপন্যাস।
স¤প্রতি কালের উলেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হলেন শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমদ, হুমায়ুন আজাদ, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখ। এ যুগের উপন্যাসে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি-সমাজনীতি, মূল্যবোধের পরিবর্তন, নগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজ মানসের চিত্র ও চরিত্র সুন্দর এবং সার্থকভাবে মূর্ত হয়ে ওঠেছে।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।