জরায়ুমুখের ক্যান্সার ও VIA ভায়া পরীক্ষা ।। নারী স্বাস্থা ।। ভায়া বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার নিয়ে অনেক মেয়ে বা নারীরা কথা বলতে অনিহা প্রকাশ করে থাকে। আসলে এটা কখনোই ঠিক না। কারন জরায়ুমুখে ক্যান্সারের মতো রোখ হওয়াটা সাবাবিক বিষয়। যা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে সঠিক সময়ে ডাক্তারের পরামর্শে ভালো হয়ে যায়।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের পদ্ধতি: ভায়া (Visual Inspection with Acetic acid বা VIA) টেস্ট বা ভায়া পরীক্ষা জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের একটি সাধারণ পদ্ধতি। জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অন্যান্য পরীক্ষাগুলোর মধ্যে ভায়া পরীক্ষা উল্লেখ্যযোগ্য।
বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে যে ধরনের ক্যানসার বেশি দেখা যায়, তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান জরায়ুমুখে ক্যানসার। নারী ক্যানসার রোগীদের মধ্যে যা ১৮ শতাংশ। ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় এ রোগ।
এক যুগের বেশি সময় ধরে জরায়ুমুখের স্বাভাবিক কোষ পরিবর্তিত হতে থাকে। একসময়ে তা ক্যানসারে রূপ নেয়। ক্যানসার কোষসংখ্যা বেড়ে বেড়ে তা পিণ্ডের আকার ধারণ করে। জরায়ুমুখের ক্যানসার পিণ্ডটি ক্ষত হয়ে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ঘটায়।
যেভাবে এই রোগ ছড়ায়
নানা কারণে জরায়ুমুখে ক্যানসার হতে পারে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো কারণগুলো হলো,
● যৌন সংক্রামক ঝুঁকিপূর্ণ হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস থেকে।
● অল্প বয়সে বিয়ে বা যৌন সম্পর্কে জড়ালে এই ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়া একাধিক বিয়ে বা একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পরে।
● ঘন ঘন সন্তান ধারণ করলেও হতে পারে।
● প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান, পানের সঙ্গে তামাক পাতা বা জর্দা খেলে, দাঁতের গোড়ায় তামাক পাতার গুঁড়া (গুল) ব্যবহার করলে।
● দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করলে এই রোগ হতে পারে। একটানা ১০–১২ বছরের বেশি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন তাই ঠিক না।
● পুষ্টিহীনতা ও শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেও এই রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।
তবে আশার কথা হলো, উন্নত দেশে এ রোগের প্রকোপ অনেক কমে এসেছে। এই রোগে মৃত্যুর হার প্রতিবছর যা ২ শতাংশ হারে কমছে। এই সাফল্যের মূলে যেসব বিষয় লক্ষণীয় তার মধ্যে আছে, নারীশিক্ষার প্রসার, উন্নত জীবনযাপন, স্বাস্থ্যসচেতনতা, সর্বোপরি যুগান্তকারী ‘পেপস টেস্ট’ আবিষ্কার, ভায়া টেস্ট ও জরায়ুমুখ ক্যানসার সৃষ্টিকারী হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস শনাক্ত করা এবং এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার।
নারী-পুরুষ: বীর্য বা ধাতুর জন্মকথা
দরকারি পেপস টেস্ট
একটি সহজ পরীক্ষা। জরায়ুমুখ হতে রস নিয়ে অনুবীক্ষণ (মাইক্রোস্কোপিক) যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষা দিয়ে ক্যানসার, ক্যানসার হওয়ার পূর্বাবস্থা ও জরায়ুমুখের অন্যান্য রোগ যেমন প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) শনাক্ত করা যায়। এতে কোনো ব্যথা হয় না।
এই টেস্টের খরচও কম। বিবাহিত নারীদের বিয়ের তিন বছর পর থেকে (২১ বছরের আগে নয়) ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি তিন বছর পরপর একবার এই পরীক্ষা করানো উচিত। তবে চিকিত্সকের পরামর্শে এই রুটিনের পরিবর্তন হতে পারে।
ভায়া টেস্ট
অ্যাসিটিক অ্যাসিড (৩-৫ শতাংশ) তরল দিয়ে ভিজিয়ে জরায়ুমুখ সরাসরি দেখা হয় ভায়া টেস্টে। এতে জরায়ুমুখের রং পরিবর্তন না হলে ভায়া পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
তবে পেপস টেস্টে অস্বাভাবিকতা কিংবা ভায়া পজিটিভ হলেই যে ক্যানসার হয়েছে, ভাবা ঠিক নয়। এরপর আরও পরীক্ষা যেমন কল্পোস্কোপি (জরায়ুমুখ ২ থেকে ২৫ গুণ বড় করে সরাসরি দেখার যন্ত্র) দিয়ে পরীক্ষা, সন্দেহজনক স্থান থেকে বায়োপসি করে রোগ নির্ণয় হয়।
জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং
প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুমুখ ক্যানসারের কোনো উপসর্গ থাকে না। এমনকি রোগ দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে গেলেও ৫০ শতাংশের অধিক রোগী থাকে উপসর্গহীন। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হলে শতভাগ নিরাময় হয়। আর তাই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের উপায় জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার ও VIA ভায়া পরীক্ষা
স্ক্রিনিংয়ের নিয়মাবলি
২১ বছরের পর থেকে (বিয়ের তিন বছর পর থেকে) ২৯ বছর পর্যন্ত করাতে হবে পেপস টেস্ট। এই টেস্ট প্রতি তিন বছরে একবার করাতে হবে। ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত পেপস টেস্ট তিন বছরে একবার। এ ছাড়া এই ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়সসীমার মধ্যে পেপস টেস্ট এইচপিভি টেস্ট করাতে হবে পাঁচ বছরে একবার।
জরায়ুমুখ ক্যানসার ঝুঁকিপূর্ণ নারী হলে চিকিত্সকের পরামর্শে এই রুটিনের পরিবর্তন হতে পারে। বয়স ৬৫ পেরিয়ে গেলে নিয়মিত পেপস টেস্টে শেষ ১০ বছরের রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকলে আর পেপস টেস্টের প্রয়োজন হয় না।
এইচপিভি ভাইরাস
জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রধান কারণ হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)। যৌন সংযোগে এর সংক্রমণ ঘটে। অল্প বয়সে বিয়ে বা যৌন সংযোগে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। এ পর্যন্ত ১০০ প্রকার এইচপিভি শনাক্ত হয়েছে।
এর বেশির ভাগই জরায়ু ক্যানসারের জন্য তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে জরায়ু ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি নম্বর ১৬, ১৮, ৬ ও ১১। এসব ভাইরাস আক্রমণ করলেই যে ক্যানসারের সৃষ্টি হয়, তা নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারীরা প্রায়ই এইচপিভি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এতে কোনো উপসর্গ থাকে না। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাবলে ১৮-২৪ মাসের মধ্যে জরায়ু প্রায় সব এইচপিভিমুক্ত হয়ে যায়।
কেবল জরায়ুতে এইচপিভি দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে জরায়ু কোষে পরিবর্তনের সূচনা করে। অতি ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি আক্রান্ত হলে জরায়ুমুখ, জরায়ুপথ, পায়ুপথ এবং সংলগ্ন স্থানে ক্যানসারসহ বিভিন্ন প্রকার রোগ হতে পারে। যেসব বিষয় জরায়ুতে এইচপিভির স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়, তা হলো ধূমপান ও তামাক পাতার ব্যবহার যেমন,পান জর্দা, সাদা পাতা, গুল, দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন (১০-১২ বছর), অপুষ্টি, ঘন ঘন সন্তান ধারণ, এইডস, জরায়ুতে অন্যান্য ইনফেকশন ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
এইচপিভি টেস্টের নিয়ম
জরায়ুমুখ হতে রস নিয়ে ডিএনএ টেস্ট করে এইচপিভি শনাক্ত করা যায়। এইচপিভি টেস্ট করার আগে অবশ্যই পেপস টেস্ট করা হয়। জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের এই টেস্ট করা হয়। ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের প্রতি পাঁচ বছর পরপর পেপস টেস্টের সঙ্গে এই টেস্ট করা হয়।
এইচপিভি আক্রান্ত হলে করণীয়
সাধারণভাবে এইচপিভি আক্রান্তদের কোনো চিকিত্সা নেই। চিকিত্সার কোনো প্রয়োজনও হয় না। তবে যদি জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নারী, তার পেপস টেস্ট অস্বাভাবিক এবং একই সঙ্গে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এইচপিভি আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাঁকে অবশ্যই এই রোগ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়। এইচপিভি আক্রান্ত জরায়ুমুখে ক্ষত হয়েছে কি না, আরও নিশ্চিত হতে কল্পোস্কোপি দিয়ে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা হয়।
ছেলে হবে না মেয়ে ৭লক্ষণে বঝুতে পারবেন
যাতে ক্যানসার পূর্বাবস্থায় রোগ শনাক্ত করা হয়। যদি জরায়ুতে কোনো অস্বাভাবিকতা শনাক্ত হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে চিকিত্সার বিভিন্ন রকম পদ্ধতি আছে। বারবার পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে জরায়ুমুখের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। ক্রায়োথেরাপি—যন্ত্রের সাহায্যে অতি ঠান্ডা করে জরাযুমুখের আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা হয়। লিপ—ইলেকট্রিক যন্ত্রের সাহায্যে জরাযুমুখের আক্রান্ত কোষ কেটে ফেলা হয়।
অধ্যাপক পারভীন শাহিদা আখতার মেডিকেল অনকোলজিস্ট, শান্তি ক্যানসার ফাউন্ডেশন ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
এইচপিভির প্রতিরোধ
কার্যকর প্রতিরোধ হলো এইচপিভির মাংসপেশিতে ইনজেকশন উপযোগী টিকা নেওয়া। এইচপিভি-১৬ ও ১৮–এর প্রতিষেধক টিকা (সারভারিক্স) কিংবা এইচপিভি-১৮, ১৬, ১১ ও ৬ প্রতিষেধক টিকা (গার্ডাসিল) টিকা নেওয়া হলে শরীরে উল্লিখিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর এন্টিবডি সৃষ্টি হয়। জরায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে সৃষ্টি হওয়া এন্টিবডি তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। যৌন মেলামেশায় কনডম ব্যবহার করা।
আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিয়মানুযায়ী ৯ থেকে ২৫ বছর বয়সে এ টিকা কার্যকর হয়। যেকোনো একধরনের টিকা (সারভারিক্স অথবা গার্ডাসিল) ১২–১৩ বছরের মেয়েদের এইচপিভি আক্রান্ত হওয়ার আগে দেওয়া হয়। সূত্র:প্রথম আলো
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন। গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।