অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩ সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত সকল কিছু জানতে পারবেন। সুতরাং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। অনার্স ১ম বর্ষের যেকোন বিভাগের সাজেশন পেতে জাগোরিকের সাথে থাকুন।
অনার্স প্রথম পর্ব
বিষয়: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
অধ্যায় ১: দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয়
বিষয় কোড: ২১১৫০১
গ-বিভাগঃ রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর
১.০৮. বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহনশীলতা বর্ণনা কর।
অথবা, পাকিস্তান আমলে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বিবরণ দাও ।
উত্তরঃ ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানগণ এক উদারনৈতিক শক্তির সূত্রপাত করে। তাদের সামাজিক সাম্যবোধ ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংস্কৃতি হিন্দু-মুসলিম সহনশীলতার সাথে বসবাস করতে সাহায্য করে। সরকারি কাজে উভয় সম্প্রদায় হতে চাকরির জন্য নিয়োগ দেওয়া হতো।
ইসলাম বাংলার আইন স্বীকৃত ধর্ম হলেও অন্য ধর্মের অনুসারীরা প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করতে পারত। তাছাড়া কোনো ধর্মীয় বিশেষ অনুষ্ঠানে একে অপরের প্রতি সৌহার্দ ভাবও প্রতিষ্ঠিত ছিল ।
বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহনশীলতা : বাঙালির সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহনশীলতা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. হিন্দু-মুসলিম সহনশীলতা : আলাদা জাতি হলেও হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে ধর্মীয় সহনশীলতা বিরাজ করতো।
২. ধর্মীয় ব্যাপারে অধিকার প্রদান : মুসলমান শাসকগণ অন্য ধর্মের লোকদের ধর্মীয়ভাবে উৎসব ও ধর্মীয় কার্যাবলি পালনের স্বাধীনতা প্রদান করেন। মুসলমান শাসকগণ ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অবলম্বন করেন। হিন্দুরা ধর্ম প্রচার শিক্ষায় পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে সক্ষম হন।
৩. প্রতিবেশীসুলভ আচরণ : এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয়ভাবে মুসলিম হলেও এদেশের হিন্দুদের সাথে প্রতিবেশীসুলভ আচরণ বজায় রাখে। হিন্দু এবং মুসলমানদের সম্পর্কের মধ্যে একটি সৌহার্দ ও সম্প্রীতির পরিবেশ বিরাজ করছিল।
৪. জ্ঞানীদের সমাদর : মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও পাকিস্তান কোনোরকম ধর্মীয় গোঁড়ামি ব্যতিরেকে তারা পণ্ডিত, কবি ও বিদ্বান ব্যক্তিদের প্রতি উদার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শন করেন। এমনকি প্রতিভাবান হিন্দুদের সরকারি পদ, উপাধি ও সরকারি জমিদার করে মর্যাদা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
৫. পারস্পরিক সম্প্রীতি : বহু শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে উভয় জাতি একে অন্যের সংস্কৃতি ৩ মতবাদগুলো বুঝতে সক্ষম হয়। ঐতিহ্যগতভাবেই একে অন্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাংলাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং প্রদেশে দুটি সম্প্রদায়ের সাধারণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সুযোগ পায় ।
৬. রাজনৈতিক কারণ : রাজনৈতিক উপযোগিতার প্রয়োজন মুসলমান শাসনকর্তাদেরকে হিন্দুদের সঙ্গে একটি সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে। তারা সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে একে অন্যকে উৎসাহিত করতো ।
৭. ঐতিহ্যগত : মুসলিম শাসনকর্তাদের ঐতিহ্যগতভাবে রাষ্ট্রনীতিতে একটি মৌলিক আদর্শ ছিল সহনশীলতা।
৮. সংস্কৃতির প্রসার : তৎকালীন সময়ে হিন্দু-মুসলমানগণ পারস্পরিক সমঝোতা ও সৌহার্দ বহু সাধারণ সাংস্কৃতিক প্রথার প্রশস্ত করেছে । পির পূজা, কবর পূজা, মোমবাতি প্রজ্বলন এগুলো উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজ করে।
৯. ব্যবসায়ী-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা : দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের দুটি প্রদেশ প্রতিষ্ঠার পর উভয় প্রদেশেই হিন্দু লোকসংখ্যা ছিল । ধর্মীয় দিক স্বাধীন হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যে একে অন্যের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা হয়।
তারা অন্যকে সম্মান করে। ফলে তাদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে ওঠে। তবে ধর্মীয় দিকটি স্বাধীন হওয়ায় পরস্পর পরস্পরের ধর্মে আকৃষ্ট হয়। অনেকে হিন্দু থেকে মুসলমানও হন ।
১০. সাংস্কৃতিক উদারতা : সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমান ও হিন্দু বিভিন্ন উৎসব পালন করে। তারা সকলেই স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠানে ধর্মীয় রীতি পরিচালনা করতে পারত। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা একে অন্যকে সামাজিকভাবে সহযোগিতা করতো।
১১. লৌকিক বিশ্বাস : সমাজে ঐতিহ্যগত কারণে কিছু লৌকিক ধারণা জন্মেছিল । তারা লৌকিক বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে পালন করতো। আর এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন লৌকিক বিশ্বাস ও স্থানীয় আচার আচরণ মেনে চলত। আর এতে ইসলাম ধর্মে নানাবিধ হিন্দু কুসংস্কার মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করে। তবে তার জন্য হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধরাও দায়ী ছিল ।
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বজায় ছিল। অনেকে হয়তো তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন কিন্তু যারা পাকিস্তানের দুই প্রদেশে বসবাস করতো তাদের মাঝে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা একে অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উৎসবে ও অন্যান্য আনন্দ উৎসবে পরস্পর অংশগ্রহণ করতো ।
একে অপরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহনশীলতার পরিচয় প্রদান করেছিল । যদিও দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছিল । তবে সেগুলো বাদ দিলে বলা যায় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।
১.০৯. সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহিঞ্চুতা সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা : ধর্মীয় ভিন্নতার কারণেও অনেক সময় সাংস্কৃতিক ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। ধর্ম ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রেখেছে।
বাঙালি সংস্কৃতির বুনিয়াদ কী? কোন কোন উপাদানে আমাদের অতীত সংস্কৃতি ও বর্তমান সংস্কৃতির ভিত গড়ে উঠেছে। – এসব প্রশ্নের উত্তরে বাঙালি সমাজের ধর্মের প্রচার প্রসার এবং তাদের উদারতা বিশ্লেষণে প্রমাণ পাওয়া যায়।
সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা : তান্ত্রিক মতাদর্শ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম ও নবম শতক থেকে প্রথমে পূর্বভারতীয় অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে। যার ঐতিহ্য অদ্যাপি রহমান, যে মতাদর্শ সংখ্যাদর্শনে পরিপক্ষতা পায়। সাংখ্যদর্শনের পথ ধরেই বিশ্বের প্রথম ডাইলেকটিক দর্শন বৌদ্ধধর্ম। বাঙালির বস্তুতান্ত্রিক উপার চিন্তাচেতনা সৃষ্টিতে এই দুই দর্শন ভূমিকা রেখেছে।
মৌর্যযুগে ও গুপ্তযুগেই বাংলায় এসেছে বেদ ও উপনিষদভিত্তিক সংস্কৃতির সংস্পর্শ। ফলে বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছে হিন্দুধর্ম। পাল যুগে বৌদ্ধ মতবাদ পল্লবিত হয়েছে নানা শাখায়। অতএব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাঙালি আবারও নিজে জারকরসে লোকায়িত ইসলাম রচনা করল।
এর ভিত্তি হলো ট্রাইবাল সমাজে টিকে যাওয়া সংস্কৃতি। তাই বাংলায় হিন্দু যেমন খোঁজে গুরুর কাছে আত্মমুক্তি, ধর্মান্তরিত মুসলমান তেমনি করে ধরনা দেয় পিরের পায়ে, সুকির আস্তানায়। পিরবাদ ও গুরুবাদের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য সামান্য।
বাংলায় হিন্দু যেমন পরমআত্মার কাছে অন্তলীন হতে চায়, তেমনি বাংলার মুসলমানও পেতে চায় সুফিবাদের ভিতর দিয়ে আল্লাহর সাথে একাত্মতার অনুভূতি ।মাজারের প্রতি হিন্দু-মুসলমানের একই বিশ্বাস পরিলক্ষিত হয়।
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি রচনামূলক প্রশ্নোত্তর সাজেশন
- আরও পড়ুনঃ (১ম অধ্যায়) রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর সাজেশন
তন্ত্র-মন্ত্র, তাবিজ-কবচে সব বাঙালির আস্থা আছে। হিন্দু মুসলমান সবার বিয়ের অনুষ্ঠানে গায়ে হলুদ, আল্পনা আঁকে পহেলা বৈশাখে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান একই ধরনের পোশাক পরিধান করে এবং পান্তাভাত ও ইলিশ দিয়ে বর্ষবরণ করে। প্রাক ব্রিটিশ যুগে বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে লোকজ সংস্কৃতির পার্থক্য ছিল কম।
তবে অভিজাত এবং অনভিজাত মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভেদ ছিল। এ বিভেদ দূর করার জন্য এগিয়ে এলেন সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী একদল সংস্কারক । এরা মূলত ইসলামের সংস্কৃতি ও দর্শনকে ধর্মের মর্মকথাতে উপস্থাপনে প্রয়াসী হলেন। এতে মূল সেমেটিক ইসলাম অনেকভাবে বাঙালিত্ব লাভ করল । ফলে বাংলায় ইসলামের এক স্বাতন্ত্র্য রূপ দেখা দিল ।
এখানে সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদিতার বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ়। বিভিন্ন ধর্মের মিলন স্থান, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উৎসবে এবং এসব অনুষ্ঠান, রীতিনীতি প্রভাবিত হয়েছে এদেশের অনার্য সংস্কৃতির দ্বারা। সেটিকে বলা যেতে পারে বাঙালির মানস । যেখানে হিন্দু মুসলমান-বৌদ্ধের চিন্তাচেতনা অভিন্ন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকের বসবাস। মুসলমান জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারপরেই হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা। এখানে হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করছে।
মুসলমান ও হিন্দু দু’টি ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় হলেও এরা প্রাক ঔপনিবেশিক, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে পাশাপাশি অবস্থান করেছে। ধর্মবোধ তাদের দুটি বিপরীতমুখী অবস্থান সৃষ্টি করেনি।
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
একে অপরের ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি করেনি। তবে বহিরাগত সংস্কারকরা বিশেষ করে ওহাবি সংস্কারকরা ওপর থেকে ইসলামের তত্ত্ব চাপিয়ে দিয়ে সাময়িক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করলেও ফলপ্রসূ হয়নি। হিন্দু সংস্কারকরা মূলত নিজেদের সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের ক্ষেত্রে বাঙালি পরিচয় প্রাধান্য পেয়েছে।
তারা ভাবতে শিখেছে আগে আমি বাঙালি তারপর হিন্দু-মুসলমান। এই বোধের কারণে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বদলে বাঙালিত্বে বিভিন্ন উপাদান রক্ষার যৌথ লড়াই হয়েছে। এই উপাদানগুলো থেকে জন্ম নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। এদেশে বসবাসকারী সব সম্প্রদায় মিলেই বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজে মানুষের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদিতা একান্ত প্রয়োজন। সমাজে মানুষে মানুষে হানাহানি ও দ্বন্দ্ব বিরাজ করলে সমাজ বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, ধর্মীয় সহনশীলতা বলতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বসবাস করাকে বুঝায়।
তাই সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
১.১০. সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা কী? বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার প্রভাব বিশ্লেষণ কর।
অথবা, সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা বলতে কী বুঝ? বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার ফলাফল আলোচনা কর।
উত্তর; ভূমিকা : বাঙালির সংস্কৃতির উৎস ছিল অনেক প্রাচীন । এদেশের মানুষ কখনও স্বকীয় সত্তার সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশ ঘটাতে পারেনি। তবুও বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্বতা রয়েছে। যে কারণে বাঙালির সংস্কৃতিতে সমন্বয়ধর্মিতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশে সহজিয়া, নারীযোগী, বাউল, কর্তাভেজা, সাহেধানী, মুর্শিদি, মাইজভাণ্ডারি প্রভৃতি বহু সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে মূলত সমন্বয়ধর্মী নীতির কারণে।
সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা : মানুষ যা করে তাই সংস্কৃতি। তাই সকলের সংস্কৃতি এক নয়। বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। মুসলমানদের মুসলিম সংস্কৃতি, হিন্দুদের হিন্দু সংস্কৃতি, বৌদ্ধদের বৌদ্ধ সংস্কৃতি । অন্যদিকে, প্রভুর এক সংস্কৃতি, চোরের আলাদা সংস্কৃতি, ডাকাতের পৃথক সংস্কৃতি আবার ধর্মীয় নেতার ভিন্ন সংস্কৃতি।
সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও প্রকৃতি রয়েছে। সব ধরনের সংস্কৃতির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা। অর্থাৎ একে অন্যের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের যখন সুযোগ থাকে তখন ঐ অবস্থাকেই বলে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ।
বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার প্রভাব : যেহেতু মানুষ যা করে তাই সংস্কৃতি তাই মানুষের জীবন সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালির সংস্কৃতিতে সমন্বয়বাদিতা খুব বেশি লক্ষণীয় কেননা বঙ্গদেশে এসে বহিরাগত সব ধর্মই পৃথক সংস্কৃতি নিয়ে বাংলার আদলে গড়ে উঠেছে। বাংলায় প্রথম সুন্নি মতবাদের তুলনায় সুফিবাদের ইসলামই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে বাঙালি জাতি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার সুফল যেমন পেয়েছিল তেমনি পেয়েছিল কুফলও। নিম্নে বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার ফলাফল বা প্রভাব আলোচনা করা হলো :
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
১. ভেদাভেদ সৃষ্টি : পৃথিবীতে সমাজ সৃষ্টির পর থেকে প্রতিটি সমাজেই ভেদাভেদ ছিল। সে যুগের সংস্কৃতিকে অবহিত করার কোনো উপায় নেই। আর বিভিন্ন সময় যারা এ অঞ্চলে বসবাস করেছে তাদের সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আর এটা এক হতে পারে না। সেই সময় থেকে দাস-প্রভুর ভেদাভেদ ছিল রাজা প্রজার মাঝে ভেদাভেদ ছিল।
আরও ছিল ধর্মভেদ ও জাতিভেদ। আর সমাজের মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়াদাওয়া, উঠাবসা, চলাফেরা, কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা ও জীবনযাত্রা পদ্ধতিতে অনেক ব্যবধান ছিল ।
২. স্থানীয় ভাষা তৈরি : আর্য বা বাংলার জনগণকে প্রাচীনকালে বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা হতো। যেমন— দৈত্য, ম্লেচ্ছ, কুকুর, দাস, রাক্ষস, দস্যু, পাপিষ্ঠ, পিশাচ ইত্যাদি। তখন এ অঞ্চলে যারা বসবাস করতো তাদের ভাষা ছিল আলাদা। আর এ অঞ্চলের ভাষা তারা কখনও বুঝতেও চায়নি, কারণ এ অঞ্চলের লোকদের তারা পাপিষ্ঠ ভাবত।
আবার আর্যদের ব্যবহৃত ভাষা স্থানীয়রা বুঝতে চায়নি, এরা নিজেরাও স্থানীয় ভাষার প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দেয়নি। এ কারণে স্থানীয় ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপভাবে একটি স্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলা সৃষ্টি হয়েছে ।
৩. কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব : যেসব রাজবংশ বাংলায় তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করেছে তাদের মধ্যে সেনরা অন্যতম। সেন শাসনামলে সর্বপ্রথম কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব হয়। বল্লাল সেনের নেতৃত্বে হিন্দু সমাজ চার বর্ণে বিভক্ত হয়। হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথাগুলো ছিল- ১. ব্রাহ্মণ, ২. ক্ষত্রিয়, ৩. বৈশ্য ও ৪. শূদ্র। আর তারা নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
৪. সভ্যতা ধ্বংস : পৃথিবীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে আবার অনেক সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। যেমন— গ্রিক সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতাসহ আরও নামকরা অনেক সভ্যতা। আর তেমনি আর্যরা ভারতের মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগরী ধ্বংস করেছিল। আর্যগণ কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত এ সভ্যতার প্রভাব এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি, বরং পরবর্তী সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতার ওপর ভিত্তি করে ।
৫. অর্থসম্পদ অর্জনের বাসনা : ইউরোপীয় বাণিজ্য সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে অনুপ্রবেশের ফলে দেশি বেনে, বাড়ৈ, মতসুদ্দি, মহাজন, গোমস্তা, দেওয়ান ও দালালের চেতনায় অর্থসম্পদ অর্জনের বাসনা জাগিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের ফলে প্রায় প্রতি পরিবারে অর্থসম্পদ অর্জনের বাসনা ব্যাপকভাবে।বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ইউরোপীয় সংস্কৃতির আগমনের পরে যারা কোম্পানির কর্মকর্তা কর্মচারী ছিল তাদের মাঝে সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। তারা বিদ্যাবুদ্ধি, বাণিজ্যনীতি, যুদ্ধাস্ত্র, হিসাব রাখার পদ্ধতি, বাণিজ্যচুক্তির ধরন, পৃথিবীর ভৌগোলিক জ্ঞানে ছিল অনন্য ও সমৃদ্ধ ।
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
৬. আর্যদের অবজ্ঞার শিকার : বাঙালিদের আর্যরা বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করতো। তারা বিভিন্ন নামে বাঙালিদের সম্বোধন করতো যেমন— দস্যু, রাক্ষস, যক্ষ, নাগ, পক্ষী, কুকুর, দৈত্য প্রভৃতি। এরই ধারাবাহিকতায় দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ, রাক্ষসদের রাবণ, নাগকুলের বাসুকীজরব কারু এগুলো কাহিনী আমরা আজ খুঁজে পাই।
তাদের সম্পর্কে আরও জানা যায় মহাভারত ও পুরাণে অনার্যদের নানা উদ্ভট কাহিনী । আর্যদের তুলনায় উন্নত ও সভ্য ছিল দ্রাবিড়রা। এর প্রমাণ কেবল মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, পান্ডুরাজার ঢিবি পুরাতন নিদর্শনে নয় তা আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়।
৭. জাত পরিবর্তন : প্রাচীনকালে বাঙালিদের জাত বা বংশ পরিবর্তনের কথা অবগত হওয়া যায়। এমনকি জাত পরিবর্তন এখনো প্রচলিত আছে। আজকে যারা মণ্ডল তারা পরবর্তীতে চৌধুরী, আজকে যারা শেখ, কাল খন্দকার আবার পরশু কোরেশি ইত্যাদি জাত পরিবর্তন এখনো চলছে।
প্রাচীনকালে এদেশের শতকরা পঁচানব্বই জন ছিল বৌদ্ধ আর সেসময় তাদের কোনো জাতিভেদও ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে নতুনভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনর্জাগরণ হলে আবার নতুন করে বর্ণবিন্যাস শুরু হয় । আর সে আমলে গড়ে উঠা ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত সবগুলোই ছিল কৃত্রিম ।
৮. গৌরবোজ্জ্বল সাহিত্য সৃষ্টি : বিভিন্ন মনীষী তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাংলা ভাষার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আর তাদের মধ্যে গৌরবের অধিকারী মীননাথ, গোরক্ষনাথ, লুইপা, কাহ্নপা, শবরপা, অতীশ দীপঙ্কর, শ্রীজ্ঞান শীলভদ্র, জীমূতবাহন, হলায়ুধ মিশ্র, গোবর্ধন আচার্য, জয়দেব, রামনাথ, রঘুনাথ, চৈতন্যদেব।
আর যেসব কবি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন শাহ মুহাম্মদ সগীর, কৃত্তিবাস, বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, মুকুন্দরাম, বলরাম, ভারতচন্দ্র, কাশীরাম দাস, দৌলত উজির বাহরাম খান, আলাওল, দৌলত কাজি প্রমুখ ।
অনার্সঃ দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয় রচনামূলক পর্ব-৩*
৯. ইতিহাস বিকৃতি : বাংলার ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকেই তেমন নেই বললেই চলে । যা আছে তার উৎসের তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য সত্যতা পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদগণ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলার ইতিহাস রচনা করেন। আর এ ইতিহাস পড়ে বাঙালি তাদের স্বকীয় সত্তার কথাও ভুলে যায়। অজানাই থেকে যায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ইতিহাস ।
১০. সংকর সংস্কৃতির উদ্ভব : প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ ছিল। অসংখ্য জাতির মনন চিন্তার দর্শন, আচার আচরণ ও সংস্কারে বাঙ্গালির সংস্কৃতিতে, জড়িত ছিল দেশি-বিদেশি অনেক জাতি।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম দ্বিতীয় শতক থেকে এদেশের মানুষের ওপর আর্যধর্ম, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করে। বাঙালির ভাষা, ধর্মবিশ্বাস সংস্কার তথা সামগ্রিক জীবনবোধের ওপর অস্ট্রিক মোঙ্গলীয় সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ মিশ্রণ ঘটে।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতার সুফল ও কুফল উভয়ই বিদ্যমান। অতীতে বাঙালিরা ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠী, কারণ তারা শোষিত ছিল । তারা স্বাধীনভাবে সংস্কৃতি চর্চা করতে পারত না। সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, আর্থিক এবং প্রথা পদ্ধতি, আচার বিশ্বাস ইত্যাদি অনেক কিছুর বাধা ছিল এক্ষেত্রে ।
আঞ্চলিক পার্থক্যের জন্য সংস্কৃতিতে পার্থক্য ছিল বিস্তর। তাই অবস্থা বিচারে সেকালের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক কর্মকাণ্ড কোনোটিরই জাতীয় রূপ কল্পনা করা যায় না।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
আমাদের সাথে ইউটিউব চ্যানেলে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে ফেইজবুক পেইজে যুক্ত হতে এখানে ক্লিক করুন।
গুরুত্বপূর্ণ আপডেট ও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।